বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান শব্দগুলোকে আর অমর্যাদা করার দরকার নেই
বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান শব্দগুলোকে আর অমর্যাদা করার দরকার নেই। জুলাই-আগস্ট পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রায় চার মাস পর দেশে আইন-বিচার-নির্বাহী বিভাগের কর্মকাণ্ডে এখন পরিষ্কার যে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছে। গত তেপ্পান্ন বছর বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করা শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। হাসিনার ষোল বছরের দুর্নীতি, অপশাসন, দলীয়করণ, গণআন্দোলনে হাসিনার পলায়ন এসব উপলক্ষ হিসাবে সাজানো নাটক। তা যদি না হবে তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এজেন্ডা হতো লীগ আমলের দুর্নীতি, অপশাসন, ভোট চুরি, দলীকরণের পরিবর্তে জনগণের জন্য একটা কল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের জন্য লীগের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে দেশকে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নেওয়া।
বলা বাহুল্য লীগ আমলের নির্বাচন ছাড়া বাকি সকল অপকর্ম এই সরকার চার মাসেই অতিক্রম করেছে। সুতরাং যে সকল অভিযোগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রয়েছে, তার সবই এই সরকারেরও ওপরও আরোপ করা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া যদি না হবে তাহলে একজন ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসীকে মিথ্যা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার, জেল এবং জামিন না দিতে ন্যাক্কারজনক ঘটনার দরকার ছিল না। চিন্ময় কৃষ্ণদাস বা ইসকন দেশের অর্থনীতি-রাজনীতিতে কোনো ফ্যাক্টর নয়। লীগের অপশাসন বা দুর্নীতির সাথেও তাদের কোনো সংস্রব নেই। তারপরও চিন্ময়ের বিরুদ্ধে কামান দেগে সরকার উগ্র মৌলবাদীদের ‘দেশকে হিন্দুশূন্য করে শতভাগ মুসলমানের দেশ’ বানানোর পরিকল্পনায় সায় দিত না।
স্বভাবতই চিন্ময় কৃষ্ণদাসকে গ্রেফতারের পর ভারত প্রতিক্রিয়া দেখাবে, দেখিয়েছেও। কেউ মানুন বা না মানুন ভারত উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বের সনাতনীদের ‘অঘোষিত অভিভাবক’। এই ইস্যুতে ভারত সরকারের ওপর আরএসএস, হিন্দু মহাসভাসহ কট্টর হিন্দু সংগঠনগুলোর চাপ অব্যাহত ছিল। এবার সেই চাপ এসেছে ভারতের সকল রাজনৈতিক মহল থেকে। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই কেন্দ্রের সমালোচক এবং এতদিন যার ‘চুপ থাকা’কে বলা হচ্ছিল মুসলিম ভোট ব্যাংক নষ্ট হওয়ার ভয়ে চুপ করে আছেন, তিনিও বাংলাদেশে সনাতনীদের ওপরকার অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন।
ভারত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করতে পারে এমন গুজব রটেছে। বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতে ব্যাঙাচির মত ‘সামরিক বিশেষজ্ঞ’রা মুখে মুখেই বিশ্ব মেরে দিচ্ছেন। সত্যিকার অর্থে ভারত কী করতে পারে, কবে নাগাদ করতে পারে বা আদৌ করবে কীনা সে বিষয়ে এদের জ্ঞান স্ট্রেরিওটাইপ। এ প্রসঙ্গে অন্য লেখায় আলোচনা করা যাবে।
সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই বড় গলা করে বলে আসছে-দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে তারা বদ্ধপরিকর। তাদের বয়ষ্ক এবং বালকরা গণতন্ত্র গণতন্ত্র করে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে, অথচ দেশে স্বৈরাচারের আমলে যেটুকু গণতন্ত্র ছিল সেটুকুও এখন নেই। গণতন্ত্রের অন্যতম পিলার সংবাদ মাধ্যমকে যেভাবে ভয়-ভীতি দেখিয়ে মুখ বন্ধ করা হয়েছে তাতেই গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক ঠোকা সারা।
গতকাল ছিল চিন্তু কৃষ্ণদাসের জামিনের শুনানি। সেখানে যে ন্যাক্কারজরনক কাণ্ড ঘটেছে তাতে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে মারাত্মক নেতিবাচক ধারণা পৌঁছেছে। সরকার পক্ষে বলা হয়েছে-‘আসামি পক্ষের আইনজীবী উপস্থিত না হওয়ায় শুনানি করা যায়নি’।
এ নিয়ে ‘প্রথম আলো’ একটি ‘এমবেডেড’ রিপোর্ট ছেপেছে। তারা বলছে-“শুনানিতে আসামিপক্ষের কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না। যার কারণে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সময়ের আবেদন করা হয়। আদালত তা মঞ্জুর করে আগামী বছরের ২ জানুয়ারি পরবর্তী দিন ধার্য করেন।“
আসামি পক্ষে আইনজীবী কেন উপস্থিত হয়নি, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন-‘রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় দাসের জামিন শুনানির জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু কেন অংশ নেননি, জানি না। শুনানিতে অংশ নিতে কোনো আইনজীবীকে ভয় দেখানো কিংবা হুমকি দেওয়ার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। এখন পর্যন্ত কোনো আইনজীবী আমাদের কিছু জানাননি।’
এদিকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর আইনজীবী উল্লেখ করে বাংলাদেশে রমেন রায়ের ওপর হামলার খবর প্রকাশ ও প্রচার করেছে ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সেও এ খবর ছড়িয়ে পড়েছে। স্বভাবতই ভারতের বিভিন্ন মিডিয়া এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু ‘প্রথম আলো’ ফ্যাক্টচেক-এর বরাতে বলছে-‘খবরটি ভূয়া’। প্রথম আলো ভালো করেই জানে ফ্যাক্টচেক বা তথ্য যাচাই সংস্থা রিউমর স্ক্যানার সাইটটি কাদের নিয়ন্ত্রণে। তার পরও তারা সেটিকে হাইলাইট করেছে।
কোতোয়ালি থানার ওসি আব্দুল করিম জানান ‘কোনো আইনজীবী তাঁর কাছে কোনো অভিযোগ করেননি।‘ এটা পুলিশ বা প্রশাসনের কমন ডায়লগ।
অন্যদিকে সনাতনী জাগরণ জোটের প্রতিনিধি গৌরাঙ্গ দাস প্রভু ডয়চে ভেলেকে বলেন,” আসলে আমাদের ৭০ জনের বেশি হিন্দু আইনজীবীকে মামলায় আসামি করায় তারা কেউ আদালতে যেতে পারেননি। তারপরও আমরা ঢাকা থেকে আইনজীবী আনার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু একদিন আগে থেকেই ‘তারা‘ হুমকি দিতে থাকে। সকালে আদালত এলাকায় ‘ওই আইনজীবীরা’ মিছিল বের করে, ফলে আমাদের পক্ষে আইনজীবী দেয়া সম্ভব হয়নি।” এ সময় দুজন আইনজীবীর নাম উল্লেখ করে তার ওপর হামলা এবং অন্য জনের ভয়ে আত্মগোপনে থাকার কথাও বলেন গৌরাঙ্গ দাস প্রভু, এর আগে আইনজীবী রিগ্যান আচার্যের চেম্বারে হামলা হয়েছে। তার ওপর হামলা চালিয়ে তাকে আহত করা হয়। আইনজীবী শুভাশীষ ভয়ে আত্মগোপনে আছেন।”
মামলার শিকার হননি এমন একজন আইনজীবী মঙ্গলবার আদালতে গিয়েছিলেন চিন্ময় দাশের পক্ষে জামিন আবেদন জানাতে৷ নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই আইনজীবী ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমাকে মামলার আসামি করা হয়নি। ফলে আমি গিয়েছি। কিন্তু সকালে আদালতে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আমি ওকালত নামায় সই করে জামিন আবেদন করার সাহস পাইনি। সেখানে জামিন আবেদন যাতে কেউ না করে এমন হুমকি দেয়া হচ্ছিল। ফলে আমি নিরাপত্তার কারণে আদালত থেকে চলে আসি।”
আদালতে ঘটিত এইসকল অপরাধের একাধিক ‘লজিক’ দিতে পারবেন পিপি, ওসি এবং আদালত সংশ্লিষ্টরা। তাতে করে আদলতে একটি বিশেষ শ্রেণির মাস্তানির খবর মিথ্যে হয়ে যাবে না। মিথ্যে হয়ে যাবে না এ নিয়ে সরকারের ‘হিডেন মনবাঞ্ছা’।
ফেসবুকে একজন পরিচিতমুখ ব্যারিস্টার লিখেছেন-“আইনি সহায়তা পাওয়া যেকোনো নাগরিকের আইনি এবং সাংবিধানিক অধিকার।“
সেই অধিকারটুকুও সরকার নিশ্চিত করতে পারল না। এর ফলে প্রতিবেশী ভারতের হিন্দু সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হলে, বিষোদগার করলে, ‘ব্যবস্থা নিতে’ তাদের সরকারকে চাপ দিলে সেটাকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ বলে বাণী বর্ষণ করেন! অদ্ভুত!
গত কয়েকদিন ধরে বুয়েটসহ বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে ভারতীয় পতাকা এঁকে, কোথাও কাপড়ের পতাকা মাটিতে রেখে জুতো দিয়ে মাড়ানোর ছবি বিশ্বময় ছড়িয়েছে। এটা গর্হিত অপরাধ। এই খবর ছড়ানোর পরে ভারতের সবকটি দল সকল ভেদাভেদ ভুলে একজোট হয়ে মোদী সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় সীমান্তে ভারতের সৈন্য সমাবেশ বেড়েছে। কানাঘুষো হচ্ছে ‘ভারত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এ যেতে পারে।
সরকারের সকলেই ব্যাপারটা জানেন। দেখেছেন। কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন? না। কারা এমন গর্হিত কাজ করল তা বের করা কি পুলিশের পক্ষে অসম্ভব? মোটেও না। এ বিষয়ে ইউনূস সরকারের নীরবতা প্রমাণ করে তিনি এবং তার দোসরদের ‘ইশারা’ কিংবা ‘গ্রীণ সিগনাল’ না পেলে এমন অপকর্মটি ঘটতে পারত না।
এর প্রতিক্রিয়ায় কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে মিছিল করে গিয়ে বাংলাদেশর পতাকা পুড়িয়েছে রাজ্য বিজেপির কর্মীরা। ব্যাস! সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘ঘুম ভেঙেছে’ এবং তারা কড়া ভাষায় ভারতের এই আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। অথচ বাংলাদেশে ভারতের পতাকা অবমাননার সময় স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সরকার নীরব দর্শক!
এরই জেরে ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ উপ হাইকমিশনে হামলা হয়েছে। একাজটি ন্যাক্কারজনক এবং জেনেভা কনভেনশনবিরোধী। অথচ এখানে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের মত নীরব থাকেনি। ঘটনায় জড়িত চার-পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে। যথাযথ দায়িত্ব পালন না করায় চারজন পুলিশের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি ভারতের সকল বাংলাদেশ উপ হাইকমিশন ও হাইকমিশনে নিরাপত্তা নিচ্ছিদ্র করেছে ভারত সরকার।
.
বাংলাদেশ কী করেছে? আবারও একটি তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাংলাদেশে ভারতের পতাকার অমর্যাদা করা দুষ্কৃতিদের গ্রেফতার করার কথা তাদের তখনও মনে হয়নি!
ব্যাপারটা যেন এমন-তোমাদের অপরাধ গর্হিত অপরাধ, আর আমাদের এখানে এমন কিছু হয়েছে বলে এখনও আমাদের নজরে আসেনি! এই ধরণের দ্বিচারিতা কী পাড়ায় পাড়ায় বা পরিবারে পরিবারে ঘটার মত? মোটেও না। এটা আন্তর্জাতিক ইস্যু। এখন সারা বিশ্ব জেনে গেল বাংলাদেশ তাদের নিজেদের অপকর্ম লুকিয়ে অন্যে অপকর্মকে নিন্দা করছে। আর সে কারণে সরকারের প্রিয় মিত্র বাইডেন প্রশাসনও সরকারের এমন দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে, এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের সূতো সামান্য যেটুকু টিকে ছিল তাও ছিঁড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
আমরা যারা সাধারণ জনগণ তাদের নিয়তি হলো আপনাদের এইসব হিপোক্র্যাসি, দ্বিচারিতা এবং পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাধানোর পরিণতি ভোগ করতে হবে আমাদেরকে কারণ আমরাই সখ করে কান ফুঁড়িয়ে ইমিটেশনের গহনা পরতে গিয়েছিলাম। মুহাম্মদ ইউনূস হয়ত বাংলাদেশকে একটি চরমপন্থী ইসলামিস্ট কান্ট্রি বানাতে পারবেন না, কিন্তু তিনি যে বীজ পুঁতে সার-জল ঢেলে মহীরূহ বানানোর কাজ করে দিলেন তার ফলাফল এ অঞ্চলে অবধারিত অশান্তি-অস্থিরতা। আর তার বলি হবে নিরীহ সাধারণ জনগণ।
সাম্প্রতিক মন্তব্য