Select Page

পরিশ্রমই কি অর্থ-বিত্তের, সফলতার চাবি কাঠি?

পরিশ্রমই কি অর্থ-বিত্তের, সফলতার চাবি কাঠি?

অনলাইনে এখন অনেক ব্যক্তিত্ব দেখা যায় যারা আসলে করেন ব্যবসা কিন্তু নিজেদের উপস্থাপন করেন সমাজসেবী বা এক্টিভিস্ট হিসেবে। এরা এমন সব কথা বার্তা বলে বা লেখে যেগুলো পড়লে মনে হয় যে তাঁরা সুপার হিউমেন আর বাকী সাধারন মানুষ যারা তাঁরা সব অপদার্থ, কোন কাজের না, এবং তাদের মত হতে না পারলে সে জীবন বৃথা। এমন সব কথা দিয়ে কি মানুষকে মোটিভেট করা যায় নাকি এতে অনেকে হীনমন্যতায় ভোগে? এটা আপনার ব্যবসার প্রচার বা আত্বপ্রচার হতে পারে, কিন্তু কোন ভাবেই সমাজ সেবা বা এক্টিভিজম নয়।

একেক মানুষের জন্ম, বেড়ে উঠা, পারিবারিক অবস্থান, তার দুর্বলতা, মানসিক গঠন, তার ভাল লাগা, মন্দ লাগা অনুভূতি, বিশ্বাস, তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা পরপম্পরা কোন কিছুই আপনার সাথে বা আরেক জনের সাথে পুরো মিলবে না। তাহলে আপনি এটা পারছেন, ওটা পেরেছেন, এই করেছেন, সেই করেছেন, আপনি বিরাট সুখী, কিন্তু অমুক, তমুক এরকম পারে না কেন, না পারলে তাঁরা একদম নগন্য হয়ে গেল এসব কথা বলেন কি করে? আপনি নিজেকে নিয়ে এত আত্বপ্রচারে ব্যস্ত যে আশেপাশে ভাল করে মানুষের জীবন খেয়ালই করেন নি। যেমন আজ একজন মহিলা ‘সেলিব্রেটির’ লেখা দেখলাম ফেসবুকে যে তিনি নিজেই নিজের সংসার খরচ চালিয়ে, নিজের উপার্জনে বাড়ি পর্যন্ত করে ফেলেছেন, বেশ কিছু ব্যবসা আছে তার, কারন তার পাশে কেউ ছিল না। তাই নিজের ক্ষুধা তার নিজের মেটাতে হয়েছে, তাই সে আজ এত কিছু করতে পেরেছে। তার খোঁচাটা অনেক গৃহিণী কিংবা কর্মজীবী নারীও যিনি নিজের বাড়ি করতে পারেন নি, অর্থ বিত্তের মালিক হতে পারেন নি তাদের দিকে ছিল। এটা কি ধরনের কথা, কি ধরনের বার্তা দিচ্ছে মানুষকে?

এখন অনেক মহিলাই পুরোদমে  অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত থাকে, সংসারের সব খরচ চালায়। অথচ তাদের বাড়ি করার মত পয়সা তো দূর সেভিংস ও নেই। তার মানে এই সব মহিলারা নিজেদের দোষে ব্যর্থ? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি যত মহিলা আমাদের বাসায় কাজ করেছেন তাদের সবাই অসম্ভব পরিশ্রমী। সংসার চালানো, কিস্তি চালানো, মেয়ের জন্য যৌতুক, ছেলের বায়না, স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতা সব কিছু সামাল দেন উনারা। সারা দিন গাধার খাটুনি খেটেও এরা বস্তিতে থাকে। এসব মহিলা আপনাদের হিসাবের বাইরে। আবার অনেক গৃহিণী এমন ভাবে হয়ত জটিল কোন সমস্যার আবর্তে জড়িয়ে থাকেন যে তার পক্ষে বের হয়ে আসা এই সমাজের প্রেক্ষাপটে সম্ভব হয় না। আবার অনেকের বুদ্ধি, সামজিক অবস্থান বা আরও অনেক কারনে তাঁরা আপনার মত ব্যবসায়িক বুদ্ধি ধারন করেন না হয়ত; আবার চাকুরি করার যেটুকু যোগ্যতা তার আছে তাতে হয়ত তার সংসার চলবে না বাচ্চা, কাচ্চা নিয়ে। এমন বহু রকমের ভিন্ন প্রেক্ষাপট, কারন থাকতে পারে। তাই আপনার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়ে আরেকজনকে জাজ করা মূর্খতা বা কোন অন্য উদ্দেশ্যজনিত কারনে।

আমি একটি মেয়েকে খুব ছোট বেলা থেকে চিনতাম, আমার খেলার সাথী ছিল শৈশবে। তার মা, বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তার ছোট বেলায়। মা তার মামাদের সংসারে এসে উঠেন। মামারা গরীব হলেও বোনকে কোথাও কাজ করতে দেয় নি। কড়া বারণ ছিল তাদের। সংসারে অভাব-অনটন ছিল ভালই। তাই মেয়েটির পুষ্টিকর খাবার খাওয়া তো দূর পেট ভরে খাওয়া হত না। লেখা পড়াও তাই বেশি দূর এগোয়নি।কিন্তু মেয়েটির আত্বসম্মান বোধ ছিল প্রবল, সংগ্রামী ছিল সে। একটু বড় হতেই সে সেলাই এর কাজ শুরু করে। কিন্তু তাতে উপার্জন বেশি হত না তার। এরপর একটা সময় তার বিয়ে দেয়া হয়। স্বামীটি ছিল প্রতারক। বিয়ের সময় যৌতুক দেয়া হয়। সব টাকা জলে গেল। অত্যাচারিত হয়ে আবার মামাদের বাড়ি ফেরত আসল সে। অপমানে, মামীদের তির্যক বাক্যবাণে জীবন তার অসহনীয় হয়ে উঠল। এক পর্যায়ে দালালদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে গেল গার্মেন্টসের কর্মী হয়ে। দু বছর হবে বোধ হয়, ঠিক স্বরন নেই আমার, এরপর সে দেশে চলে আসতে বাধ্য হল। যা কিছু উপারজন করেছিল তা দিয়ে মাকে নিয়ে আলাদা একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করল। আবার সেই সেলাই এর কাজ। এর মাঝে তার মায়ের বিরাট অসুখ হল, হৃদযন্ত্রের। যমে মানুষে টানা টানি হল। মেয়ের সেবায়, যত্নে মা সুস্থ হল। জীবন সংগ্রামে আর পেরে উঠছিল না মেয়েটি। ক্লান্ত হয়ে পরল, সবাই বুঝাতে লাগলো আবার বিয়ে করতে। একটা সময় সে রাজি হল, এক বিপত্নীক, তিন সন্তানের পিতা, বয়স্ক লোকের সাথে বিয়ে হয়ে গেল তার। মা, মেয়ে দুজনেই ভাবল এবার তাদের আর মামীদের অপমান সইতে হবে না, পেট পুরে ভাত খেতে পারবে। অভাবের জ্বালা আর সইতে হবে না। সত্যি তাই হল।  আমাদের বাসায় আসত মাঝে মাঝে বেড়াতে, বলত ‘আমার বাসায় এখন আর ভাতের অভাব নেই। এখন আর কেউ আমাকে ‘এক্সট্রা লোক’ বলে খোটা দিতে পারবে না’ (তার এক মামী তাকে এক্সট্রা লোক কেন খাবে আমার বাসায় বলে খোটা দিত সব সময়)। দুটো সন্তান হল তার পিঠা পিঠি। ছোট সন্তান যখন দেড় বছর, এরকমই হবে, তখন জ্বর হল মেয়েটির। কিছু দিন ভোগার পর ধরা পরল ব্লাড ক্যান্সার। ১৫ দিনের মাথায় তার মৃত্যু হল। সে আমার ছোটবেলার খেলার সাথী ছিল। তার এভাবে মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারিনি, বহু দিন ট্রমায় ভুগেছি। এখন বলুন এই মেয়েটি কোন দিক থেকে কম সংগ্রামী, কম আত্বসম্মানহীন ছিল? এরকম আরও বহু মেয়ে আমাদের সমাজে, আপনার আশেপাশেই আছে। আপনি খেয়াল করেন না তাদের, বা তাদের মানুষ বলে হয়ত সেভাবে গণ্য করেন না। তাই আমাদের দেশের অসংখ্য গৃহকর্মী, গার্মেন্টস কর্মী, নারী শ্রমিক, মধ্যপ্রাচ্যের দাসীর জীবন যাপন করা নারী শ্রমিক তাদের যে অবদান তাদের সংসারে, এই দেশের অর্থনীতিতে, তাদের যে অমানুষিক পরিশ্রম ও বঞ্চনা, শোষণের জ্বালা তা আপনাদের লেখায় কখনই আসে না। তাঁরা যেন আপনাদের চোখে ‘ইনভিসিবল’ বা অদৃশ্য। এত বিপুল সংখ্যক কর্মঠ নারীদের কোন বিত্ত নেই, তাই তাঁরা বিবেচ্য নয় আপনাদের লেখায়। বিত্ত, অর্থ, নেইম, ফেইম এই হল আপনাদের জাজ করার মানদণ্ড। সত্যি কথা হল আপনারা বিত্তের মালিক হয়েছেন কেবল পরিশ্রম দিয়ে নয়, শাসক শ্রেণীর আনুকুল্যে, তাদের পা চেটে, তেল মেরে। আপনারা ব্যবসা করেন এই সমাজের অসুস্থতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে। ডাক্তারদের যেমন রোগ বাড়লে আয় বাড়ে, উকিলদের যেমন অপরাধ বাড়লে ব্যবসা পসার হয়, তেমনি এই সমাজ যে ভয়ংকর ব্যাধিগ্রস্ত তার সুফল ভোগকারী বেনিয়া আপনারা। কেবল পরিশ্রম, সততা, আর সৎ বুদ্ধি দিয়ে এই সময়ে কেউ বিত্তশালী হতে পারে না। তাহলে রিকশা চালক, কৃষক আর শ্রমিকরা যে এত পরিশ্রম করেন তাঁরা কেন সারা জীবন অভাবে থাকেন? এবার কি বলবেন যে এটা তাদেরই বুদ্ধির দোষ?

৩ Comments

  1. ফৈয়জ

    অর্থবিত্তের সাথে পুঁজির সম্পর্ক আছে। যে পরিশ্রমের সাথে পুজির যত বেশি ঘনিষ্ঠতা থাকবে, সেই ধরনের পরিশ্রমের সাথে অর্থবিত্তের নৈকট্য লাভের সম্ভাবনা তত প্রবল হবে। যে কারণে Microsoft কোম্পানিরএকজন শ্রমিকের অর্থবিত্ত এবং একজন বঙ্গীয় রিক্সা চালকের অর্থবিত্ত একরকম নয়।‌ বলার অপেক্ষা রাখে না যে Microsoft এর সাথে বৈশ্বিক পুঁজিবাদের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।

    Reply
  2. eklotan

    পরীক্ষামূলক মন্তব্য।

    Reply

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার

%d bloggers like this: