Select Page

ধন্যযোগ নয় ধন্যবাদ

<strong>ধন্যযোগ নয় ধন্যবাদ</strong>

ধন্যবাদ শব্দের দুটি অংশ – ধন্য এবং বাদ। ধন্য শব্দের অর্থ হল – ধনপ্রাপ্তি যুক্ত হয় বা থাকে যে আধারে; অর্থাৎ ধনী-নির্ধন নির্ব্বিশেষে যদি কারও ধনপ্রাপ্তি হয় তবে তিনি ‘ধন্য’ হয়ে যান।

এই ধন আবার দুই প্রকার (এক) মানসিক বা মানস-সম্পদ, চেতনা-সম্পদ, জ্ঞান-সম্পদ বা চিত্ত-সম্পদ। (দুই) দৈহিক বা বৈষয়িক বা বিত্ত-সম্পদ। যারা ধন্য তারা এই দুই-এর যেকোন একটি ‘ধন্” যোগে ধন্য বোধ করতে পারেন। দুই প্রকার ধনসম্পদের মধ্যে একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল উভয় সম্পদই তেজ-গুণসম্পন্ন। এখন প্রশ্ন হল যার কারণে বা যিনি এই ধনপ্রাপ্তিতে সহায়তা করেছেন তাঁর প্রতি অর্থাৎ দাতার প্রতি ধন-গ্রহীতার ভূমিকা/কর্ত্তব্য কী হবে এবং সেই ইতিকর্ত্তব্য তিনি কীভাবে পালন করবেন। দু’ভাবে তা করা যায় – (১) তিনি যে ধনযোগের কারণে ধন্য হলেন তার সম-পরিমান কিংবা তার চেয়ে অধিক পরিমাণ ধন দাতাকে ফিরিয়ে দেবেন, অথবা (দুই) যিনি ধন্য হয়েছেন ধনগ্রহীতা হিসাবে দাতাকে তার দান-গ্রহণের স্বীকৃতি বয়ান করবেন।

প্রথমটি করলে দাতার দান এবং গ্রহীতার ধন্য হবার উদ্দেশ্য মাটি হয় যায় যা দাতার বা গ্রহীতার উদ্দিষ্ট নয়। সেক্ষেত্রে দাতাকে তার প্রদত্ত দান ফেরত দেওয়া বা প্রাপ্ত ধন-কে দাতার উদ্দেশ্যে যোগ করার প্রশ্নই ওঠেনা কারণ দান গ্রহণ না করলে ধন্য হবার প্রশ্ন নেই অতএব দান ফেরতের সম্ভবনা নেই। এককথায় ‘ধন্য’ ‘যোগ’ করার প্রশ্নই নেই। গ্রহীতার হাতে থাকল দ্বিতীয়টি অর্থাৎ তিনি ধন্য হয়েছেন এই কথাটা দাতাকে সৌজন্যের খাতিরে জানিয়ে দেওয়া বা বাদিত করা। অর্থাৎ কোন নতুন কিছু যোগ না করে স্বীকৃতির সংবাদ জ্ঞাপন করা বা বয়ান করা। এই কাজে ধনের কোন ‘যোগ’ বা ‘বিয়োগ’ নেই অর্থাৎ ‘ধন্যযোগ’ শব্দের প্রয়োগ উদ্দেশ্যহীন হতে বাধ্য।

এতদিন আমরা ‘ধন্যবাদ’ শব্দবন্ধটিই ব্যবহার করেছি দাতার ধন-দানের কাজকে স্বীকৃতি জানানোর জন্য এবং এর বেশী কিছু করিনি। এখন প্রশ্ন, প্রাচীন শব্দশাস্ত্রীরা কি এতই মূর্খ ছিলেন যে তারা ‘ধন্যযোগ’ শব্দের ব্যবহার না করে ‘ধন্যবাদ’ শব্দটির প্রচলন ঘটালেন কেন? যাঁরা এই ‘ধন্যবাদ’-এর পরিবর্ত্তে নতুন শব্দ ‘ধন্যযোগ’ আমদানী করেছেন তাঁরা কি নতুন কিছু ‘যোগ’ করতে চাইছেন অর্থাৎ অতিরিক্ত অর্থযোগ ঘটাতে চাইছেন এই ‘ধন্যবাদ’ শব্দের পরিবর্ত্তে? না, দাতার উদ্দেশ্যে নতুন কোন চিত্তসম্পদা/মানসসম্পদ বা বিত্তসম্পদ যোগ করতে চাইছেন না শুধু ‘বাদ’ (নেতিবাচক) এর বদলে ‘যোগ’ (ই্তিবাচক) শব্দের প্রতিস্থাপনা চাইছেন। এবং এই বদল কিসের বিনিময়ে? ‘বাদ’-এর বিনিময়ে।

আসুন, দেখা যাক ‘বাদ’ শব্দের ভিতরে কী অর্থ লুকিয়ে আছে।. ‘বদন’-নিঃসৃত ‘বদ’ হইতে জাত এই ‘বাদ’ শব্দটির অর্থ তিন প্রকার। আর ‘বদ’ শব্দটির অর্থ দুই প্রকার ঃ ( অর্থ-এক) “বদ = ব-এর [ ভাব(মনোভাব)-বাহীর দান যাহাতে; অথবা যাহা (যে উচ্চারণ) দ্বারা মনোভাব দান করা হয়; কিংবা, অর্থপূর্ণ কথা বলা হয় যাহাতে। কথন, বলা, উচ্চারণ করা। (অর্থ-দুই) বদ = ব-এর অন্যতর বা অনাকাঙ্খিত [ ভাব-বাহীর (ব) ] দান (দ) যাহাতে; অর্থাৎ যাহা (যে উচ্চারণ) দ্বারা অন্যতর বা অনাকাঙ্খিত মনোভাব দান করা হয়; কিংবা, বিপরীত (ব) অর্থপূর্ণ কথা বলা হয় যাহাতে; অথবা, যাহা বাদ দিতে হয় বা বদল করিয়া লইতে হয়; কিংবা, যে কোনো প্রকার বিশেষ, বিপরীত, অন্যতর, অনাকাঙ্খিত ব্যাপার যাহাতে)। অনাকাঙ্খিত, অন্যতর, বিপরীত, এবং [ বঙ্গে পাঠানযুগ হইতে আরবী-ফারসীর সংস্পর্শে ] মন্দ, খারাপ,যথা দূষিত…ইত্যাদি অর্থে উপসর্গ রূপে প্রচলিত; যথা – বজ্জাত, বদনাম, বদভ্যাস, বদমেজাজ, বদরক্ত, বদরাগ, বদহজম, …ইত্যাদি”। – [ কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তী প্রণীত ‘সরল শব্দার্থকোষ’ থেকে গৃহীত। এবার দেখা যাক ‘বাদ’ শব্দটির অর্থ [ বাদ = বদ হইতে জাত ]

বাদ শব্দের তিনটি অর্থ আছে – (অর্থ-এক) “বাদ = বদ (কথন) হইতে জাত। ভাষণ, কীর্ত্তণ, ধ্বনি, কূজন …ইত্যাদি। (অর্থ-দুই) বাদ = বদ (নতুন, অজানা কথা বলা) হইতে জাত; অথবা, নতুন বা অজানা কথা বলা থাকে যে শব্দোচ্চারণে বা সুরেলা বাজনায়; কিংবা, বাদিত্র বাজাইয়া বা বাদন করিয়া যে কথা সবাইকে জানাইয়া দেওয়া হয়। কথন, বাদন, বাজন। {অর্থ-তিন) বাদ = বদ (অনাকাঙ্খিত বা অপ্রয়োজনীয় বিষয়বাহীর দান থাকে যাহাতে, তাহা) হইতে জাত। বিয়োগ, বিযুক্ত, ছাড়, ছাড়া, ত্যক্ত” – [ কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তী প্রণীত “সরল শব্দার্থকোষ” থেকে উদ্ধৃত ]। এই তিন রকমের অর্থের কোনটা কখন কোন অর্থে প্রয়োগ হবে তা নির্ভর করবে প্রেক্ষিতের উপর। দেখা যাক যিনি ধন্য হয়েছেন তিনি কোন অর্থে ‘বাদ’ শব্দটি প্রয়োগ করতে পারেন। তৃতীয় অর্থে বিয়োগের কথা, বিযুক্তির কথা, ছাড়ের কথা আছে। নিশ্চই দান-গ্রহীতা যে দান পেয়ে ধন্য হয়েছেন তিনি নিশ্চই প্রাপ্ত ধনকে ‘বাদ’ দিতে বা বিযুক্ত করে দাতাকে ফিরিয়ে দিতে চাইছেন না! এবার দ্বিতীয় অর্থটি বিবেচনা করুন, এটাও তাঁর ধন্যবাদ বলার জন্য উদ্দেশ্য হতে পারে না, কারণ ধন্য হওয়ার সংবাদ দাতাকে জানানো গ্রহীতার কাছে কাঙ্খিত, অনাকাঙ্খিত মোটেই নয়। গ্রহীতার উদ্দেশ্য ছিল দাতাকে ধন্য হবার সংবাদটি প্রেরণ করে দান গ্রহণের সংবাদের স্বীকৃতি প্রদান। তাই এই ধন্যবাদের ‘বাদ’ শব্দটির অর্থ হল কথন, বলা, বয়ান করা – যা সৌজন্যপ্রদর্শনের বা দানগ্রহীতাকে স্বীকৃতি জানানোর উদ্দেশে বাদিত করার জন্য।

তাহলে কেউ কেউ আজ ভাবপ্রকাশের অযোগ্য বাংলাভাষাকে যোগ্য করে গড়ে তোলার সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্দেশে ব্রতী হয়ে ‘ধন্যবা্দ’-এর মত বহুল ব্যবহৃত শব্দের থেকে ‘বাদ’কে বাতিল ঘোষণা করে ‘ধন্যযোগ’ শব্দ ব্যবহারে উৎসাহী হয়েছেন, তাঁর ভাষিক চিন্তাধারার ভিত্তিভূমির একটু বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আমরা জানি অথবা জানিনা যে বাংলা তথা ভারতীয় ভাষায় শব্দ এবং বর্ণগুলি বহুরৈখিক অর্থধারী। বিপরীতে পাশ্চাত্যের ভাষাসমূহ বিশেষ করে ইংরেজী (যার সঙ্গে আমাদের বহুল পরিচিতি) ভাষার শব্দ এবং বর্ণগুলি মূলত একরৈখিক অর্থধারী। ফলে ইংরেজী শিক্ষিত বা পাশ্চাত্য প্রতীকী লোগোসেণ্ট্রিক ভাষাতত্ত্ব অনুযায়ী এক শব্দের একটি অর্থ না থাকলে অর্থ সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে এমন ধারণা বা বিশ্বাসের প্রভাবে (যে বিশ্বাস বা প্রভাব আমাদের মনের গভীরে গত দু-তিনশ বছর ধরে গভীরভাবে প্রোথিত করে দেওয়া হয়েছে বিশেষ করে ভারতের স্বাধীনতার পরে যার তীব্রতা ব্যাপকতর হয়েছে) বাংলা শব্দের অর্থকেও একরৈখিকভাবে বোঝার চেষ্টা হয়েছে এবং ব্যাপকতর হচ্ছে। এরই ফলে ‘বাদ’ শব্দের বাকী অর্থগুলি ফেলে দিয়ে একটি স্থির অর্থ ধরে নিয়ে প্রয়োগকারী ভেবেছেন ‘ধন্যবাদ’-এর ‘বাদ’ মানে ‘বিয়োগ বা বিযুক্ত করা।

অতএব ‘ধন্যবাদ’ শব্দটির ভিতরে গাঠনিক ভ্রান্তি থেকে গেছে এবং অর্থবিভ্রাটের জন্য দায়ী। তাই তিনি ‘ধন্যবাদ’-এর ‘বাদ’-কে বিযুক্ত করে যুক্ত করেছেন ‘যোগ’ শব্দটিকে। ধন্যবাদ-এর বদলে ধন্যযোগ হয়ে গেল। বাংলা শব্দগুলি অর্থসম্পদে এতই ধনী যে তার বহুরৈখিক শব্দার্থগুলিকে বাঁচাতে হবে না হলে বাংলা শব্দের বদলে বিদেশী শব্দের অনুপ্রবেশের ব্যাপকতা এমন তীব্র হবে যে অচিরেই বাংলাভাষায় আর বাংলা শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই বাংলাভাষাকে বাংলাভাষা ভেবে নিয়ে তার স্বভাবসঙ্গত নিয়মাবলী অনুসরণ না করলে এমন ভ্রান্তি ও দুর্গতি দিনে দিনে বেড়েই যাবে এবং অচিরেই বাংলাভাষার মৃত্য অনিবার্য্য করে তুলবে।

ধন্যবাদ একটি তৎসম বা সংস্কৃতজাত শব্দ, কিন্তু এটি বাংলায় বিকৃত উচ্চারিত হয়ে থাকে। বাংলায় অন্ত:স্থ ব (ওয়া বা W) ও য(ইয় বা Y) বর্ণ দু’টি যথাযথ উচ্চারন করা হয় না।

ধন্যবাদ সংস্কৃতিতে উচ্চারন হয় ধন্যওয়াদ; কিন্তু বাংলায় ‘ওয়াদ’ হয়ে গেল ‘বাদ’–নেতিবাচক। হয়তো তাই বাদ কে বাদ দিয়ে যোগ সংযুক্ত করা হচ্ছে।
এ ভাবে ভাষা বিবর্তিত হয় এবং এটি খারাপ নয়। সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হলেই অভিধানে স্থান পাবে।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার