বৃৎ ধাতু থেকে জাত শব্দগুচ্ছ
বৃৎ ধাতু থেকে জাত শব্দগুচ্ছ
শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র
বর্ত্ত, বৃত্ত, বৃত্তি, উদ্বৃত্ত, প্রবর্ত্তন, বিবর্ত্তন, বর্ত্তমান, বার্ত্তা, বার্ত্তিক, বৃত্তান্ত ইত্যাদি শব্দগুলির অর্থ একত্রে বিবেচনা করলে অর্থবোধের খুবই সুবিধা হয়। এইসব শব্দগুলি বৃৎ ক্রিয়ামূল থেকে জাত হয়। মৎপ্রণীত পদ্যাভিধান ‘বর্ণসঙ্গীত’-এর ‘বার্ত্তিক’ কবিতায় বৃৎ ক্রিয়ামূলে জাত এইসব শব্দগুলির অর্থ আলোচিত হয়েছে। নিম্নে সেই ‘বার্ত্তিক’ কবিতাটি উদ্ধৃত করছি। এর থেকে উপরিউক্ত শব্দগুলির ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ যেমন বুঝা যাবে, তেমনি শব্দগুলিতে ত-এর দ্বিত্ব হয় কেন হয় তাও বুঝা যাবে। অবশ্য বর্তন, বিবর্তন ইত্যাদি বানানও (দ্বিতহীন) শুদ্ধ বলে বিবেচিত হয়; সেই কথাও গোড়াতেই বলে রাখা ভাল।
বার্ত্তিক
বৃৎ ধাতু আর অ জুড়লে বর্ত্ত হয়ে যায়,
নিজেকে কেন্দ্র করে ঘুরে সত্তা বর্ত্তে যায়।
বর্ত্তন মানে বৃত্তি জীবিকা, স্বপথে আবর্ত্তন;
ভিন্ন পথেতে বর্ত্তালে কেহ তা হয় বিবর্ত্তন।
নিজ আবর্ত্তে ঘুরছে যা তাই বর্ত্তমান;
মনে হয় তা দাঁড়িয়ে আছে, আসলে ঘূর্ণ্যমান।
বর্ত্তমানেরা স্থির জড় ও অনড় অচল নয়,
জীবন ধরে বাঁচতে হলে বর্ত্তে ঘুরতে হয়।
প্রকৃষ্ট রূপে বর্ত্তন হলে তাই প্রবর্ত্তন,
উদলোকে কিছু বর্ত্তিত হলে তা উদ্বর্ত্তন।
বিবর্ত্তনেতে ”যোগ্যতমের উদ্বর্ত্তন” হয়,
তবু একসাথে মিলে সব প্রজাতি বর্ত্তে রয়।
বৃৎ ধাতু আর ত জুড়ে দিলে বৃত্ত হয়ে যায়,
নিজেকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণন তারিত হবে তায়।
বৃত্ত মানে অতীত, বিগত ও চরিত্র হয়;
বৃত্তভঙ্গ চরিত্রনাশ তাতে নেই সংশয়।
একটি বিন্দু থেকে সমদূরে অন্য ছুটে যায়;
পাই গোলাকার ক্ষেত্রভেদ, বৃত্ত বলি তায়।
বৃত্তের পথে ঘুরে ধরা, সূর্য্য কেন্দ্রে রয়,
তার ফলেই ক্রান্তিবৃত্তে সৌরবৃত্তি হয়।
বৃত্ত যাতে সক্রিয় হয় বৃত্তি বলব তায়;
জীবিকা, বেতন, কর্ত্তব্য বৃত্তি হয়ে যায়।
কৃষিবৃত্তিতে বৃত্তন করে অনেক ধান্য হয়,
বেঁচেবর্ত্তেও বাঁচে যদি ধান তা উদবৃত্ত হয়।
উঞ্ছশীলেরা ধানশিষ নিয়ে উঞ্ছবৃত্তি করে,
ছাত্র বৃত্তি পরীক্ষা দেয় বৃত্তি পাবার তরে।
মনের মাঝে মনোবৃত্তি বা মনের শক্তি রয়,
শব্দের অর্থ প্রকাশশক্তি শব্দবৃত্তি হয়।
বৃত্তি শব্দ হতে বার্ত্ত শব্দ প্রসূত হয়;
বার্ত্ত মানে ভব্য, সুস্থ অর্থাৎ অনাময়।
বার্ত্ত লোকেরা বৃত্তিমান ও নানা কর্ম্মময়,
বার্ত্তাবাহক বার্ত্ত লোকের সকল বার্ত্তা বয়।
বার্ত্তা কেবল কিংবদন্তী এবং খবর নয়,
বার্ত্তা বর্ত্তে থাকার আধার ও বৃত্তান্ত হয়।
কৃষিবাণিজ্যপশুপালনাদি বার্ত্তা হয়ে যায়,
বার্ত্তা মানে বৃত্তি ও অনর্থোবারণোপায়।
ধরাধামে অতি বিখ্যাত পাণিণির ব্যাকরণ,
সেই গ্রন্থের বার্ত্তিক এক লিখল কাত্যায়ন।
পাণিণি মুনির বার্ত্তা বুঝতে পড় সেই বার্ত্তিক,
তিনি পাণিণির সূত্র বাখ্যা করলেন ঠিকঠিক।
বৃত্ত, বৃত্তি, বর্ত্তমান, বিবর্ত্তন ইত্যাদি শব্দগুলি একসূত্রে গাঁথা। সুতরাং হঠাৎ করে ‘বিবর্তন’ বানান লিখতে একটু অসুবিধা হতে পারে। অন্ততঃ ‘বিবর্ত্তন’ বানান মোটেই ভুল নয়, এই বিষয়ে নিঃসংশয় থাকতে পারেন। আগেকার দিনে বর্ত্তমান, বিবর্ত্তন ইত্যাদি বানান লেখা হত। সেগুলি সত্যিই শুদ্ধ। আজকাল বিবর্তন লেখা হয়, আমি সেই বানানকেও গ্রহণ করছি। আপনারা এই বিষয়ে ব্যাকরণের যুক্তি আলোচনা করলে অনেকে উপকৃত হতে পারেন।
এই প্রসঙ্গে আরো বলা যেতে পারে যে কৃৎ ধাতু থেকে যেমন কৃত্ত, কৃত্তি, কার্ত্তিক, কর্ত্তন ইত্যাদি হয়; বৃৎ ধাতু থেকে তেমনি বৃত্ত, বৃত্তি, বার্ত্তিক, বর্ত্তন, বিবর্ত্তন ইত্যাদি হয়। এইসব বানানগুলির সর্ব্বত্র ত-এর দ্বিত্ব (ত্ত) শুদ্ধ হয়।
সঙ্গের ছবিটি জীববিবর্ত্তন বিষয়ক। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। তবে এই বিষয়ে অনেকের একটা ভুল ধারণা আছে, সেটা সংশোধন ক’রে দিই। কেউ কেউ বলেন যে বানর থেকে মানুষ এসেছে। এটা ভুল কথা, ডারউইন এমন কথা বলেননি। ঠিক কথাটা হল মানুষ ও বানর একই পূর্ব্বপুরুষ থেকে এসেছে। বিবর্ত্তনের ফলে পৃথিবীতে নানা জীবপ্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে, সে খুবই আকর্ষণীয় কাহিনী। আগ্রহী ব্যক্তিরা এই ব্যপারে রিচার্ড ডকিন্সের ‘অন্ধ ঘড়ি নির্ম্মাতা’ (The Blind Watchmaker) বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
পরিশেষে এই কথা বলি যে, রেফের নীচে নির্বিচারে দ্বিত্ব বর্জ্জন করার দরকার নেই। বিবর্ত্তন, কার্ত্তিক ইত্যাদি শুদ্ধ বানানগুলিকে অশুদ্ধ বলা চলবে না। সেগুলি যে আসলে শুদ্ধ এই বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলার দরকার আছ। আমি ব্যাকরণে পণ্ডিত নই। আমার ভুল হলে বলুন। ধন্যবাদ।
(রচনাটি এডিট করা হল। অর্থাৎ এটি ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে।)
সাম্প্রতিক মন্তব্য