
এসকেপ ২

হলদেটে চেহারা, কুতকুতে ছোট চোখ আর থ্যাবড়া মুখোটা কাল রাতেও এসেছিল আর ওর বাবাকে ধমকাচ্ছিল।সদ্য ওঠা কালচে গোঁফের আবছা রেখাওয়ালা তের বছরের ছেলেটা একবার বাবার দিকে আর একবার লোকটার দিকে তাকাচ্ছিল। লোকটা তখনো বলছিল ” তোদের বলেছি না শিগগির গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে। কবার বলবো রে শালা? রোজ এক নখড়াবাজি করছিস।কিসের আমড়াগাছি রে তোর?এই শেষবার বলছি কাল সকালের মধ্যে গ্রাম ছাড়বি।না হলে বাঁচবি না বলে দিলাম।”
ওর বাবা ককিয়ে উঠে বলল ” কোথায় যাব ? এখানেই তো জন্মাবদি আছি। বাপ ঠাকুর্দা ও এখানেই জন্মেছে । কোথায় গিয়ে মরব বলুন ?”
” আর এখানে থাকলেও মরবি তুই।” পাশের শতচ্ছিন্ন চটের আড়াল থেকে যে ভীরু মুখের আধেক দেখা যাচ্ছিল সেদিকে তাকিয়ে বলল ” আর তোর ঐ বউটাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে ছেলেরা। পারবি ঠেকাতে? মনে রাখিস কাল সকাল।” থ্যাবড়া মুখোটা বেরিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে।
পরদিন সকালে ওর বাবা গেছিল খামারে । গরু দুটোকে জাব্না দিতে । হঠাৎ আর্ত জান্তব চিৎকার ভেসে এল ওদিক থেকে। ও এক ঝলক তাকিয়ে দেখলো খামারের দিক থেকে ধেয়ে আসছে একদল উন্মত্ত জনতা। তার ফাঁকে দেখল বাবা মাঠে লুটিয়ে পড়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাথা। তার আর চিন্তা বা দোটানায় সময় ছিল না। এক লাফে কুঁড়েঘরে ঢুকে ওর ময়লা চটের আড়াল থেকে মার হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে ঢুকে গেল বাড়ীর পেছনের জঙ্গলে। তের বছরের ছেলে বুঝে গেছে এরপর কি হতে পারে।পেছনে শোনা যাচ্ছিল চিৎকার ” ধর ধর মাগীটাকে ছাড়বি না।”
ও আর ওর মা আরো দুরে জঙ্গল যেখানে ঘন হয়েছে সেদিকে পালাতে লাগলো। জঙ্গলের বাবলাকাটা আর ঝোপঝাড়ে লেগে ওর হাত আর কনুই চিরে ফালাফালা হচ্ছিল। একটা কাটা গাছে আটকে ওর মার পরনের কাপড় ছিড়ে ফালা হয়ে গেল আর ওর হতভাগিনী মা সন্তানের সামনে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে গেল।
তবু ওরা একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে দৌড়াচ্ছিল পাগলের মতো। একবার পিছন ফিরে একঝলক দেখেছে ।দেখল আগুনের লেলিহান শিখায় দাউ দাউ করে জ্বলছে ওদের কুঁড়েঘর।আর ভাবনার সময় নেই,এখন লক্ষ্য একটাই।জঙ্গলের পর আছে উত্তুঙ্গ পাহাড়, আর পাহাড় পেরিয়ে ওপাশে নদী। নদী পেরুলে নিশ্চিন্ত। এই পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তা ও চেনে।ছোটবেলা থেকে অনেকবার গেছে ওদিকে। কিন্তু এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে জঙ্গলের ভিতর মা দৌড়াতে পারছিল না একেবারে ।প্রায়ই বসে পড়ছিল আর জোরে জোরে হাঁফাচ্ছিল । ও মাকে টানতে টানতে বলছিল ” এই তো মা আর একটু পরেই
নদী পার করব। একটু পা চালাও। “
ক্ষতবিক্ষত শরীর টানতে টানতে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছিল মা ও ছেলে। পাহাড় চড়তে গিয়ে মার পা ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। তবু থামলো না ওরা । দৌড়াতে দৌড়াতে দিন গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল।
এখন পাহাড় থেকে দ্রুত নামছে ওরা।হঠাৎ দুরে দেখা গেল রোদ পড়ে জলের উপর ঝিকমিক। ছেলে চেঁচিয়ে বলল ” হে মা ! ঐ দেখ নদী । আর একটু কষ্ট কর মা। এসে গেছি।”
” আর পারি নে বাবা ।আমি এখানে একটু জিরিয়ে নিই বাবা। তুই দেখ নৌকা আছে নাকি?” মা আর না পেরে বসে পড়লো ।
সামনেই নদী । দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ। নতুন জীবনের হাতছানি ওপারে। মার কষ্ট দেখে ও আর আপত্তি করলো না। বলল ” তুমি এখানে বসে দুমিনিট জিরিয়ে নাও।আমি নৌকা দেখে আসি।যাব আর আসবো।”
ও দৌড় লাগালো সামনের দিকে।
নদী পারে নৌকা অগুনতি। লোক ও প্রচুর। সবাই ওপারে যাবে, কিন্তু খেয়া পারাণির মাঝি বিকেলবেলা দাম হাঁকছে অনেক। কেউ যেতে পারছে না।
” বা ………. চা……………ও……..” দুর থেকে নারী কণ্ঠের চিৎকার ভেসে এলো।সবাই পেছনে তাকালো। ছেলেটা চমকে ফিরে তাকালো। মুহূর্তে ওর রক্ত হিম হয়ে গেল । একদল হলদেটে থ্যাবড়া মুখো উন্মত্ত নরপশু পিশাচের মত আনন্দে চিৎকার করে ওর ক্লান্ত অবসন্ন মাকে টেনে উঠিয়ে পাহাড়ের পেছনে চলে যাচ্ছে।ও চিৎকার করে পিছু নিতে চাইল,কিন্তু অন্যরা ওকে টেনে ধরল মুখ টিপে। “করিস কি ! আমাদের সবাইকে মারবি নাকি?”
ওর চোখ দিয়ে জল টপ টপ করে পড়তে লাগলো। মাকে বাঁচাতে পারল না। সামনে নাফ নদী। ওপারে মুক্তির হাতছানি। কিন্তু কি লাভ এই মুক্তির? মা বাবা তো সংসারে রইলো না।কি করবে সে ওপারে গিয়ে? একমুহূর্ত চিন্তা করল ও। তারপর লাফ দিয়ে পড়ল দুরন্ত নাফ নদীতে। সবাই হা হা করে উঠলো,কিন্তু কেউ বাঁচাতে এগিয়ে গেল না।
সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। নাফ নদী বয়ে চলেছে নীরবে।শুধু তার অথৈ জলে হারিয়ে গেছে আজ আরেকটা
রো ..হি…ঙ্গি…..য়া!
অপূর্ব