Select Page

আফগানিস্তানের রাজনীতিতে তালেবানদের উত্থান

আফগানিস্তানের রাজনীতিতে তালেবানদের উত্থান

আফগানিস্তানে তালেবানরা আবারও ক্ষমতায় ফেরার পর দেশটিতে নানা ধরণের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে বড় সংকটটি হলো মেধা শক্তি হিসেবে আফগানিস্তানের শিক্ষিত অংশ এবং নাগরিক সমাজের প্রধানাংশ আর দেশে থাকতে চাইছে না। কাবুল বিমানবন্দরে বোমা হামলার ঘটনায় অনেকের মৃত্যু হলেও চিত্রটি বদলায়নি। এই সামগ্রিক বিষয় নিয়ে অনেকেই মতামত রাখছেন। আমি ঠিক মতামত নয়, কয়েকটি পয়েন্টে বিষয়গুলি উত্থাপন করতে চাচ্ছি। যাতে করে আফগানিস্তানের যে চলমান সংকট তার গোড়ার দিকের কিছু ঘটনা আমরা বুঝতে পারি।

মূলত ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে দেশটিতে একটা প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, এটা আমরা কমবেশি জানি। এখনে মূল বিষয়টি হলো ওই প্রতিরোধের কয়েকটি পর্ব রয়েছে। এর মধ্যে একটি পর্ব হলো পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামল। অন্যটি বেনজির ভুট্টোর শাসনামল। আফগানিস্তান নিয়ে কথা বলতে গেলে আমরা সাধারণত জিয়াউল হকের সামরিক শাসনামলটিকে ধরি। বেনজির ভূট্টোর পর্বটি এড়িয়ে যাই। কিন্তু বাস্তাবতা হলো, এই পর্ব দুটিকে একটু পৃথকভাবে পর্যালোচনা না করলে তালেবানদের উত্থানের বিষয়টি বোঝা যাবে না। এর সঙ্গে মিলিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হস্তক্ষেপটিও বিশ্লেষণ করা দরকার। ফলে আমি খুব সংক্ষেপে বিষয়গুলি তুলে ধরছি।

১) আফগান যুদ্ধে মার্কিন ও পাকিস্তানের স্বার্থ:

‘বিশ্বের ইতিহাসে কোন বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? তালেবানদের উত্থান, নাকি সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতন?’ এই যে প্রশ্নটি করলাম, এই জিজ্ঞাসাটা কিন্তু আমার নয়, বিগনিউ ব্রেজনিস্কির (Zbigniew Brzezinski)।

ব্রেজনিস্কি হলেন পোলিশ বংশোদ্ভুত আমেরিকান নাগরিক। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের আমলে জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা (National Security Adviser)। আফগানিস্তানে তালেবানদের নিয়ে কথা বলতে গেলে আমরা প্রথমেই যে বয়ানটি হাজির করি, সেটা হলো ওই দেশে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের প্রতিক্রিয়ায় মুজাহিদিন ও তালেবানদের উত্থান ঘটেছিল। মূলত এটা হলো পশ্চিমাবিশ্ব ও তার সহযোগীদের একটি শক্তিশালী প্রোপাগান্ডা। কারণ আফগান যুদ্ধে মার্কিনিদের একটা ভিন্ন স্বার্থ ছিল। এই স্বার্থের গোড়ার কিছু কথা প্রথম প্রকাশ করেছিলেন রবার্ট গেটস। রর্বাট গেটসও ছিলেন এক সময় আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা বা সিআইএ’র ডিরেক্টর। তিনি ১৯৮৬ সালে ‘ফ্রম দি স্যাডোস’ নামে আত্মজীবনী লিখেন। সেখানে দাবি করেন, সোভিয়েত সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করার ছয় মাস আগে থেকেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ আফগান মুজাহিদদের সাহায্য করা শুরু করে। রবার্ট গেটসের এই বইয়ের সূত্র ধরে ১৯৮৯ সালে এক ফরাসি পত্রিকা বিগনিউ ব্রেজনস্কির একটি সাক্ষাৎকার নেয়। ওই সাক্ষাৎকারে ব্রেজনস্কি জানান, প্রেসিডেন্ট কার্টার ১৯৭৯ সালের ৩ জুলাই কাবুলের সোভিয়েতপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে মুজাহিদিনদের গোপনে সাহায্য করার জন্য আমাকে প্রথম লিখিত নির্দেশ দেন। আমি প্রেসিডেন্টকে বলি, আমাদের এই সাহায্য আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে প্ররোচিত করবে। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্টের কোনো খেদ আছে কিনা? প্রেসিডেন্ট উত্তর দেন, কিসের খেদ? এরপর ব্রেজনস্কি ওই পত্রিকায় আরও জানাচ্ছেন, সোভিয়েত সেনাবাহিনী যেদিন সীমানা অতিক্রম করে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে, সেদিনই আমি প্রেসিডেন্ট কার্টারকে লিখিতভাবে জানায়, সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভিয়েতনামের যুদ্ধ উপহার দেয়ার সময় এসেছে।

ফরাসি সাংবাদিক এরপর ব্রেজনস্কিকে প্রশ্ন করেন, ভবিষ্যতে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে অন্ত্র তুলে দেয়া, পরামর্শ দেয়া বা ইসলামিক মৌলবাদীদের সমর্থন করা নিয়ে কি আপনার কোনো খেদ নেই? এর জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন, বিশ্বের ইতিহাসে কোন বিষয়টি বেশি জরুরী, তালিবান নাকি সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতন? কিছু উত্তেজিত মুসলান নাকি মধ্য ইউরোপের স্বাধীনতা এবং ঠাণ্ডাযুদ্ধের অবসান? এখানে উল্লেখ করা দরকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টার ১৯৭৯ সালের ৩ জুন পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়া আফগানিস্তানের মুজাহিদিনদের সাহায্যের জন্য যে প্রথম লিখিত নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেটা ছিল গোপন। এবং পাকিস্তানে মুজাহিদিনদের সাহায্য করার বিষয়টি নজরে আসলে সোভিয়েত রাষ্ট্র আফগানিস্তানে তাদের সমর্থিত সরকারকে রক্ষায় তাদের সেনাবাহিনী পাঠায়। রাশিয়ার সেনাবাহিনী ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম আফগান সীমানা অতিক্রম করে। কাবুলে প্রবেশ করে ২৫ ডিসেম্বর।  অর্থাৎ আমেরিকা ১৯৭৯ সালের ৩ জুন আফগান মুজাহিদিনদের সামরিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়। আর তারই প্রতিক্রিয়ার রাশিয়ার তাদের সমর্থিত সরকারকে রক্ষার জন্য ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে তাদের সেনাবাহিনী পাঠায়। ফলে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনাবাহিনী প্রবেশ করার পর মুজাহিদিন ও তালেবানদের উত্থান ঘটেছে বলে, যে প্রচারণা এটা  আদতেই ঠিক নয়। এটা হলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ লবির প্রচারণা। তবে হ্যাঁ, এখানেও প্রশ্ন উঠতে পারে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ নিয়ে। সেটা কিন্তু ভিন্ন তর্ক। তার আগে আর একটি তর্ক ওঠা জরুরী, কেন কার্টার তার সামরিক উপদেষ্টাকে গোপনে লিখিত নির্দেশটি দিয়েছিলেন?

এখানে যে বিষয়টি পরিস্কার করা দরকার তাহলো, ওই সময় আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ছিল সোভিয়েত সর্মথিত  নাজিবুল্লাহ সরকার ছিল। ওই সরকার এবং রাষ্ট্র কিন্তু তখনও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। পশ্চিমা কোনো রাষ্ট্র কিন্তু নাজিবুল্লাহকে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল বা তাদের উপরে কোনো ধরণের অর্থনৈতিক অবরোধ করেছিল, এর নজির কিন্তু নেই। আন্তর্জাতিকভাবে এই স্বীকৃত সরকারে সঙ্গে সোভিয়েত রাষ্ট্র ১৯৭৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সনদের ৫১ নং ধারা অনুসরণ করে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে। এই চুক্তিও ছিল আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। এই চুক্তি অনুসারে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক বাহিনীর উন্নয়নে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি বিশেষজ্ঞ দল আসে। ওই চুক্তির মধ্যে আফগানিস্তানের সেনাবাহিনীর উন্নয়নের প্রশ্নটিও ছিল।  আন্তর্জাতিক আইনে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে এ ধরণের চুক্তি কিন্তু স্বীকৃত বিষয়। এটা হরহামেশা নানা দেশের ক্ষেত্রেই ঘটছে। এই চুক্তি অধিনতামূলক কিনা, সেটা ভিন্ন তর্ক। এ সব আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর কারণেই কিন্তু আমেরিকা প্রকাশ্যে নয়, গোপনে পাকিস্তানের মাধ্যমে আফগানিস্তানের মুজাহিদিনদের সাহায্যের সিদ্ধান্ত নেয়।  

এবার আসা যাক দ্বিতীয় প্রশ্নে। ১৯৭০ সাল থেকেই আফগানিস্তানে চলছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। অনেকগুলি অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটেছে এ সময়। এর মধ্যে ১৯৭৭ সালের ২৭ এপ্রিল বিভিন্ন স্তরের শ্রমজীবী মানুষ ও আফগান সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থান করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭৭ সালের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে যে সরকার গঠন করা হয় তার নাম Democratic Repubici of Afghanistan বা পিডিপিএ। এই পিডিপিএ সরকারটিই ছিল সোভিয়েত সমর্থিত।  এই সরকারের সঙ্গেই সোভিয়েতের চুক্তি হয়। চুক্তিটি কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনে মেনেই হয়েছিল। ফলে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কার্টারকে প্রথম পর্যায়ে এই আফগান সরকারকে উচ্ছেদের জন্য গোপনে নির্দেশ দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে মার্কিনিদের লক্ষ্য কী? বিগনিউ ব্রেজনস্কি আমাদের জানাচ্ছেন,ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া।  মূলত এটা ছিল একটা ফাঁদ। এই ফাঁদে আটকা পড়ে রাশিয়াকে দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধ চালাতে হয়। এক পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে। এই কথাটিও কিন্তু বিগনিউ ব্রেজনস্কি তার সাক্ষাৎকারে মুক্ত ইউরোপের প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন।

এবার আসা যাক তৃতীয় প্রশ্নে।

এই প্রশ্নের গোড়ায় রয়েছে পাকিস্তানের কী ধরণের স্বার্থ ছিল? এক কথায় এর জবাব হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

আমরা সবাই কমবেশি জানি, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে  ভয়াবহ গণহত্যা ও নিপীড়ন শুরু করে। এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েতের চেয়ারম্যান নিকোলাই পদগর্নি নিজে পাকিস্তানের সামরিক জেনারেল ইয়াহিয়াকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। পরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট সোভিয়েত ও ভারত সরকারের  মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়। এই চুক্তির ৯ নং ধারায় উল্লেখ ছিল এই দুই পক্ষের মধ্যে যদি কোনো পক্ষ আক্রান্ত বা হুমকির সম্মুখীন হয়, তবে অপর পক্ষ তাকে সামরিক শক্তি দিয়ে সাহায্য করবে। এই চুক্তির উপরে ভিত্তি করে ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় ও যুদ্ধে অংশ নেয়।  রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে এই চুক্তির পর মার্কিনিরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বঙ্গোপসাগরে তাদের পারমাণবিক এয়ারক্র্যাফট কেরিয়ার এন্টারপ্রাইজ পাঠায়। এর বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্লডিভস্টক থেকে পরপর দুটি পারমাণবিক সাবমেরিন পাঠায়। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি এড়াতে তার এন্টারপ্রাইজকে সরিয়ে নেয়।  এরপরের ইতিহাস হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই ভূমিকাকে পাকিস্তানসহ সৌদি আরব ব্লক  বরাবরই বহিরাগত হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেছে। এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত পাকিস্তানের অখণ্ডতা ভেঙে দিয়েছে নামে একটা বয়ানও দাঁড় করিয়েছে। ফলে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ পরাজয়ের ওই অবস্থান থেকে পাকিস্তান আফগানিস্তানে সোভিয়েত উপস্থিতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। এখানে তথ্য হিসেবে আরও বলা দরকার , পাকিস্তানে জিয়াউল হকের সময় ছিল একটা জোট সরকার। জেনারেল জিয়াউল হকের সামরিক সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলাম জোট গঠন করেছিল।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে জামাতের ভূমিকা আসলে কি ছিল, তা আমরা সবাই জানি। 

আফগান যুদ্ধের প্রথম পর্ব

২) আগেই উল্লেখ করেছি ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর সোভিয়েত সেনাবাহিনী প্রথম আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ করে। কাবুলে ঢোকে ২৫ ডিসেম্বর। ১৯৮৮ সালের ১৪ই এপ্রিল তৎকালীন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ জেনেভায় জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহরের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রাশিয়া তার সমস্ত সেনা প্রত্যাহার করে। এটা হলো ঘটনার প্রথম পর্ব।

সোভিয়েত আগ্রাসনের এই প্রথম পর্বে আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে প্রায় ৩৫ লাখ ও ইরানে ১৫ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই সংখাটি ছিল আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। এই পর্ব বা ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের যে দলগুলি সোভিয়েত দখলদারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, সেই লড়াই শেষ হয়ে যাওয়ার পর একটি ঘটনা ছাড়া কিন্তু তালেবানদের সোভিয়েত বিরোধী লড়াইয়ের কোনো ইতিহাস নেই। অথচ আমরা আমাদের আলাপচারিতায় তালেবানদের ভূমিকা উল্লেখ করতে গিয়ে শুরু করি জেনারেল জিয়াউল হকের আমল থেকে।

মূলত সোভিয়েত সমর্থিত আফগানিস্তানের শেষ রাষ্ট্রপতি নাজিবুল্লাহ ১৯৯২ সালে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে কাবুলে জাতিসংঘের দফতরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কাবুলের এই দফতরে তিনি ছিলেন ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। সুযোগ থাকলেও তিনি কিন্তু দেশ ছাড়েননি। ১৯৯৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত একটায় হেরাতের গভর্নর মোল্লা আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে তালেবানদের পাঁচজনের একটি দল নাজিবুল্লাহকে গ্রেফতার ও পরে নিপীড়ন করে হত্যা করে। মোল্লা আব্দুর রাজ্জাক পরে জানান, পাঁচজনের ওই দলের মধ্যে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর একজন সদস্য ছিল। এবং তাদের উপর নির্দেশ ছিল নাজিবুল্লাহকে সরাসরি হত্যা করার। এই একটি ঘটনা ছাড়া আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন বিরোধী যুদ্ধে তালেবানদের কোনো ভূমিকা ছিল না। এখানে আরও উল্লেখ করা দরকার সোভিয়েত সেনাবাহিনী আফগানিস্তান ছাড়ার পরও নাজিবুল্লাহ তিন বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এ সময় মুজাহিদিদের সঙ্গে নাজিবুল্লাহ’র সেনাবাহিনীর বড় ধরণের কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছে। প্রতিটি যুদ্ধে কিন্তু মুজাহিদিন গ্রুপগুলিই পরাজিত হয়েছে। নাজিবুল্লাহ প্রধানভাবে সাংবিধানিক সংকট থেকে পদত্যাগ করেন। একই সঙ্গে তিনি তার সরকার ও সেনাবাহিনী ভেঙে দেন। নিজে জাতিসংঘের দফতরে রাজনৈতিক আশ্রয়ে নেন। তাকে যখন হত্যা করা হয় তখন কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল বেনজির ভুট্টো। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কিন্তু আমাদের আলাপচারিতায় সব সময় অনুল্লেখ থাকে।

৩) ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর যারা পাকিস্তান ও ইরানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই আফগান জনগণের মধ্য থেকে গড়ে উঠেছিল কয়েকটি মুজাহিদিন গ্রুপ। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল জিয়াউল হক। মূলত তার নির্দেশ ও আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার ব্যবস্থাপনায় মুজাহিদিন গ্রুপগুলি গড়ে তোলা হয়। এই মুজাহিদিনরা ছিল প্রধানভাবে দুটি ধারায় বিভক্ত। একটি হলো রাজনৈতিক ইসলামের ধারা। অন্যটি সনাতন মুসলিম ঐতিহ্যবাহী ধারা। এই দুই ধারা আবার কয়েকটি ভাগ ছিল। আমরা সেগুলি একটু দেখে নিতে পারি।

রাজনৈতিক ইসলাম

ক) এর মধ্যে একটি ধারা ছিল গিলজাই-পশতুন সমর্থিত গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ার নেতৃত্বাধীন ‘হিজাব-ই-ইসলাম’। এদের সামরিক শাখার নাম ছিল ‘লস্কার-ই-সিহার’। এই গ্রুপটি মূলত যুদ্ধ শেষে আফগানিস্তানে যাতে একটি সুন্নি ধারায় রাজনৈতিক ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেই ঘোষণা তার যুদ্ধের শুরুতেই দিয়েছিল। এই ধারার সঙ্গেই প্রধানভাবে পাকিস্তানের শাসক জেনারেল জিয়া ও জামায়াতে ইসলামের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্কের কারণেই ‘হিজাব-ই-ইসলাম’কে পাকিস্তান ও মার্কিন প্রধানভাবে  সামরিক ও আর্থিক সাহায্য  করে।  সুন্নি ধারার এই রাজনৈতিক ইসলাম ছিল আবার শিয়া ধারার রাজনৈতিক ইসলামের ঘোর বিরোধী।  আমাদের স্মরণ রাখা দরকার পাকিস্তান যখন মুজাহিদিনদের গ্রুপগুলি গড়ে তোলা হচ্ছে ওই একই সময় ইরানে শিয়া ধারার রাজনৈতিক ইসলাম কিন্তু ক্ষমতা দখল করেছে। ফলে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিরোধী লড়াই যাতে কোনোভাবেই ইরানের শিয়া ধারায় প্রভাবিত না হয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক ইসলামের বিরোধী শক্তি হয়ে না দাঁড়াতে পারে, সেই লক্ষ্য শুরু থেকেই নিয়েছিল পাকিস্তান ও আমেরিকা। হেকমতিয়ার রাজনৈতিক ইসলামের নামে পাকিস্তান ও আমেরিকার এই পলিসিকে সমর্থন করে। আর এই দলটি পেশয়ার কেন্দ্রিক হলেও তাদের কর্ম তৎপরতা ছিল নাংরাহার, উত্তর কুন্দুজ এবং বাগালন প্রদেশে।

খ) মুজাহিদদের দ্বিতীয় ধারার নেতৃত্বে ছিলেন, বুরহানুদ্দীন রব্বানী। তিনি গড়ে তুলেছিলেন জামীয়াত-ই-ইসলামী নামে সুন্নিভিত্তিক আর একটি রাজনৈতিক ইসলামিক দল। এই ধারার সামরিক নেতা ছিল আহমেদ শাহ মাসুদ। হেকমতিয়ারের ধারার সঙ্গে তাদের নীতিগত পার্থক্য ছিল দুটি প্রশ্নে। রাব্বানী গ্রুপ হেকমতিয়ার হিজবের কট্টর শিয়া বিরোধিতা মেনে নেননি। অন্যদিকে তারা সুন্নি ধারার রাজনৈতিক ইসলাম চর্চার ক্ষেত্রে পশতুন গোত্রের প্রাধান্যেরও বিরোধী ছিলেন। ফলে জামীয়াত-ই-ইসলামী এই ধারাটি প্রধানভাবে মিশ্র জাতীয়তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ইসলাম গড়ে তুলতে চেয়েছিল। এর মধ্যে আহমেদ শাহ মাসুদ নিজেই ছিলেন তাজিক।

গ) সুন্নি ধারার তৃতীয় দলটির নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুর রব এবং রাসুল সাইয়াফ। তাদের রাজনৈতিক দলের নাম ছিল ইত্তেহাদ-ই-ইসলামী বারা-ই-আজাদি আফগানিস্তান। এই দলটি সরাসরি সৌদি সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গড়ে উঠেছিল। সৌদি পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়ন করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। এই ধারাটিও ছিল কট্টর শিয়া বিরোধী। মূলত লাদেনের নেতৃত্ব সৌদি, সুদান, লেবানন, প্যালেস্টাইন, চেচেন, ফিলিপাইন, আলজেরিয়া, কেনিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে যে সব স্বেচ্ছাসেবক আফগান যুদ্ধে শামিল হয়েছিল তারা আলকায়দা গড়ে ওঠার আগে এই ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিল। আলোচিত এই তিনটি ধারা সোভিয়েত মুক্ত আফগানিস্তানে একটি সুন্নি ধারার ইসলামিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার লড়াই জারি রেখেছিল। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন।

সনাতন মুসলিম ঐতিহ্যবাহী ধারা

সনাতনি মুসলিম হিসেবে পাঁচটি ধারা আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। তাদের মূল লক্ষ্যই ছিল সোভিয়েত মুক্ত আফগানিস্তান। যুদ্ধ শেষে অংশগ্রহণকারীদের সনাতন গোত্র জীবনে ফিরে যাওয়া। তবে যুদ্ধ শেষে বাদশাহ জহির পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসুক এটাই তারা চাইতেন। এই ধারাগুলি হলো;

ক) হিজব-ই-ইসলামী। আব্দুল হক ছিলেন এই গ্রুপের নেতা। তাদের কাজের ভিত্তি ছিল কান্দাহারে গিলজাই পশতুনদের মধ্যে। হেকমতিয়াও কাজের ভিত্তি ছিল গিলজাই পশতুনদের মধ্যে। কিন্তু এই দুই ধারার মধ্যে পার্থক্য ছিল আব্দুল হকের হিজব-ই-ইসলাম ছিল সুন্নি ধারার রাজনৈতিক ইসলামের ঘোর বিরোধী। পূর্ব আফগানিস্তানের উলামা শ্রেণি ছিল এই ধারার মূল পৃষ্ঠপোষক।

খ) হরকত-ই-ইনকিলাব-ই-ইসলামি। এই দলের নেতা ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য মৌলভী নবী মুহাম্মাদ। এই ধারাটি ছিল আবার পশতুন সুফি ঘরানার অনুসারী। তারাও ছিল সুন্নি ধারার রাজনৈতিক ইসলামের ঘোর বিরোধী। তারা লড়াই গড়ে তুলেছিল লেগার প্রদেশ ও হেলমান্দ উপত্যকায়।

গ) মাজাহ-ই-মিল্লি-ই-ইসলাম। কাদেরিয়া তরিকা অনুসারী সুফি সৈয়দ আহমেদ জিলানি ছিলেন এই ধারার নেতা। এই ধারাটিও ছিল রাজনৈতিক ইসলামের ঘোর বিরোধী। উত্তর-পশ্চিম তুর্কেমেন এবং কান্দাহারের পাশে তাদের ছিল ব্যাপক সমর্থন।

ঘ) যাবহা-ই-নাজাত মিল্লি। এই ধারার নেতা ছিলেন সেবাগাতুল্লাহু মুজাদ্দেদীর। তিনিও ছিলেন রাজনৈতিক ইসলামের ঘোর বিরোধী। ১৯৮৮ সালে তাকে প্রবাসী আফগান সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও ঘোষণা করা হয়। ১৯৯২ সালে নাজিবুল্লাহ পদত্যাগ করলে তিনি আফগান মুজাহেদীন সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন কিছু দিন।

ঙ) হাজারাজাত শূরা। এটা ছিল আফগান হাজারা শিয়া সম্প্রদায়ের একটি সনাতন গ্রুপ। এটা গড়ে উঠেছিল প্রধানভাবে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে। বিশেষ করে ইরানে রাজনৈতিক শিয়া ধারাটি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানে বিভিন্ন সুন্নি ধারার পক্ষ থেকে তাদের উপরে আক্রমণ নেমে আসে। তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারাও একটি সামরিক শাখা গড়ে তোলে। পরে সাজমান-ই-নসর-ই-আফগানিস্তান নামে শিয়াদের আর একটি ধারা গড়ে ওঠে। সোভিয়েত সেনাবাহিনী আফগান ত্যাগের পর উল্লেখিত দুটি ধারা মিলিতভাবে হিজব-ই-ওয়াহাদাত নামে একটি দল গঠন করে।

আলোচিত এই দলগুলি ছাড়া জেনারেল আব্দুর রশিদের নেতৃত্বে উজবেক জনগোষ্ঠীর আর একটি সামরিক শাখাও সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধ গড়ে তুলেছিল। আমি এ পর্যন্ত যতটুকু তথ্য উল্লেখ করলাম, সেখানে কিন্তু তালেবানদের নাম নেই। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে তালেবানদের কোনো ভূমিকা নেই এটাই কিন্তু বাস্তব।

তালেবানদের উত্থান ও বেনজির ভুট্টোর শাসনামল

১) মূলত সোভিয়েত সমর্থিত আফগানিস্তানের শেষ রাষ্ট্রপতি ছিলেন নাজিবুল্লাহ। তিনি ১৯৯২ সালে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেন। এরপরে দেশটিতে একটি সংকট তৈরি হয়। তখন মুজাহিদিনদের মধ্যে সামরিক দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালি দল ছিল আহমেদ শাহ মাসুদের মিশ্রসেনাবাহিনী। এটা ছিল প্রধানভাবে তাজিক জনগোষ্ঠী নির্ভর। কিন্তু গোটা আফগানিস্তান তাদের কব্জায় ছিল না। এই ধারাটি কয়েক দফা সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু হেকমতিয়ার রাজনৈতিক দল তা মেনে নেয়নি। তারা আমমেদ শাহ মাসুদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। অর্থাৎ রাশিয়ার সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে আফগানিস্তানে মুজাহিদিনদের যে গ্রুপগুলি গড়ে ওঠেছিল তাদের মধ্যে প্রতিদিনই ক্ষমতা দখল নিয়ে যুদ্ধ একটা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় বা ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন বেনজির ভুট্টোর রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)।

মূলত বেনজির ভুট্টোর সরকারও ছিল জোট সরকার। এই জোট সরকারের মধ্যে ছিল জামিয়ত-ই-উলামা-ইসলাম বা জেইউআই নামে আর একটি শরিয়া ভিত্তিক ইসলামিক রাজনৈতিক দল। যাদের আরেকটি পরিচয় হলো এই ধারাটি ব্রিটিশ আমলে থেকেই দেওবন্দ ঘরানা হিসেবে পরিচত। বেনজির ভুট্টো ক্ষমতায় আসের আগেই সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙে গিয়েছে। ফলে এক কালের সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত মধ্য এশিয়ার স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে আফগানিস্তানকে মিলিয়ে যে বিশাল ভূ-ভাগ, সেখানে পাকিস্তানে স্বার্থ কিভাবে রক্ষা করা যায় এটা ছিল বেনজিরের একটি বড় পরিকল্পনা। যার সঙ্গে কম্পিয়ায় অঞ্চলের তেল ও গ্যাসের রাজনীতিও ছিল যুক্ত। কিন্তু সংকট ছিল অন্য জায়গায়। সেটা হলো রাশিয়ার সেনাবাহিনী আফগান ছাড়লেও বা তাদের সমর্থিত সরকার পদত্যাগ করলেও যুদ্ধে কিন্তু থামেনি।  ফলে বেনজির ভুট্টো তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জামিয়ত-ই-উলামা-ইসলাম এর নেতা মাওলানা ফজলুর রহমানকে পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার সুন্নি ধারার এই রাজনৈতিক দল জামিয়ত-ই-উলামা-ইসলামের সঙ্গে কিন্তু আবার পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামের ছিল ঘোর দ্বন্দ্ব। ফজলুর রহমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি অনেকগুলি রাষ্ট্র সফর করেন।

অন্যদিকে ফজলুর রহমানের দল আফগান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাক-আফগান সীমান্তের পশতুন ও বেলুচিস্তানে গড়ে তুলেছিলেন অসংখ্য মাদ্রাসা। সেখানে পাকিস্তানের ছাত্রদের পাশাপাশি শিক্ষার সুযোগ পেত শিক্ষা বঞ্চিত আফগান শিশু ও কিশোর শরনার্থীরা। মাদ্রাসা থেকে তাদের খাওয়া,পরা ও সামরিক প্রশিক্ষণের সুযোগও করে দেয়া হয়। কিন্তু আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ মোকাবেলা করে রাজনৈতিকভাবে কোনো একক শক্তির পক্ষে ক্ষমতা দখলের রাস্তা তৈরি করে দেয়া ফজলুর রহমানের দলের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। এই পরিস্থিতিতে দেওবন্দের অপর শাখাগুলির সঙ্গে যোগাযোগ ও ঐক্য তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

জামিয়ত-ই-উলামা-ইসলাম ছিল দেওবন্দের আর একটি শাখা। এর নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তানের সংসদ সদস্য মাওলানা সামীউল হক। সামীউল হক পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আখোরা-খাটাক অঞ্চলকে ভিত্তি করে গড়ে তুলেছিলেন দারুল উলুম হাক্কানিয়া মাদ্রাসার একটা বিশাল নেটওয়ার্ক। এই মাদ্রাসায় ১৯৯১ সাল থেকে তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান ইত্যাদি দেশ থেকে রাজনৈতিক ইসলামী ভাবধারায় অসংখ্য ছাত্র পড়তে আসত । এ ছাড়া পাকিস্তানের করাচি ভিত্তিক দেওবন্দিদের জামিয়ত-উল-উলুম ইসলামীয়া নামে মাদ্রাসা আর একটি শাখা ছিল। মৌলভী ইউসুফ বিনোরী ছিলেন এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। মূলত এই তিনটি মাদ্রাসার শাখা-প্রশাখা থেকেই আজকের আলোচিত তালেবানদের সৃষ্টি করা হয়। এখানে তথ্য হিসেবে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার মোল্লা উমর ১৯৯৯ সালে যে মন্ত্রীসভা গঠন করেন সেখানে আটজন মন্ত্রী ছিল হাক্কানিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র।  একই সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে যখনই মোল্লা উমরের নতুন লোকবলের প্রয়োজন হয়েছে তখনই মাওলানা সাফী তার মাদ্রাসা সময়িকভাবে বন্ধ করে হাজার হাজার ছাত্রকে যুদ্ধের মাঠে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দল হিসেবে তালেবানরাও ছিল কিন্তু পশতুন গোত্র নির্ভর। তবে হেকমোতিয়ারের সঙ্গে তাদের একটি বড় ধরণের পার্থক্য রয়েছে। হেকমতিয়ার হিজবে ইসলাম ছিল গিলজাই পাশতুনদের দল।  আর তালেবানরা হলো প্রধানভাবে দূররানী পশতুনদের দল। রাজনৈতিক ইসলামের এই ধারাটি গোড়া শরিয়াপন্থী। দেওবান ঘরানার ছাত্রদের নিয়ে যখন তালেবানদের গড়ে তোলা হয় তখন পাকিস্তান ভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে সিপাহি-সাহাবা নামে আর একটি দল তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এই সিপাহি-সাহাবা দলটি ছিল কট্টোর শিয়া বিরোধী। এরা পাকিস্তানে শিয়া সম্প্রদায়ের শতশত মানুষকে হত্যা করেছিল। এই অপরাধে পাকিস্তান সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। এরাও তালেবানদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।  এ লেখায় আগেই উল্লেখ করেছি, আব্দুর রব এবং রাসুল সাইয়াফের নেতৃত্বে ইত্তেহাদ-ই-ইসলামী বারা-ই-আজাদি আফগানিস্তান নামে আর একটি দল গড়ে উঠেছিল। যাদের লক্ষ্য ছিল সৌদি পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়ন করা। লাদেনের নেতৃত্ব সৌদি, সুদান, লেবানন, প্যালেস্টাইন, চেচেন, ফিলিপাইন, আলজেরিয়া, কেনিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে যে সব স্বেচ্ছাসেবক আফগান যুদ্ধে অংশ নিতে পাকিস্তানে আসে তারাও প্রথমে এই ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরে তারা নিজেদের আলকায়দা নামে পরিচিতি গড়ে তোলে। তারাও এই দ্বিতীয় ধাপের লড়াইয়ে তালেবানদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।

আফগানিস্তানে তালেবানদের প্রবেশ

আফগান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এক সময় অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে বিভিন্ন দলগুলিকে সাহায্য করে আসছিল। সেটা কিন্তু এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। এর কারণ হলো এই দুই দেশের মধ্যে ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারিতে একটা দ্বিপাক্ষিত চুক্তি হয়। কিন্তু এই চুক্তির পরেও সৌদি আরব তালেবানদের জন্য তার সাহায্য অব্যাহত রাখে। এবং পাকিস্তানের বেনজির সরকার তালেবানদের সামরিক সহযোগিতা দেয়া শুরু করে।

তালেবানরা প্রথম আফগানিস্তানে ট্যাঙ্ক, সাজোয়া যান ও ভারী দূরপাল্লার কামান নিয়ে প্রবেশ করে ১৯৯৪-৯৫ সালে। ওই সময় তাদের এয়ার সাপোর্ট দেয় পাকিস্তানের যুদ্ধ বিমান। তারা প্রথমে আফগান-পাকিস্তান সীমানার বাণিজ্যিকেন্দ্র স্পিন বালদাক শহরটি দখল করে  নেয়। এই শহরেই পাকিস্তান ও সৌদি সরকারের সহযোগিতায় লাদেন একটি উন্নতমানের সামরিক কেন্দ্র গোড়ে তুলেছিল। তালেবানরা এই সামরিক কেন্দ্র থেকে ১৮ হাজার কালাশনিকভ রাইফেল, ভারি কামান ও প্রচুর গোলা বারুদ পায়। কিন্তু আফগানিস্তানে ঢুকেই আজকের মত চোখের পলকেই দেশটি তারা দখল করে ফেলেছিল বিষয়টি এমন নয়। আহমেদ শাহ মাসুদের বাহিনী শক্তিশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে তালেবানদের প্রচণ্ড লড়াই করতে হয়েছে। অনেক যুদ্ধে তালেবানদের বড় ধরণের পরাজয় ঘটেছে। তালেবানদের হাতে আহমেদ শাহ মাসুদের প্রথম পরাজয় ঘটে তালোকান যুদ্ধে। এই যুদ্ধে তালেবানদের পক্ষে ১৫ হাজার যোদ্ধা অংশ নিয়েছিল। তাদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ যোদ্ধাই ছিল সৌদি,  সুদানি, লেবানিজ, প্যালেস্টাইন, চেচন, ফিলিপাইন, আলজেরিয়া, কেনিয়া, পাকিস্তান, আফ্রিকান-আমেরিকান ও বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবক। এরা প্রধানভাবে লাদেনের আলকায়দার সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরে আলকাদায় ও তালেবানদের একটি ছোট্ট দল আহমেদ শাহ মাসুদের সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা বলে তাকে হত্যা ও আফগানিস্তান দখলের রাস্তা পরিস্কার করে। এরপরে ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন সৌদির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান প্রিন্স আল ফয়সাল ইসলামাবাদ ও কান্দাহার সফর করে পাকিস্তানের প্রশাসনের সঙ্গে এক বৈঠক করে। ওই বৈঠকে তালেবানরা যাতে দ্রুত কাবুল দখল করতে পারে সেই পরিকল্পনা নেয়া হয়। ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী তালেবানরা জালানবাদ হয়ে মাজার-ই-শরীফ দখল করতে যায়। কিন্তু এখানে ছিল শিয়াদের হাজারাজাত শূরার একটি শক্তিশালী বাহিনী। তাদের সঙ্গে তালেবানদের টানা ১৫ ঘণ্টার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে তালবানদের পরাজয় ঘটে। ৬০০ সৈন্যসহ তালেবানদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোল্লা মোহামদ গাইস, মোল্লা রাজ্জাক, এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মোল্লা এহাসানুল্লাহসহ ১০ জন শীর্ষ নেতা নিহত হয়। ওই সময় তালেবানদের লাইন ছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রে ফিল্ড কমান্ডার হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের পাঠিয়ে দেয়া। এ ঘটনার পরবর্তিতে ১৯৯৮ সালের ৮ আগস্ট তালেবান বাহিনী আবার মাজার-ই-শরীফে হামলা চালায়। যুদ্ধে গুলি ফুরিয়া যাওয়ায় শিয়াদের শহর রক্ষিবাহিনীর দেড় হাজার যোদ্ধা মারা যান। এরপর টানা দুইদিন তালেবানরা শহরের নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। যা হালাকুসম হত্যাকাণ্ড নামে খ্যাত। তালেবানদের এই যুদ্ধের কমাণ্ডার ছিল দোস্ত মোহাম্মাদ। তিনি হাজারা সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করে ৪০০ হাজার নারীকে যুদ্ধবন্দি দাসী হিসেবে নিয়ে যায়। একই সঙ্গে দোস্ত মুহাম্মাদের দল মাজার-ই-শরীফে ইরানি দূতাবাসে হামলা চালিয়ে ১১জন কূটনৈতিককে হত্যা করে। ১৯৯৮ সালের ১৩ই সেপ্টম্বর বামিয়ানা প্রদেশ দখল করে। পালাতে অক্ষম ৫০ জন বৃদ্ধা-বৃদ্ধকে হত্যা করে এই বাহিনী। মূলত তালেবানরা যখন আফগানিস্তান দখলের যুদ্ধে শুরু করে তখন ওই যুদ্ধে প্রায় ১ লাখ মানুষ মারা যায়।

লাদেন প্রসঙ্গে

বিন লাদেনকে আফগান যুদ্ধে নিয়োগ করেছিল সৌদি রাজ পরিবার। পরে ইরাক যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হয়। তবে মার্কিনিদের সঙ্গে তার বিরোধ শুরু হয় ১৯৯৬ সাল থেকে। ১৯৯৮ সালের আগস্টে কেনিয়া ও তানজানিয়ায় আমেরিকান দূতাবাসে আলকায়দা হামলা চালালে ২২৪ জনের মৃত্যু হয়। তখন সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে।  তার আগে লাদেনের আল কায়দা ১৯৯২ সালে এডেন, ১৯৯৩ সালে নিউ  ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও সোমালিইয়ায়, ১৯৯৫ সালে রিয়াদে, ১৯৯৬ সালে দাহারানে মার্কিন স্বার্থের উপরে আঘাত হেনে, সুদানে আশ্রয় নিয়েছিল। আমেরিকার চাপে সুদান সরকার তাকে ওই দেশ থেকে বহিস্কার করে। ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন Anti Terroisn Act তৈরি এবং সন্ত্রাসবাদী দলগুলির সহায়-সম্পত্তির উপর ক্রোক-পরওয়ানা জারি করে। এই আইনের আওতায় বিন লাদেনের ৩০০ মিলিয়ন মূল্যের সম্পদ ক্রোক করা হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে লাদেন আফগানিস্তানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন থেকেই আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের উপর লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। এরপরে ১১ সেপ্টম্বর আমেরিকা নিজে আক্রান্ত হলে লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের উপর চাপ আরও বাড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় আফগানিস্তানে মার্কিনিরা ব্যাপক সামরিক হামলা চালায়। তালেবান সরকারের পতন ঘটায়।

No description available.

৩ Comments

  1. Ifat Sharmin

    দুর্দান্ত নিরীক্ষণধর্মী লেখনী।

    Reply
  2. স্বপন মাঝি

    তালবানদের সম্পর্কে কম জেনে, মনগড়া কথা বলে যাচ্ছেন অনেকে, প্রগতিশীলদের কেউ কেউ রয়েছেন এই তালিকায়।
    পড়তে বসে আর উঠতে পারি নি। অবাক হয়েছি নিজের অজ্ঞতায়, মুগ্ধ হয়েছি লেখকের নিষ্ঠায়।

    Reply
  3. শেখ খলিল শাখা নির্ভানা

    তালেবান বিষয়ক রচনাটি যথেষ্ট তথ্যনির্ভর। বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহাসিক দলিল থেকে বিভিন্ন ঘটনা পঞ্জি তুলে আনা হয়েছে, যে গুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।

    Reply

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার

%d bloggers like this: