Select Page

নারীদের কর্মঘন্টা কমানোর জামাতি প্রস্তাব – যেভাবে বন্দী হল আফগান নারীরা

নারীদের কর্মঘন্টা কমানোর জামাতি প্রস্তাব – যেভাবে বন্দী হল আফগান নারীরা

“আফগানিস্তানের নারীরা ভোটাধিকার পায় ১৯১৯ সালে, আজ থেকে ১০৬ বছর আগে। ঠিক তার এক বছর পর থেকে মেয়েরা স্কুলে যাওয়া শুরু করে। ১৯৭০ সালে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ বছর করা হয়, শিক্ষাকে করা হয় বাধ্যতামূলক, আইন করে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। তখন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা একই ক্লাসরুমে বসে পড়ালেখা করতে পারতো!

অথচ আফগানিস্তানের এক বছর পর আমেরিকার নারীরা প্রথমবারের মত ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল! একই সুযোগের জন্য ফ্রান্সের নারীদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও ২৫ বছর (১৯৪৪), আর ভারতবর্ষের নারীরা ১৯৫০ সালের স্বাধীনতার পর প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়।

তার একশ বছর পর, আমেরিকার মেয়েরা এখন কোথায়? ফ্রান্সের মেয়েরা একটা আধুনিক দেশের নাগরিক হয়ে সকল সুবিধা ভোগ করছে, ভারতের মেয়েরাও এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে!

অথচ ধর্মের নামে, শরীয়াহ চাপানোর পর, আফগানিস্তানের মেয়েরা কেমন আছে, চলুন দেখা যাক!

১৯৮০ সালে মুজাহিদ বা তালেবান বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধে জেতার পর সবার আগে নারীদের ওপর নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করে! ২০০১ সালে আমেরিকা দখল নেওয়ার পর ২০ বছর সেসব বিধিনিষেধ শিথিল থাকলেও, ২০২১ সালে আবার আফগানিস্তান তালেবানের অধীনে চলে যায়!

আফগানিস্তানে নারী ও শিশুরা কোনো ধরনের নিপীড়নের শিকার হলে সেটা রিপোর্ট করার জন্য Law on the Elimination of Violence against Women নামের একটা আইন ছিল। নির্যাতিতদের সুরক্ষার জন্য সেইফ হাউজ ছিল। তালেবান সরকার প্রথমে এই দুইটা বিলুপ্ত করেছে।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে তালেবান সরকার এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে ষষ্ঠ শ্রেণীর পর মেয়েদের পড়ালেখা নিষিদ্ধ করেছে। এই মুহুর্তে আফগানিস্তান পৃথিবীর একমাত্র দেশ; যেখানে মেয়েদের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

যেসব মেয়েরা চাকুরি করতো, প্রথমে তাদেরকে সরকারি চাকুরি থেকে সরানো হয়েছে, বাকিদেরকে প্রথমে বাসা থেকে কাজ করার জন্য বলা হয়েছিল! যারা কাজে যাবে, তাদেরকে সাথে মাহরাম (পুরুষ অভিভাবক) নিয়ে যেতে বাধ্য করা হল!

এরপর চাকুরি হারানো দরিদ্র পরিবারগুলো পথে বসে গেল। দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হতে শুরু করলো; বিশেষ করে সিঙ্গেল মাদারদের অবস্থা হলো সবচেয়ে করুণ।

আফগানিস্তানের রাস্তায় ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়ল আশংকজনক হারে। তরুণদের পড়ালেখা এমনিতেও ছিলনা। বেকারত্ব বাড়তে থাকলো, জীবন বাঁচাতে সেসব তরুণরা জল-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে লাগলো।

জাস্ট আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরের কথা ভাবুন। রপ্তানি আয়ের ৮৪ ভাগ আসা গার্মেন্টস খাতে নারী কর্মী ৬০ ভাগ! এই কর্মীরা হঠাৎ করে ছাটাই হলে, তাদের পরিবারে ভয়ানক দূর্দর্শা নেমে আসবে না? বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বেনা? ঠিক একই অবস্থা হবে, যদি নারীদেরকে কৃষি কাজ করতে না দেওয়া হয়।

২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার আগে সংসদে ২৭% নারী এমপি ছিল, নিরাপত্তা বাহিনীর সব শাখা মিলে নারী ছিল ২১%। প্রায় ২০০০ বিচারকের মধ্যে নারী বিচারকের সংখ্যা ছিল ২৬৫ জন! তিন বছরের মাথায়, উপরের তিনটা ক্ষেত্রেই এখন ১ জন নারীরও নেই। শূণ্য….

যে মেডিকেল কলেজে ছেলে মেয়েরা সমান তালে পড়ালেখা করতো, সেই দেশে এখন সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় প্রতি দুই ঘণ্টায় ১ জন আফগান নারীর মৃত্যু হয়। এর কারণ, পুরুষ ডাক্তারের কাছে নারীদের চিকিৎসায় নিষেধাজ্ঞা, সকল ধরনের জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতির ব্যবহার বন্ধ। উল্টাদিকে, মেয়েদের পড়াশুনা নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায়, নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা কমে গেছে।

কিছুদিন আগে হওয়া ভূমিকম্পে নারী ও কিশোরীদেরকে ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধার করা হয়নি, কারণ আটকে পড়া সেসব নারীদের সাথে পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ কোনো পুরুষ ছিল না (কারণ পুরুষেরা নিজেদের জান বাঁচাতে আগেই সটকে পড়েছে)।

এই পৃথিবীর একটা আধুনিক দেশ জাস্ট শরীয়াহ্ আইনের কবলে পড়ে কিভাবে ধ্বংস হয়ে গেল, শুধু নারী হওয়ার অপরাধে একটা দেশের ৫০ ভাগ মানুষের মানবাধিবার কিভাবে নাই হয়ে গেল, তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ আফগানিস্তান!

একই কর্মস্থলে পুরুষের কর্মঘণ্টা যদি ৮ ঘণ্টা হয় এবং নারীর যদি হয় ৫ ঘণ্টা, তাহলে ঘটনাটা কি দাঁড়াবে? একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যার মূল কাজ মুনাফা করা; সে কেনো কম কাজের বিনিময়ে পুরুষের সমান বা তারচেয়ে বেশি বেতন দিতে হয়, এমন কর্মীকে নিয়োগ করবে?

ফলে নারী কর্মীদের নিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে। চাকুরিবাকুরি করতে না পারলে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে পারলে মেয়েদের পড়ালেখা করিয়ে লাভটা কি? ফলে মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষাও বন্ধ হবে! সরাসরি বন্ধ করতে না পারলে এই হবে তাদের কৌশল…

এই কৌশল ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

ইউএন উইমেন ও সিটিজেন প্লাটফর্ম এ বছরের মে মাসে ‘জেন্ডারভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রায় ২১ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১৮ লাখই নারী, যা মোট চাকরি হারানো মানুষের ৮৫ শতাংশ। বর্তমানে মাত্র ১৯ শতাংশ নারী শ্রমবাজারে সক্রিয়, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

ব্যাংকসহ নানা খাতে নারীরা চাকুরি হারাচ্ছে! কর্মস্থলে হিজাব পরতে বাধ্য করা হচ্ছে। যারা হিজাব পরছেনা, তাদেরকে নানাভাবে পরোক্ষভাবে হয়রাণি করা হচ্ছে! অপ্রয়োজনে ডেকে নিয়ে বকাবকি করা হচ্ছে। রাস্তাঘাটে বের হওয়া নারীরা কি ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, সেটাতো আমরা দেখছিই! এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলে, যেকেনো কর্মজীবি নারীর সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন।

ফলে, এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি, সেসব হলো ট্রেইলার। মূল সিনেমা শুরু হবে, জামাত যদি ক্ষমতায় আসতে পারে, তখন! সিনেমার গল্প কিরকম হবে, তার খানিকটা আঁচ আজ জামাতের আমিরের বক্তব্যে শোনা গেছে!

তাই আপনারা যারা জামাতকে ক্ষমতায় দেখার স্বপ্নে বিভোর, বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব মেয়েরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে শিবিরকে ভোট দিচ্ছেন, জেনে রাখবেন, আপনাদের ভোটে জামাত যদি একবার ক্ষমতায় আসতে পারে, তবে আপনার পরিবার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অব্দি পড়তে আসা শেষ নারীটা আপনি…

লিখে রাখেন…”

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার