Select Page

কাঠপুতলি

কাঠপুতলি

সকাল পৌনে সাতটা। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি, শৈত্য প্রবাহ চলছে। লেপের নিচ থেকে বের হতে মন চাইছে না পুতুলের।কিন্তু স্বামী তাকে ডাকছে তার বিছানায়। ছোট ছেলেটা হওয়ার পর থেকে  পুতুল তার  বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা বিছানায় ঘুমায়। মাসে কয়েক বার এরকম ডাক আসে স্বামীর কাছ থেকে।পুতুলের বেশ ঠাণ্ডা লেগেছে।এই কনকনে ঠাণ্ডায় লেপ থেকে বের হতে মন চাইছে না তার।তবুও উঠতে হল।

পুতুলঃ আমার অনেক ঠাণ্ডা লেগেছে, কেন ডাকছো?

স্বামীঃ দরকার আছে, আসো।

পুতুলের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ কাজ করে। এমনিই তার স্বামীর অন্য নারীদের  প্রতি আকর্ষণ বেশী। এখন যদি পুতুল তার ডাকে সাড়া না  দেয়, সে অজুহাত খুঁজে পাবে।

হয়ত আর বিশ পনের দিন কাছেই আসবে না। পুতুলের শরীর যখন সঙ্গ চায় তখন সে খুব কমই পায় তার স্বামীকে। ভাল করে তার দিকে তাকিয়েও দেখে না বোধহয়, তাই কি সে বুঝতে পারে না? নাকি আসলে পাত্তা দেয় না? ভাবত পুতুল এক সময়। কিন্তু এখন, দীর্ঘ এতগুলো বছর পার হওয়ার পর, পুতুল বুঝে গেছে যে সে আসলে তাকে পাত্তাই দেয় না। কারন তার স্বামী জানে সে অন্য কোন পুরুষের কাছে যাবে না। পুতুলের নৈতিক মানদণ্ড সমাজ, তার পরিবার যেভাবে বেঁধে দিয়েছে তার বাইরে সে যেতে পারবে না। তাই হয়ত এত নির্বিকার তার স্বামী। এমনটাই মনে হয় পুতুলের। তাছাড়া সেই সুযোগও নেই তেমন। সারাক্ষন সংসার, রান্না বান্না, বাচ্চা, কাচ্চা সামলে তার দিন চার দেয়ালের ভিতরেই কেটে যায়। বিছানা থেকে উঠতে উঠতে পুতুল এসব ভাবতে থাকে। তার স্বামী তার দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসছে। পুতুল গিয়ে শুয়ে পড়ে তার পাশে।তার স্বামীকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। সাধারনত সে তার বউ এর প্রতি এত উত্তেজিত হয় না। অন্য কোন নারীর কল্পনা তাকে বেশি উত্তেজিত করে। তাই পুতুল জিজ্ঞেস করে, ‘কি ব্যাপার, এত উত্তেজিত কেন?’স্বপ্ন দেখেছ বুঝি?

স্বামীঃ না, বাজে স্বপ্ন দেখেছি।

পুতুলঃ তাহলে?

কোন উত্তর না দিয়ে সে পুতুলকে জড়িয়ে ধরে।  পুতুল শুধু বলে, ‘আমার অনেক ঠাণ্ডা লেগেছে, কাপড় পুরোটা খুলোনা।

এরপর, খুবই পাশবিক ভাবে স্রেফ জৈবিক চাহিদাটুকু মেটায় তার স্বামী। শেষ হওয়ার পর পুতুলের চোখে পাড়ার কুকুরগুলোর দৃশ্য ভেসে উঠে।

পুতুলঃ তুমি একটা কুত্তা।

স্বামীঃ হ্যা, আমিতো কুত্তাই।

পুতুলঃ কিন্তু আমি কোন কুত্তা চাইনি।

স্বামীঃ কি চেয়েছ তাহলে?

পুতুলঃ রোম্যান্টিক একজন মানুষ, যে ভালবাসবে।

স্বামীটির এসব কথায় তেমন আগ্রহ নেই। সে আরামে লেপ মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। পুতুল একাই কথা বলতে থাকে।

পুতুলঃ আমার দরকারে তোমাকে তো পাই না। তুমি তো ভাল করে আমাকে দেখই না।

স্বামীঃ আবার শুরু করলে ঘ্যান ঘ্যান।

পুতুলের হটাত গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কথা মনে হয়। শ্রমিকরা যতক্ষন মুখ বুজে কাজ করে যায় ততক্ষন ভাল; শৃঙ্খলা বজায় থাকে। কিন্তু বঞ্চনা, বকেয়া পাওনা বেশি হয়ে গেলে যখন দাবি দাওয়া নিয়ে কথা বলা শুরু করে তখনই মালিক পক্ষের কাছে উপদ্রব মনে হয়। হয় তখন ডাণ্ডা মেরে বা চাকুরি যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ঠাণ্ডা করা হয়। নিজেকে পুতুলের এরকমই একজন শ্রমিক মনে হয়। তার কষ্টের কথা, বঞ্চনার কথা তুললেই তার স্বামী খুবই বিরক্ত হয়। বেশি রেগে গেলে উত্তম মধ্যমও দেয়া হয় তাকে। বেশিরভাগ সময় ই বলে ভাল না লাগলে অন্য কোথাও চলে যাও, আমি এমনই।

কিন্তু অন্য কোথায় যাবে পুতুল। অনেকবার ভেবেছে সে চলে যাবে। কিন্তু বাবার বাড়ির অবস্থা ভাল নয়, নিজে শিক্ষিত হলেও এত বছর সংসার করে সময় অনেক চলে গেছে, এখন এই বয়সে কে তাকে চাকুরি দেবে। আর সামান্য চাকুরির বেতনে তার দুই ছেলের খরচ চলবে? আবার যদি তার বাচ্চা দুটো রেখে দেয়? সৎ মায়ের কাছে ভাল থাকবে না তার আদরের জাদু মণিরা। এটা ভাবলেই তার বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠে। ‘আমার অবস্থা কারখানার শ্রমিকের চেয়েও করুণ,’ বিড় বিড় করে বলে পুতুল।

তাই এ অপমান, বঞ্চনা, গালাগালি, মারধোর, এ জীবন, মেনে নিতে হচ্ছে পুতুলকে। এগুলো মেনে নেয়ার প্রক্রিয়া সহজ ছিল না শুরুতে। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে যখন সে বুঝতে পেরেছে তার কোন বিকল্প পথ খোলা নেই, তখন সে মেনে নিতে শিখেছে। মেনে নেয়া শিখতে গিয়ে তাকে ‘পজিটিভ মাইন্ডের’ বয়ান আত্মস্থ করতে হয়েছে। সে তখন তার স্বামীর ভাল দিক গুলো নিয়ে ভেবেছে।  হাজার হলেও তার ও তার সন্তানদের সব খরচ সে বহন করে। মাঝে মাঝে তাকে বেড়াতে নিয়ে যায়। কিছু গহনা করে দিয়েছে। মন মেজাজ খুব ভাল থাকলে তার সাথে একটু আধটু হাসি তামাশাও করে। অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখাতে কার্পণ্য করে না। সমাজে মান সম্মান নিয়ে খেয়ে পড়ে আর দশটা শকুনের হাত থেকে বেচে থাকতে পারছে পুতুল, এই বা কম কিসে। অনেক মেয়ে তো তাও পায় না, ভাবে পুতুল।  তাই ক্ষমা করে দেয় তার স্বামীর সমস্ত বিশ্বাঘাতকতাকে, অপমানকে দুর্ব্যবহারকে, গায়ে হাত তোলাকেও। মেনে নেয় যৌন সুখহীন,  ভালবাসাহীন, সম্মানহীন এক কাঠপুতলির জীবন।

কিন্তু কেন কে জানে মাঝে মাঝে এই কাঠপুতলির ভেতর থেকে এক রক্ত মাংসের, হৃদয়ের অধিকারিণী মানবী উঁকি দেয়; সব ভেঙ্গে চুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে পুতুলের। মার খাবে জেনেও তর্ক জুরে দিতে ইচ্ছে করে তার স্বামীর সাথে।   

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার