Select Page

কলিম খান: হরিচরণের যোগ্য উত্তরসূরী

কলিম খান: হরিচরণের যোগ্য উত্তরসূরী

ভাষাতত্ত্ব কলিম খানের বিষয় ছিল না, কিছুটা পাকেচক্রেই জড়িয়ে পড়েন ভাষাব্যবস্থার মনের গভীরে। অসীম অনুসন্ধিৎসায় জানতে চেয়েছিলেন মানব-সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস। কিন্তু কোনও পাঠেই সন্তোষ এল না। এমনকি মার্ক্সীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ইতিহাসবোধেও খুঁজে পেলেন ত্রুটি। ‘পণ্য উৎপাদন’ মানবসমাজে কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, তার কোনও উত্তর তিনি মার্ক্সে পেলেন না। পণ্য-উৎপাদন আগে ঘটেছিল নাকি শ্রমবিভাজন? গাছ আগে না ফল আগে? প্রথম গাছটি তবে কে কোথায় বানিয়েছিল?

ইয়োরোপের প্রাচীন ইতিহাসে মার্ক্সসাহেব এই প্রশ্নের উত্তর পাননি। পেয়েছিলেন প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে। স্পষ্ট লিখলেন, Primitive Indian community has made division of labour before production of commodity। এখানেই মার্ক্স অনন্য। সুদুর লন্ডনে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বসে ১৮৫০ সালে তিনি এটা জানলেন কী করে? তাঁর হাতে তো দু-চারটে ভারত-বিষয়ক জার্নাল আর কয়েকটা প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের অক্ষম অনুবাদ! কখনও ভারতেও আসেননি। অসামান্য প্রতিভার আলোয় সীমিত উপাদান থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের সেই অতীত দেখে ফেলতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় সমাজ শ্রম-বিভাজনের পরে কীভাবে ‘পণ্য’ উৎপাদন করেছিল, তা জানতে পারেননি জার্মান সাহেব।

এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানেই নিজেকে নিয়োজিত করলেন কলিম খান। পড়ে ফেলতে চাইলেন প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস। এবং তা জানতে গিয়েই জড়িয়ে পড়লেন বাংলা ভাষার শব্দার্থ-সমস্যার জালে। রামায়ণ মহাভারতই আমাদের ইতিহাস — রবীন্দ্রনাথের কথা মাথায় নিয়ে খুলে বসলেন মহাকাব্য। কৃত্তিবাসী রামায়ণ। শুরুতেই হোঁচট। প্রথম ছত্রের অর্থই পারলেন না ধরতে। ‘গোলোক বৈকুণ্ঠপুরী সবার উপর। লক্ষ্মীসহ তথায় আছেন গদাধর।’ মানে কী? চেনা-গল্পটুকুর বাইরে অজস্র পয়ারের অর্থ উদ্ধার করতে পারলেন না। পুরাণ, পুরাণ-পণ্ডিতদের টীকা, বহু অভিধান, শব্দকোষ ঘেঁটে ফেললেন। নাহ্‌, কোথাও কোনও সদুত্তর পেলেন না।

পণ্ডিত ও ভাষ্যকারের দল টীকার ওপর টীকা যোগ করেছেন, প্রকৃত অর্থ বলতে পারেননি। হতাশ কলিম বুঝতে পারলেন অ্যাকাডেমিক দুনিয়া বুঝতেই পারেনি পুরাণ ও মহাকাব্যের মধ্যে নিহিত গূঢ় সত্য। জনসাধারণ তাঁদের জীবনযাত্রায়, আচরণে, ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে, ভাষায়, প্রবাদ-প্রবচনে, এক কথায় সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ধারণ করে আছে এই প্রাচীন ইতিহাস। কিছুটা বুঝে, বেশিটাই না-বুঝে। কেন ‘রামলীলা’ বা ‘রাধাকৃষ্ণলীলা’ শুনে উদ্বেল হয় ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ? কেন ‘রামচরিতমানস’-এর এত প্রভাব গোটা উত্তরভারতে? কেন ‘হনুমান চালিশা’ শোনেন অসংখ্য মানুষ?

প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর অজানা। বহু পণ্ডিত, অধ্যাপক, পিএইচডিকে প্রশ্ন করেছেন যথার্থ উত্তরের আশায়, কিন্তু জনে জনে জিগিয়েও জবাব মেলেনি। হাল ছাড়লেন না কলিম, তীব্র জিজ্ঞাসায় দিন-রাত এক করে অনুসন্ধানে নেমে পড়লেন। শুরু হল সাধনা। ফল পেলেন অচিরেই। একদিন ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময়ই মাথায় খেলে গেল বিদ্যুৎ। পুরাণ ও মহাকাব্য পাঠ করতে গিয়ে যে-বিমূঢ় দশায় পড়েছিলেন কলিম খান, অকস্মাৎ সেই দশা থেকে মুক্তি দেখালেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। হরিচরণ শব্দের অর্থ বোঝাতে গিয়ে অদ্ভুত এক পদ্ধতি মেনেছেন, কেবল শব্দ নয়, বাক্যের সাহায্যে দিয়েছেন শব্দের অর্থ। ক্রিয়াকারী বিশেষ্যকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন হরিচরণ। আর্কিমিডিসের মতো ইউরেকা বলে লাফিয়ে উঠলেন কলিম।

‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ খুলে কলিম খান দেখতে পেলেন একই শব্দের অজস্র অর্থ এবং সেই শব্দের অর্থ খুঁজতে ডিক্সনারি বা থিসরাস মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই। শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে শব্দের মানে। শব্দের বানানে যে বর্ণ বা ধ্বনিগুলি থাকে, সেগুলিই সেই শব্দের অর্থকে বহন করে। আমাদের মহাকাব্য ও বেদ-পুরাণের আপাত ধাঁধা ও জটিলতার জাল কেটে বেরোতে গিয়ে পেয়ে গেলেন ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ তত্ত্ব। বলা ভালো পুনরাবিষ্কার করলেন।

শব্দের অন্তর থেকে শব্দের অর্থ নিষ্কাশন একটি প্রাচীন ভারতীয় কৌশল। এই কৌশলের নাম ‘নির্বচন’। কলিম খান বলেন, এই কৌশলের আদি স্রষ্টা কে, তা জানা যায় না। ভারতবর্ষের সব বিদ্যার জনক যেহেতু সনাতন শিব, এই বিদ্যার স্রষ্টাও তিনিই হবেন। কথিত আছে, ‘১৪টি শিব স্ত্রোত্র’ এবং ‘মাহেশ্বর সূত্র’ অবলম্বন করেই পাণিনি তঁর বিখ্যাত ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ও ‘শিক্ষা’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই কৌশল প্রথম লিপিবদ্ধ করেন যাস্ক ও পাণিনি। কলিম খান প্রাচীন কোনও চরিত্রকে ব্যক্তিচরিত্র ধরতে নারাজ। তাঁর মতে তখনও ‘ব্যক্তি’ গড়ে ওঠেনি। ফলত, যাস্ক ও পাণিনিও তাঁর মতে কোনও ব্যক্তিবিশেষ নয়, দুইটি পৃথক গোষ্ঠী। এইযুগের ভাষায় ‘ঘরানা’ বা ‘স্কুল অফ থট’ বলা যায়। এছাড়া বৌদ্ধযুগের ‘অমরকোষ’ও এই কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করে গেছে। শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করে সেই অভ্যন্তরস্থ অর্থটিকে বাক্যের সাহায্যেই প্রকাশ করা রীতি। পরবর্তী কোষকারগণ একই পদ্ধতি মেনেছেন।

মহাত্মা হরিচরণও একই কাজ করেছেন তার ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ। কোনও ক্রিয়াই দৃশ্যমান নয়। কোনও কারক যখন সেই ক্রিয়াকে ধারণ করে, তখনই সেই ক্রিয়াকে দেখা যায়। ‘করণ’ বা ‘গমন’কে দেখা যায় না। কেউ কিছু করলে বা গমন করলেই ‘করণ’ বা ‘গমন’ দৃশ্যমান হয়। অর্থ কীভাবে শব্দের ভেতরে থাকে? কলিম খান উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। যেমন ‘কর’ শব্দ = ক্‌+অ+র্‌+অ = ‘কারককে রক্ষা করে যে’। এটি আপনার ‘হাত’ হতে পারে, দেশের রাজার চাপানো ‘খাজনা’ হতে পারে, ‘রবির কর’ও হতে পারে। যে-যে সত্তা কারককে রক্ষা করে তাদের প্রত্যেকেই ‘কর’ পদবাচ্য। ফলত, শব্দ অনড় অচল নয়, স্থির নির্দেশক কোনও মানেও তার নেই। এখানে সতর্কও করছেন কলিম। তাই বলে শব্দের অনন্ত অসীম মানেও হয় না। ক্রিয়াটির সীমার মধ্যে যে-যে পড়বে, তাদের প্রত্যেককেই সেই শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে।

এই তত্ত্বই প্রয়োগ করে তিনি পড়ে ফেললেন রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ। তারপরেই ঘটে গেল ম্যাজিক! চিচিং ফাঁক হয়ে খুলে গেল অন্তর্নিহিত অর্থের বন্‌ধ্‌ দরওয়াজা। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস নতুন রূপে হাজির হল।

১৯৯৮ সালে সহযাত্রী হিসেবে পেলেন শ্রীরামপুর কলেজের ইংরাজি ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপক রবি চক্রবর্তীকে। পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি বিপুল পরিশ্রম ও নিষ্ঠায় যৌথভাবে লিপিবদ্ধ করলেন ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের বৃহৎ দুই খণ্ড অভিধান ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’। শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে তৈরি করলেন ‘বঙ্গযান’ পত্রিকা।

বঙ্গীয় অ্যাকাডেমিক মহল প্রত্যশা মতোই তাঁর ভাবনাকে স্বীকৃতি জানায়নি। তাতে কী, তাঁরা তো হরিচরণকেও স্বীকৃত দেন না। হরিচরণের জন্মের সার্দ্ধশতবর্ষ নমো-নমো করে সারেন, ভুলেও ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অবশ্যপাঠ্য বইয়ের তালিকায় আসতে দেন না! কারন কী? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ সামনে আনা মানেই বাংলা ভাষা ও বানানবিধি নিয়ে ছিনিমিনি-খেলা অনেক ‘ভাষাবিদ’-এর করেকম্মে খাওয়ার দিন শেষ হয়ে যাবে।

তাছাড়া অ্যাকাডেমি-নিয়ন্ত্রক পুঁজি একই শব্দের বহু অর্থ স্বীকার করবে কেন? বাজার সবসময়ই একরৈখিকতার পক্ষে। শব্দের বহুরৈখিকতা তাই স্বীকার্য নয়। হরিচরণ তাই ব্রাত্যই থেকে যান। তাঁর সুযোগ্য শিষ্য কলিম খান বিষয়েও স্বভাবত অ্যাকাডেমি নীরব। কলিম খান যা বলেছেন বা যা-যা বলেছেন সবই অক্ষয় সত্য, এমত বালখিল্য দাবি কেউই করেন না, কিন্তু ‘বিকল্প’ ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে বাধা কোথায়? তার বদলে হিরণ্ময় ‘নীরবতা’ দিকে তাঁকে উপেক্ষা করার এই ‘অ্যাকাডেমিক মৌলবাদ’ এত সক্রিয় কেন? আলোচনা বা চর্চায় ভয় কেন? প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর অজানা।

কলিম খান জন্মেছিলেন অবিভক্ত মেদিনীপুরের ডেবরার কাঁসাই নদীর ধারের এক গণ্ডগ্রাম মামুদাবাদে, ১৯৫০-এর ১ লা জানুয়ারি। মাত্র ৬৮ বছর বয়সে, দুরারোগ্য রক্তের ক্যান্সারে, ১১ জুন রাত ন’টায় কলকাতায় তাঁর বর্তমান বাসভবনে শেষ হয়ে গেল ‘একটি জীবন’। তাঁর সিকি শতকের অক্ষরযাত্রায় অ্যাকাডেমিকে তোয়াক্কা না-করেই তিনি রেখে যেতে পেরেছেন ‘অন্য চিন্তার খোরাক’ ও দেশবিদেশের অজস্র গুণমুগ্ধ পাঠক।

[জুন ২০১৮। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম নামক ওয়েব পত্রিকায় প্রকাশিত। আজ কলিম খানের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী।]

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার