Select Page

বাংলাভাষার বানান-সমস্যা সমাধানের পথ

বলা হয়, বাংলা ভাষা, সংস্কৃতর কাছে ঋণী। আসলেই কি তাই? খান-চক্রবর্তীর মতে বাংলা নয়; সংস্কৃত ভাষাই বাংলার কাছে ঋণী। আসুন জেনে নিই, কীভাবে। বাংলা বানান নিয়ে যে নৈরাজ্য চলছে তার অবসান কল্পে গুরুত্বপূর্ণ এই লেখটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা মনে করি। জলমাটি

বাংলাভাষার বানান-সমস্যা সমাধানের পথ

– রবি চক্রবর্তী এবং কলিম খান

১.

বাংলাভাষার বানানে ব্যাপক নৈরাজ্য দেখে রবীন্দ্রনাথ তা দূর করার কথা ভাবেন ১৯৩৫ সালে। নিজেই তা দূর করবেন, এমন সময় বা উপায় নিশ্চয় তাঁর হাতে ছিল না। তাই তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর শ্রীযুক্ত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। সেই উদ্যোগের ফলস্বরূপ একটি সমিতি গঠিত হয়। বানানে নৈরাজ্য দূর করে নিয়মের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, ‘বাংলাভাষাকে বাংলাভাষা বলে স্বীকার করে তার স্বভাবসঙ্গত নিয়মগুলি উদ্ভাবন’ করা হোক (১)। সেই সমিতি কিন্তু সেই নিয়ম ‘উদ্ভাবন’ বা আবিষ্কার করতে পারেননি। না করেই নানারকম বিধান দিয়ে তথাকথিত ‘বানান সংস্কার’-এর কাজ শুরু করে দেন। ফলে, বাংলা বানান নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই, যা আজও সমানে চলছে এবং যত দিন যাচ্ছে বিধানের সংখ্যা ততই বেড়ে চলেছে।

এদিকে শব্দার্থসন্ধান করতে গিয়ে আমাদের দুজনের সামনে বাংলাভাষার অন্তর্নিহিত নিয়ম ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’-এর মতো বেরিয়ে পড়ে (২)। তাকে শব্দার্থের নিয়ম ভেবে পরখ করতে গিয়ে আমরা দেখি, বাংলা শব্দের বানান কীরকম থাকলে শব্দটির মাধ্যমে প্রকাশিতব্য অর্থ ঠিক থাকে, এ হল তারও নিয়ম। সেই নিয়মই যে বাংলা শব্দের বানানের রীতি-নীতি নির্ধারণ করে, সে বিষয়ে আমরা ক্রমে নিঃসন্দেহ হই। বর্ত্তমান প্রসঙ্গে সেই নিয়মটিকে সূত্রবদ্ধ করা দরকার। কিন্তু তার আগে সংস্কৃতভাষা ও বাংলাভাষার স্বরূপ ও সম্পর্কটি বুঝে নেওয়া জরুরী।

‘সংস্কৃতভাষা’ শব্দটিই আমাদের বলে দেয়, সে এমন একটি ভাষা যাকে সংস্কার করে বানানো হয়েছে। রান্নার আগে গিন্নী-মায়েরা যেমন রান্নার নিমিত্ত প্রাপ্ত উপকরণগুলিকে বেছে সাফসুফ করে কেটে কুচিয়ে ধোয়াধুয়ি করার মাধ্যমে সংস্কার করে নিয়ে তবেই রান্না চড়িয়ে ব্যঞ্জন প্রস্তুত করেন, তেমনি নিশ্চয় নানা প্রকার প্রাপ্ত ভাষিক উপকরণকে সংস্কার করেই সংস্কৃতভাষা বানানো হয়েছিল। প্রশ্ন হল, সেই ভাষিক উপকরণগুলি কী? সংস্কৃতকারগণ সেগুলি কোথা থেকে পেয়েছিলেন?

ভাষিক উপকরণগুলি হল, শব্দসম্ভার (vocabulary) এবং শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়ম; যে দুটি নিয়মকে যথাক্রমে শব্দের ভিতরে অর্থ নিষেক ও নিষ্কাশনের (‘semantic’) ও শব্দের পাশে শব্দ গাঁথবার (‘syntactic’) নিয়ম বলে মনে করা হয়। সেগুলি তাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন তাঁদের চারপাশে প্রচলিত তৎকালের স্বাভাবিক (natural) ভাষাগুলি থেকে; সংস্কৃতভাষা বানিয়ে ফেলার আগে তাঁরা নিজেরাও যে ভাষাগুলিতে কথাবার্ত্তা বলতেন (৩)। কিন্তু কথা হল, কীভাবে তাঁরা তাঁদের সেই প্রাপ্ত ভাষিক উপকরণগুলিকে সংস্কার করে সংস্কৃত ভাষা বানিয়েছিলেন?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা যতদূর জেনেছি ও বুঝেছি তা হল, প্রতিটি স্বাভাবিক (natural) ভাষার হাতে তার নিজস্ব শব্দসম্ভার যেমন থাকে, সেই শব্দসম্ভারের সাহায্যে বাক্য গঠন করে মনোভাব লেনদেনের কাজ চালানোর জন্য তার স্বাভাবিক নিয়ম (natural law) দুটিও (শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়ম দুটিও) অবশ্যই থাকে; কিন্তু থাকে অব্যক্তভাবে (tacitly)। সংস্কৃতকারগণ সেই অব্যক্ত (tacit) নিয়ম দুটিকে সূত্রবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত করে ব্যক্ত (explicit) করে নিয়েছিলেন এবং তার সাহায্যে ঐ শব্দসম্ভারের প্রতিটি শব্দকে (প্রত্যেকটি শব্দের মাতৃকাবর্ণ, ক্রিয়ামূল, ক্রিয়া-পরিবার ইত্যাদি নির্ণয়পূর্ব্বক বিন্যাস ও পরিমার্জ্জন-শোধন করে) সংস্কার করে নিয়ে মনোভাব লেন-দেনের কাজে বা বাক্যে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেছিলেন।

আমাদের অনুসন্ধানলব্ধ বোধ অনুসারে (৫০০ খ্রিষ্ট-পূর্ব্বাব্দের বেশ কয়েক শতাব্দী পূর্ব্বেই) তৎকালের প্রচলিত ভাষাপ্রবাহগুলি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে উপরোক্ত ব্যক্ত (explicit) শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়মে সংস্কার করে, জ্ঞানচর্চ্চার ও সমাজ শাসনের ভাষা রূপে ব্যবহারের জন্য যে মানভাষা (standard language) বানানো হয়েছিল, সেটিই সংস্কৃত ভাষা। সেকারণে সংস্কৃতভাষা বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম ভাষাই বটে। স্বভাবতই ভাষাটির নিজস্ব বাহক স্বরূপ কোনো স্বাভাবিক (natural) জাতি ছিল না, যেমন অনাদিকাল থেকে বাংলাভাষাকে বহন করে নিয়ে চলেছে বাঙালী জাতি, কিংবা ইংরেজীকে বহন করে নিয়ে চলেছে ইংরেজ জাতি, সেরকম।

তার মানে, নিজ ভাষা নিয়ে আবর্ত্তমান কোনো একটি জাতি আদিম কাল থেকে প্রজন্মক্রমে সংস্কৃতভাষা বহন করে স্বভাবত আবর্ত্তমান ছিল না, নেই। তবে সেকালের জ্ঞানচর্চ্চাকারী পণ্ডিত ও সমাজ-শাসকেরা এই ভাষা বহন ও ব্যবহার করতেন। তাছাড়া সেকালের ‘চারপাশের ভাষাগুলি’ থেকে উপাদান নিয়ে সংস্কার করে বানানো হয়েছিল বলে আশপাশের ভাষাভাষী জ্ঞানীগুণী ও ক্ষমতাবান মানুষেরা এই মানভাষা স্বরূপ সংস্কৃতভাষায় কথাবার্তা বলতে ও বুঝতে পারতেন। সেকারণেই প্রাচ্যের জাতিগুলির জ্ঞানতাত্ত্বিক অর্জনের অধিকাংশ মানসসম্পদ এই ভাষাতেই লিপিবদ্ধ পাওয়া যায়। সর্ব্বোপরি, বিশ্বের সমস্ত ভাষার তুলনায় সংস্কৃত ভাষার মহত্তম গৌরব ঠিক এইখানে যে, ভাষাটিকে মানবভাষায় বিধৃত প্রকৃতির নিয়ম (natural law in human language) স্বরূপ শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক ব্যক্ত (explicit) নিয়ম দ্বারা সংস্কার করে নির্ম্মাণ করে নেওয়া হয়েছিল। (সেকারণেই, এমনকি একালের কমপিউটার প্রযুক্তির বিচারেও সংস্কৃতই সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাষা)। পরবর্ত্তীকালে ঐ শব্দার্থতাত্ত্বিক নিয়মই যাস্কের নিরুক্তে এবং ঐ বৈয়াকরণিক নিয়মই পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

এখন কথা হল, ঐ সংস্কৃতভাষা যখন বানানো হয়েছিল, তখন আমাদের বঙ্গবাসী-বঙ্গভাষিদের প্রাচীন পূর্ব্বপুরুষেরা নিশ্চয় পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্ত্তা বলতেন, তাঁরা নিশ্চয় বোবা ছিলেন না। আর, তাঁরা যে ভাষাতেই কথা বলুন, সেটি নিশ্চয় আমাদের বর্ত্তমান বাংলাভাষারই প্রাচীন রূপ, তা আপনি তাকে প্রাচীন প্রাকৃত, প্রাকৃত-অপভ্রংশ, প্রাকৃত বাঙ্লা ইত্যাদি যে নামেই শনাক্ত করুন (৪)। কেননা, আমাদের আদিম পূর্ব্ব পুরুষদের সেই প্রাচীন বাংলাই তো প্রজন্মক্রমে প্রবাহিত ও বিবর্ত্তিত হয়ে এসে একালের বাংলাভাষায় পরিণত হয়েছে। তা আমাদের সেই প্রাচীন বাংলা থেকে সংস্কৃতকারগণ শব্দসম্ভার ও ভাষার নিয়মাদি নিয়েছিলেন কি?

হ্যাঁ, নিয়েছিলেন এবং ব্যাপকভাবে নিয়েছিলেন। নিয়েছিলেন বলেই একালের ভাষাবিদ দেখতে পান যে, বাংলাভাষার ৯০ শতাংশ শব্দই সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে কমবেশী মেলে (৫)। নিয়েছিলেন বলেই আমরা আজ বাংলাভাষার ভিতরে যে শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়মকে সক্রিয় দেখি, সংস্কৃতের শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়মের সঙ্গে তা প্রায় হুবহু মিলে যায়। তার মানে, বাংলাভাষা হল আদিম কাল থেকে আজ পর্য্যন্ত প্রবাহিত হয়ে আসা এমন একটি স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক (natural) ভাষা, যার প্রাচীন রূপের নিকট সংস্কৃতভাষা যথেষ্ট পরিমাণে ঋণী। তবে সেই ঋণ পরবর্ত্তিকালে (মধ্যযুগে) বাংলাভাষা সুদসহ ফেরত নিয়ে নিয়েছে। নিয়েছে বলেই স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক (natural) ভাষা হওয়া সত্ত্বেও পরবর্ত্তিকালের বাংলাভাষার শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়ম অন্যান্য স্বাভাবিক ভাষার মতো প্রধানত অব্যক্ত (tacit) হলেও যথেষ্ট পরিমাণে ব্যক্তও (explicit-ও) বটে। ব্যাপারটি কীরকম?

ধরা যাক, আপনার নিজের ক্ষেতের ধান কড়াই শাকসব্জি ইত্যাদি একত্রে পাক করে সপরিবারে খিচুড়ী খেয়েই আপনি দিন কাটান। আপনার প্রতিবেশী এরকম আরও কয়েকজন আছেন। একদিন কয়েকজন সরকারী কর্ম্মী এসে আপনাদের মাঝে বসবাস করতে লাগলেন এবং আপনাদের সকলের কাছ থেকে চাল ডাল শাকসব্জি নিয়ে রান্না করে খেয়ে দিনাতিপাত করতে লাগলেন। ক্রমে জানা গেল, তাঁরা আপনাদের মতো খিচুড়ী খান না, আপনাদের দেওয়া চাল ডাল শাকসব্জি ইত্যাদি দিয়ে তাঁরা পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করে খেয়ে থাকেন। তাঁদের ভাত ডাল সুক্তো ঘণ্ট ঝাল ঝোল অম্বল সবই আলাদা আলাদা এবং তাদের একের পর এক সুবিন্যস্তভাবে সাজিয়ে যথানিয়মে ভোজন করা হয়। রান্নাবান্না, পরিবেশন ও ভোজনের পুরো কর্ম্মকাণ্ডটাই আপনি দেখলেন, দেখেশুনে চেখে খেয়ে শিখেও গেলেন এবং সপরিবারে সেভাবেই সেই রান্নাবান্না করে আপনার পরিবারের ভোজনব্যবস্থা চালাতে লাগলেন। এরকম করলে যা হয়,বাংলাভাষার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে।

সংস্কৃত-ভাষার নিজস্ব মাটি ছিল না, সেকারণে নিজস্ব ফসলও ছিল না। বাংলার এবং তার চারপাশের ভাষাগুলি থেকে জাত শব্দসম্ভার এবং শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক (‘বাংলাভাষার স্বভাবসঙ্গত’) নিয়মগুলি গ্রহণ করে সেগুলিকে সংস্কার করে সংস্কৃতভাষা এক নিয়মবদ্ধ সুবিন্যস্ত ভাষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। মধ্যযুগের বাংলাভাষা তাকে আত্মসাৎ করে সংস্কৃতভাষার থেকেও সম্পদশালী হয়ে যায়। একে তো তার নিজের মাটি, নিজের স্বাভাবিক উৎপাদন, নিজের অব্যক্ত প্রযুক্তি; এবার তার সঙ্গে জুড়ে যায় সংস্কার-কৃত ব্যক্ত প্রযুক্তি, উভয়ের সাহায্যে নিজের জ্ঞানতাত্ত্বিক অর্জ্জন – মধ্যযুগের বাংলা রামায়ণ মহাভারত মঙ্গলকাব্য নব্যন্যায় এবং হিন্দু-মুসলিম পদকর্ত্তাদের সৃষ্ট ও বঙ্গসমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত পদাবলী কীর্ত্তন …ইত্যাদিতে বিধৃত বাংলাভাষাকে দেখা যাচ্ছে, সে তার নিজস্ব ‘স্বভাবসঙ্গত নিয়মগুলি’ ব্যক্তরূপে অনুসরণ করে নিজের বিপুল বিকাশ সাধনে সমর্থ হয়েছে, অজস্র নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছে ও বিপুল মানসসম্পদ অর্জ্জন করেছে। (যে বর্ণগুলিতে তেমন কিছু শব্দ-সম্ভার সংস্কৃতের ছিল না, সেই ছ-ঝ-ঠ-ড-ঢ-থ প্রভৃতি বর্ণে উপরোক্ত ব্যক্ত প্রযুক্তির সাহায্যে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে বিপুল শব্দসম্ভার মধ্যযুগের বাংলাভাষা নিজেই সৃষ্টি করে নিয়েছে। শব্দের সূচনায় থ-বর্ণ আছে, এমন কোনো সংস্কৃত শব্দই ছিল না, আর ঠ-বর্ণে মাত্র একটি শব্দ ছিল ‘ঠক্কুর’।)

বঙ্গদেশে ব্রিটিশ শাসন বাংলাভাষাকে তার স্বকীয়তা ত্যাগে প্ররোচিত করলেও ১৯৩৫ সালের আগে পর্য্যন্ত বাংলাভাষার বিকাশ রোধ করা যায়নি। বাংলাভাষীর জ্ঞানচর্চ্চার জগতে সে রাজার মতোই বিরাজ করেছে। কার্য্যত স্বাধীনতা লাভের পর দিন থেকেই বাংলাভাষার দুর্দ্দিনের সূচনা হয়। অ্যাকাডেমীতে বাংলার শিক্ষকেরা নিষ্প্রভ হয়ে যান। বাংলাভাষাকে তার স্বভাব ত্যাগ করে ইংরেজী ভাষার মত বানিয়ে ফেলার অ্যাকাডেমিক চক্রান্ত শুরু হয়, যার ফলে বাংলাভাষিগণ তাঁদের অতীত থেকে বিচ্যুত হতে থাকেন। ফলত, বাঙালী জাতি তার স্বভাববশত যে ভাষায় তার মানসিক শ্বাসপ্রশ্বাস চালিয়ে প্রাণবন্ত থাকত, সেই ভাষা পরিত্যক্ত হতে থাকে, ইংরেজী ভাষার দ্বারা দূষিত হতে থাকে। বাঙালীর একালের অ্যাকাডেমিগুলির সেই চক্রান্ত বর্ত্তমানে এমন চরমে পৌঁছেছে যে সাধারণ বাংলাভাষী জনসাধারণ সাংস্কৃতিক শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করেছেন।

এখানে আমরা দেখলাম, বাংলাভাষা নিজে একটি স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক (natural) ভাষা। সংস্কৃতভাষা সৃষ্টির আগে থেকেই সে জন্মলাভ করে প্রবাহিত হয়ে আজ পর্য্যন্ত এসে পৌঁছেছ। তার ভিতরের অব্যক্ত (tacit) শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক নিয়মগুলি ব্যক্ত (explicit) ভাবেও তার হাতে রয়েছে, যদিও খানিকটা ধামাচাপা পড়ে। সেগুলির মধ্যে শব্দার্থতাত্ত্বিক নিয়মগুলিকে সম্প্রতি আমরা পুনরুদ্ধার করে একালিকরণ করেছি। সেই নিয়মই বানান সমস্যা সমাধানের কাজে লাগবে। এবার তবে সেই নিয়মকে সূত্রবদ্ধ করে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক।

২.

বাংলা শব্দের বানান যেমন থাকলে শব্দটির মাধ্যমে প্রকাশিতব্য অর্থ ও উচ্চারণ ঠিক থাকে, বাংলা শব্দের বানানের সেই নীতি নির্ধারণ করে যে-নিয়ম, সেই নিয়মটিকে সূত্রবদ্ধ করলে তা এইরকম দাঁড়ায় :-

“যে বর্ণ বা বর্ণসমবায় দিয়ে কোনো শব্দ (গঠিত) লিখিত হয়, সেই বর্ণের বা বর্ণসমবায়ের অর্থ ও শব্দটির অভিধার্থ অভিন্ন হয়” (উদ্ধৃতি চিহ্ন লেখকদ্বয়ের)।

এই নিয়ম অনুসরণ করে বাংলা শব্দের বানান লিখতে হবে। তাহলেই বাংলাভাষার বানানে নৈরাজ্য থাকবে না।

যেমন, ‘তীর’ শব্দের অভিধার্থ হল কূল (নদীর পাড়)। তার সঙ্গে ‘ত্-ী-র্-অ’ এই পর্য্যায়ক্রমে বিন্যস্ত বর্ণগুলির অর্থের যোগফল এক হতে হবে। যদি হয়, তাহলে শব্দটি ‘ত্- ী-র্-অ’ বা তীর বানানেই লিখতে হবে।আপনি বলবেন, তাহলে তো বর্ণমালার ৪৩টি বর্ণেরই অর্থ জানতে হবে। হ্যাঁ, জানতে হবে। জানতে হবে মাত্র ৪৩টি বর্ণের মানে। এবং শুধু জানলেই হবে না, তার ব্যবহারেও দক্ষ হতে হবে। আমরা সেই ৪৩টি অর্থ নিম্নে লিপিবদ্ধ করছি এবং তার প্রয়োগ বিষয়ে দিশানির্দ্দেশ দেওয়ার চেষ্টা করছি। মনে রাখা দরকার, উপরোক্ত এই ‘বানান সংস্কার সূত্র’–এর সাহায্যে কোনো বাংলা শব্দের সংস্কার করে শব্দটি লিখলে সেটিকে ‘সংস্কার-কৃত বাংলা’ শব্দ বা ‘সংস্কৃত-বাংলা’ শব্দ বলা চলে। একেই সেকালের শব্দবিদগণ ব্যুৎপত্তিগত অর্থসম্পন্ন সংস্কৃত শব্দ নামে শনাক্ত করতেন। আমরা দুজন তাকেই ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি মান্যকারী শব্দ নামে চিহ্ণিত করেছি। করেছি এইজন্য যে, কোনো শব্দের ক্রিয়ামূল বোঝা যাক আর নাই যাক, তার বর্ণ ধরে নির্ব্বচন করলেই শব্দটির অর্থ নিষ্কাশন করা সম্ভব। এ নির্দ্দেশ যাস্কের নিরুক্তেই রয়েছে।

তা সে যাই হোক, ‘বানান সংস্কার সূত্র’ নামক এই নিয়মের ক্ষেত্রে এমন কয়েকটি শব্দার্থতাত্ত্বিক সত্য মেনে নিতে হয়, যেগুলিকে একালের অ্যাকাডেমীতে প্রচলিত পাশ্চাত্যের ভাষাতত্ত্ব সম্যকভাবে জানে না। আমরা দেখছি যে, লিপি, শব্দ, পদ, অর্থ, ধ্বনি, বর্ণ, ও বানান বলতে বাংলায় যা বোঝায় ও বোঝানো হয়, পাশ্চাত্যের ভাষাতত্ত্বে যথাক্রমে script, word, part of speech, meaning, phoneme, letter ও spelling বললে ঠিক তা বোঝায় না। কী বোঝায়, সে প্রসঙ্গেই আমরা যাব। কেননা, ঐ বিষয়গুলিতে বাংলা ও ইংরেজীর বোধের পার্থক্যের বিষয়ে ঠিকঠাক জানা না থাকলে উপরোক্ত সূত্রটিকে ভুল বুঝবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এই তুলনামূলক আলোচনায় প্রতিটি বিচার্য্য বাংলা শব্দের ক্রিযাভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ শুরুতেই বন্ধনীর মধ্যে দিয়ে তার পরে আমরা আলোচনায় এগোব। সর্ব্বদা মনে রাখতে হবে, আমরা ভাষার লিখিত রূপ নিয়ে কথাবার্ত্তা বলছি।

২.১ : লিপি

(‘লিপ বা কালি লেপন করা সক্রিয় যাহাতে বা যে সক্রিয়তায়’, অথবা, ‘কালি দিয়ে লিপে বা লিখে যা করা হয়’)।

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ তো অর্থপূর্ণ শব্দ গেঁথে বাক্য বানিয়ে কথাবার্ত্তা বলে আসছিল। তাতে কোনোরকম বানান সমস্যা দেখা দেয়নি। সমস্যা দেখা দেয় সেই বার্ত্তাকে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে। লোকে যখন কোনো শব্দ বলে, তা সে ‘পদ’ বলুক আর ‘leg’ বলুক, শ্রোতা কেবল একপ্রকার আওয়াজই (উচ্চারণই) শোনে না, তার অর্থটাও বুঝতে পারে। তার মানে, মানুষের ভাষার শব্দমাত্রই একটি দ্বৈতাদ্বৈত (two in one) সত্তা। সমস্যা দেখা দিল, সেই দ্বৈতাদ্বৈত সত্তাকে লিপিতে রূপান্তর করতে গিয়ে। একটি মানুষের দুটো পায়ের মতো লিপির প্রতিটি এককের (বর্ণের, বানানের) আওয়াজ ও অর্থ এই দুই পা-কে লিপিতে ধরে রাখা যাবে কীভাবে? নিজ নিজ ভাষার শব্দকে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আদিম মানবজাতিগুলি এই সমস্যায় পড়েছিল। আমাদের অনুসন্ধান জানায়, এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে প্রাচীন মানবজাতির ভাষাগুলি প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ইংরেজী প্রভৃতি পাশ্চাত্যের ভাষাগোষ্ঠিগুলি যে লিপিতে লিখতে শুরু করে, তা আওয়াজ (উচ্চারণ) ধরে রাখতে সক্ষম হয়, কিন্তু অর্থ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। লিখিত শব্দের অর্থটিকে তাঁদের বুঝে নিতে হয় আরোপিত প্রথারূপে, যার সঙ্গে লিপিবাহিত উচ্চারণের নাকি সম্পর্ক নাই। ফলত আজও লিখিত ইংরেজী ভাষাকে কাজ চালাতে হয় এমন একরকম খঞ্জ লিপি নিয়ে, যার একটি পা আস্ত থাকলেও অন্য পা-টি নেই, তার বদলে আছে বৈশাখী (ক্রাচ)। এই ধরনের নানান লিপিকে পাশ্চাত্যের ভাষাবিদগণ সংজ্ঞায়িত করেন phonetic script ব’লে।

চীনাগোষ্ঠীর ভাষাগুলি আবার এমন লিপিতে লিখতে শুরু করে, যা অর্থ (idea) ধরে রাখতে সমর্থ হয়, কিন্তু আওয়াজ ধরে রাখতে পারে না। ফল হয় এই যে, চীনের এক প্রদেশের মানুষ অন্য কোনো প্রদেশের মানুষকে চিঠিপত্র লিখে পাঠালে, পত্রপ্রাপক বার্ত্তাটি বুঝে নিতে পারে বটে; কিন্তু পত্রপ্রেরক যদি তার চিঠিতে লেখা সেই বাক্যগুলি উচ্চারণ করে প্রাপককে বলতে শুরু করে, সে তার কিছুই বুঝতে পারে না। প্রাপক উচ্চারণ করে চিঠিটি পড়লে প্রেরকেরও একই দশা হয়। তার মানে, চিঠির লিপি অর্থ বহন করে নিয়ে যেতে সক্ষম, কিন্তু আওয়াজ বহন করে না। সেই কারণে চীনা লিপিকে ideographic script ব’লে চিহ্ণিত করা হয়েছে। তার মানে, ইংরেজী প্রভৃতি লিপিগুলির যদি বাঁ পা খোঁড়া হয়, তো চীনা লিপির ডান পা খোঁড়া।

এদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃত বাংলা প্রভৃতি ভাষাগুলি যে লিপির ব্যবহার শুরু করে, তা একই সঙ্গে শব্দের আওয়াজ ও অর্থকে ধরে রাখতে সমর্থ হয়। হয় বলেই লিখিত ‘পদ’ যেমন আমরা উচ্চারণ করতে পারি, তেমনি তার ভিতরের ‘পালন দান করে যে’ অর্থটিও বুঝতে পারি। সেই অর্থকেই ‘পদ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বা ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ বলে। তদ্রূপ অর্থ ধারণ করে বলেই শব্দটি পদাঘাতের পদ, পদাধিকারীর পদ, পদোন্নতির পদ, পদচ্যুতির পদ, গানের পদ, ভোজনের পদ, বাক্যের পদ, ধর্ম্মের পদ …ইত্যাদি যে কোনো প্রকার পদকে বোঝাতে পারে। তবে তার কোন অর্থটি বোঝা হবে, তা ঠিক হয়, বাক্যের প্রেক্ষাপট অনুসারে। সুতরাং, বাংলাভাষায় যখন আপনি কোনো শব্দকে লিপিবদ্ধ করতে যাচ্ছেন, আপনাকে মনে রাখতে হবে, আপনি শব্দটির আওয়াজ ও অর্থ দুটিকেই লিখছেন। কেননা, আমাদের লিপির দ্বৈতাদ্বৈত (two in one) চরিত্র কমবেশী অক্ষুণ্ণ আছে,দুটো পা-ই রয়েছে,আজও। পাশ্চাত্যের ভাষাবিদগণ এবং তাঁদের শিক্ষায় অত্যন্ত প্রভাবিত ভারতবর্ষীয় ভাষাবিদগণ আমাদের লিপির এই স্বভাবকে বুঝতেই পারলেন না। পারতেন, যদি না তাঁদের অর্থবহনের দায়িত্বহীন phonetic script -এর তত্ত্বে তাঁরা সম্পূর্ণ নিমগ্ন (conditioned) থাকতেন।

যাই হোক, প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করে আজ আমরা দুজন আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা প্রভৃতি লিপিকে আখ্যাত করছি phonetic-cum-ideographic script বা phono-ideographic script ব’লে। এর পরও আপনি বলতে পারেন, উচ্চারণকে ধারণ করাই যদি ইংরেজী লিপির যোগ্যতা হয়, তবে gnat, know, knife প্রভৃতি লিখিত ইংরেজী শব্দ তাদের উচ্চারণকে যথাযথ ভাবে ধারণ করে না কেন? করে না কারণ, ইংরেজী শব্দেও যে এককালে অর্থ নিহিত থাকত, ঐ ধরনের লিখিত শব্দগুলি তারই রেশ টেনে নিয়ে চলেছে আজও। তার মানে, আমরা যে বাংলাভাষায় কথা বলি, তার আদি রূপ ও ইংরেজী ভাষার আদি রূপ যে একই ছিল, এই ধরনের ইংরেজী শব্দগুলি তারই স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। আমাদের ‘জ্ঞ’ (জ্ + ঞ) ও ইংরেজীর know (gnow) তার স্পষ্ট উদাহরণ।

যাই হোক, আমরা যদি লিপিবাহিত আওয়াজ ও অর্থকে যথাক্রমে লিপির দেহ ও মন বলি, তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইংরেজী লিপির দেহ আছে মন নেই, চীনা লিপির মন আছে দেহ নেই, আর বাংলা লিপির দেহ-মন দুই-ই আছে। বাংলা শব্দ লিখবার সময় কথাটি ভোলা চলবে না।

২.২ : শব্দ

(‘শব দান করে যে’ বা ‘মনোভাবের শব দান করে যে’ কিংবা ‘ঘটনা বা ক্রিয়া অতীত হইলেও তাহার যে মৃতদেহ আওয়াজ রূপে চাউর হইয়া থাকে’)।

ইংরেজীতে যাকে word বলে, বাংলায় তাকে শব্দ বললে শব্দের অর্থকে সঙ্কুচিত করে ফেলা হয়। কেননা, বাংলায় মানুষের মুখনিঃসৃত ভাষিক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে যেমন শব্দ বলে, বাহ্য-জগতের যে কোনো আওয়াজকেও (sound-কেও) শব্দ বলে। বাংলায় ভাষিক শব্দের ভিতরে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ (meaning) ও অর্থপূর্ণ ধ্বনি (meaningful sound) বা উচ্চারণ উভয়ই থাকে, বাহ্যিক শব্দের ভিতরেও আওয়াজের (sound-এর) উৎসস্থলের ঘটে যাওয়া (মেঝেতে চামচ পড়ার মতো) ঘটনার বা ক্রিয়ার সংবাদও (অর্থও) থাকে। বাংলায় ‘শব্দ’ বাক্যের অংশ নয়, বাক্যের অংশ হল ‘সক্রিয়-শব্দ’ যাকে ‘পদ’ বলা হয়। ইংরেজীর word–এর ভিতরের বর্ণগুলি বিশেষ আওয়াজ (sound) ধরে রাখে বটে, কিন্তু কোনো প্রকার অর্থ (meaning) আবশ্যিকভাবে ধারণ করে না বলেই পাশ্চাত্যের ভাষাতাত্ত্বিকগণ ঘোষণা করে রেখেছেন। যখন কিনা বাংলা ভাষার প্রতিটি শব্দই উচ্চারণের পাশাপাশি আপন গর্ভে তার অর্থ ধারণ করে রাখে। সেকারণে লিখিত বাংলাভাষার শব্দ মাত্রেই অর্থধারী আওয়াজের লিপিবদ্ধ রূপই বটে। সুতরাং বাংলাভাষায় শব্দকে লিপিবদ্ধ করতে গেলে, তার অর্থ ও আওয়াজ দুইই যেন লিখিত শব্দটির ভিতরে থাকে, সে কথা মনে রাখতে হবে।

২.৩ : পদ

(‘পালন বা প্রাপণ দান করে যে’, বা ‘যাহা দ্বারা জীব মানুষ সংস্থা সমাজ বাক্য গান ভোজন মূলধন… প্রভৃতি এক বা একাধিক পদীগণ হাঁটে’)।

বাক্যে ব্যবহৃত শব্দকে পদ বলে। তার মানে, সক্রিয়-শব্দকে পদ বলা হয়। কেননা, মানুষ যার উপর নির্ভর করে হাঁটে, তাকে যেমন তার পদ বা পা বলে, তেমনি বাংলার বাক্য তার যে অংশগুলির উপর নির্ভর করে হাঁটে সেগুলিকে সেই বাক্যের পদ বা পা বলে। ইংরেজীতে একে part of speech বলা হয়। প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে দুটি তো আসলে একই কথা। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বাংলার লিখিত বাক্যের পদ যেন একটি মনপ্রাণবান জীবন্ত মানবদেহের প্রত্যঙ্গগুলি। তার প্রতিটি প্রত্যঙ্গই সমগ্র বাক্যশরীরের সঙ্গে বাস্তবিক ও মানসিক ভাবে যুক্ত, পৃথক করে নিলে প্রত্যঙ্গটির বা পদের অর্থ ক্ষুণ্ণ হয়ে যায়। বাংলায় বাক্য গঠনকালে প্রতিটি শব্দকে সক্রিয় সজীব করে নিতে হয়। যেমন, ‘আমি’ ‘বিদ্যালয়’ ‘যা’ এই তিনটি শব্দকে বাক্যে পরিণত করতে গেলে বিভক্তি-প্রত্যয়াদি যুক্ত হয়ে শব্দগুলি হয়ে যায় ‘আমি বিদ্যালয়ে যাই’। ‘বিদ্যালয়’তে এ-বিভক্তি, যা-এ ই-বিভক্তি এবং এমনকি ‘আমি’তে শূন্য-বিভক্তি জুড়ে তাদের একত্র করে একটি দেহমনসম্পন্ন বাক্যে পরিণত করা হয়েছে।

কিন্তু ইংরেজী ভাষায় বাক্য গঠনকালে প্রতিটি শব্দকে সক্রিয় সজীব করার উপায় নাই। তাতে বিভিন্ন নিষ্ক্রিয় শব্দকে আংটা বা নাটবল্টু দিয়ে জুড়ে নিয়ে একটি রোবোটের ন্যায় দেহসম্বল বাক্য বানানো হয়, যে বাক্যদেহটি সচল হয় বাইরের কারও নির্দ্দেশে। ইংরেজী বাক্যের I, school, go এই শব্দগুলিকে অদলবদল করে জুড়ে নিয়ে বানানো হয় ‘I go to school’। যেন তিনটি নিষ্ক্রিয় মরা প্রত্যঙ্গকে to নামক আংটা দিয়ে জুড়ে নেওয়া হল। তার মানে বাংলা ভাষায় বাক্য গঠন কালে শব্দের পাশে শব্দ গাঁথার প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ও প্রাণবন্ত; যান্ত্রিকতা যেটুকু দেখা যায়, তা আধুনিকতার দূষণ। আর, ইংরেজী ভাষার বাক্য গঠন কালে শব্দের পাশে শব্দ গাঁথার প্রক্রিয়াটি যান্ত্রিক, সজীবতা যেটুকু দেখা যায়, তা প্রাচীন উত্তরাধিকারের রেশ। বাংলার লিখিত বাক্যের পদ সজীব সপ্রাণ দেহমনধারী বাক্যের জীবন্ত অংশ। আর ইংরেজীর লিখিত বাক্যের part of speech হল মনপ্রাণহীন রোবোটের বিচ্ছিন্ন হাত পা মাথা ইত্যাদি। লিপিবদ্ধ করার সময় বাংলা ও ইংরেজী বাক্যের অংশগুলির এই পার্থক্য মনে রাখতে হবে।

২.৪ : অর্থ

(‘অর বা পুনরাবর্ত্তন থাকে যাহাতে বা যে বিকল্পে’, কিংবা ‘সামাজিক মানুষ যে পুনরাবৃত্তি-যোগ্য জ্ঞানধন লাভের চেষ্টা করিয়া থাকে’)।

বাংলাভাষায় লিখিত শব্দের ভিতরে তার অর্থ থাকে। সেই অর্থকে সেকালে ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বা অভিধার্থ বলা হত, আমরা তাকে একালিকরণ করে তার নাম দিয়েছি ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক (ধ্বনিভিত্তিক) অর্থ। দেহের ভিতরে প্রাণ-মন-আত্মা থাকার মতো শব্দের ভিতরে নিহিত থাকে বলে, একে আপনি শব্দের নিহিতার্থও বলতে পারেন। এই অর্থের সঙ্গে স্বভাবতই শব্দের দৈহিক সম্পর্ক বর্ত্তমান থাকে। এই অভিধার্থের উপর নির্ভর করেই তার লক্ষণার্থ ও ব্যঞ্জনার্থগুলি সক্রিয় হয়ে থাকে। সেকারণে বাংলাভাষার শব্দ বা পদকে লিপিবদ্ধ করার সময় তার অভিধার্থকেই শব্দের অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হয়ে থাকে, লক্ষণার্থ বা ব্যঞ্জনার্থকে নয়।

ওদিকে ইংরেজী ভাষার লিখিত শব্দের ভিতরে সেরকম কোনো meaning থাকে না, আরোপিত প্রথারূপী অর্থকে বা arbitrary meaning-কে বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। সেই প্রথারূপী আরবিট্রারী অর্থের উপর নির্ভর করে বিকশিত হয় তার metonymy, metaphor, contextual meaning প্রভৃতি যা আসলে বাংলাভাষার লক্ষণার্থ ও ব্যঞ্জনার্থেরই অধঃপতিত রূপ। তাই বাংলাভাষার বাক্য বা শব্দ যখন লিপিবদ্ধ করা হয়, তার বানানের ভিতরে অবশ্য অবশ্যই শব্দের অভিধার্থটিকে নিষেক করে রাখা হয়, রাখতে হয়, রাখতে হবে। লিখিত বাংলাভাষায় এই রীতি বহু প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে।৬

২.৫ : ধ্বনি

(‘ধারণ-বহন সক্রিয় যাহাতে’, অথবা ‘যাহা কোনো এক প্রকার ধারণা বা অর্থ বহনকারী আওয়াজ রূপে উচ্চারিত হইতেছে’)।

ধ্বনি শব্দটির অভিধার্থ হল, ‘ধারণা বহনকারী আওয়াজকে বোঝায়। অর্থাৎ, বাংলাভাষার ধ্বনি হল এমন এক আওয়াজ-ধারী বা উচ্চারণ-বাহী একক সত্তা যা ধারণা (অর্থ) বহনের কাজে সক্রিয় রয়েছে। সেখানে ইংরেজী ভাষায় রয়েছে phoneme। সে হল উচ্চারণের এমন একক যার কাঁধে অর্থের বোঝা নাই, কিন্তু আওয়াজের বোঝা রয়েছে। তার মানে, বাংলাভাষার ধ্বনি যদি কাঁধে বোঝা নিয়ে চলা মুটে হয়, ইংরেজী ভাষা phoneme সেখানে মুটে মাত্র, যাঁর কাঁধে কোন অর্থের বোঝা নেই মনে করা হয়। আধুনিক ভাষাবিদগণই এ’রকম অযৌক্তিক সিন্ধান্ত করে রেখেছেন। সুতরাং বাংলার ধ্বনি আর ইংরেজীর phoneme আদৌ এক ব্যাপার নয়।

২.৬ : বর্ণ

(‘ক্রিয়ার আধার রূপে স্বভাবত বরেণ্য যে’)।

বাংলাভাষায় রয়েছে ৪৩টি মাতৃকা বর্ণ। তাদের প্রত্যেকের সুনির্দ্দিষ্ট বহুরৈখিক অর্থ আছে। সেই ৪৩টি বর্ণে গড়ে উঠেছে (দাশবংশ, ঘোষবংশ ইত্যাদির মতো) ক-বংশ, খ-বংশ প্রভৃতি ৪৩টি শব্দবংশ। এ’রূপ প্রত্যেকটি শব্দবংশ থেকে জাত হয়েছে অজস্র শব্দ-পরিবার; প্রত্যেকটি পরিবারের আবার রয়েছে দুশো-পাঁচশো শব্দ-সদস্য। এইভাবে ৪৩টি শব্দবংশ থেকেই বাংলাভাষার বিপুল শব্দসম্ভার সৃষ্টি হয়েছে। মনে রাখা দরকার, শব্দ-পরিবারের শব্দ-সদস্যরা প্রত্যেকেই উচ্চারণ-বান ও অর্থবান এবং তাদের মধ্য থেকেই অনেককে বাক্যের কর্ম্মীরূপে খাটার জন্য ডেকে কাজে লাগানো হয়। তখন তাদেরকেই পদ বলে। ইংরেজী ভাষার letter-এর সে গৌরব নাই। অর্থ তো letter-দের নেই-ই, শুধুমাত্র a আর i-এর অর্থ ছাড়া; আছে শুধুই উচ্চারিত হওয়ার যোগ্যতা। ইংরেজীর সেই অর্থহীন উচ্চারণ-সম্বল letter-এর সংখ্যা মাত্র ২৬টি। ত-বর্ণটি তার নাই বললেই চলে। তাছাড়া ইংরেজীর শব্দবংশ, শব্দ-পরিবার, শব্দ-সদস্য স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে অস্পষ্টভাবে থাকলেও ইংরেজী ভাষাবিদগণ তাদের উদ্ধার করে সংস্কার করে একালিকরণ করতে পারেন নি আজও। সংস্কৃতকারগণের অর্জ্জিত শব্দার্থতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিক প্রযুক্তির সহায়তায় ও বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় বাংলাভাষার বর্ণমালাকে এমন সুবিন্যস্ত করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যার সঙ্গে কেবল মেণ্ডেলিয়েভ টেবিলেরই তুলনা করা যায়। আদিম বাংলাভাষায় (সংস্কৃতভাষায়) তখনও পর্য্যন্ত ছ-ঝ-ঠ-ঢ-থ প্রভৃতি মাতৃকাবর্ণে বলতে গেলে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র শব্দ সৃষ্টি হয়ে ঘর ছেড়ে রেখে যাওয়া হয়। বাংলার প্রাচীন ভাষাবিদগণ জানতেন, ঐ ঘরের শব্দগুলি জন্মাবে পরে। যে কোনো বাংলা অভিধান দেখলেই বোঝা সম্ভব, ঐ বর্ণগুলিতে কী পরিমাণে কত নতুন নতুন শব্দ পরবর্ত্তী কালে জন্মলাভ করেছে।

বাংলাভাষার উপরোক্ত ৪৩টি বর্ণেরই আওয়াজ ও অর্থ দুই-ই আছে। কিন্তু মানবমনের গভীরে এক রহস্যময় প্রক্রিয়ায় ঐ আওয়াজ ও অর্থ প্রস্তুত হয় বলেই তাদের উদ্ধার করা কঠিন। এর কারণ হল, একক ধ্বনি বা বর্ণকে নিয়ে মানবমনের গভীরে যে অর্থময় ধ্বনির বিবর্ত্তন (meaningful-phonemic evolution) চলে, উপরিতলে মানবের মুখের উচ্চারিত ভাষায় তাকে প্রকাশ করা সহজ কাজ নয়। যেমন ঐ ‘চালক’, ‘পালক’ প্রভৃতি শব্দের ক্ষেত্রে ‘ক’-বর্ণের অর্থটি খুবই স্পষ্ট ও প্রকট। অনেকে জানেন ঐ ‘ক’-এর অর্থ হল ‘করে যে’। কিন্তু বর্ণমালার অধিকাংশ বর্ণের বাহিত অর্থ অত স্পষ্ট ও প্রকট নয়; কারও কারও অর্থ অস্পষ্ট, কারও বা খুবই অস্পষ্ট ও রহস্যময়। সেরকম বর্ণগুলির (ধ্বনিগুলির) অর্থ অনুভব করা গেলেও ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কিন্তু করা যায়, করতে হয়, করতে হয়েছে, একেবারে নিখুঁতভাবে না হলেও,। দুই খণ্ডে ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ ও অখণ্ড ‘সরল শব্দার্থকোষ’ রচনার মাধ্যমে আমরা দুজন তা সাধ্যমতো করে দিয়েছি।

তা সে যাই হোক, আজ আমরা নিঃসন্দেহ যে, অ থেকে হ পর্য্যন্ত বর্ণমালার প্রত্যেকটি বর্ণের অর্থ আছে; সেজন্যেই তাদের নিয়ে গড়ে ওঠা শব্দেরও অর্থ আছে এবং সেই অর্থের প্রচলনও আছে। শুধুমাত্র তাই নয়, তার ঐতিহাসিক সত্যতা যেমন রয়েছে, তেমনি নিত্যতাও বর্ত্তমান রয়েছে। নিত্যতা আছে বলেই বাংলার মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষেরা আজও আওয়াজ ও অর্থবান নব নব শব্দ সৃষ্টি করে চলেছেন। ‘টপকা ঝোল’, ‘পুঁচকে ঝলক’, ‘পাগুলু’ প্রভৃতি তার টাটকা উদাহরণ। ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে সেই নব নব শব্দগুলিকে সংস্কার করে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল, আমাদের পূর্ব্বসুরিগণ আমাদের শব্দসম্ভার নিয়ে যে কাজ করে রেখে গিয়েছিলেন, নানান কারণে যার উপর শ্যাওলা জমে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল, সেগুলিকেও উদ্ধার করা ও একালিকরণ করা। আমাদের দুজনের লেখা শব্দার্থকোষগুলিতে আমরা তা সাধ্যমতো করেছি। একেবারে নিখুঁতভাবে ও সম্পূর্ণভাবে করে ফেলেছি, এমন দাবী আমরা করি না। শব্দতত্ত্ববিদগণ অনেকে মিলে হাত লাগালে তবেই কাজটি সম্পূর্ণ ও নিখুঁত হতে পারে।

এখন তাহলে বাংলাভাষার মাতৃকাবর্ণগুলির অর্থ যেরূপ পাওয়া গেছে, সেগুলি উপস্থাপন করা দরকার। কেননা, বানান সংস্কার করার জন্য ঐ অর্থগুলি লাগবে। নিম্নে বানান ও spelling-এর তুলনামূলক আলোচনা করে তার পরই আমরা সেই অর্থ সরবরাহ করে তার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করব।

২.৭ : বানান

(‘শব্দ বানাকরণ বা নির্ম্মাণ চলমান যাহাতে’, অথবা, ‘নিয়মানুসারে বর্ণের সহিত বর্ণ যোগ করিয়া শব্দ বানানো বা নির্ম্মাণকরণ করা চলমান যাহাতে’)।

বাংলায় যাকে বানান বলা হয়, ইংরেজীতে তাকে spelling বলা হয়ে থাকে। বাংলায় ‘বানান’ মানে হল, যে এক বা একাধিক বর্ণের ইট দিয়ে একটি শব্দ বানানো হয়, সেই ইঁটগুলির কথা বলা। ইংরেজীতে spelling মানে হল, শব্দ ভাঙলে যে বর্ণের ইঁট বা ইঁটগুলি পাওয়া যায়, যেন সেই ইঁটগুলির কথা বলা। একই কথা হলেও বাংলায় বলা হয় শব্দ গড়তে কী কী লাগছে তার কথা,যখন কিনা ভাঙলে কী কী পাওয়া যাবে, ইংরেজীতে তার কথা বলা হচ্ছে। দৃষ্টিভঙ্গীটাই আলাদা। তার ওপর, ইংরেজীতে শব্দের spelling রূপে যা পাওয়া যায, তার উচ্চারণ আছে, অর্থ নাই। যখন কিনা, বাংলায় বানান রূপে যা পাওয়া যায, তার উচ্চারণ আছে, অর্থও আছে। পুরনো-পন্থী বাংলা ভাষাবিদগণ মনে করেন, বানান শব্দটি প্রাচীন বাংলার সংস্কারকৃত (সংস্কৃত) রূপের ‘বর্ণন’ শব্দ থেকে বিবর্ত্তিত হয়ে একালের বাংলায় এসেছে। অতএব সেটি লিখতে হবে ‘বাণান’ বানানে। নব্যপন্থীরা এর বিরোধী। তাঁরা ‘বানান’ বানানেই স্বস্তি বোধ করেন এবং সেরকমই লিখে থাকেন। অথচ তাঁদের হাতে ‘বানান’-এর পক্ষে তেমন যুক্তি নেই। আমরা কিন্তু বুঝেছি ‘বানান’ কথাটিকে ‘ণ’ দিয়ে লেখা ঠিক নয়। কেননা, বর্ণন শব্দটি যে অর্থ ধারণ করে, বাণান শব্দটি সে অর্থ ধারণ করে না ; তার অর্থ হল চলমান বাণ বা শর। বিপরীতে ‘বানান’ শব্দটি বর্ণন শব্দের উদ্দিষ্টকে গড়ে তোলার দিক থেকে সিদ্ধ করে। বাংলায় বন, বনিবনা, বানিয়ে তোলা, বানানো প্রভৃতি শব্দ যে নিয়মে সৃজিত হয়েছে, বানান শব্দটি সেই নিয়মেই সৃজিত হয়েছে। ‘যাহা দ্বারা শব্দকে বানিয়ে তোলা বা বানানো হয়’ তাকেই বানান বলে। অতএব এইরকম বানানই যুক্তিযুক্ত।

উপরে বাংলা বানান সমস্যা সমাধানের যে নিয়মটির কথা আমরা বলেছি,এখন তাহলে সেটি পুনরায় স্মরণ করা যাক –

“যে বর্ণ বা বর্ণসমবায় দিয়ে কোনো শব্দ (গঠিত) লিখিত হয়, সেই বর্ণের বা বর্ণসমবায়ের অর্থ ও শব্দটির অভিধা-অর্থ অভিন্ন হয়”।

এই সূত্রানুসারে বাংলাভাষিগণ কোনো একটি বিষয়কে বোঝাতে যে শব্দ মুখে উচ্চারণ করে বলেন, সেই শব্দটি লিপিবদ্ধ করতে হলে দেখতে হবে, লিখিত রূপে শব্দটির সেই উচ্চারিত ও কথিত অভিধার্থ ঠিকঠাক থাকছে কি না। অবশ্য আমরা বঙ্গবাসী বঙ্গভাষিরা স্বভাবতই দেহমনবাদী বা দ্বৈতাদ্বৈত-(two in one)-বাদী হলেও মনের উপরই আমাদের বেশী টান। অপমানকর মণ্ডা-মিঠাই-ভূরি-ভোজের চেয়ে পান্তাভাত খেয়ে থাকাই আমরা শ্রেয় বিবেচনা করে থাকি। সুতরাং শব্দের বানান থেকে শব্দটির উচ্চারণ মোটামুটি ঠিক বা কাছাকাছি আওয়াজে বেরিয়ে এলেই আমরা সন্তুষ্ট হয়ে যাই, কিন্তু অর্থের কোনো বদলে আমাদের মন সায় দেয় না। সুতরাং শব্দের ভিতরের বর্ণগুলির প্রত্যেকটির অর্থ জানতে হবে। তার জন্য, আমাদের বর্ণমালায় থাকা সকল মাতৃকাবর্ণের অর্থ জানতে হবে। জানতে হবে তার প্রয়োগকৌশল। সেই অর্থ সাধ্যমতো উদ্ধার করে এবং প্রয়োগকৌশল দেখিয়ে আমরা দুজন আমাদের দুইখানি ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থকোষ লিখেছি। এখন তাহলে সবার আগে সেই অর্থগুলিই জেনে নেওয়া যাক।

অ = অস্তিত্বন, আ = অস্তিত্ব, ই = সক্রিয়ন, ঈ = সক্রিয়, উ = উত্তীর্ণন (নবরূপে), ঊ = উত্তীর্ণ (নবরূপে), ঋ = আবর্ত্তন (আবর্ত্ত), এ = দিশাগ্রস্তন, ঐ = দিশাগ্রস্ত, ও = অস্তিত্বাদিকরণ, ঔ = অস্তিত্বাদিকর, ক্ = করণ (ক = কারী), খ্ = করণথিতি (খ = করণথিত), গ্ = গমন (গ = গামী), ঘ্ = গমনথিতি (ঘ = গমনথিত), ঙ = কারীরহস্য, চ্ = চয়ন (চ = চয়নকারী-চায়ী), ছ্ = চয়নথিতি-ছাদন (ছ = চয়নথিত-চয়নিত-ছাদিত), জ্ = জনন (জ = জাত), ঝ্ = জননথিতি (ঝ = জননথিত), ঞ = চায়ীরহস্য, ট্ = টঙ্কারণ (ট = টঙ্কারী), ঠ্ = টঙ্কারথিতি (ঠ = টঙ্কারথিত), ড্-ড়্ = গড়ান-উড়ান (ড-ড় = গড়ায়িত-উড্ডীত), ঢ্-ঢ়্ = গড়ান-উড়ান-থিতি (ঢ-ঢ়=গড়ান-উড়ানথিত) , ণ্ = টঙ্কার-রহস্যন (ণ = টঙ্কার-রহস্য), ত্ = তারণ (ত = তারী), ত=তারণথিতি, (থ=তারণথিত), দ্ = দানন (দ = দাতা), ধ্ = ধারণ (ধ = ধারী), ন্ = নাকরণ-অনকরণ (ন = নাকৃত-অনকৃত), প্ = পালন-পান-প্রাপণ (প = পালক-পায়ী-প্রাপক), ফ্ = পালনাদিস্থিতি, (ফ = পালনাদিথিত), ব্ = বর্দ্ধন-বহন (ব = বর্দ্ধক-বাহক), ভ্ = বর্দ্ধনথিতি-ভরণ-ভক্ষণ (ভ = বর্দ্ধনথিত-ভরক-ভক্ষক), ম্ = সীমায়ন (ম = সীমায়িত), য্ = যাওয়ন (যাওয়া) (য = যায়ী), র্ = রহন-ভক্ষণ-রক্ষণ (র = রহক-ভক্ষক-রক্ষক), ল্ = লালন-লোপন (ল = লালক-লোপক), শ = শক্তিযোজন (শ = শক্তিযোজক), ষ্ = দিশাগ্রস্ত শক্তিযোজন (ষ = দিশাগ্রস্ত শক্তিযোজক), স্ = একরৈখিক শক্তিযোজন (স = একরৈখিক শক্তিযোজক, সত্তামাত্র), হ্ = হওয়ন (হ = ভূত, হ-ইত)।

এবার তাহলে ‘তীর’ বা ‘ত্ ী র্ অ’ বর্ণ-সমবায়টির দ্বারা ধরে রাখা আওয়াজ ও অর্থটিকে নিষ্কাশন করে নেওয়া যেতে পারে। মুখের উচ্চারণের সঙ্গে লিখিত ‘তীর’ শব্দের দ্বারা ধরে রাখা আওয়াজের খুব একটা ফারাক হয় না, হলেও বাংলাভাষা তা মানিয়ে নেয়। কিন্তু অর্থের ক্ষেত্রে বাংলাভাষা নড়চড় করতে চায় না। লিখিত ‘তীর’ শব্দের অর্থের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ত্ = তারণ, ী = সক্রিয়, র্ = রক্ষণ, অ = অস্তিত্বন। এর যোগফলই থাকতে হবে ‘তীর’ শব্দের ভিতরে। প্রাথমিক ভাবে সেই যোগফল হল – ‘তারণ রূপ ক্রিয়া সক্রিয় রহে যে অস্তিত্বে বা আধারে’। এই বাক্যের অর্থকে সুস্পষ্ট মনে হয় না। এরকম মনে হওয়ার কারণ হল, মনের সুগভীর অবস্থান থেকে বর্ণের অর্থ নিষ্কাশন করলেই হয় না, তাকে মনের দ্বিতীয় তৃতীয় স্তর পেরিয়ে মুখের কথার চতুর্থ স্তরের বোধ্য ভাষায় প্রকাশ করতে হয় এবং সেই উদ্দেশ্যে বর্ণ-সমবায়ের অর্থের যোগফলকে যথাযথভাবে উদ্ধার করা ও ভাষায় প্রকাশ করার জন্য শব্দের ব্যুৎপত্তিগত (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক) অর্থ নিষ্কাশনের বিদ্যাটি আয়ত্ত করতে হয়। তার জন্য অমরকোষ থেকে হরিচরণ পর্যন্ত অনেকের কাছেই দীর্ঘকাল শিক্ষানবিশী করতে হয়। সাধারণ পাঠক সে কাজ অবশ্যই করতে যাবেন না, যাবেন তাঁরাই যাঁরা বানান অভিধান লিখবেন অথবা অভিধান প্রদত্ত অর্থকে বিচার করতে বসবেন।

এক্ষেত্রে সাধারণ পাঠকের জন্য যতদূর সম্ভব সহজ করে আমরা ‘তীর’ শব্দটির অন্তর্নিহিত অর্থটি নিষ্কাশন করে প্রকাশ করে দিচ্ছি।

ক্ষীণ (তির তির করে বহমান) জলধারা বোঝাতে ‘তির’ এবং কূল বা নদীর পাড় বোঝাতে কিংবা শর বোঝাতে ‘তীর’ শব্দটির কথা শিক্ষিত বাংলাভাষী মাত্রেই জানেন। ভিন্নার্থক ‘তির’ ও ‘তীর’ শব্দের এইরূপ ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। একালের অ্যাকাডেমিক ভাষাবিদগণ বলবেন, শব্দ দুটির এইরূপ বানান বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের উত্তরাধিকার। কেউ বা বলবেন, শরবাচক ‘তীর’ শব্দটি ফারসী ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে (৭)। আমাদের অর্জ্জিৄত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব বাংলা শব্দের ঐরূপ ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ খুঁজে পায়নি। তাই আমরা দুটি শব্দকেই বাংলাভাষার নিজস্ব শব্দভাণ্ডারের বাংলা শব্দ বলেই মনে করি।

এখন আমাদের জানা দরকার, তির তির ধারা বোঝাতে যে ‘তির’ তাতে হ্রস্ব-ই কেন, নদীর পাড় প্রভৃতি বোঝাতে যে ‘তীর’, তাতে দীর্ঘ-ঈ কেন? এই কেনর উত্তর পাওয়া যায় শব্দ দুটির অন্তর্নিহিত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থে। ‘তির’ শব্দের ভিতরে রয়েছে ‘ত্ ি র্ অ’ এই চারটি বর্ণ। এরা প্রত্যেকে একটি করে মোট চারটি ক্রিয়ামূলক অর্থ ধারণ করে। (ত-এর) তারণের (ি) সক্রিয়তা (র্) রহে (অ) যে অস্তিত্বে। অন্য দিকে ‘তীর’ শব্দের ভিতরে রয়েছে ‘ত্ ী র্ অ’ এই চারটি বর্ণ। পার্থক্য শুধু দীর্ঘ-ঈ-তে। ফলে মানে দাঁড়ায় – তারণ (ী) সক্রিয় রহে যাহাতে। দেখা যাচ্ছে, তারণের সক্রিয়তাকে ধরে রাখে যে, সে হল তির (তির তির ধারা)। আর, তারণ সক্রিয় রহে যে আধারে তাকে বলে তীর। এই পার্থক্য থেকে স্বভাবতই তির-এর মানে হয়ে যায় তির তির ধারা, এবং তীর-এর মানে হয়ে যায় সেই তির তির ধারাকে ধারণকারী আধাররূপী তার দুই কূল বা পাড়। শরের বেলাতেও কথাটি এই জন্য খাটে যে, তিরতিরিয়ে ছুটে চলা শরের গতিকে তার অভিমুখে ধরে রাখে তার পেছনের অংশে থাকা দুই দিকে প্রসারিত পালক। যে শরে এরূপ পালক থাকে না, তাকে তীর বলা যায় না। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ‘তির’ যখন একমুখী গতিময় কোনো বস্তু, ‘তীর’ তখন তার আধার। তার মানে, হ্রস্ব-ই যদি কোনো বস্তুর গতিময়তা বা সক্রিয়তাকে বোঝায়, দীর্ঘ-ঈ তখন সেই হ্রস্ব-’ই’-এর আধারকে বোঝায়। ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধিতে সেকারণে হ্রস্ব-’ই’-এর অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘সক্রিয়ন’ এবং দীর্ঘ-’ঈ’-র অর্থ দেওয়া হয়েছে, সক্রিয়নের আধার বা সক্রিয়। এ কেবল তির ও তীর শব্দের ক্ষেত্রেই হয়, এমন নয়। বাংলাভাষার যে সমস্ত (কিরণ, কীর্ণ, করি, করী প্রভৃতি) শব্দে হ্রস্ব-ই দীর্ঘ-ঈ রয়েছে, সেই সমস্ত শব্দের ক্ষেত্রেই হ্রস্ব-ই দীর্ঘ-ঈ-র উপর্যুক্ত (সক্রিয়তা, সক্রিয়) অর্থই হয়। আমরা দুইখানি শব্দার্থকোষ রচনাকালে অজস্র শব্দে প্রতিটি বর্ণের একই অর্থ থাকার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি।

যাই হোক, হ্রস্ব-ই দীর্ঘ-ঈ-র এই পৃথক অর্থ জানা থাকলে তির ও তীর দুটি শব্দকেই একই ‘তির’ বানানে লেখা সম্ভব নয়। লিখলে, ‘তির’ শব্দটি ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ হয়ে যায়। ফলত, বাংলাভাষার শব্দার্থবোধ বিপর্য্যস্ত হয়ে পড়ে। এরকম চললে অচিরে আমাদের ভাষাসম্পদ থেকে তীর, তীর্থ, তীর্থঙ্কর, তীরন্দাজ প্রভৃতি এই গোত্রের বহু শব্দ ও তাদের অর্থকে আমরা হারিয়ে ফেলব এবং ক্রমে সাংস্কৃতিক ভিখারী হয়ে যাব। বানান বিতর্কের মূলে রয়েছে এই সমস্যা এবং অতএব এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে বাংলা শব্দকে তার অন্তর্নিহিত অর্থের ধারক বর্ণের সাহায্যেই লিখতে হবে। পাঠক সমজাতীয় দুটি শব্দ নিয়ে নিজেও চেষ্টা করে দেখতে পারেন। সে দুটি হল কুল কুল ধারা ও তার ধারক কূল বা নদীর পাড়।

যে সকল শব্দের বানান নিয়ে ‘বানান বিতর্ক’-এ অংশগ্রহণকারিগণ নানারকম তর্ক করে গেছেন, আমাদের উপরোক্ত বানান সংস্কার সূত্রের সাহায্যে এবার আমরা সরাসরি সেই বানানগুলির সমাধান করার চেষ্টা করব। প্রায় সবাই যেটি মেনে নিয়েছেন, তা হল, তৎসম শব্দের বানান পূর্ব্বের মতোই রাখতে হবে। কারণ তৎসম শব্দ ও সংস্কৃত শব্দ আসলে একই শব্দ। সবাই জানেন, সংস্কৃত শব্দেরা ব্যুৎপত্তিগত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক) অর্থের নিয়ম মেনে চলে। তার মানে, বাংলাভাষার যে সকল শব্দকে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক নিয়ম দ্বারা বা বানান সংস্কার সূত্রের নিয়ম দ্বারা সংস্কার করা হয়ে গেছে, তাদের অভিধার্থ ও বর্ণসমবায়ের অর্থ অভিন্নই থাকে। সেকারণে ঐ শব্দগুলির বানান শব্দগুলির উচ্চারণ ও অভিধার্থকে যথানিয়মে ধারণ করে রাখে। সেই কারণে ঐ শব্দসমূহের বানান নিয়ে কোনো সমস্যা নাই।

তাই যদি হয়, বাংলা শব্দসমূহ তাহলে তো দু-ভাগে ভাগ হয়ে রয়েছে – যে শব্দগুলির সংস্কার সাধন করা হয়ে গেছে সংস্কৃারকৃত বা সংস্কৃত) এবং যে শব্দগুলির সংস্কার প্রয়োজন (অসংস্কারকৃত=অসংস্কৃত)। তার মানে, বানান-সমস্যার নিরীখে বাংলা শব্দের তৎসম তদ্ভব প্রাকৃত দেশজ প্রভৃতি বিভাজনের প্রয়োজন নেই। কেননা, তাদের দুটি মাত্র ভাগ – (ক) সংস্কারকৃত বাংলা শব্দ ও (খ) অসংস্কৃত বাংলা শব্দ। এই দুটি ভাগের মধ্যে দেখা যাচ্ছে সংস্কার-কৃত শব্দসমূহের কোনো বানান সমস্যা নাই। রইল বাকি অসংস্কৃত বাংলা শব্দসমূহ। সেই শব্দসমূহকে সংস্কার করে নিলে তাদের কোনো রকম বানান সমস্যা থাকবে না। তাহলেই বাংলা ভাষার বানানে কোনোরকম নৈরাজ্যও আর থাকবে না।

এখন প্রশ্ন হল, অসংস্কৃত বাংলা শব্দকে সংস্কার করা যাবে কেমন করে? উত্তর হল, সংস্কারকৃত শব্দগুলিকে যেভাবে সংস্কার করা হয়েছে, সেইভাবে। শব্দের ভিতরের ক্রিয়াপদ বিভক্তি প্রত্যয়াদি নির্ণয় করে তদনুযায়ী তার বর্ণবিন্যাস করে শব্দটির লিখিত রূপ দেওয়া, কিংবা, ক্রিয়াপদ না পাওয়া গেলে শব্দটির সম্ভাব্য বানানের অর্থের সঙ্গে শব্দটির অভিধার্থকে মিলিয়ে বর্ণবিন্যাস করে শব্দটির লিখিত রূপ দেওয়া। যেমন, কুম্ভীর, কুম্ভীল, কুম্ভীলক, এগুলো হল সংস্কারকৃত বাংলা শব্দ, অতএব তাদের বানান সিদ্ধ। কিন্তু ‘কুমির’ বা ‘কুমীর’ হল অসংস্কৃত বাংলা শব্দ। এই শব্দ দুটির ভিতরে কোনো ক্রিয়ামূলকে শনাক্ত করা যায় না, আমরা শনাক্ত করতে পারিনি। কিন্তু শব্দ দুটির বর্ণসমবায় (‘ক্ ু ম্ ি র্ অ’ কিংবা ‘ক্ ু ম্ ী র্ অ’) ধরে তাদের অর্থের যোগফলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায় কুমির বা কুমীর শব্দের অভিধার্থের সঙ্গে ঐ যোগফল সঞ্জাত অর্থটি মিলছে কি না। আমরা দেখেছি, ‘কুমীর’ বানানে লেখা শব্দটি সেই বিচারে উত্তীর্ণ হয়, কিন্তু ‘কুমির’ বানানে লেখা শব্দটি উত্তীর্ণ হতে পারে না।(দ্রষ্টব্য ‘সরল শব্দার্থকোষ’)।

এইভাবে ‘কুমীর’ শব্দটি সংস্কারকৃত বাংলা শব্দ রূপে বাংলা বানান অভিধানে স্থান পেতে পারে। এইভাবে পাখি, পাখী, শিষ, শীষ, শাড়ি, শাড়ী … প্রভৃতি সকল শব্দের সংস্কার করে ফেলা সম্ভব। (সেভাবেই হাঁদা ও হাঁদু শব্দ দুটি নিম্নে করে দেখানো হয়েছে)। একালের বাংলাভাষায় একাজ এখনও সেভাবে শুরু করা হয়নি। অনেক বড় কাজ। কিন্তু করতে হবে।তবেই বাংলাভাষা তার বানান নৈরাজ্য থেকে মুক্তি লাভ করবে। সবিনয়ে জানাই,আমরা দুজন আমাদের শব্দার্থকোষ দুখানির মাধ্যমে অসংস্কৃত বাংলা শব্দকে সংস্কার করে নেওয়ার সূচনা করেছি। আবারও সবিনয়ে বলি, একশো দুশো প্রখ্যাত ভাষাবিদ নয়, এ কাজ করেছি নানান সঙ্কটে ভোগা প্রান্তবাসী আমরা দুজন মাত্র এবং আমরা কাজটির সূচনা করেছি মাত্র। তাতে যে অজস্র ভুলত্রুটি ঘটেছে সে বিষয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। যেমন করে হোক, সূচনা করতে পেরেছি, এইটুকু মাত্র আমাদের সান্ত্বনা।

আমরা দেখলাম, হ্রস্ব-ই (ি)-কার ও দীর্ঘ-ঈ ( ী)-কারের অর্থ আলাদা এবং সেই বিচারে তির ও তীর দুটি আলাদা শব্দ, তাদের অর্থও আলাদা। একই ভাবে উ-কার থাকলে নবরূপে উত্তীর্ণন বোঝায়, ঊ-কার থাকলে সেই নবরূপে উত্তীর্ণনের আধার বোঝায়। স্বভাবতই কুলের আধারই কূল। এই কারণে চূণকে চুণ বা পূবকে পুব লিখলে অর্থের বিকার ঘটে। আমরা লক্ষ্য করেছি, খই দই বউ মউ প্রভৃতি শব্দকে এইরূপ বানানেই বানান সংস্কার সূত্র দ্বারা সিদ্ধ সংস্কারকৃত বাংলা শব্দ বলে ঘোষণা করে দেওয়া যায়। আমরা লক্ষ্য করেছি, ক্ষ স্থানে খ লিখলে শব্দের অর্থ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বদলায় না। বানান অভিধান রচয়িতাগণকে সেগুলি চিহ্ণিত করে এগোতে হবে। জ ও য-এর অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা হওয়ায় তাদের স্বেচ্ছাচারী প্রয়োগ শব্দের অর্থকে বিকৃত করে দেবে। ‘যাদু’কে ‘জাদু’ কিংবা ‘যাদুঘর’কে ‘জাদুঘর’ লেখা যাবে না।

গুণী ও গুণিজন প্রভৃতি শব্দ নিয়ে ভারী সমস্যা হয়। সন্ধি হলেই দীর্ঘ-ঈ(ী) কার বদলে গিয়ে হ্রস্ব-ই(ি)-কার হয়ে যায়। কেন হয়? উত্তর হল বদলে যাওয়ার কারণ কী? এক্ষেত্রে অবশ্যই সংস্কৃত ব্যাকরণের নির্দ্দেশ আছে; কিন্তু সেই নির্দ্দেশের প্রকৃত যুক্তিগত ভিত্তি কী? না, তার উত্তর নাই। তবে উত্তরটি উদ্ধার ঙ্করা যায়।

গুণের ‘সক্রিয়তার আধার’ই তো দীর্ঘ-ঈকার যুক্ত ‘গুণী’। সেই ‘আধার’-এর দায় যদি অন্য কারও উপর বর্ত্তায়, দীর্ঘ-ঈকার অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে; থেকে যায় শুধু ‘সক্রিয়তা’ বা হ্রস্ব-ইকার। ‘গুণী’ শব্দের সঙ্গে ‘জন’ যুক্ত হলে এই কাণ্ড ঘটে; ‘আধার’-এর দায় বর্ত্তায় ‘জন’-এর উপর। সেকারণেই শব্দটি তখন ‘গুণীজন’ না হয়ে ‘গুণিজন’ হয়ে যায়। যেন হোটেল-রেষ্টুর‍েণ্টের অশনাক্ত রাঁধুনীর রান্না খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া পিতৃমাতৃহীন আইবুড়ো চাকুরীজীবীর বিয়ের পর গৃহিণী ঘরে এলে আর তার কোনো অশনাক্ত রাঁধুনীর দরকার পড়ে না; রান্নার কাজ তখন তার সুনির্দ্দিষ্ট রাঁধুনী গৃহিণীতে বর্ত্তায়, এ-ও অনেকটা তেমনই। সেকারণেই ‘গুণী’র পাশে ‘জন’ এসে গেলে ‘জন’ই ‘গুণ’-এর সক্রিয়তার আধারের (-ী-কারের) ভূমিকা গ্রহণ করে; ী-কারের দায় তখন ‘জন’-এ বর্ত্তায়। তখন ‘গুণিজন’ তেমন জনকে বোঝায়, যাঁর গুণ আছে। কিন্তু তখনও ‘গুণীজন’ লিখলে সেটি দুটি সত্তা হয়ে যায় – ‘গুণী’ যেন এক সুধী বয়স্ক মানুষ, আর ‘জন’ যেন তাঁর মজুর। তার মানে, বাস্তবে ক্রিয়ার জগতে যেমন বদল হয়, সন্ধি সমাসের নিয়মগুলির দ্বারা শব্দেরও সেইরকম বদল হয়। বর্ণ কিন্তু সেই সসশব্দে গুণের সক্রিয়তার আধার তখন স্বরূপ একটি অশনাক্তকারী-সত্তা(ী-কার) তো ছিলই। তার সঙ্গে সক্রিয়তার অপর একটি শনাক্ত আধার ‘জন’কে যোগ করে দিলে অশনাক্ত সত্তাটি স্বভাবতই থাকবার সুযোগ পায় না। পিতৃমাতৃহীন আইবুড়ো চাকুরিজীবী যে কোনো হোটেল-রেস্টুরেন্টের রাঁধুনীর রান্না খেয়ে কাটিয়ে দেয়, কিন্তু তার বিয়ের পর গৃহিণী ঘরে এলে তার আর কোনো অশনাক্ত রাঁধুনীর দরকার পড়ে না। রান্নার কাজ তখন তার সুনির্দিষ্ট রাঁধুনী গৃহিণীতে বর্তায়।একই ভাবে ‘গুণী’র পাশে ‘জন’ এসে গেলে ‘গুণ’-এর সক্রিয়তা তখন ‘জন’-এ বর্তায়। তখন গুণের সক্রিয়তার আধারস্বরূপ অশনাক্ত ঈ-কারের প্রয়োজন আর থাকে না। তখন গুণিজন তেমন জনকে বোঝায়, যাঁর গুণ আছে। কিন্তু তখনও ‘গুণীজন’ লিখলে সেটি দুটি সত্তা হয়ে যায়। ‘গুণী’ যদি এক সুধী বয়স্ক মানুষ হন, তাহলে ‘গুণীজন’ হবে সেই বয়স্ক মানুষ ও তার মজুর। তার মানে, বাস্তবে ক্রিয়ার জগতে যেমন যেমন বদল হয়, সন্ধি সমাসের নিয়মগুলির দ্বারা শব্দেরও সেইরকম বদল হয়। বর্ণভিত্তিক বানান সংস্কার সূত্র তাকে স্বভাবতই সমর্থন করে।

শ ষ স এই তিন বর্ণের অর্থ একই ক্রিয়ার তিনরকম রূপকে বোঝায় – (সূর্য্যালোকের ন্যায়) সার্ব্বিক শক্তিবিচ্ছুরণ, (টর্চ্চের আলোর ন্যায়) দিশাগ্রস্তু শক্তিবিচ্ছুরণ, (একমাত্র রশ্মির ন্যায়) একরৈখিক শক্তিবিচ্ছুরণ। স্বভাবতই বর্ণ তিনটি ভিন্ন অর্থ ধারণ করে। আমরা আমাদের ‘সরল শব্দার্থকোষ’ গ্রন্থে তা প্রয়োগ করে দেখানোর চেষ্টা করেছি।

এবার ং-রূপিণীর কথায় আসা যাক। রহস্যময় কার্য্যকারিণী ং-বর্ণটি (ধ্বনিটি) করণ প্রভৃতি ক্রিয়ার সঙ্গে (বা ক-বর্গের সঙ্গে) যুক্ত হলে ‘ঙ’-রূপ গ্রহণ করে যথা অঙ্ক, শঙ্খ, গঙ্গা, জঙ্ঘা ইত্যাদি; চয়ন প্রভৃতি ক্রিয়ার সঙ্গে (বা চ-বর্গের সঙ্গে) যুক্ত হলে ‘ঞ’ হয়, যথা চঞ্চল, লাঞ্ছনা, রঞ্জন, ঝঞ্ঝা; টঙ্কারণ প্রভৃতি ক্রিয়ার সঙ্গে (বা ট-বর্গের সঙ্গে) যুক্ত হলে ‘ণ’ হয়, যথা বণ্টন, লণ্ঠন, কাণ্ড, ষণ্ঢ ইত্যাদি; তারণ প্রভৃতি ক্রিয়ার সঙ্গে (বা ত-বর্গের সঙ্গে) যুক্ত হলে ‘ন’ হয়, যথা দন্ত, পান্থ, কন্দ, অন্ধ; পালন প্রভৃতি ক্রিয়ার সঙ্গে (বা প-বর্গের সঙ্গে) যুক্ত হলে ‘ম’ হয়, যথা চম্পা, লম্ফ, কম্বল, দম্ভ; যাওয়া প্রভৃতি ক্রিয়ার সঙ্গে বাকি বর্ণগুলিতে যুক্ত হলে তা রহস্যময় কার্য্যকারিণী ং-ই থেকে যায়, যথা সংযম, সংরাগ, সংলাপ, বংশ, সংসার, সংহার ইত্যাদি। তার মানে পঞ্চ বর্গে ং-রূপিণী তত্তদ বর্গের নিজস্ব ং-রূপ (ঙ, ঞ, ণ, ন, ম) লাভ করে, কিন্তু অন্যদের বেলায় সে তার ং-রূপ ত্যাগ করে না। শুধু তাই নয়, বহু ক্ষেত্রে সে তুলনায় কম রহস্যময় কার্য্যকারিণী চন্দ্রবিন্দু রূপও গ্রহণ করে থাকে। মহারহস্যময়ী ং-রূপিণীর এই যে রূপবদল, আমাদের অতি অনুভূতিপ্রবণ পূর্বসূরী সংস্কৃতকারগণ তার কারণ নিশ্চয় অনুভব করতে পেরেছিলেন। আমরা যতদূর বুঝেছি, ক-বর্গ থেকে প-বর্গে পৌঁছানো পর্যন্ত বহু অর্থধারী বা রহস্যময় অর্থধারী ং-ধ্বনি তার অব্যক্ত রূপ থেকে ক্রমশ ব্যক্ত হয়। ম্-বর্ণে সে সম্পূর্ণ ব্যক্ত রূপ লাভ করে সীমায়ন (সীমায়িত) অর্থকে ধারণ করতে সক্ষম হয়। ন্-বর্ণে তার মোটামুটি ব্যক্ত রূপটিকে আমরা অনকরণ-নাকরণ রূপে শনাক্ত করতে পেরেছি। ণ্‌-বর্ণে সে আধা-অব্যক্ত আধা-ব্যক্ত রূপে বিরাজ করে। তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার দ্বারা ধারিত অর্থকে প্রকাশ করা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা রহস্যময়ই থেকে যায়। ঙ, ঞ, ও ঁ (চন্দ্রবিন্দু)-র ক্ষেত্রে ং-রূপিণী তুলনায় কম অস্পষ্ট রহস্যময়ীই থাকে। বাক্যের প্রেক্ষাপট অনুসারে তার অগণিত রকমের নির্দ্দেশকতা (reference) হয় বলে, আমরা তাকে রহস্যময়ী রূপেই চিহ্ণিত করেছি।

‘হাঁদা’ ও ‘হাঁদু’ শব্দ দুটির বর্ণবিশ্লেষণ করলে চন্দ্রবিন্দুর (ঁ) রহস্যময় অর্থকে খানিকটা বোঝা যায়। হ্-এর অর্থ হওয়ন। কোনো সচল চঞ্চল সত্তাকে এক স্থানে স্থির করে দিলেই সে ‘হ’ হয়ে যায়। গাড়োয়ানরা গরুকে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন ‘হ’ ‘হ’ বলে। হয়ে যাওয়া মানেই অস্থির গতিময় কোনো সত্তার একটি স্থির রূপ গ্রহণ করা। তাতে চন্দ্রবিন্দু প্রয়োগ করলে কোনো কিছুকে মনের ভিতরে গ্রহণ করে স্থির রূপ দেওয়া হয়। যে কারণে নিবিষ্ট শ্রোতা আপনার বিবরণের এক একটি অংশ শুনে হঁ হঁ বলতে থাকেন। গ্রামবাংলার বয়স্ক মানুষদের মুখে এই হঁ হঁ প্রায়শই শুনতে পাওয়া যায়। এর অর্থ ‘আপনি যা বলেছেন, তাকে আমি মানসিকভাবে গলাধঃকরণ করে মনের ভিতরে স্থির রূপ দিয়ে ফেলেছি, বা বুঝে গেছি’। এই হঁ-এর আধার হল হাঁ। তাতে কোনো কিছুকে মানসিকভাবে গ্রহণ করে মনের ভিতরে স্থির রূপ দেওয়া চলে বলেই তাকে হাঁ বলে। একে মুখের গ্রাস বা মনের গ্রাসও বলা হয়। মনের গ্রাসের বেলায় এই হাঁ-এর একটু বিবর্তিত রূপ হল ‘হ্যাঁ। তার মানে, আপনি যা যা বললেন, তা সব মনে মনে গ্রাস করে মনের ভিতরে স্থির রূপ দিয়ে ফেলেছি এবং সেকথার স্বীকৃতি দিচ্ছি। তবে মুখের গ্রাস অর্থে ‘হাঁ’ শব্দের মানে খুবই চিত্তাকর্ষক হয়, যখন তার সঙ্গে দা (দান করে যে) যোগ করে দেওয়া হয়। তখন ‘হাঁদা’ শব্দের মানে হয় ‘হাঁ (মুখের গ্রাস) দান করে দেয় যে’। এমন মানুষকে তো হাঁদা বলা হবেই,তা তার মুখের গ্রাস রসগোল্লা হোক, মোটা মাইনের ভাল চাকুরি-র প্রস্তাব হোক, আর coalgate-এর কয়লা খাদানই হোক। হা-এর চন্দ্রবিন্দু এখানে কত রকমের ‘গ্রাস’কে যে বোঝায় তার ইয়ত্তা নেই। এতরকম বোঝায় বলেই কোনো একটি অর্থে চন্দ্রবিন্দুকে বিবৃত করা যায় না। সেকারণে আমরা তাকে রহস্যরূপিণী বলেই আগাগোড়া উল্লেখ করে গেছি। এমন গ্রাস যে গ্রহণ না করে অন্যকে ছেড়ে দেয় বা দিয়ে দেয়, তাকে সমাজ তো ‘হাঁদা’ বলবেই।

কিন্তু পাড়ার যে ছেলেটা তার মুখের গ্রাস-স্বরূপ কলাটা আপেলটা রসগোল্লাটা নিজে না খেয়ে অন্যকে (চাইলেই) দিয়ে দেয়, তাকে তো কেবল ‘হাঁদা’ই বলা যাবে না। তার এই সদগুণকে স্বীকৃতি দিয়ে মায়েরা দিদিরা তাকে ‘হাঁদু’ বলে ডাকতেই পারেন। তাতে ‘হাঁদা’র হাঁদামীটা সকলের প্রিয় হয়ে নবরূপে উত্তীর্ণ (উ-কার) হয় ও হাঁদার সদগুণ রূপে ঘোষিত হয়ে যায়।

যাই হোক, ং ও তার অন্য রূপগুলির (ঙ ঞ ণ ন ম ঁ প্রভৃতি রূপগুলির) দ্বারা ধারিত অর্থ বিষয়ে আমরা যেটুকু পেরেছি, সেটুকু করেছি। এই বিষয়ে আরও গবেষণা করা গেলে হয়তো তাদের অর্থ আরও স্পষ্ট রূপে ব্যাখ্যা করার যোগ্যতা অর্জ্জন করা যাবে। মনে রাখতে হবে, সাধারণ বাংলাভাষীই নব নব শব্দ সৃষ্টি করেছেন, করেন। তাঁদের সেই যোগ্যতার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা উচিত।

আমরা দেখেছি, ং-রূপিণী প্রথম যে স্পষ্ট রূপটি ধারণ করে তা মানসলোকে, বোধ রূপে, যাকে সংস্কৃতকারগণ ‘ণ’ রূপে শনাক্ত করেছেন। গণ, পণ, বাণ, বণিক প্রভৃতি শব্দের ক্ষেত্রে ‘ণ’ একপ্রকার বোধের আধার রূপে সক্রিয় থাকে। আর ঋণ, ঘোষণা, বিষণ্ণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ‘ন’-ই ‘ণ’ হয়ে যায়। কারণ, ঐ শব্দগুলিতে বোধের প্রাথমিকতা থাকে বলে ‘অন’করণ বা ‘না’করণ রূপী ‘ন’-কে ‘ণ’ হয়ে যেতে হয়।

হিন্দু যুগের সূচনা কালে বিশাল সংখ্যক বঙ্গবাসীকে যেমন ‘ছোটজাতের লোক’ বলে নিন্দিত জাতি হিসেবে দেগে দেওয়া হয়েছিল, বিপুল পরিমাণ অসংস্কৃত বাংলা শব্দকে তেমনি ইদানীংকালের চর্চ্চায় ‘দেশজ শব্দ’ নাম দিয়ে নিন্দিত শব্দ বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্য-প্রভাবিত শিক্ষিত ভাষাবিদগণের অল্প ভাষাজ্ঞানের ফল হিসেবেই এই ঔদ্ধত্যজনিত ভ্রান্তিগুলিকে ভুলে যাওয়া ভাল। মানুষের মুখের ভাষার পিছনে যে বিজ্ঞান থাকে, তা যারা দেখতে পায় না, একমাত্র তারাই পারে এরকম কুকর্ম্ম করতে। আমাদের বিচারে তথাকথিত সমস্ত ‘দেশজ শব্দ’ প্রকৃতপক্ষে বাংলার মাটি থেকে জাত শতকরা একশো ভাগ বাংলাভাষার নিজস্ব শব্দ, নিজস্ব অর্জ্জন। সেই সমস্ত শব্দকেই সংস্কার করে সংস্কারকৃত বাংলা শব্দে পরিণত করে ফেলা যায়। আমাদের শব্দার্থকোষে আমরা সেরকম অজস্র শব্দকে সংস্কার করে সংস্কারকৃত বাংলা শব্দ রূপে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছি। ঐ শব্দার্থকোষ সঙ্কলনকালে আমরা দেখেছি, তথাকথিত অজস্র ‘দেশজ শব্দ’-এর সংস্কার করতে গেলে তাদের অধিকাংশেরই কোনো বদল ঘটানোর দরকার পড়ে না।তার মানে সেই শব্দগুলি জন্মসূত্রে যে শুচিতা পেয়েছিল (স্বাভাবিক জন্ম হওয়ার কালে সব শব্দই যা পেয়ে থাকে) তা তাদের (উপরোক্ত হাঁদা, হাঁদু শব্দের মতো) আজও অক্ষুণ্ণ আছে, তাই তাদের সংস্কার করার দরকারই পড়ছে না। তারা স্বভাবতই সংস্কারকৃত বাংলা শব্দসমূহের দলে পড়ে।

আমাদের বিচারে বাংলাভাষার অন্তর্ভুক্ত বিদেশী ভাষার শব্দ (৭) বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু হয় না। বিশ্বের সকল মানবিক ভাষার আদি রূপ এক এবং অভিন্ন।একই আদিম অভিন্ন মানসসরোবর-রূপ উৎস থেকে বিশ্বের সব ভাষাই নির্গত ও বিভাজিত হয়ে হয়ে পৃথক পৃথক সামাজিক ও ভৌগোলিক মাটির উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে কালে কালে মাটির গুণে ও কালের নিয়মে পরস্পর থেকে আলাদা চেহারা নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের ভিতরে জিনগত সম্বন্ধ যথেষ্ট পরিমাণে আজও আছে। আছে বলেই কোনো কোনো তথাকথিত বিদেশী ভাষার শব্দকে আমাদের চেনা চেনা মনে হয়, কাউকে বা অচেনা লাগে। কোনো কোনো শব্দকে তাই সংস্কার করে সংস্কারকৃত বাংলা শব্দে পরিণত বা উত্তীর্ণ করে ফেলা যায়, কাউকে বা সেরকম করা কঠিনন; আমরা পারিনি। তার মানে, যে সকল তথাকথিত বিদেশী শব্দকে সংস্কারকৃত বাংলায় উন্নীত করা যায়, আমরা তাদের বিদেশী শব্দ বলতে রাজী নই। আমাদের ‘সরল শব্দার্থকোষে’ বাংলা শব্দ হিসেবেই সেরকম তথাকথিত আরবী, ফারসী, হিন্দী, এমনকি কিছু ইংরেজী শব্দও আছে। যেমন জানানা (জনানা), জানোয়ার, টনিক …ইত্যাদি বহু। যাদের আমরা এখনও সংস্কার করতে পারিনি, বাংলাভাষার অন্তর্ভুক্ত একমাত্র সেইরকম বিদেশী শব্দকে আপাতত কিছু কালের জন্য ‘বিদেশী শব্দ’ নামে চিহ্ণিত করা যেতে পারে। যেদিন সেগুলিকেও সংস্কার করে ফেলা যাবে, তখন সেগুলিকেও আর ‘বিদেশী শব্দ’ বলা যাবে না।

সবশেষে আমাদের নিবেদন এই যে, আমরা কোনো প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় আশ্রিত গবেষক নই। ঘটনাচক্রে বানান সংস্কারের যে নিয়ম আমাদের হাতে এসে গেছে, কর্ত্তব্য ভেবে সেই সত্যই পাঠক সাধারণের গোচরে আনলাম। আমাদের বিশ্বাস, এই নিয়মের সাহায্যে বাংলাভাষার বানান সমস্যার সমাধান করা যাবে। যাঁরা বাংলাভাষাকে ভাল বাসেন, তাঁরা একটু ভাবুন। যাঁদের যথেষ্ট জ্ঞান, ধন ও সময় আছে, তেমন বাংলাভাষিরা এই পথে তাঁদের সময়, ধন ও জ্ঞান নিয়োগ করতে পারেন। তাতে শুধু বাঙালী জাতির নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর ভাল হবে। আমরা তেমন কর্মযোগীর পথ চেয়ে রইলাম।(৮)

পাদটীকা:


পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমী প্রকাশিত ‘বানান বিতর্ক’ গ্রন্থের ‘বাংলার বানান বিতর্ক’ নামে সঙ্কলিত বিমলনারায়ণ চৌধুরী মহাশয়ের পত্রের উত্তরে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্যস্বরূপ ‘বাংলার বানান সমস্যা’ নামে সঙ্কলিত পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন – ‘অন্তত এ কাজটা আমাদের নয়, এ সুনীতিকুমারের দলের। বাংলাভাষাকে বাংলাভাষা বলে স্বীকার করে তার স্বভাবসঙ্গত নিয়মগুলি তাঁরাই উদ্ভাবন করে দিন’। তিনি আরও লিখেছেন – ‘আমি এক সময় সুনীতিকুমারকে প্রাকৃত বাংলার অভিধান বানাতে অনুরোধ করেছিলুম, সেই উপলক্ষ্যে শব্দবিজ্ঞানের নিয়ম অনুসরণ করে বানান যদি বেঁধে দেন, তবে বিষয়টাকে মীমাংসার পথে আনা যেতে পারে ।


বাংলাভাষায় শব্দের লিখিত রূপের নানা রকম বানান প্রচলিত থাকায় যাঁরা পঠনপাঠন, লেখালিখি ও মুদ্রণের কাজে যুক্ত তাঁরা খুবই অসুবিধায় পড়েন। তাঁদের মনে হয়, বাংলা বানানের যেন কোনো নিয়ম নেই। এই বানান নৈরাজ্য নিয়ে কথাবার্ত্তা তাই বহু দিন ধরেই চলছে। বলতে গেলে ১৯৩৫ সাল থেকে আজ পর্য্যন্ত এই নিয়ে কত যে নিবন্ধ প্রবন্ধ গ্রন্থাদি লিখিত ও প্রকাশিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। উপর্যুক্ত ‘বানান বিতর্ক’ নামের নিবন্ধ-সঙ্কলনটি পাঠ করলেই বাংলাভাষার সেই বিপুল বিতর্কের স্বরূপ খানিকটা উপলব্ধি করা যায়। বাংলাভাষার বহু জ্ঞানীগুণী গণমান্য শিক্ষাবিদ সাহিত্যিক ভাষাবিদগণ এই বিতর্কে অংশ গ্রহণ করেছেন। এঁদের মধ্যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও আছেন। এবং এত কিছু সত্ত্বেও সে বিতর্কের অবসান আজও হয়নি। হয়নি ব’লে, আমাদের প্রণম্য ঐসব জ্ঞানীগুণী বড় মানুষেরা যে বানান সমস্যার সমাধান আজও করে উঠতে পারেননি, অখ্যাত আমরা দু’জন যাব সেই সমস্যা সমাধানের উপায়ের কথা বলতে, এমন দুঃসাহসিক বাসনার কথা আমরা আগে কখনো কল্পনাও করিনি। কিন্তু কথায় বলে, ভবিতব্যকে ঠেকায় কে ! …

ব্যাপার খানিকটা ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ বেরিয়ে পড়ার মতো। বাংলাভাষার শব্দের মানে জানতে গিয়ে শব্দের ভেতরটা দেখার জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করতে শুরু করি এবং পড়ে যাই গভীর গাড্ডায়। তার থেকে উদ্ধার পেতে গিয়ে যখন আঁকুপাঁকু করছি, তখন ঘটনাচক্রে বাংলাভাষায় বহুকালক্রমাগত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির মরণাপন্ন রূপের দেখা পেয়ে প্রাণে বাঁচি। সুদীর্ঘ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেই শব্দার্থবিধিকে পুনরুদ্ধার ও একালিকরণ করে তার সাহায্যে আমরা আমাদের শব্দার্থ-সমস্যার সঙ্কট থেকে নিষ্কৃতি লাভ করি। আমাদের সেই শব্দার্থ পরিক্রমা বলতে গেলে ১৯৬৮ সাল থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। সেই পরিক্রমার ফসলস্বরূপ আমাদের হাত দিয়ে ঐ নব্য শব্দার্থবিধির সাহায্যে বাংলাভাষার বিপুল সম্পদের কিছু কিছু উদ্ধার হতে থাকে এবং সেগুলি মোট ১১টি নিবন্ধ-গ্রন্থ রূপে প্রকাশিত হয়ে যায়। সবশেষে আমাদের পাঠকগোষ্ঠীর অনুরোধে ও সক্রিয় সহায়তায় আমরা ঐ নতুন শব্দার্থবিধির সাহায্যে দুই খণ্ডে ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ লিখে শেষ করি ২০১১ সালের জানুয়ারিতে এবং এক খণ্ডে ‘সরল শব্দার্থকোষ’ লিখে শেষ করেছি বিগত ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। … … … এই ধরনের বাকফসলের চাষ তার স্বভাববশত রাজপুরুষদের বিরক্ত এবং প্রজাদের উত্তেজিত করে থাকে। এক্ষেত্রেও তাই করল। বানান নিয়ে প্রথম ঘটনাটি ঘটল ২০০৪ সালে। ২০০৪ সালের ২ জুলাই সংখ্যার ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রখ্যাত কবি শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘আমাদের হ্রসসি দীর্ঘি জ্ঞান’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখে বাংলাভাষার বানান বদলের পবিত্র সরকারী প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানান। তার কয়েকদিন পরেই ঢাকা থেকে কলকাতা আসেন আমাদের পাঠকবন্ধু বাংলাদেশের কবি তুষার গায়েন। তিনি ঐ ‘দেশ’ পত্রিকাটি হাতে পেয়ে খানিক উত্তেজিত হয়ে এসে জানতে চান, আমরা দুজন ঐ বানান বদল সমর্থন করি কি না। সমর্থন করি না শুনে তিনি জানতে চান, কেন তাহলে আমরা ঐ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য লিখে প্রকাশ করছি না। বিশেষত, আমরা দুজন যখন ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে শব্দের ভিতর থেকেই শব্দার্থ নিষ্কাশনের রহস্য জেনে গেছি, এবং জেনে গেছি যে, শব্দের বানান বদলে গেলে শব্দের মানেও বদলে যায়, তাহলে চুপ করে আছি কেন?

দীর্ঘ আলোচনার পর আমাদের হাতের কাজ কিছুদিনের জন্য সরিয়ে রেখে আমরা ঐ বিষয়ে লিখতে সম্মত হই। ফলস্বরূপ আমাদের বক্তব্য (পৃথক ভাবে দুইখানি এবং পরে আরও একখানি) মোট তিনখানি নিবন্ধের আকারে লিখে কলকাতা ও ঢাকায় একসঙ্গে প্রকাশ করি। পরে ঐ নিবন্ধগুলি নিয়ে ‘বাংলা বানান, বাংলা ভাষা’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয় ২০০৫-এর কলকাতা বইমেলায়। তারও পরে আমাদের দুজনের ‘বাংলাভাষা -প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে সেই তিনটি নিবন্ধই সঙ্কলিত হয়।

বাংলা শব্দের বানান বদল করে দিলেই যে সে শব্দের মানে বদলে যায়, আমাদের ঐ নিবন্ধগুলি সেকথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে দেয়। তবে কিনা নিবন্ধগুলি প্রধানত বাংলা বানান বদলের রাজকীয় প্রচেষ্টার প্রতিবাদ রূপেই লিখিত হয়েছিল; বানান সমস্যা সমাধান করা যাবে কোন পথে, সে বিষয়ে ঐ নিবন্ধগুলিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া যায়নি। তার কারণ হল, তখন পর্য্যন্ত আমরা বাংলাভাষার অধিকাংশ শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করে উঠতে পারিনি। শব্দার্থভিত্তিক বেশ কিছু নিবন্ধ লিখে ফেললেও আমাদের ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ রচনার কাজ তখনও প্রারম্ভিক পর্য্যায়ে। সম্প্রতি সেই শব্দার্থকোষ প্রণয়নের কাজ শেষ হয়েছে এবং তা প্রকাশিত হয়ে গেছে। তাতে শব্দের বানান অনুসারে তার মানে কীরকম হয়, অধিকাংশ প্রচলিত বাংলা শব্দের বিশ্লেষণ করে তা করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। জানা গেছে, শব্দের বানান যেরকম হয়, তার অর্থও তদনুযায়ী হয়। তাহলে তো শব্দের বানান কীরকম থাকলে শব্দটির মাধ্যমে প্রকাশিতব্য অর্থও ঠিক থাকে, সে কথা আমরাই এখন বলে দিতে পারি। ফলত, আগের সেই দাবি পুনরায় উঠে পড়ে – এবার তাহলে বাংলাভাষার বানান সমস্যা সমাধান করা যাবে কেমন করে, সেটা বলতেই হবে। এই হল ভবিতব্য, যাকে ঠেকানো যায়নি। সে কারণেই এই নিবন্ধের অবতারণা।

সৃষ্টির কালে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষ পরস্পরের ভাষা বুঝতেন। সংস্কৃতভাষা সৃষ্টিকারী পণ্ডিতগণকে ঘিরে থাকা চারদিকের ভাষা বলতে আমরা প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সকল ভাষার আদি রূপের কথা বলছি। এ বিষয়ে ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের (৩৯৩-৩৯৫ পৃষ্ঠায়) ‘ভাষা’ শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

আমরা বাংলাভাষা বলতে প্রাচীন বাংলা থেকে আধুনিক বাংলা পর্য্যন্ত সমগ্র বাংলাভাষা প্রবাহটিকে বুঝি। রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন বাংলাকে ‘প্রাচীন প্রাকৃত’ নামে বুঝতেন ও প্রকাশ করতেন বলেই আমাদের মনে হয়েছে। উপরোক্ত ‘বানান বিতর্ক’ গ্রন্থে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেবপ্রসাদ ঘোষ মহাশয়ের বিতর্কমূলক পত্রগুলি থেকেই সেরূপ ধারণা জন্মায়। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘সংস্কৃত এবং প্রাচীন প্রাকৃত ভাষা ছাড়া সভ্য জগতের অন্য কোনো ভাষারই লিখনব্যবহারে বোধ করি উচ্চারণ ও বানানের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য নেই …।’ ‘মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের সঙ্গে প্রাকৃত বাংলা ভাষা সম্বন্ধে আমার আলোচনা হয়েছিল। তিনি প্রাকৃত বাংলা ভাষার স্বতন্ত্র রূপ স্বীকার করবার পক্ষপাতী ছিলেন একথা বোধ হয় সকলের জানা আছে’। এ বিষয়ে দেবপ্রসাদ ঘোষ মহাশয় রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন, ‘ঠিক কী অর্থে যে আপনি “প্রাকৃত” বাঙ্গালা কথাটি ব্যবহার করিয়াছেন আপনার প্রবন্ধে এবং পত্রে, তাহা আমি সব সময়ে বুঝিতে পারি নাই। একটু যেন loosely কথাটা ব্যবহৃত হইয়াছে মনে হইল। কোন সময়ে মনে হয় যে, বাঙ্গালা ভাষাকেই আপনি “প্রাকৃত” বাঙ্গালা বলিয়াছেন ; কোন সময়ে মনে হয় যে, বাঙ্গালা ভাষার অ-সংস্কৃত অংশকে আপনি প্রাকৃত বাঙ্গালা বলিয়াছেন ; আবার কোন সময়ে মনে হয় যে, ভাষার যে মৌখিক (colloquial) রূপ আজকাল বহুল পরিমাণে সাহিত্যে চলিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহাকেই আপনি “প্রাকৃত” বাঙ্গালা বলিয়াছেন। …’

এখানে মনে রাখা দরকার, প্রাচীন বাংলাভাষায় ছ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, থ প্রভৃতি বর্ণ থেকে তখনও যথেষ্ট সংখ্যক শব্দ জন্মায়নি বলেই ঐ বর্ণগুলিতে সংস্কৃত শব্দের পরিমাণ খুবই কম। ঐ বর্ণগুলিতে বিপুল পরিমাণে বাংলা শব্দ পরবর্তী কালে জন্মেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তথাকথিত বিদেশী শব্দ এবং সে সবই একালের বাংলাভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর সেই সব শব্দ নিয়ে একালের বাংলাভাষার যে বিপুল শব্দসম্ভার, তার তুলনায় প্রাচীন বাংলার শব্দসম্ভার অনেক কম ছিল। যে কারণে সুনীতিবাবু যখন বলেন, বাংলাভাষায় ৯০ শতাংশ শব্দ সংস্কৃতের সঙ্গে মেলে, তখন পরবর্ত্তী-কালের বহু বাংলাভাষাবিদ বলেন, বাংলাভাষায় সংস্কৃত ও সংস্কৃতজ শব্দের সংখ্যা ৯০ শতাংশের অনেক কম। তার মানে, সুনীতিবাবু বাংলাভাষার যে শব্দসম্ভার নিয়ে কাজ করেছিলেন, তা মূলত প্রাচীন বাংলা এবং অন্য ভাষাবিদগণ যে বাংলাভাষা নিয়ে কাজ করেছেন, তা কার্য্যত আধুনিক বাংলা। সেই কারণে আমাদের পূর্ব্ববর্তী কোনো কোনো গ্রন্থে আমরা সংস্কৃতভাষাকেই প্রাচীন বাংলা বলে উল্লেখ করেছি। করব নাই বা কেন। বাংলা অব্যয় শব্দগুলির সঙ্গে সংস্কৃত অব্যয় শব্দগুলির কি বিন্দুমাত্র পার্থক্য আছে? এ বিষয়ে আমাদের শব্দার্থকোষে বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।

বিদেশী ভাষা সম্পর্কে আমাদের গবেষণা ভিন্ন কথা বলে। আমরা জেনেছি, বিশ্বের সমস্ত ভাষাই এক আদি ভাষা থেকে জন্মলাভ করে, এক নদীর ৬০০০ শাখানদীতে পরিণত হয়ে প্রবাহিত হয়ে চলার মতো, ৬০০০ ভাষা রূপে প্রচলিত রয়েছে। প্রবাহপথের মাটির গুণে প্রত্যেক নদীর জলের স্বভাবের খানিক বদল হয় বটে, কিন্তু উৎস থেকে আসা জলের স্বভাব তার পরেও অনেকখানি থেকে যায়। আমরা দেখেছি, আমরা বাংলা ভাষায় যে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির পুনরুদ্ধার ও একালিকরণ করেছি, তার সাহায্যে বহু তথাকথিত বিদেশী ভাষার বহু শব্দের অর্থ প্রকাশ করা যায়। আমরা আরও লক্ষ্য করেছি, ঐ শব্দার্থবিধির সাহায্যে যে ‘বিদেশী’ শব্দের অর্থ নিষ্কাশন করা যায়, তাকে আপন ভাষার অন্তর্ভুক্ত করে নিতে বাংলা ভাষার বাধেনি। বাধবেই বা কেন? ভাই বেরাদর আত্মীয় বলে চিনতে পারলে তাকে আপন করে নেওয়াই তো স্বাভাবিক। বলে রাখা ভাল, ইংরেজ ভাষাবিদেরা যখন তাঁদের কোনো শব্দের অতীত আত্মীয়তার সূত্র সন্ধানে ব্যর্থ হন, তাঁরা বলে দেন – ‘origin unknown’। আর আমাদের বাংলাভাষী অ্যাকাডেমিশিয়ান ভাষাবিদগণ যখন সে কাজে ব্যর্থ হন, বলে দেন – ‘দেশজ শব্দ’। আমরা নিশ্চয় করে ঘোষণা করছি, বিশ্বের সকল ভাষা একই আদি মহাভাষার সন্তানসন্ততি এবং নানা কারণে তারা পরস্পর থেকে অনেক দূরে সরে গেছে বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের জিন-গবেষণা (শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থানুসন্ধান) করলে দেখা যাবে, আত্মীয়তার স্মৃতিচিহ্ণ তাদের ভিতরে আজও বিদ্যমান, কারও কম, কারও বেশী।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার