Select Page

একটি গান

একটি গান

প্রায় দু’ঘন্টা ধরে তিন মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে রূম্পা। অসংখ্য রোগীর সিরিয়াল। তার বাচ্চার সিরিয়াল আসতে আরও কতক্ষন লাগবে কে জানে। অথচ কোমর তাঁর ব্যাথায় টনটন করছে। বাচ্চাটা হওয়ার পর থেকে তার মাথার আর বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কেবল পানি তেস্টা পায়। মা-মেয়ে দু’জনই অপুষ্টিতে ভুগছে, দেখলেই বোঝা যায়। বাচ্চাটা এত দুর্বল যে মায়ের বুকের দুধটুকু টেনে খেতে তার কষ্ট হয়। তাই সে ঘন ঘন এবং অনেকক্ষন ধরে দুধ টানে। ডাক্তার রুম্পাকে বলেছে বাচ্চাকে খাওয়ানোর সময় যেন সে অবশ্যই সোজা হয়ে বসে এবং ৪৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে কোলে নিয়ে খাওয়ায়; নয়তো বাচ্চার শ্বাসনালীতে দুধ চলে যেতে পারে। ভীষণ কষ্ট হয় রুম্পার এত দীর্ঘক্ষণ এভাবে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে। পিঠের শিরদাঁড়া, ঘাড় আর হাত দুটো খুব ব্যাথা করে। তবু ডাক্তারের কথা সে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে, যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায় এই ভয়ে। টুনি যে তাঁর অনেক কষ্টের মেয়ে।

টুনি যখন পেটে তিন মাসের তখন রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল রুম্পার। বাচ্চাটাকে বাঁচাতে কত ঔষধ, ইঞ্জেকশান যে নিতে হল তাঁকে। আর ডেলিভারির আগ পর্যন্ত এতগুলো মাস, সারা দিন, সারা রাত, বিছানায়; বেড প্যানে টয়লেট। ঘুম হতো না। চার তলার উপর একটা ছোট ফ্ল্যাটে একা সারাটা দিন। স্বামী চাকুরি করেন। সকালে বেরিয়ে ফেরেন রাত আটটার দিকে। আর কেউ ছিল না যে রুম্পাকে একটু সংগ দেবে। যেন এক কনডেম সেলে বন্দী সে। দোতলায় শ্বশুর-শাশুড়ি থাকেন। সেখান থেকে দু বেলা ভাত , আর এক বাটি তরকারি দিয়ে যেত তাদের কাজের লোক। কখনও কখনও এমনও হত যে একবার খাবার পাঠানোর পর সারাদিন আর কোন খাবার আসত না। বাচ্চা পেটে ধরা পড়ার পর প্রথম দিকে রুম্পার খাওয়ায় অরুচি ছিল না, কিন্তু বেডরেস্ট শুরু হওয়ার পর পর্যাপ্ত খাবার পেত না সে। এরপর খাওয়ায় অরুচি চলে এল। কিছুই খেতে পারত না, কেবল বমি আর বমি আর গা গুলানো গন্ধ। রুম্পার ভাগ্য বিরুপ তাই ঠিক তাঁর সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় তাঁর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দীর্ঘদিন তাঁর মানসিক স্থিতি ছিল না।রুম্পা তাঁর সবচেয়ে ছোট মেয়ে, অথচ তাঁর প্রথম সন্তান হওয়ার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পরে রইলেন।

অবশেষে একদিন দুপুরে রুম্পার পানি ভাঙল। একটু একটু করে ব্যাথা উঠলো। সন্ধ্যার পর হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হল রূম্পা। ঠিক তারিখ মতই হচ্ছিল সব। বাচ্চার পজিশান নরমাল ছিল। ডিউটি ডাক্তার দেখে বললেন রাত আড়াইটার দিকে ডেলিভারি হবে মনে হচ্ছে। দুপুরে ভাত খেতে বসার সময় পানি ভাঙ্গা শুরু হয়েছিল, এরপর আর কিচ্ছু খাওয়া হয়নি। রাত দশটার দিকে খেতে বসল যখন তখনই আবার এক ডাক্তার আসলেন পরীক্ষা করতে, আর খাওয়া হল না রুম্পার। এরপর শুরু হল লেবার ওয়ার্ডের এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটা। এভাবে হাঁটলে ডেলিভারি তাড়াতাড়ি হবে বললেন কয়েকজন মহিলা। কিছুক্ষন হাঁটার পর মনে হল তাঁর টয়লেট হবে, আমাশয় হলে যেমন লাগে ঠিক তেমন। তাড়াতাড়ি টয়লেটে গেল রূম্পা। কিন্তু না, কোন টয়লেট হল না। আবার হাঁটাহাঁটি, আবার টয়লেট। এই চলল সারারাত। তাঁর শাশুড়ি তাঁকে সারারাত হাঁটালেন নরমাল ডেলিভারির আশায়, কিন্তু একবারও তাঁকে আর কিছু খেতে দেয়ার কথা উনার মনে হল না। ভোরের দিকে শরীর একদম ছেড়ে দিল রুম্পার, সেই সাথে থেমে থেমে
তীব্র ব্যথা। এই রকম ব্যাথার কথা কল্পনায়ও কখনও ভাবে নি সে। প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক শক বা মনে হচ্ছিল কেউ ভারী হাতুড়ি দিয়ে তাঁর শ্রোণি চক্রের হাড়, হাড্ডি ভেতর থেকে ভাঙছে। প্রচণ্ড দুর্বল, ক্লান্ত শরীর সেই অসহনীয়, দানবীয় ব্যথার আক্রমণ সহ্য করতে পারছিল না। রক্ত হিম করা এক ভয়, অসহায়ত্ব গ্রাস করে রুম্পাকে। তাঁর মনে হতে থাকে সে আর কিচ্ছু চায় না, কেবল এই ব্যাথা থেকে মুক্তি চায়। তাঁর চোখে মুখে এক অসহায় আর্তি। সিস্টারদের সে আকুল আবেদন জানায় যেন তাঁর ব্যাথা যে করে হোক কমানোর ব্যবস্থা করা হয়, এক্ষুনি। এমন করে কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে যায়। সময় যেন থমকে গেছে রুম্পার জন্য। এক অনন্তকাল পরে স্বিধান্ত হয় তাঁর সিজারিয়ান অপারেশান হবে। ট্রলিতে করে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে। একটি ইঞ্জেকশান তাঁর পিঠের মেরুদণ্ডে পুশ করে কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবশ করে ফেলার পর এক গভীর শান্তি পেল রূম্পা। খানিক পর তাঁর পেট কাঁটা হল। সে টের পেল ফুস করে কিছু বাতাস বের হল তাঁর পেট থেকে। জিহ্বা, গলা শুকিয়ে যেতে থাকে রুম্পার। এক বিন্দু পানির জন্য ছটফট করে সে। যে লোকটি তাঁর ব্লাড প্রেশার মনিটর করছিল মাথার কাছে দাঁড়িয়ে তাঁকে খুব অনুরোধ করে রূম্পা এক ফোঁটা পানি তাঁর মুখে দেয়ার জন্য। লোকটির দয়া হল। সে ডিসটিল্ড ওয়াটার এর এম্পুল ভেঙ্গে রুম্পার জিভে এক ফোঁটা পানি ছিটিয়ে দেয়। লোকটিকে তাঁর দেবতা মনে হয়। একটু পর বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসে কানে, আর তখনই রূম্পা জ্ঞান হারায়।

জ্ঞান ফেরার পর থেকে রুম্পার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত রকমের ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতি হতে থাকে। কেমন এক অচেনা কষ্ট। সে কষ্টের কোন সমাধান নেই, কেউ নেই যে সেই কষ্ট দূর করতে পারে। সে সৃষ্টিকর্তাকে প্রাণপণে ডাকার, তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়ার চেস্টা করে। কিন্তু মন থেকে কেন যেন কোন ভরসা পায় না যে কোন ইশ্বর তাঁকে এই কষ্ট থেকে বাঁচাবে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও কেউ নেই, এক অসীম শুন্যতা অনুভব করে সে। রুম্পার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে সে কথা মনে হলে আজও। এরপর সাতদিন হাসপাতালে এক বদ্ধ কেবিনে বাচ্চাকে নিয়ে ছিল সে। সবার সকল মনোযোগ (এবং তাঁর নিজেরও) নবজাতকের প্রতি। বাচ্চার ওজন বেশ কম হয়েছে। গরমে ঘেমে খুব কাশি হল রুম্পার; তলপেটে বেল্ট পরে থেকে অনেকগুলো ফোস্কা পরল। সারারাত কোন ঘুম নেই। ঠিক চোখ বরাবর অনেক আলো করা একটি লাইট জ্বলে থাকে সারাক্ষন। ভাল মত দাঁড়াতেও কষ্ট হয় তাঁর, কেবলি মাথা ঘুরে। তবু তাকেই নানান কথা শুনতে হচ্ছে; তাঁর স্বামীও তাঁর সাথে রাগ করছে সে ঠিক মত বাচ্চার যত্ন নিতে পারছে না নাকি। নিজেকে কি ভীষণ একা, অপাংক্তেয়, অসহায় মনে হয়। বাসায় ফেরার তিন দিন পর প্রচুর রক্ত যাওয়া শুরু হল তাঁর। প্রেশার একবার লো তো আরেকবার হাই। সে রাতে প্রায় মারাই যাচ্ছিল সে। পাশে শুয়ে থাকা ছোট্ট বাচ্চার দিকে তাকিয়ে কেবলি কান্না পায় তাঁর।

“এত ছোট বাচ্চা আমি মরে গেলে কে দেখবে, খুব কষ্ট হবে আমার বাচ্চাটার। একটু বড় হলে তারপর না হয় মরি,” মনে মনে কত কি ভাবনা আসে তাঁর। “বাচ্চাটা আমার অনেক ছোট, এ যাত্রা আমায় বাঁচিয়ে দাও আল্লাহ,” রূম্পা আল্লাহকে ডাকে। তাঁর স্বামী শেষ রাতে উপায়ন্ত না দেখে তাঁর মাকে দোতলা থেকে ডেকে আনে। রূম্পা দেখে তাঁর শাশুড়ি খুবই বিরক্ত এত রাতে তাঁকে ডাকায়। তাঁর স্বামী ডাক্তার আনতে উদ্যত হলে সে ছেলেকে বাঁধা দেয়। ঝগড়া বেঁধে যেতে পারে এই আশঙ্কায় রূম্পাও না করে তাঁর স্বামীকে বাইরে যেতে। এই ভাবে রাত পার হয়। সে যাত্রা বেচেই গেল রূম্পা, কিন্তু এক জীবন্ত জম্বি হয়ে। মাথার ভেতর ফাঁকা, বুকের ভেতর ফাঁকা, তীব্র পানি তেস্টা আর তুলার মত হাল্কা শরীর। পুরো জগতটাই কেমন অপার্থিব মনে হতে থাকে রুম্পার। চারপাশের মানুষ, তাদের কলরব, এই জগত-সংসার, সব কিছু কেমন ঝাপসা। রূম্পা বুঝতে পারে না কেন তাঁর এমন হল। “ আমার সাথে আরও ক’জনের তো সিজারিয়ান করে বাচ্চা হল, তারা তো ভালই আছে।“ তাদেরকে খুব সৌভাগ্যবতী, আর নিজেকে ভীষণ দুর্ভাগা বলে মনে হয় তাঁর। কিন্তু বেশী কিছু ভাবার মত অবস্থায় নেই ও। এক ঘোরের মধ্যে কেবল সময় পার করছে। সন্ধ্যা থেকে বসে আছে চেম্বারে, এখন রাত ন’টা বাজে প্রায়। এতটা সময় চারপাশে্র এত মানুষ, এত কোলাহল, সবকিছুই সিনেমার স্লো মোশন দৃশ্যের মত লাগে রুম্পার। হঠাৎ টিভি থেকে ভেসে
আসা একটা গানের শব্দে তাকিয়ে দেখে টিভির স্ক্রিনে একদল উচ্ছল তরুন তরুণী প্রাণখুলে নাচছে,গাইছে । “ইটস মাই লাইফ। ইটস নাউ ওর নেভার,” গানটির কথাগুলো আর তরুণ-তরুণীদের প্রাণখোলা আনন্দ রুম্পার মনের খুব গহীনে স্পর্শ করে।বাঁচার এক সুক্ষ্ম আকাঙ্খা উঁকি দেয় তাঁর মনে। সে রাতের পর থেকে রুম্পার মাথার ভেতর বাজতে থাকে, “ইটস মাই লাইফ, ইটস নাউ ওর নেভার।“ ধীরে ধীরে সে জীবনের দিকে পা বাড়ায়। এর ঠিক তিন মাস পর ফিনিক্স পাখির মত পুনর্জন্ম লাভ করেছিল রূম্পা।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার