তীর্থস্থান (ধর্মীয়ভাবে পবিত্রস্থান)
তীর্থ শব্দটার আভিধানিক অর্থ পায়ে হেঁটে গমন। তবে তীর্থস্থান বলতে ধর্মীয়ভাবে পবিত্র স্থান বুঝায় যে স্থানে দেবতা বা স্রষ্টার পূজা/প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয় এবং যে স্থানে গমন করলে মানুষ পাপ থেকে মুক্ত হতে পারে।
প্রাচীনকালে, মানুষেরা দূর দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এই ধরনের স্থানে এসে পূজা দিতেন বা স্রষ্টার উদ্দেশ্যে কিছু উৎসর্গ করতেন, সে কারণে ধর্মীয়ভাবে পবিত্র স্থানের নাম তীর্থস্থান হতে পারে। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটা ধর্মের অনুসারীদেরই কোন না কোন স্থানে তাদের তীর্থস্থান রয়েছে। মানুষ জীবন জীবিকার প্রয়োজনে নানা ধরনের অপকর্ম, অন্যায়, অনাচারে লিপ্ত থাকে যাকে ধর্মীয়ভাবে পাপ কর্ম বলা হয়।এই ধরনের কর্মে নিয়োজিত থাকলে মানুষ এক ধরনের পাপবোধে তাড়িত হয়। এই পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মানুষ তীর্থস্থানে গমন করেন, অনেকে অবশ্য কোন মনোবাসনা পূরণের ইচ্ছায়ও তীর্থস্থানে যান। ইদানিং কেউ কেউ অন্যকে দেখানোর উদ্দেশ্যেও তীর্থস্থানে গমন করছে।
যাহোক, আজকের লেখার মূল বিষয় হলো “তীর্থস্থানসমুহ কি স্রষ্টার সৃষ্ট এবং তীর্থস্থানে যাওয়ার আদৌ কি কোনো প্রয়োজনীয়তা রয়েছে”?। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে পৃথিবীর সমস্ত স্থানই পবিত্র স্থান, একটি স্থান অন্য স্থান থেকে অধিকতর পবিত্র, এমনটা হতেই পারে না। তবে এটা হতে পারে কোন স্থান দুর্গম, কোন স্থান সমতল বা পাহাড় পর্বতময়,কোন স্থান জঙ্গলে পরিপূর্ণ, আবার কোনো স্থান ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ। ধর্মীয় বিবেচনায় যে স্থানে গমন করলে/পূজা দিলে বা স্রষ্টার উদ্দেশ্যে কোন কিছু উৎসর্গ করলে পুণ্যি লাভ হয়, পাপ ক্ষয় হয় এবং মৃত্যুর পর স্বর্গে যাওয়া সম্ভব হয় সেই স্থানকে ধর্মীয়পবিত্র স্থান বা তীর্থস্থান বলা হয়।
একটু খেয়াল করলেই লক্ষ্য করবেন বেশিরভাগক্ষেত্রে তীর্থস্থানগুলো লোকালয় থেকে দূরে বা দুর্গম স্থানে অবস্থিত এবং যেখানে যেতে অনেক কষ্ট করতে হয়। যুগে যুগে তীর্থস্থানে গমন করতে যেয়ে অসংখ্য মানুষ দুর্ঘটনায় কবলিত হয়েছে,চোর/ডাকাত দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং তীর্থযাত্রীরা সর্বস্ব খুয়েছেন, অনেকে আহত- নিহত হয়েছেন এবং রোগব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়েও অসংখ্য মানুষের জীবন হানি হয়েছে ।
বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে এবং তীর্থস্থানের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত থাকে যার ফলে এখন তীর্থস্থানে যেতে যেয়ে পুজারীদের দুর্ঘটনায় কবলিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমেছে তবুও কিন্তু তীর্থস্থানসমূহ সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ নয়। এখনো তীর্থস্থানে যেয়ে বা পথে ‘তীর্থযাত্রীরা আহত নিহত হচ্ছেন’ এ ধরনের সংবাদ প্রায়ই সংবাদপত্রে দেখা যায়। তাছাড়া তীর্থস্থানে যেতে যেয়ে অনেকেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, দেশের সম্পদ অন্য দেশে চলে যাচ্ছে কোন ধরনের পণ্য আমদানি ছাড়াই। এখন প্রশ্ন হল, স্রষ্টা কি সত্যিই কোন কোন স্থানকে তীর্থস্থান বা পবিত্র স্থানের মর্যাদা দিয়েছেন, নাকি মানুষ নিজেরাই কোন কোন স্থানকে তীর্থস্থান রূপে ঘোষণা করেছেন? এই প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর হল মানুষই এসব তীর্থস্থান সৃষ্টি করেছেন।
প্রাচীনকালের মানুষেরা বড় কোন বৃক্ষ, পাথর নদী বা জলাশয়কে পবিত্র বা তীর্থস্থান মনে করতেন, আধুনিককালে সেই ধারণাটির পরিবর্তিত রূপ হল ‘তীর্থস্থান’ যেখানে মন্দির/ উপাসনালায় থাকে। পাপ থেকে মানুষকে ক্ষমা করতে পারে একমাত্র স্রষ্টা। স্রষ্টা যদি মানুষের পাপ ক্ষমা করেন, তাহলে মানুষকে পাপ মুক্তির জন্য অন্য কোন (তীর্থ)স্থানে যেতে হবে কেন? সব ধরনের পাপকর্ম থেকে বিরত হয়ে পবিত্র মনে নিজ ঘরে বসে স্রষ্টার আরাধনা করে, স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চাইলেই তো ক্ষমা পাওয়া যাওয়ার কথা। পাপ থেকে মুক্তির জন্য অন্য দেশে বা দুর্গম কোন স্থানে অবস্থিত তীর্থস্থানে যেতে হবে কেন? তাছাড়া স্রষ্টা যদি কারো বাড়ির কাছে তীর্থস্থান করেন, সেটা তার জন্য সুবিধাজনক হলেও তা কিন্তু পৃথিবীর দূর দূরান্তের মানুষের জন্য খুবই অসুবিধাজনক। স্রষ্টা কেন সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করবেন না?
তীর্থস্থানে যেয়ে যদি পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয় তাহলে যাদের আর্থিক সামর্থ্য বেশি তারা খুব সহজেই পাপ থেকে মুক্ত হতে পারেন আবার যাদের আর্থিক সামর্থ্য কম তারা তাদের পাপ কর্ম থেকে কখনোই মুক্তি পাবেন না। বিভিন্ন মানুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিধান স্রষ্টা সৃষ্টি করতেই পারেন না। তাছাড়া তীর্থস্থান উৎপত্তির ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় এর সাথে সেই স্থানের মানুষের এক ধরনের ব্যবসায়িক বা লাভের সম্পর্ক রয়েছে। তীর্থস্থান যদি স্রষ্টার সৃষ্টি না হয়ে থাকে, তাহলে তীর্থস্থানে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকে না এবং মানুষ তীর্থস্থানে যেতে যেয়ে যে ধরনের দুর্ঘটনায় কবলিত হয় বা যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন তা থেকেও মুক্তি পেতে পারেন। তাই তীর্থস্থান সম্পর্কে মানুষের পরিষ্কার ধারণা থাকাটা বাঞ্ছনীয়। বর্তমান পৃথিবীতে বেশকিছু তীর্থস্থানে বা ধর্মীয়ভাবে পবিত্র স্থানে ক্রমাগত সংঘাত চলছে। স্রষ্টা যদি তীর্থস্থান বা ধর্মীয় পবিত্রস্থান সৃষ্টি করে থাকে তাহলে সেই স্থানে কেন সংঘাত চলমান থাকবে?
সাম্প্রতিক মন্তব্য