ভারতের চন্দ্রাভিযান এবং আমাদের দেউলিয়াত্ব
ভারত সফল্ভাবে তাদের চন্দ্রাভিযান সম্পন্ন করেছে। এই সংবাদটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম অনেকেই তাদের নানান প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আমার বন্ধুতালিকায় যারা আছেন তাদের বেশিরভাগই সাংবাদিক, কেউ শিক্ষক বা অন্তত শিক্ষিত ও সমাজ নিয়ে সচেতন মানুষ। এদের বাইরে যে সাধারন মানুষ, বা ব্যবসায়ী বা তরুন, বা ছাত্র সমাজ তাদের প্রতিক্রিয়া কি? ফেসবুক স্ট্যাটাসে একজন লিখেছেন অনেক তরুণ বা মেধাবীরা প্রশ্ন করছেন যে ভারত চাঁদে যান পাঠালে আমাদের কি। আমাদের কেন ভারতের সাথে তুলনা করতে হবে? এখানে আমার ফেসবুক বন্ধু মোস্তফা সবুজের সেই স্ট্যাটাসটি হুবুহু তুলে ধরছি পাঠকদের সুবিধার্থে –
“এই জাতি চিন্তা চেতনায় এতই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে যে জাতির মেধাবী সন্তানরা প্রশ্ন তুলেছে যে ভারত চাঁদে যান পাঠালে আমাদের কি? ভারতের সাথে কেন তুলনা? চিন্তা করা যায়? এরা এখন স্বপ্ন দেখতেও ভুলে গেছে ! ভারত যেমন তোমাদের কাছে পিঁয়াজ, মরিচ বিক্রি করে তেমনি ভবিষ্যতে ও চাঁদের জল, খনিজ তোমাদের কাছে বিক্রি করবে! আর যদি সেই বিক্রি বন্ধ করে তাহলে তোমরা হয় জলের জন্য নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-মারামারি করবে না হলে জলের দাম কত হবে তা মরিচ পিঁয়াজের দামের সাথে তুলনা করে বের কর। অথবা ভারত ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জিতেছে বলে আমদের কেন জিততে হবে এই প্রশ্ন তুলে বিতর্ক জুড়ে দাও! এর বাইরে তো তোমরা আর চিন্তা করতে পারবে না!
বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে কি কি খাতে এগিয়েছে তা নিয়ে ভারতের ছেলে-মেয়েদের পিএইচডি করতে দেখেছি।
ভারত খেলে আমাদের খাওয়া হয় না দাদাভাই।“
এই স্ট্যাটাসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা আমাদের ভাবনার কারণ।প্রথমত, আমাদের দেশের মেধাবী সন্তানরা ভারতের চাঁদে যান পাঠানো কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটা বুঝতে অপারগ। দ্বিতীয়ত, এদের হৃদয়ে আর কোন সুদুরপ্রসারী চিন্তা নেই, বা মহৎ স্বপ্ন নেই। তৃতীয়ত, এদের আবেগ বা চিন্তার দৌড় ক্রিকেট খেলা পর্যন্ত। এই স্ট্যাটাসে কেন চাঁদে অভিযান বা চন্দ্রাভিযান গুরুত্বপূর্ণ তার কিছুটা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এই যে আমাদের মন-মানসিকতার, স্বপ্নের জগতে এই দেউলিয়াত্ব তার ভয়াবহ চিত্রটা আমরা দেখছি কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবছি না। কেন আমাদের দেশে এমন সময় ও পরিস্থিতি সৃষ্টি হল যখন সকল পড়ালেখা ও উদ্যোগের একটাই মাত্র উদ্দেশ্য তা হল টাকা উপার্জন ও বিলাসী জীবন যাপন, অথবা পশ্চিমা উন্নত দেশে চলে যাওয়া। প্রায় প্রত্যেকেই এখন লেখাপড়া করে ডিগ্রী অর্জন করছে, এবং এদের সিংহ ভাগ ছাত্র জীবন থেকে বিসিএস পরীক্ষার, বিভিন্ন সরকারি চাকুরির বা ব্যাঙ্কে চাকুরির জন্য প্রস্তুতি শুরু করে। কি করে? গাইড মুখস্ত করে। অনেক অনেক সাধারন জ্ঞানের তথ্য মুখস্ত করে। যে তথ্য একজন মানুষের মনের সুকমল বৃত্তির কোন বিকাশ ঘটায় না, তার চিন্তার জগতে কোন আলোড়ন তুলে না, তাকে ভাবতে শেখায় না, তাকে পরোপকারী বানায় না, তার জ্ঞানের কোন উন্মেষ ঘটায় না। যখন ছাত্ররা একাডেমিক বইয়ের বাইরেও জ্ঞান, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বই পড়বে, সাহিত্য পড়বে তখন কিনা তারা একটি সরকারি চাকুরির জন্য কেবল গাইড মুখস্ত করে চলেছে অথবা উন্নত পশ্চিমা দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন আরেক দল আছে যারা ছাত্র জীবন থেকে শর্টকাট ধান্দাবাজিকে বেছে নেয়। তো এই হচ্ছে আমাদের দেশে মেধাবী বা ছাত্রদের অবস্থা। আর কিছু সংখ্যক যারা আসলেই জ্ঞান চর্চাকে ভালবাসে, গবেষণা করতে চায় তাদের জন্য আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ কি হাত বাড়িয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ কতটুকু? বিশ্ববিদ্যালয়ের মুলত জ্ঞান বিকাশের জন্য কাজ করার কথা, অথচ সেখানে গবেষণা কাজকে কতটুকু গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বা উৎসাহিত করা হচ্ছে? নাকি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রিসোর্স এর অভাবে একেক জনের গবেষণাকর্মকে দীর্ঘ সময় ঝুলে থাকতে হচ্ছে? একেকজন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে বড় আমলা হয়েছে বা অনেক টাকা পয়াসা কামিয়েছে জীবনে এটাই এখনকার সময়ে তাদের গৌরব। কিন্তু গবেষণায় আমাদের কোন উৎসাহ নেই। আমাদের কোনও গবেষক দরকার নেই, দার্শনিক দরকার নেই, জ্ঞান তাপস দরকার নেই, সাহিত্যিক দরকার নেই; আমাদের মানবিক মানুষ দরকার নেই। দরকার শুধু সফল মানুষ। আর এখনকার বাস্তবতায় সমাজে সফল মানুষ কারা? যারা যেভাবেই হোক প্রচুর টাকা কামিয়েছে, যার বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স আছে, যে বিদেশে ভ্রমনে যায় প্রায়শ; যে দান খয়রাত করে ছবি তুলে, ভিডিও করে তা প্রচার করে; যে ক্ষমতাশালী বা প্রভাবশালীদের সাথে ঘনিষ্ঠ, তাদের সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে সাজিয়ে রাখে। এরা হল এখন সফলতার আইকন। তাই সকল মেধাবী, ছাত্র, বা পেশাজীবীরা এখন টাকার পেছনেই ছুটছে নীতি, আদর্শ, বিবেক বিক্রি করে। এরা বুঝে গেছে এই সমাজের সিস্টেম ও মনসতত্ত্ব। যত গুণ বা মেধা বা জ্ঞান আপনার থাক না কেন কোনও কাজে আসবে না, আপনি অসম্মানিত হবেন, হয়রানির শিকার হবেন, এমনকি হয়ত একটা কাজও আপনার জুটবে না। কোনও অন্যায়ের শিকার হয়ে আপনি প্রতিবাদ করতে যাবেন, আপনাকে নিপীরণ, হয়রানি করার জন্য অপরাধী একটু পয়সা খরচ করলেই দেখবেন ভাত ছিটালে যেমন কাকের অভাব হয় না তেমনি আপনার পেছনে লাগার লোকের অভাব হবে না তার। এভাবে এই সমাজ ব্যবস্থা, এই রাষ্ট্র এমন মেধাহীন, মহৎ স্বপ্নহীন, জ্ঞানহীন একটা জাতি তৈরি করেছে। সকল সম্মানিত পেশা যা কেবল পেশা ছিল না একসময় , যা আসলে পেশা হলেও মানব সেবার সাথে ও মানুষ গড়ার সাথে সম্পর্কিত সেই সকল পেশার মানুষগুলো আজ প্রশ্নবিদ্ধ। মুল কারণ সেই একই — তেলবাজি বা ধান্ধাবাজি ছাড়া চাকুরি, পদ, পজিশান হয় না, হলেও ধরে রাখা যায় না, এটা ছাড়া টাকা হয় না’ আর টাকা না হলে সে সফল মানুষই নয়। তাই সকল মহৎ পেশার কিছু মানুষ মহৎ পেশাগুলোকে কলঙ্কিত করেছে, সাধারন মানুষের শ্রদ্ধা, আস্থা নস্ট করেছে। আজ মানুষ আর শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, রাজনীতিকদের শ্রদ্ধা করে না। জ্ঞানের দিক থেকে, শিল্পের দিক থেকে, মানবিক মানুষ গড়ার দিক থেকে আমাদের অর্জন আজ শূন্যেরও নিচে নেমে গেছে। আমরা এখন বুঝতেই পারি না যে জ্ঞানের বিকাশ কেন প্রয়োজন, গবেষণার কেন প্রয়োজন, মানবিক মূল্যবোধ কেন প্রয়োজন।
পুনশচঃ আবার কেবল প্রযুক্তিগত লেখাপড়া বা বিজ্ঞান পড়াকেই উৎসাহিত করে ও শিল্পকলা, মানবিক বিদ্যায় পড়াশোনাকে অনুৎসাহিত করার যে মাশুল এখন বিশ্ব দিচ্ছে একদল অমানবিক, নীতিহীন কেবল অর্থ ও ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক গবেষক, চিকিৎসক, প্রযুক্তিবিদ তৈরি করে যারা মানুষের, বা এই পৃথিবীর তোয়াক্কা করে না সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা ভয়ঙ্কর সব বোমা বানাচ্ছে, রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্র তৈরি করছে, তারা ব্রিজ বা অট্টালিকা বানাতে গিয়ে দুর্নীতি করছে যার ফলে অনেক মানুষ প্রাণ হারাতে পারে, তারা অর্থের জন্য জীবন বাঁচানোর চিকিৎসক না হয়ে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তার মানে হল এই যে আপনি যে বিষয়েই এক্সপার্ট হন না কেন যদি আপনার মানবিক মূল্যবোধ বা নীতি না থাকে, এবং কেন মানবিক মূল্যবোধ খুব গুরুত্বপূর্ণ সকল মানুষের জন্য, সমাজের জন্য এবং এই পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য তা আপনার জানা না থাকে তবে আপনি খুব বিপদজনক, মানুষের জন্য ও এই সভ্যতার জন্য।
খুব ভাল লিখেছ,এই ভাবে লিখতে থাক সব সময়।শুভকামনা রইল ।
ধন্যবাদ তোমায় উৎসাহ দেবার জন্য।