Select Page

কদমবান : যাপনের অন্তঃস্থল

কদমবান : যাপনের অন্তঃস্থল

কোটি বছর পুরনো গ্রহ তার আগের দশা পরিবর্তন করে সমৃদ্ধ হয়েছে ক্রমশঃ। জন্ম নিয়েছে নানা প্রাণ, প্রতিনিয়ত বিবর্তিত হয়েছে, হচ্ছে তার সাথে সাথে প্রকৃতিও। এই প্রক্রিয়ার ই কোন এক ধাপে মানুষের আবির্ভাব। সে ইতিহাস বিজ্ঞানীরা নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, ইতিহাসবিদরা ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন, সমালোচকরা সমালোচনা করেছেন। অর্থনীতিতে দাস যুগ থেকে সামন্ত যুগ, সামন্ত যুগ থেকে পুঁজিতন্ত্রে প্রবেশ করেছে মানুষের শ্রমনির্ভর সভ্যতাটি বহু আগেই। মানুষের সাথে সহাবস্থান কিংবা বাস্তুসংস্থানে প্রকৃতি এবং প্রাণ অবিচ্ছেদ্য। পুঁজিতান্ত্রিক তথা মুনাফা নির্ভর অর্থনীতি তা কতটুকু বা মনে রেখেছে ! প্রয়োজন বোধ করেছে কতটুকু ? যেখানে সহোদর মানুষের মৌলিক অধিকার এর লড়াই আর লাশের মিছিলে দেশে দেশে সয়লাভ, মুনাফার ঝুপকাষ্ঠে রক্তের হলিখেলা খেলছে যুদ্ধদানব, পুঁজিতন্ত্রের সাধুপনা কিংবা দায়সারা গোছের দায় সচেতন প্রাণ মাত্রই নগ্ন। বোবা প্রাণ প্রকৃতি মহাপ্রলয়ে ফুঁসে উঠবার পূর্বে ধূরন্দর পুঁজিতন্ত্র ‘আধুনিকতা’ আর ‘সেবা’র ভেলকিবাজি শব্দে সর্বপ্রাণকে তুলছে মুনাফার বাটখারায়।



কদমবান। ২০১৭ সালের ১৪ এপ্রিল রিলিজপ্রাপ্ত তামিল ভাষার এ চলচ্চিত্রটি দেখলে একজন ইতিহাস, প্রকৃতি এবং রাজনীতি সচেতন মানুষ হিসাবে আপনার নিত্য যাপনের সাথে; ক্ষোভ ঘৃণা আর কিছু করে উঠতে না পারার যন্ত্রনার সাথে খুব সহজে ম্যাচ করে যাবে পরিচিত এ দৃশ্যপটটি। হিন্দি এবং তেলেগু ভাষায়ও চলচ্চিত্রটি ইউটিউবেও পাওয়া যায়।


প্রথম দৃশ্যটিতেই এক ঝটকায় পুরো অঞ্চলটির প্রাণ প্রকৃতি জিওগ্রাফিক্যাল ধারণাটি তৈরি হয়ে যাবে আপনার মননে। কদমবান নামে পাহাড়ি এ অঞ্চলটির যতদূর দৃষ্টি যায় সবুজ বনভূমি। বনের ভিতরে ঝর্ণা, নদী, ছোট বড় পশু পাখী আর পোকামাকড় এর প্রানচঞ্চল সহাবস্থান। আর তার মাঝেই ৫০ পরিবারের ছোট্ট কদমবান গ্রামটি। এটি বিচ্ছিন্ন এক উপজাতি গ্রামের গল্প। ব্যক্তিগত ছোট দুয়েকটি দ্বন্ধকে পাশে রেখে একসাথে সকলের সংঘবদ্ধ সুখের জীবন যাপন।


জীবন জীবিকার প্রায়াংশই প্রকৃতি কিংবা বন নির্ভর। বাড়ি ঘর থেকে শুরু করে ব্যবহার্য আসবাব, খাদ্যদ্রব্য থেকে রান্নার জ্বালানী, দাওয়াই, পেশা, প্রেম জীবনের প্রায় সর্বাংশই । প্রধান পেশা মধু সংগ্রহ এবং তা শহরে বিক্রি করে অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো। সুখ দুখ, রাত্রি দিন যেমন জীবন আর যাপনের এপিঠ ওপিঠ, তেমনি এতসব সরল সুখের আয়োজনে এক আধটু বিচ্যুতি দ্বন্ধ যে এখানেও অনুপস্থিত তা নয়। তাই তো কাদম্বা (Arya) আর চঞ্চল রথি (Catherine tresa) যারা গ্রামবাসীদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব পায় তাদের মাঝেও সরল দ্বিমতে রথি’র ভাই এর সাথে যে ছোট দ্বন্ধ কখনওবা, তা ও বিপদে দেয়াল হয়ে দাঁড়ানোর সাহস করেনা। কখনওবা দুয়েকটি বেপথুর পশুর চামড়া বিক্রি কিংবা হাতির দাঁত বিক্রির লোভেরও দেখা মেলে।


এই সুখের উদ্যানে একদিন নজর পড়ে মুনাফার কারবারী সিমেন্ট বাণিজ্যের কর্পোরেটগ্রুপ মাহেন্দ্র ব্রাদার্স এর। তাদের গবেষণায় কাদমবানের ভূগর্ভস্থ ৬০ বছরব্যাপি উত্তোলনোক্ষম লাইমস্টোন এর সন্ধান মেলে। যা থেকে অর্জনযোগ্য বাৎসরিক ১০ হাজার কোটি টাকার মুনাফা । তাদের এ অর্জনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ছোট্ট এই কদমবান গ্রামটি। তারা গ্রামবাসীদের নানা প্রলোভনে স্থানান্তরের ফন্দি আঁটতে থাকে। তাদের এ পরিকল্পনায় সহায়ক হয় প্রশাসন আর বন বিভাগ। নানা প্রলোভনে এই কর্মকর্তাদের হাত করে তাদের অপারেশনে নামায় মাহেন্দ্র ব্রাদার্স। প্রথমে এনজিওকর্মী কতৃক নানা সাহায্য প্রদান করে গ্রামবাসীর আস্থা অর্জন করা এবং এনজিওর মাধ্যমে গ্রামের বাইরে পেশা পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি করে গ্রাম থেকে দলে দলে বাইরে নিয়ে যাওয়া, নানা ভোগ্যপণ্যে আসক্তি তৈরি এবং তথাকথিত উন্নত জীবন এর প্রলোভন, অন্যত্র আবাসন তৈরির প্রলোভন ইত্যাদি দেখিয়ে সরানোর চেষ্টা করে। গ্রামবাসী কতৃক তাদের চক্রান্ত ধরা পরে গেলে এনজিও কর্মীদের ধিক্কার দিয়ে তারা সব ত্যাগ করে।

এ পরিকল্পনার ব্যর্থতায় পরবর্তীতে বনবিভাগ কতৃক প্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করে গ্রাম ত্যাগের নোটিশ জারি করলে গ্রামবাসীকে তাতেও টলানো সম্ভব হয়ে উঠে না। জনতার বিরুদ্ধে শাসক আর শোষকের শেষ অস্ত্র হিসাবে পুঁজি তন্ত্র এর পর বেছে নেয় তার ভ্রম্মাস্ত্র; সন্ত্রাস। নির্যাতন, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া আর লাশের স্তুপ, ঘৃণ্য লালসার অট্টহাসির ভীত এর উপর দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে লাইমস্টোনবাহী গাড়ির বহর।


রাতের আঁধারে, নরমাংস খেতে আসা বন্য হায়নাদের সাথে, মেরে ফেলে যাওয়া লাশের স্তুপ থেকে দাঁড়ানো কাদমবা এর লড়াইয়ের জয়, আর প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে চোরাবালি থেকে উদ্ধারের দুটি দৃশ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় ভবিষ্যত সম্ভাবনার। খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়া অবশিষ্ঠ গ্রামবাসী ঈশ্বরকে দাঁড় করায় কাঠগড়ায়। কর্পোরেট পুঁজির আধুনিক সমরাস্ত্রের সাথে অসম লড়াইয়ে বনসন্তানদের জঙ্গলকে ব্যবহার করেই শেষ জয়ের হাসি যেনো হতাশা যন্ত্রনা আর ধ্বংসের সাগরে ভবিষ্যৎ লড়াইয়ে মানুষেরই জয়ের আশাবাদ।

সাবলীল বোধগম্য ভাষায় নির্মিত এ চলচ্চিত্রটি আপনাকে ভাবাবে, পরিপার্শ্বের অতি পরিচিত পরিপাটি কখনওবা ত্রানকর্তা মনে করা চরিত্রগুলোকে (বুর্জোয়া রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, চ্যারিটেবল প্রতিষ্ঠান এবং পুঁজির মালিক) নতুন করে পরিচয়ে সহায়তা করবে। আপনার পরিচিত এতদিনকার স্বাভাবিক জগতের প্রতিচ্ছবিটি নতুন একটি মাত্রায় নতুন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে ধরা দেবে।


চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্যের কাজ করেছেন ডিরেক্টর N. Ragavan এবং Deb. কোথাও আপাত স্থুলতা যেনো বাজারি প্রবণতার চলচ্চিত্রকারের গলাচেপে ধরার চেষ্টা। তবুও ধস্তাধস্তিতে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই নির্মাতা হিসাবে N. Ragavan এর ১৩৯ মিনিটের স্বার্থকতা। তামিলনাড়ুর দূর্গম kodaikanal ফরেস্ট টি এই চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র। বেশ পরিশ্রম করেই ৪০ কোটি রুপীর ক্যরিয়ারের এই তৃতীয় চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন রাগবান। নেটওয়ার্ক কাভারেজ বিহীন অঞ্চলটিতে কাজের প্রয়োজনে কমিউনিকেশন টাওয়ার বসাতে হয়েছিলো তাকে। ক্লাইমেক্স দৃশ্যটিতে ৭০ টি হাতির ব্যবহার, vfx সহ নানা চড়াই উৎড়াই পেরোতে হয়েছে তার টিমকে। চলচ্চিত্রটির সকল চরিত্রদের আউটলুক এর ব্যাপারেও যথেষ্ঠ মনযোগী থাকার চেষ্টা করেছেন।


চলচ্চিত্রটির সিনেমাটোগ্রাফিতে ছিলেন S.R Satish Kumar. তিনি এর আগেও বেশ কয়েকটি তামিল এবং হিন্দি একশন এডভেঞ্জার জনরার সিনেমায় সিনিয়ন সিনেমাটোগ্রাফার হিসাবে কাজ করেছেন। এছাড়া মিউজিক এ কাজ করেছেন Yuvan shangkar Raja যার ঝুলিতে ফিল্ম ফেয়ার এওয়ার্ড সহ নানা পুরষ্কার রয়েছে। আর্টে ছিলেন A.r Mohan. অভিনেতা অভিনেত্রীরাও যার যার জায়গায় যথাসাধ্য চেষ্টার কার্পন্য করেননি। প্রধান চরিত্র Arya আর Catherin tresa পরিচিত মুখ। তাদের ছাড়াও অন্যান্য শিল্পীরাও সাবলীল ছিলেন।
super good film এর এই চলচ্চিত্রটি আইএমডিবি রেটিং 5.3 হলেও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের কারণে সহজবোধ্য এ চলচ্চিত্রটি আপনার চিন্তাকে প্রসারে সহায়ক হবে।

চলচ্চিত্রটির অফিসিয়াল ট্রেলার লিংক : https://youtu.be/QBD2pcjtSzc

২ Comments

  1. স্বপন মাঝি

    কদমবান ছবিটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। জল-জঙ্গল-পাহাড়ে যাদের জীবন, তারা কীভাবে প্রকৃতিকে রক্ষা করে, নিজেদের বেঁচে থাকা, বন বিনাশী কর্পোরেট দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই – সবকিছু মিলে দারুণ।

    Reply
  2. eklotan

    চলচ্চিত্রটি দেখব। ধন্যবাদ লেখককে।

    Reply

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার

%d bloggers like this: