আমাদের জাতীয় সংগীত যে কারণে অনন্য, বিশ্বসেরা
আমাদের জাতীয় সংগীত যে কারণে অনন্য, বিশ্বসেরা
দুর্জয় রায়
আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির জননী ইউনাইটেড কিংডম বা ব্রিটেনের জাতীয় সংগীতের প্রথম অংশটা হচ্ছে:
“God save our gracious King,
Long live our noble King,
God save the King:
Send him victorious,
Happy and glorious,
Long to reign over us:
God save the King.”
দ্বিতীয় অংশটাও প্রথম অংশেরই প্রতিধ্বনি প্রায়। ব্রিটেনের জাতীয় সংগীতের পুরোটাই তাদের রাজার কল্যাণের জন্য তাদের গডের কাছে প্রার্থনা। গড যেন তাদের উদার মহান রাজাকে রক্ষা করেন, দীর্ঘজীবী করেন, বিজয়ী করেন, সুখী করেন, বিজয়ী করেন, এবং প্রজাদেরকে রাজা যেন চিরদিন শাসন করতে পারেন। আরও বলা হচ্ছে, গড যেন রাজার শত্রুদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দেন, তাদের রাজনীতি পংগু করে দেন, তাদের সমস্ত কৌশল বানচাল করে দেন! আহা! কী চমৎকার একান্ত বাধ্যগত অনুগত প্রজা সাধারণ! নিজেরদের জন্য কোনো চাওয়া নেই! “ভরপেট না-ও খাই, রাজকর দেয়া চাই”- টাইপ প্রজা ও জাতীয় সংগীত বটে!
শেষ লাইনের আগের লাইনে গডের প্রতি পরিপূর্ণ আত্মনিবেদনের কথা বলা হয়েছ। একেবারে শেষ লাইনে ‘গড সেইভ আস অল’ বলে প্রজাদের মংগলের কথাও একটু বলা হয়েছে বটে।
এই ‘গড’ মানে কিন্তু আমরা যেভাবে ‘স্রষ্টা’ বলে সকল মানুষের, অসীম মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তাকে বুঝিয়ে থাকি তা নয়। এই গড হচ্ছে খ্রিস্টানদের গড বা প্রভূ। তার মানে, ব্রিটেনের জাতীয় সংগীতটি প্রথমত: একটা খ্রিস্টিয় প্রার্থনাসংগীত; দ্বিতীয়ত: দেশটির রাজার মংগলকামনাকারী প্রার্থনাসংগীত, এবং সাম্রাজ্যবাদী, অন্য দেশের অমংগল ও ধ্বংস কামনাকারী সংগীত। অত্যন্ত সংকীর্ণ মানসিকতার একটি জাতীয় সংগীত।
ব্রিটনের জাতীয় সংগীতটিতে ৫ বার ‘কিং’ শব্দটি এবং কিং-এর বদলে ২ বার ‘হিম’, ১ বার ‘হিজ’ এবং ২ বার ‘হী শব্দের ব্যবহার আছে। রাজা যখন নিজে জাতীয় সংগীত গায় তখন কি তিনি ‘কিং’ ‘হিজ’ ‘হিম’ ‘হী’-এর স্থলে ‘মি’ বা অন্যকিছু বলেন? নাকি চুপ থাকেন? কী জটিল এক জাতীয় সংগীত!
কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রিটেনের আরও কিছু প্রাক্তন কলোনী স্বাধীন হওয়ার পরও গত শতাব্দীর শেষ দিক পর্যন্ত ব্রিটেনের জাতীয় সংগীতকেই তাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে মানতো।
কানাডা:
১৯৮০ সালের পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটেনের ‘গড সেইভ দ্য কিং’-ই ছিল কানাডার জাতীয় সংগীত। বর্তমান জাতীয় সংগীত ‘O Canada’ গৃহীত হয় ১৯৮০ সালে। কানাডার জাতীয় সংগীতেও গড-এর নিকট প্রার্থনা আছে যেন দেশটিকে তাদের গড গৌরবময় এবং মুক্ত রাখেন। “God keep our land glorious and free!” স্বাভাবিকভাবেই এই গড খ্রিস্টানদের প্রভূ, লর্ড। এই লাইনটার কারণে কানাডার জাতীয় সংগীতটি একটা খ্রিস্টিয় প্রার্থনাসংগীতে পরিণত হয়েছে। তবে কানাডার সাবেক জাতীয় যসংগীত, ব্রিটেনের ‘গড সেইভ দ্য কিং’-ও বর্তমান জাতীয় সংগীতের মতোই সম্মান লাভ করে থাকে। জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে এমন জটিলতা বা স্বাধীন হয়েও পূর্বের ভিন্ দেশি শাসকের জন্য এমন আনুগত্যের বিষয়টি বড় বিচ্ছিরি রকমের জটিল মনে হয় আমার কাছে!
অস্ট্রেলিয়াঃ
১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের জাতীয় সঙ্গীত ‘গড সেইভ দ্য কিং’-ই ছিলো অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সঙ্গীত। ১৯৮৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান জাতীয় সঙ্গীত ‘Advance Australia Fair’ অফিসিয়ালি গৃহীত হয়। তবে পূর্বের জাতীয় সঙ্গীতটিও ‘রয়্যাল এনথেম’ হিসেবে সমান মর্যাদা পেয়ে থাকে। ব্রিটেনের রাজা বা রাজপরিবারের কোনো সদস্য অস্ট্রেলিয়া সফরে গেলে ‘গড সেইভ দ্য কিং’ পরিবেশন করা হয়। এই দেশেও কানাডার মতো জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিচ্ছিরি জটিলতা!
নিউজিল্যান্ডঃ
১৯৭৬ সাল পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডের জাতীয় সঙ্গীত ছিল ব্রিটেনের ‘গড সেইভ দ্য কিং’। ১৯৭৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বর্তমান জাতীয় সঙ্গীত ‘God Defend New Zealand’ অফিসিয়ালি গৃহীত হয়। বোঝাই যাচ্ছে এটি আগের ব্রিটিশ জাতীয় সংগীতেরই একটু পরিবর্তিত রূপ। গড-এর কাছে প্রার্থনা বা খ্রিস্টিয় প্রার্থনাসঙ্গীত।
আমেরিকাঃ
ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার জাতীয় সংগীতটি বেশ কাব্যিক। দেশকে ভালবাসার কথা, দেশের প্রতি আনুগত্যের কথা, যুদ্ধের বেদনা এবং বিজয় ও শান্তির কথা আছে। কিন্তু এটিও একটি খাঁটি খ্রিস্টিয় প্রার্থনাসঙ্গীত। “And this be our motto: ‘In God is our trust’.” এই একটি লাইন আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীতের সকল সৌন্দর্য নষ্ট করে দিয়ে একে খ্রিস্টিয়সঙ্গীতে পরিণত করেছে। “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে গড-এর প্রতি আমাদের বিশ্বাস।” স্বাভাবিকভাবেই এই ‘গড’ মানে সকল প্রাণি বা সকল কিছুর সৃষ্টিকারী ‘স্রষ্টা’ নন। খ্রিস্টানদের প্রভূ বা লর্ড ‘গড’। বলা যায়, আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীতে ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে যে দেশটি একটি খ্রিস্টানরাষ্ট্র হবে!
রাশিয়াঃ
এই দেশটির জাতীয় সঙ্গীতে নিজেদেরকে পৃথিবীর সেরা বলে অহংকার প্রকাশের পাশাপাশি দেশটিকে God কর্তৃক তাদের জন্য রক্ষিত ভূমি বলে দাবী করা হয়েছে।
You are the only one in the world!
You are the only one –
the native land so kept by God!”
এটি একটি অহংকারী এবং God –এর প্রতি অনুগত খ্রিস্টিয় জাতীয় সঙ্গীত।
জাপানঃ
জাপানের জাতীয় সঙ্গীতটি বলা যায় পুরোপুরি দেশটির সম্রাটের প্রশস্তি ও প্রশংসাগীতি। ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ ও জাপানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, টোকিও ইম্পেরিয়াল ইউনিভারসিটির জাপানিজ ভাষার প্রফেসর Basil Hall Chamberlain (1850 – 1935) জাপানের জাতীয় সঙ্গীতের নিম্নরূপ ইংরেজি অনুবাদ করেছেনঃ
“Thousands of years of happy reign be thine;
Rule on, my lord, until what are pebbles now
By ages united to mighty rocks shall grow
Whose venerable sides the moss doth line.”
বাংলা করলে এমন হয়ঃ “হে, মহারাজ, অনন্তকাল আপনি সুখে রাজ্য শাসন করুন, যতদিন না এই ক্ষুদ্র নুড়িপাথরগুলো বিরাট পর্বতে পরিণত হয়, যতদিন না সেই পর্বতের সুন্দর পাশগুলো নানাবিধ শৈবালে শোভাময় হয়।” প্রজার জন্য কোনকিছু চাওয়ার নাই। তাদের সম্রাট সুখে থাকুক! সম্রাট ও তার বংশধরদের শাসন চিরঅক্ষয় হোক। জাপানের জাতীয় সংগীত সম্রাটকে খুশি করার জন্য রাজবন্দনা ছাড়া কিছু নয়।
সৌদি আরব:
Saudipedia সৌদি আরবের জাতীয় সংগীতের নিম্নরূপ ইংরেজি অনুবাদ করেছে:
Hasten to glory and supremacy, Glorify the Creator of the heavens
And raise the green flag,
Carrying the written light reflecting guidence.
Allahu Akbar, O my homeland.
My homeland, Live as the pride of Muslims!
Long live the King, For the flag and the homeland!
বোঝাই যাচ্ছে, সৌদি আরবের জাতীয় সংগীতটি আল্লাহর স্তুতি ও মুসলমানদের গৌরবগাথা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলছে। এবং সৌদি বাদশাহর দীর্ঘজীবন ও তার শাসনের চিরস্থায়ীত্ব কামনা করছে। এটিও রাজবন্দনা ও ইসলামিসংগীত বিশেষ।
ভারত:
“জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে
ভারতভাগ্যবিধাতা!…
তব শুভ নামে জাগে,
তব শুভ আশিষ মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে
ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে,
জয় জয় জয় জয় হে।”
ভারতের জাতীয় সংগীতে ঈশ্বরবন্দনার মাধ্যমে দেশের মঙ্গল কামনা করা হয়েছে। দেশাত্মবোধের চেয়ে ঈশ্বরের প্রতি ভরসা ও বিশ্বাসের ভাবটাই বেশি ফুটে উঠেছে। ফলে এটিও একটি ভক্তিগীতি হয়ে উঠেছে।
গানটি নিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝি ও তৎকালীন পত্রিকার ভুল রিপোর্টের কারণে বলা হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথ গানটিতে জনগণমন-অধিনায়ক, ভারতভাগ্যবিধাতা বলতে তৎকালীন ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জকে বুঝিয়েছেন। এটি যে ভুল তা রবীন্দ্রনাথের এক চিঠি থেকেই প্রমাণিত। ১৯৩৭ সালের ২০ নভেম্বর
বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী পুলিনবিহারী সেনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি
চিঠি থেকে:
“…সে বৎসর (১৯১১ সালের ডিসেম্বর) ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনও বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জনগণমন-অধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি, পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায় যুগ যুগ ধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথি, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ কোনো জর্জই কোনক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন।…”
(গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ, সমীর সেনগুপ্ত, প্যাপিরাস, ২০০৮, পৃষ্ঠা ১১৬)
ফ্রান্স:
ফ্রান্সকে বলা হয় শিল্প ও সংস্কৃতির দেশ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন: ছবির দেশ কবিতার দেশ। অথচ ফ্রান্সের জাতীয় সংগীতে দেশটির জনগণকে বলা হচ্ছে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে! “To arms, citizens!” “শুনতে পাচ্ছ কি বর্বর শত্রুসৈনদের হুংকার? অস্ত্রসজ্জিত হও, দেশবাসী! চলো যুদ্ধের ময়দানে! ওদের নোংরা রক্ত দিয়ে আমাদের শস্যক্ষেতে সেচ দেবো।… মৃত্যুপথযাত্রী শত্রুরা দেখুক আমাদের বিজয়উল্লাস এবং শৌর্য। অস্ত্রসজ্জিত হও, দেশবাসী!”
ফ্রান্সের জাতীয় সংগীতটি আসলে যুদ্ধের হুংকারপূর্ণ গণসংগীত!
“Let us march, let us march!
That their impure blood
Should water our fields….
That your dying enemies
Should see your triumph and glory!
To arms, citizens!”
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি:
যে কোনো বিবেচনায় “আমার সোনার বাংলা” একটি আদর্শ অনন্য অতুলনীয় জাতীয় সংগীত। রাজা বা শাসকের বন্দনা নেই, ঈশ্বরের প্রতি কোনো নিবেদন আবেদন নেই, কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নেই, কারও প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সকল দেশবাসীর দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার কথাটিই চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে আমাদের জাতীয় সংগীতে। এখানে দেশের অপরূপ প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতার কথা আছে। দেশের দু:সময়ে মন ব্যাকুল হয়ে উঠার কথা আছে।
দেশকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে আমাদের জাতীয় সংগীতে। মায়ের অন্ধকার গর্ভ থেকে অন্ধের মতোই আমরা জন্ম নিই। দেশের সূর্য চন্দ্রের আলোতেই আমাদের দৃষ্টিতে আলো ফোটে। দেশের বাতাসেই আমাদের নতুন জীবন লাভ হয়, বেঁচে থাকি। এই মাটি থেকে উৎসারিত জলে, এই মাটিতে জন্মানো শস্যে আমাদের জীবন বাঁচে। আমার দেশের মাটি, আমার দেশ আমার মায়ের চেয়ে বড় বৈ ছোট নয় কোনো ভাবেই। এই দেশই তো আমার আরেক মা। জননীজন্মভূমি।
এই অকৃত্রিম অফুরান অতুলনীয় অতলান্তিক ভালবাসাই ব্যক্ত হয়েছে আমাদের জাতীয় সংগীতে। সন্দেহাতীতভাবে আমাদের জাতীয় সংগীত অনন্য অতুলনীয় বিশ্বসেরা।
আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে মানুষের কথা নেই বলে; এক সময় অনেকে উপহাস করত। কিন্তু যা আছে, তা পায়ের তলার মাটি।
আমাদের আকাশ দূষিত, বাতাস দূষিত, আমের বন দূষিত, নদীর কূল দূষিত।
আমাদের মায়েদের চোখে জল।
ধরিত্রী না বাঁচলে কেউ বাঁচবে না। তা মানুষ যত ক্ষমতাধরই হোক না , সেও বাঁচবে না।
মা ও প্রকৃতির বন্দনা হোক আমাদের চলার পাথেয়।