কাজী নজরুল ইসলামের রামায়ণ ভাবনা
কাজী নজরুল ইসলামের রামায়ণ ভাবনা
তাহের আলমাহদী
কেঁচো খুড়তে গিয়ে যেন অজগর লাভ। নজরুল রচনাবলীর অনলাইন সংস্করণের জন্য ওসিআর করতে গিয়ে পেয়ে গেলাম নজরুলের রামায়ণ ভাবনা। ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলীর জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণের সপ্তম খণ্ডের ৬৯ পৃষ্ঠায় “একটি রূপক রচনার খসড়া পরিকল্পনা” নামক একপৃষ্ঠার একটি রচনা রয়েছে। প্রবন্ধ হিসেবে সঙ্কলিত রচনাটিতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে রূপক পরিকল্পনা করেছেন, তার সাথে রয়েছে শ্রদ্ধেয় কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ‘ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ’ বিধির চমৎকার মিল। কবি বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, আমি ব্রাহ্মণ হলেও রামায়ণ মহাভারতের মূল সংস্কৃত গ্রন্থ কখনো পড়ার সৌভাগ্য হয়নি, নজরুল মুসলমান হলেও রামায়ণ মহাভারতের সংস্কৃত ভাষার মূল গ্রন্থ পড়েছে, এবং আমার চেয়ে নজরুল এইসব বিষয়ে ভালো বুঝেছে। শৈলজানন্দের উদ্ধৃতিটা হুবহু দিতে পারিনি, অনেকদিন আগের পড়া, কোন গ্রন্থে পড়েছি তাও মনে নেই। কিন্তু নজরুলের রূপক রচনার খসড়া পরিকল্পনাটি দেখে মনে হলো, শৈলজানন্দ মোটেই ভুল বলেননি। তিনি ঠিকই উপলদ্ধি করেছেন, নজরুল রামায়ণ মহাভারতের অন্তর্নিহিত অর্থ যথার্থই অনুধাবন করতে পেরেছেন। নিম্নে নজরুলের প্রবন্ধটি হুবহু তুলে দিচ্ছি— একটি রূপক রচনার খসড়া পরিকল্পনা [নজরুল ইসলামের এই অসমাপ্ত রচনাটির পাণ্ডুলিপি সুরশিল্পী শ্রীজগৎ ঘটকের সংগ্রহে আছে। এতে একটি রূপক নাটকের খসড়া বিষয়-কল্পনা draft theme আছে বলে অনুমিত হয়।] জনক = যে শস্য ফসল উৎপাদন করে। রাম = কৃষকদের প্রতিনিধি (জনগণ-অধিনায়ক)। সীতা = জনক অর্থাৎ শস্য উৎপাদকের কন্যা; শস্য। হরধনু-ভঙ্গ = অর্থাৎ Hard Soil উর্বর করে শস্য অর্থাৎ সীতাকে পাওয়া। লক্ষ্মণ = শ্রীমান (?)। রাবণ = যে সেই শস্য বা সীতাকে হরণ করে। লোভের প্রতীক। যে বিশ হাত দিয়ে লুণ্ঠন করে, দশ মুখ দিয়ে গ্রাস করে। রাম = জনগণ বা কৃষকদের প্রতিনিধি, তাই দুর্বাদল-শ্যাম। হনুমান = নৌ-যান ও আকাশযানের প্রতীক। পবন = গতি (speed) ভরত = President শত্রুঘ্ন = শক্ৰহন্তা। কুশ-লভ = শস্যের দুই অর্ধ। বিভীষণ = লোভের সহোদর নির্লোভ: বিবেক। কৌশল্যা = ডিপ্লোমেসি; তার গর্ভেই জনগণ-অধিনায়ক জন্ম নেয়। দশরথ = দশ দিকে যার অব্যাহত গতি। রাবণের বৈমাত্রেয় ভাই কুবের। ঐশ্বর্যের দুই দিক—দেবশক্তিতে ঐশ্বর্য নিয়োজিত হলে মঙ্গল সাধন করে; রাক্ষস শক্তিজাত ঐশ্বর্য অমঙ্গল সাধন করে, লুণ্ঠন করে। কুশ = যজ্ঞাদি কার্যে লাগে; তৃণ। লব = কুশের নিম্নার্ধ ভাগ। সীতার পাতাল প্রবেশ = রাম অর্থাৎ কৃষকদের প্রতিনিধি যখন শস্যকে অবহেলা করে জনগণের দুর্বুদ্ধিপ্রসূত স্বর্ণকে গ্রহণ করেন, তখন শস্য পাতাল প্রবেশ করেন। অর্থাৎ শস্য-উৎপাদিকা শক্তিকে অবহেলা করে স্বর্ণরৌপ্যকে (স্বর্ণসীতাকে), বড় করে ধরলে দেশের সমূহ অকল্যাণ হয়। এই ভ্রম বুঝে রামকে বা জনগণের প্রতিনিধিকে সরযুর জলে ডুবতে হয়। কৈকেয়ী ও মন্থরা = দুর্বুদ্ধি। কৃষক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধি বনবাসে গেলে বা Departure হলে শস্য অর্থাৎ সীতাও সহগামিনী হন। কৃষক ও শ্রমিক সাহায্য না পাওয়ায় রাবণ শস্যহরণ করতে সমর্থ হয়। রাবণ = ঐশ্বর্য-পিপাসী সুমালির দৌহিত্র। কুবেরের ঐশ্বর্য দেখে সুমালির ঈর্ষা হয়, সেই ঈর্ষা বুদ্ধিপ্রসূত যে issue. তারই নাম নিকতা। তার সন্তান লোভ বা রাবণ। বিশ্রুবা = ঋষি। রাবণ = ব্রাহ্মণ-শক্তি + রাক্ষস-শক্তি।
সম্পাদকের নোট:
( রবি চক্রবর্তী এবং প্রয়াত কলিম খান বর্ণভিত্তিক ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি প্রয়োগ করে রামায়ণ , মহাভারতসহ সকল পৌরাণিক গ্রন্থগুলো পাঠ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই পদ্ধতি অবলম্বন করেই গ্রন্থগুলোর অর্থোদ্ধার সম্ভব; অন্যথায় মনে হবে গাঁজাখোরি। যদিও একাডেমিক পণ্ডিতদের অনেকে কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তীর তত্ত্বকে পাত্তাই দিতে চাইলেন না। কথা হল, কাজী নজরুল ইসলাম, বর্ণভিত্তিক ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাথে পরিচিত ( তখনও এই তত্ত্ব অধরা ) না হয়েও কেমন করে লিখে গেলেন, সেইসব মানে? Taher Al-Mahdi বিষয়টি নজরে আনলেন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, কাজি নজরুল ইসলাম , রাম , রাবণ , সীতা , রাক্ষস, দশরথ -এর মানেগুলো ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় লিখে রেখেছিলেন। — স্বপন মাঝি)
সাম্প্রতিক মন্তব্য