Select Page

শোভাযাত্রা যখন যুদ্ধযাত্রা, এর নেপথ্যে কী?

শোভাযাত্রা যখন যুদ্ধযাত্রা, এর নেপথ্যে কী?

১লা বৈশাখকে বরণ করার জন্য ঢাকায় চারুকলার আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। সেটার সামনে পেছনে ও চারপাশে যেভাবে নিরপত্তা বাহিনী কর্ডন করে নিয়ে গেলো তাতে এটাকে শোভাযাত্রা মনে হওয়ার পরিবর্তে মনে হয়েছে যুদ্ধযাত্রায় যাচ্ছে কোথাও। বিবিসি শিরোনাম করেছে, ‘Bengali new year parade in Dhaka stands up to militancy.’ এর পরিভ্রমণ পথও ছিলো ভিসি’র বাসভবন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। ভাবটি এমন এই এলাকার বাইরে গেলে নিশ্চিত হামলার সম্ভাবনা!

পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে পূর্ব নির্দেশনা ছিলো দুপুর ২ টার মধ্যে বৈশাখের সকল অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে। সময় বেধে দেওয়া, শোভাযাত্রাকে স্বল্প গন্ডির মধ্যে আটকে ফেলা, সর্বোপরি যুদ্ধযাত্রার আদলে শোভাযাত্রা দেখে এটাই মনে হলো দেশের সংখ্যালঘু অংশের মানুষের চাওয়াকে পূরণ করতে যেয়ে সরকার এই সকল ব্যবস্থা নিয়েছে।

সরকার তার আচারণ ও কার্যক্রমের মাধ্যমে এটা প্রতীয়মান করেছে ১লা বৈশাখ উদযাপন এখন দেশের সংখ্যালঘু মানুষের আকাঙ্খা। সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এটা চাচ্ছে না। তারপরেও তারা উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সংখ্যালঘু অংশের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করেছে। দেশে অপরাপর যেসকল রাজনৈতিক দল আছে তারা ক্ষমতায় থাকলে এই সুযোগ আরো সীমিত হয়ে আসবে। আসুন, তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে উঠি!!

নিজেদের ক্ষমতাতন্ত্র-লুটপাটতন্ত্র-গুন্ডাতন্ত্রকে চীরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার জন্য এক নোংরা অপরিনামদর্শী খেলায় মেতে উঠেছে। তারই অংশ হিসাবে সমাজের অভ্যন্তরে আরোপিত বির্তক উত্থাপন করছে। ক্ষমতাসীন সরকারের এই পরিকল্পনা অনুসারে দুই পক্ষ পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে। দেশের সকল সংকট ‘ইসলামে কী করা যাবে, আর কী যাবেনা’ এই বির্তকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে! ঠিক যেমনটি শাসকগোষ্ঠী চাইছে।

বর্তমানের এই অবস্থাটি বোঝার জন্য আমাদের একটু পেছনের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। ’৭১ এর রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ধর্ম নিরেপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। এই ধর্ম নিরেপেক্ষ দেশটিই ১৯৭৪ সালে, বলা যায় বঙ্গবন্ধুর একক সিদ্ধান্তে ওআইসিতে যোগ দেয়। তাজউদ্দিন আহমেদ তাঁর বিরোধিতা করে বলেছিলেন,‘ধর্ম নিরেপেক্ষ একটি দেশ হিসাবে আমরা ওআইসিতে যোগ দিতে পারিনা’।

বাংলাদেশ যখন ওআইসিতে যোগ দিয়েছে অর্থাৎ সেই ’৭৪ সাল থেকেই তার ধর্ম নিরেপেক্ষ চরিত্র বিলীন হয়েছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশাতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম একটি স্তম্ভকে (ধর্ম নিরেপেক্ষতা) জলাঞ্জলি দেন। তিনিই বাংলাদেশেকে মুসলমানের দেশে হিসাবে বিশ্বের কাছে পরিচিত করান। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শুরু হয় তখন থেকেই।

জিয়াউর রহমান এর সময়ে ওআইসিতে বাংলাদেশের অবস্থান আরো সুসংহত হয়, এরশাদের সময় এটা আরো বেশি দৃঢ় হয়, যেহেতু তিনি বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের তুলনায় বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। এরশাদ সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রর্ধম হিসাবে যুক্ত করে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার পাকাপোক্ত করেন। আজকের আওয়ামী লীগ ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ সাথে নিয়েই পথ চলছে। জিয়া ’৭৭ সালে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে যেটা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু সময় পেলে সেই একই কাজটি করতেন বলেই আমার মনে হয়। অন্তত এ বিষয়ে জিয়া বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই হেঁটেছে, এরশাদ জিয়ার দেখানো পথে আর আজকের আওয়ামী লীগ এরশাদের দেখানো পথে!

কোন পার্থক্য খুঁজে পান? প্রকৃত অর্থে কোন পার্থক্য নেই। একটা পার্থক্য অবশ্য আওয়ামী লীগ দেখাতে চায়। সেটি হলো মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব তার ধর্ম নিরেপেক্ষতার ইমেজ। এই ইমেজ ব্যবহার করেই সে অন্যদেরকে দিকভ্রান্ত করে। দেশে এখন যে বির্তক চলছে (ইসলাম বনাম বাঙালি সংস্কৃতি) এটা যে পরিপূর্ণভাবে ক্ষমতাসীনদের সৃষ্টি সেটি একটু গভীরে চিন্তা করলেই পানির মতো পরিস্কার হয়ে যায়।

যারা ইসলামের দোহায় দিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা, ভাস্কর্য স্থাপন, শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো, টিপ পরা, ফাল্গুন উৎসবসহ প্রচলিত সংস্কৃতিগুলোকে অনৈসলামিক বলে ফেসবুক গরম করছে, অন্যদের চিন্তাকে প্রভাবিত করছে এরা কারা? এদেরকে চিনবেন কিভাবে? এরাই তারা, যারা ইসলাম অনুসারে যে বিষয়গুলি একেবারেই নিষিদ্ধ যেমন ঘুষ, দুর্নীতি, মজুতদারি, আত্মসাৎ, প্রতারণা, খুন-ধর্ষণ, অপরের সম্পদ ভোগ-দখল, সুদ খাওয়া, পাপাচার, ব্যাভিচার ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে নিশ্চুপ থাকে।

যখন মাদ্রাসায় ছাত্র বলাৎকার হয়, দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পায়, ক্ষমতাসীনরা মাদক আর জুয়ার ব্যবসা করে, নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, খাদ্যে ভেজাল মেশানো হয়, শ্রমিক ছাটাই হয়, সড়কে মানুষ হত্যা হয়, আন্দোলন তো পরের কথা, মুখে কুলুপ এটে বসে থাকে, ফেসবুকে এক লাইনের একটা প্রতিবাদও চোখে পড়েনা! অথচ এই সবকিছুই কিন্তু অনৈসলামিক!!

তাহলে এরা কারা, নিশ্চয়ই চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। উপরের যে বিষয়গুলি উল্লেখ করলাম সে বিষয়ে প্রতিবাদ হলে অভিযোগের তীর সরাসরি ক্ষমতাসীনদের দিকে যায়। ক্ষমতাসীনদের অপরিহার্যতার পরিবর্তে পরিবর্তনের দাবি আরো বেশি জোরালো হয়ে ওঠে। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি তখন তাদের বিপক্ষে চলে যায়।

আমাদের তথাকথিত এই মুসলিম তৌহিদী জনতা সেটুকুই বলে যতোটুকু ক্ষমতাসীনরা চায়। যার মাধ্যমে জুজুর ভয় দেখিয়ে তারা তাদের অপরিহার্যতা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়। আর অধিকাংশ প্রগতিশীলরাও সেই স্রোতে ভেসে যায়। তারাও এই মর্মে প্রশ্ন উত্থাপন করে, যে দেশে বাংলা সাল মানা হয়না সেই দেশে পহেলা বৈশাখ এতো ঘটা করে কেনো পালন করতে হবে? আর এই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য পক্ষে ও বিপক্ষে প্রগতিশীলদের আর একটি অংশ ঝাঁপিয়ে পড়ে!

এই দুই অংশই মূলত এ সমস্ত পরিকল্পিত তৈরি করা বিতর্ক উপস্থাপন করার মাধ্যমে জনজীবনের সকল সংকটকে আঁড়াল করে ক্ষমতাসীনদেরকে সেফ জোনে রাখার দায়িত্ব পালন করছে। নির্বাচন যতোই এগিয়ে আসবে এধরনের অপতৎপরতা ততোই বাড়তে থাকবে। মানুষ এসব নিয়েই মেতে থাকবে।

আমাদের তথাকথিত এই ধর্মপ্রাণ তৌহিদী জনতা তাদের নিজেদের জীবনে নুন্যতম ধর্মীয় অনুশাসন মানেনা। মানলে দিনের পর দিন মাদ্রাসায় বলাৎকার আর ধর্ষণের ঘটনা ঘটতোনা। অথচ এরাই পহেলা বৈশাখের কোনটি অনৈসলামিক সেটা নিয়ে বির্তক এবং ফতোয়া জারি করছে! এর সাথে যুক্ত হয়েছে মধ্যবিত্তের একটা অংশ যারা সারাদিন বিভিন্ন অনৈতিক তৎপরতার মধ্যে থাকে আর দিনশেষে ফেসবুকে ধর্মের জ্ঞান বিতরন করে!

বাংলাদেশের প্রত্যেক শাসকগোষ্ঠী ধর্মকে তাদের ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার জন্য ব্যবহার করেছে, এখনো করে যাচ্ছে। সমাজে-রাষ্ট্রে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এর প্রভাবে কিছু মেধাবী যুবক যেমন বিপথগামী হয়েছে, তাদের নিজেদেরকে শেষ করেছে পাশাপাশি অনেক মানুষের জীবন ছিনিয়ে নিয়েছে। আগামীতেও এমন কিছু ঘটবেনা এর নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যাবেনা। কারণ সাপ নিয়ে খেলা করলে সুযোগ পেলে সে ছোবল মারবেই। কিছু ক্ষতি হবে।

বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর ঘেরাটপে পা না দিয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করুন। জন জীবনের প্রকৃত সংকট নিয়ে সংগ্রাম সংগঠিত করা ব্যতীত এই রাহুরগ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবেনা।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার