Select Page

নারী দিবস

নারী দিবস

নারীদের নিয়ে ভাল কিছু বলতে গেলে, বা সহানুভূতি দেখাতে গেলে সবাই তাদের হয় মা, নয় বোন, নয় কন্যা, নয় খালা, ফুপু ইত্যাদি বিবেচনা করে বলে বা এই সম্পর্কগুলোর দোহাই দিয়ে বলে। নারী একজন মানুষ আপনার মতই। মানুষ জাতি বলতে কেবল পুরুষ লিঙ্গধারী বোঝায় না। আর সকল উন্নত প্রানীর মতই মূলত নারী এবং পুরুষ এই দুই লিঙ্গধারী মিলেই মানব প্রজাতি।

নারীরা সন্তান দেহে ধারন করেন বলে তারা আপনার চেয়ে একটু নিচু, কম বুদ্ধিসম্পন্ন, শারীরিকভাবে আপনার চেয়ে দুর্বল এসব ধারণা বহুকাল ধরে চলে আসছে। মানব সভ্যতার কোন পর্যায়ে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হল সেটা জানতে হলে একটু কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হবে। তো এই ধারণাগুলো পুরুষতন্ত্রের টিকে থাকার জন্য জরুরি. আবার অনেকে বলবেন কেন মেয়েরা তো আসলেই শারীরিক ভাবে দুর্বল। এখন ধরুণ আপনি যদি একটা মানুষকে তার জন্ম থেকে গৃহবন্দি করে রাখেন, তার শারীরিক চলাফেরা খুব সীমিত করে রাখেন, এরকম আরও অনেক সীমা রেখার ভেতর তাকে রাখেন, তাকে মেলা মেশার সঙ্গী না দেন, কথা বলার মানুষ যদি সে না পায়, সেই মানুষটা যত সুস্থ শিশু হিসেবে জন্ম নিক না কেন, তার বেড়ে ওঠার পরিবেশের কারনে তার শরীর, মন, ভাষাগত দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছুই অনেক প্রভাবিত হবে। এরকম কিছু বাস্তব উদাহরন আছে। যেমন দু’একজন মানব শিশু উদ্ধার হয়েছে যারা জঙ্গলে বড় হয়েছে, তাদের আচরন ও ভাষা মানুষের মত হয়নি। তো হাজার বছর ধরে একটা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে, ভাবনা বলয়ে, দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীকে রেখে তাকে আপনার সাথে হুবুহু একই রকম ভাবে তুলনা করবেন এবং আপনার মত না হলেই সে নিম্নতর, তাকে শাসন করার, তার জীবন নিয়ন্ত্রন করার অধিকার আপনার, এই ভাবনা কি সভ্য, যুক্তিসঙ্গত?

আপনি এযুগের মানুষ, আপনি তো আর বর্বর, অন্ধকার যুগের মানুষ নন, তাই না? আপনার পড়াশোনার অনেক সুযোগ আছে, ইতিহাস জানার সুযোগ আছে। তাহলে আপনি সে সুযোগ কাজে না লাগিয়ে, সমাজ বিবর্তন এর ইতিহাস, অর্থনীতি কিভাবে সমাজ ও মানুষকে প্রভাবিত করে, এসব না জেনে, বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন না বুঝে এবং বাস্তবে অসংখ্য প্রমাণ চোখের সামনে দেখে যে নারীরা মহাকাশ বিজ্ঞান থেকে শুরু করে মল্লবিদ, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, রাষ্ট্রশাসক, রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, কি নয়; এরপরও নারীরা পুরুষের মত যোগ্য, বুদ্ধিমান, প্রতিভাবান, সমপর্যায়ের মানুষ কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান, হাসি তামাশা করেন, বা কুতর্ক করেন; কেন? এর পেছনে আপনার কি মনস্তত্ত্ব কাজ করে? হীনমন্যতা? নিরাপত্তাহীনতা? হাজার বছর ধরে যে সুবিধা, ক্ষমতা ভোগ করছেন তা হারানোর ভয়? তাই নারীর উপর কোন অন্যায় হলে, তাকে সুবিচার পেতে হলে তাকে মা, বোন বা কন্যা হতে হবে, এটা বুঝানোর জন্য যে সে ঘরের ইজ্জত, পুরুষদের ছায়ায় থাকা বিভিন্ন সম্পর্ক।

কাউকে সম্মান পেতে হলে, সুবিচার পেতে হলে তাকে মা, বোন, কন্যা বা বাবা, ভাই, ছেলে হতে হবে? না। একজন মানুষ, সে কারো কিছু না হলেও, সম্মান এবং সুবিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। মানুষকে প্রথমত মানুষ ভাবতে অভ্যাস করুন। নারীকে বেশী বেশী মহিমান্ত্বিত করাও নারীর জন্য ক্ষতিকর। এতে নারী যে একজন স্বভাবিক মানুষ, তারও অনেক দোষ থাকবে, চাহিদা থাকবে, অভিলাষ থাকবে, আবেগ থাকবে, ভুল করার অধিকার থাকবে, এটা অস্বীকার করা হয়। এটা মানুষ হিসেবে তাকে গন্য না করার সামিল। এজন্যই পুরুষকে নিয়ে এত মহিমা কপচানো হয় না। কারণ তারা নিজেদের স্বাধীন, স্বাভাবিক মানুষ ভাবে। আমরাও তো পুরুষদের মানুষ হিসেবেই দেখি। আমার মনে হয় না কোন নারী সকল পুরুষকে বাবা, ভাই, ছেলে, প্রেমিক, স্বামী, বা কোন না কোন আত্বীয়তার চোখে দেখে। আর এদের মাঝে যারা আমাদের আত্বীয় বা প্রেমিক বা স্বামী কেবল তাদেরকেই ওই চোখে দেখি।

আরেকটা কথা, নারীবাদ নিয়ে অনেক তর্ক, বিতর্ক, কুতর্ক চোখে পড়ে। দেখুন নারীবাদ এর জন্মের একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে, সলিড কিছু ঘটনা আছে, ইতিহাস আছে, এর বিবর্তন আছে। এখন নারীবাদ বলতে আপনি কি বুঝেন তার উপর এই ইতিহাস, প্রেক্ষাপট, ঘটনাবলী বদলে যাবে না। এগুলো না জেনেই এখন যদি আমি বলি নারীবাদের আমি এই সংজ্ঞা দিলাম, এটাই নারীবাদ। ব্যাপারটা আসলেই হাস্যকর।

যেটা নিয়ে কথা বলছেন, মতামত দিচ্ছেন সেটা নিয়ে স্টাডি করবেন না কেন? আর সেই বিষয়টা যদি হয় সামাজিক বা রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ তবে সেই বিষয়ের গভীরে না গিয়ে সেটা নিয়ে মানুষকে জ্ঞান দেয়া, উপদেশ দেয়া দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরন। আর হ্যা, নারীদিবসের প্রয়োজন কেন এখনও? কারণ এখনও নারীরা কেবল লিঙ্গ ভিত্তিক পরিচয়ের জন্য অপমানিত, হন, অন্যায়ের শিকার হন, খুন হন, বঞ্চনার শিকার হন। আর পৃথিবীতে যারাই অত্যাচারিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত তাদের সংঘ করার অধিকার, চর্চা বিদ্যমান। তাদের নিয়ে একটি বিশেষ দিবস হতেই পারে। কিন্তু এখন সব কিছুই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বদৌলতে পণ্য বেচা কেনার উৎসবে পরিণত হয়েছে, বিনোদনের বিষয়েও পরিণত হয়েছে। যারা এলিট শ্রেনির বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারী, নারী দিবস পালন করছেন, তারা এই দিবসের জন্মের ইতিহাসটা একটু কস্ট করে জানবেন। এটার যাত্রা শ্রমজীবী নারীদের হাত ধরে। কেবল খাওয়া তাও নিম্ন মানের খাবার, কয়েক ঘণ্টা ঘুম এর সময় বাদ দিয়ে যারা স্বল্প মুল্যে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হন সেই সকল নারীদের কথা এই নারী দিবসে ভুলে যাবেন না।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার