Select Page

এ যুগের কর্ণ-কুন্তী

এ যুগের কর্ণ-কুন্তী

একটি গল্প-কথন : এ যুগের কর্ণ-কুন্তী

মনস্বিতা বুলবুলি

হুট করে এক সন্ধ্যেবেলা সুমন তাঁর প্রেমিকার বাসার সামনে হাজির। আজই বিয়ে করবে সে, প্রেমিকা সম্পর্কে ইতি টানতে চাইছে তাই। সে জানে মিতু তাকে ভালবাসে, ভীষণ। কিন্তু পরিবার, সমাজ আরও কিছু কারনে সে সরে যেতে চাইছে যা সুমন  কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তাঁর প্রচণ্ড জেদের কাছে হার মানে মিতু। বের হয়ে আসে বাসা থেকে। এক কাজী অফিসে খুব সাদামাটা ভাবে বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের পর সোজা যে যার বাসায়। একটি ছবিও নেই তাদের বিয়ের, এই ভেবে মিতুর মাঝে মাঝে আফসোস হয়। কিন্তু সুমনের এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। সে মিতুকে পেয়েই খুশি। সেই খুশিতে কোন কষ্টই যেন তাকে কাবু করতে পারে না। বেকার অবস্থায় বিয়ে করেছে। সুমনের বাবা নেই। মা আর ভাইয়ের সংসার। তাই তারা গোপন রাখে বিয়ের কথা। কিন্তু একসময় মিতুর পরিবার জেনে যায়। তাঁর আর বাবার বাড়ি থাকার উপায় থাকে না। অগত্যা সুমন মিতুকে তাঁর বাসায় নিয়ে আসে। সুমনের বাসায় জানে মিতু বড় পরিবারের মেয়ে, উচ্চ শিক্ষিত তাই সুমনের বোঝা আর টানতে হবে না তাদের। এই ভেবে তারা তেমন আপত্তি করেনি।  অবশ্য সুমনের বোঝা বলতে ওই দুবেলা বা তিন বেলা ভাত, আর রাতের থাকার জায়গাটুকু। বিনিময়ে প্রবাসী ভাইয়ের ছেলে মেয়েদের দেখাশোনা, বাজার সদাই। এখন ছেলে মেয়েরা অনেকটা বড় হয়েছে। শ্বশুরও আর নেই। তাই সুমন এখন তাদের বোঝাই বটে। তবু নিরুপায় সুমন ও মিতুকে সে বাসায় উঠতে হল। তারা কেউ খারাপ ব্যবহার করেনি মিতুর সাথে। মিতু বেশ খুশী তাতে। সুমন জোরেশোরে চাকুরির জন্য চেষ্টা করছে। আর মিতু তখন মাস্টার্স করছে। শেষ হতে আরও এক সেমিস্টার বাকি। এই বাজারে চাকুরি তো চট করে হয় না। একদিন বাসার লোকেরা মিতুকে বলে তাঁর বাবার বাড়ির লোকদের বলে সুমনকে একটা ব্যবসার ব্যবস্থা করে দিতে। মিতু বলে যে তার বাবা-মা এ বিয়ে এখনও মেনে নেয়নি। কিছুদিন পর সবার মুখ কালো হতে থাকে।  কেমন যেন একটা থম থমে ভাব। সামনে ঈদ। সুমনের ভাই আসবে প্রবাস থেকে। সুমনের বিয়ের আগে কথা ছিল তাঁর ভাই তাকে কিছু টাকা দেবে ছোট খাটো একটা ব্যবসার জন্য। কিন্তু এখন সব এলোমেলো হয়ে গেছে।  মিতুর কাছে যা কিছু ছিল সব শেষ। এমনকি চাকুরির খোঁজে দৌড়ানোর গাড়ি ভাড়া টুকুও নেই। এদিকে বাসায় বেশ উৎসব আমেজ। ভাই এসেছে ক’বছর বাদে। অন্য ভাইয়েরা তাদের বউ বাচ্চা নিয়ে এসেছে। একসাথে ঈদ করবে সবাই।  নতুন বউকে নিয়ে তাদের অবশ্য কোন উৎসাহ নেই। তবে মিতু মনে মনে ভেবেছিল তাঁর ভাসুর হয়ত তাঁর জন্য কিছু আনবে, সে তো নতুন বউ এ বাড়ির। হোক সে সামান্য উপহার, একটি সাবান, কিংবা পাউডার। কিন্তু তাঁর ধারণা ভুল ছিল।তখনও এক মিথ্যে জগতে বাস করছিল মিতু আর সুমন। এরই মাঝে সুমনের দাঁতের ব্যাথা শুরু হল। সুমনের বেশ কটা দাঁতে সমস্যা। কখনও চিকিৎসা করানো হয়নি।  আজ দু’দিন হল রাত হলে ব্যথাটা বাড়ছে। সারা রাত ঘুমাতে পারে না।  ক্রমশ ব্যথাটা বেড়েই চলছে। দাতে দাঁত চেপে, পেটে বালিশ চেপে সুমন গড়াগড়ি খায়। পেইন কিলারেও এখন আর তেমন কাজ হচ্ছে না। হলুদ রঙের কয়েকটা ছোট ছোট ফুল নিয়ে আসে সুমন। নাম কি ফুলগুলোর জানা নেই মিতুর। এই ফুলগুলো মুখে দিলে দাঁতের ব্যথা কমে কিছুটা, ঝিম ঝিম করে অবশ হয়ে আসে মুখ কিছুক্ষনের জন্য।  

সুমনের মা সবই দেখছেন। একদিন সুমন মিতুর চাপাচাপির কারনে তাঁর ভাইকে জানায় তাঁর দাঁতের সমস্যার কথা;  কিন্তু পাত্তা দেয়নি তারা কেউ। হলুদ ফুলগুলো দেখে সুমনের মা বলেন এই ফুলগুলো নাকি আসলেই দাঁত ব্যাথা কমায়। ব্যস, এই টুকুই। সুমন মুখে হলুদ ফুল গুজে পেটে একটা বালিশ চেপে ধরে গোঙাতে থাকে, তাঁর মুখ দিয়ে লালা পরতে থাকে, চোখ দুটো রক্ত বর্ণ। রাত বাড়তে থাকে, আর তাঁর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তাঁর দাঁতের ভয়ঙ্কর অসহ্য ব্যথা। অন্য রুমগুলো থেকে আসা আড্ডা, গল্প, হাসির শব্দে সুমনের গোঙানি চাপা পরে যায়। সে জানে কেউ এগিয়ে আসবে না, কেউ তাঁর দাঁতের চিকিৎসার জন্য একটা পয়সাও দেবে না। অকস্মাৎ সুমনের মাথায় কি খেলে গেল বুঝতে পারে না মিতু। সে বিছানা থেকে উঠে ঘরে থাকা একটা প্লাস হাতে তুলে নেয়। মিতু তখন বুঝতে পারে না কি করতে যাচ্ছে সুমন। প্লাস হাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরে সে। সেই প্লাস দিয়ে সজোরে টানতে থাকে তাঁর দাঁত, মিতু খুব ভয় পেয়ে যায়। ফেরাতে চেষ্টা করে তাকে। কিন্তু সুমন নাছোড় বান্দা। সে সত্যি সত্যি প্লাস দিয়ে পর পর দুটো দাঁত তুলে ফেলে। প্রচণ্ড ভীত মিতু অবিশ্বাস ভরা চোখে দেখতে থাকে রক্তে ভেসে যাচ্ছে সুমনের মুখ।

না, সুমন মরেনি সে রাতে। প্রচণ্ড প্রানশক্তি হয়ত তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তবে সে বাঁচাতে পারেনি তার প্রথম সন্তান সীমান্তকে। মিতুর গর্ভে সুমন এবং মিতুর এক সন্তান এসেছিল। তাঁর নাম রেখেছিল তারা সীমান্ত। সীমান্ত পৃথিবীর আলো দেখতে পারেনি। দুজনেই বেকার থাকায় এবং কোন পরিবার মেনে না নেয়ায় তারা বাচ্চাটিকে আর পৃথিবীতে আনতে পারেনি।

এর কিছুদিন পর সুমন আর মিতুকে বের হয়ে আসতে হল বাসা থেকে। সুমনের ভাই-ভাবী আলাদা থাকবে, শ্বাশুড়ি চলে যাবে গ্রামের বাড়ি তাঁর আর দুই ছেলের সাথে। মিতুকে চলে যেতে হল বাবার বাড়ি, আর সুমনের ঠাই হল রাস্তায়, শুন্য হাতে।

এরপরের একমাস সুমন কেবল রাতে একবেলা দু’মুঠো ভাত মুখে দিতে পেরেছে। না খেতে খেতে তাঁর খাদ্যনালী শুকিয়ে গেছে। তখন শীতকাল। না পেরে সে বাড়ি যায় তাঁর মায়ের কাছে, তাঁর ভাইয়ের কাছে কিছু টাকা সাহায্য চাইতে। তাঁর ভাই তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে  খুব বিরক্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে বলে দেয় আর কখনও যেন সে তাদের বিরক্ত না করে। আর মা তাকে শীতের একটা পুরনো লেপ দিয়ে দেয়। অথচ মায়ের হাতে তখন সুমনের বাবার পেনশনের টাকা। এই পেনশানের টাকা তোলার সকল কাজ সুমনই করেছিল। কিন্তু টাকাটা যখন হাতে পেল মা, তাকে বুঝতেও দেয় নি। তাঁর মায়ের হাতে এই টাকা থাকা অবস্থায় সে দাঁতের ব্যাথায় তীরবিদ্ধ আহত পশুর মত ছটফট করেছে। কিন্তু তাতে মায়ের বা আর কারো হৃদয় এতটুকু বিচলিত হয়নি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সুমনের মাথায় এই স্মৃতিগুলো ছুরির ফলার মত আঘাত করতে থাকে। নিজের অজান্তে চোখ দুটো ভিজে উঠে তাঁর। কিছুতেই যেন আজ থামতে চাইছে না চোখের জল। অস্পষ্ট, ঝাপসা দৃষ্টিতে শেষ বারের মত মাকে আর বাড়িটাকে পেছন ফিরে দেখে সুমন। তাঁর চোখ দুটো কি যেন খোঁজে তাঁর মায়ের চোখে; কিন্তু যা সে খুঁজে ফিরছিল তাঁর কোন চিহ্ন নেই সেই চোখে।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার