পেশায় শিক্ষক। অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন। ঢাকা নটরডেম কলেজে অধ্যাপনার কারণে সমালোচনার চোখে পড়ে ওখান থেকে চলে আসেন। ব্যাপারটা এখন আমার কাছে এমন মনে হয় যেন, দেশের সবগুলো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করত বিপ্লবী শক্তি। তারা অন্য কোথাও জীবিকার প্রয়োজনে কাজ করতে পারবে না। বলছিলাম অধ্যাপক ননী দত্তের কথা। পত্র-পত্রিকায় লিখতেন অজয় দত্ত নামে। রাজনৈতিক কর্ম্মীদের কাছে পরিচিত ছিলেন মোস্তাক ভাই, নাজমুল ভাই নামে। হ্যাঁ, উনি জীবনের শেষদিন পর্য্যন্ত বিপ্লবী ছিলেন। আপোষ করেন নি। চিন্তার দিক থেকে কখনোই উনাকে ‘গোড়া’ বলে হয় নি। কোন মত উনার ভাবনার বিরুদ্ধে গেলেও না। উনার লেখাগুলো এখনো খুব প্রাসঙ্গিক বলেই , আমরা ‘পাথর’ বিভাগে প্রকাশ করব যেন , যে কেউ তথ্যসূত্র হিসাবে লেখাগুলোকে ব্যবহার করতে পারেন। ভাষা নিয়ে যা-ইচ্ছে-তাই ব্যাপার হচ্ছে। মূল ঘটনাকে আড়াল করে ফেলা হয়েছে অনেক আগেই। এ নিয়ে অধ্যাপক ননী দত্ত লিখেছেন, আমরা আপাতত একটি লেখা প্রকাশ করলাম। জলমাটি
একুশের চেতনাকে যারা হত্যা করতে চাইছে ও ছাই-চাপা দিচ্ছে
অধ্যাপক ননী গোপাল দত্ত
প্রতি বছরের মতো এবারও একুশে ফেব্রুয়ারি আসবে, ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকেই শুরু হয়েছে সেই তোড়-জোড়, যা প্রতিবছরই হয়ে থাকে, বইমেলার নামে সাধারণ মেলায়। তাতে বইয়ের কিছু দোকানপাট অবশ্য থাকে। প্রতিবছর এই মেলার আকার ক্রমাগত বড় হচ্ছে। মাছ, মাংস ছাড়া সবকিছুই এ মেলায় পাওয়া যাবে। মাঝে মধ্যে থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আসর, যেখানে পাওয়া যাবে না ১৯৫২ সনের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে যে চেতনা, যে মানসিকতা উৎসারিত হয়েছিল তার কণামাত্র ছাপ। বক্তৃতার আসরে, বক্তৃতা-বাগীশদের মুখ থেকে বের হবে অন্যান্য বছরের মত গৎবাঁধা একই কথা, ‘এখনও সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি’, ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘একুশের চেতনার পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রভৃতি। পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হবে তথাকথিত ভাষা সৈনিক যাদের কেউ বা ১৯৭১ সনের পরিস্থিতিতে সংগ্রামের জন্য অর্থ আত্মসাৎ করে রাতারাতি অর্থশালী বনে গেছেন, কেউ বা দীর্ঘ দিন বাম রাজনীতির পতাকা বহন করে বর্তমান ডান রাজনীতির তথা সংশোধনবাদের পতাকা বহন করছেন। একুশের চেতনার পরম শত্রু কেউ আবার ‘ভাষা সৈনিকের টুপি’ পরার চেষ্টা করবেন।
বইয়ের বাজারে বাজিমাত করবেন সেসব লেখকরাই, যারা বিভিন্ন রকম মাদকতা, যৌনতার মতো সমাজ অবক্ষয়ী প্রবণতায় সুড়সুড়ি দিয়ে চুটিয়ে। বাবসা করবেন, অটোগ্রাফ দেওয়ার মাধ্যমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইবেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অনুষ্ঠানমালায় । যে সংস্কৃতি প্রচারিত হবে তাতে প্রতিফলিত হবে না একুশের চেতনার প্রকৃত রূপ । প্রচারিত হবে তার বিকৃত রূপ। উগ্র জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি। মারামারি চলবে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ তথা ধর্মীয় মৌলবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের মধ্যে। একুশের চেতনা ডুবে যাবে এ ডামাডোলের মধ্যে। বস্তুত প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে এ বিশাল আয়োজন একুশে ফেব্রুয়ারির প্রকৃত চেতনাকে ছাই-চাপা দিয়েছে।
১৯৫২ সনের আন্দোলন যার সর্বোচ্চ প্রকাশ ২১ শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার মধ্য দিয়ে তার রয়েছে দুটো দিক। তা হলো সম্পূর্ণ অবাস্তব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্ব বিরোধী চেতনা তথা সামন্তবাদী সংস্কৃতি বিরোধী প্রাথমিক চেতনা। ধর্ম ও কুসংস্কারই সামন্তবাদের মতাদর্শগত ভিত্তি। উপমহাদেশের জনগণকে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত রাখার মাধ্যমে নিজেদের শোষণ শাসনকে অব্যাহত রাখার প্রয়োজনেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের বুলি আওড়ে ছিল। বাঙালি বেলুচ, সিন্দী, পাঠান প্রভৃতি বিভিন্ন জাতিসত্তার জনগণকে পাকিস্তান রাষ্ট্রে আটকে রেখে নির্মম শোষণের প্রয়োজনেই তারা সৃষ্টি করেছিল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের । ১৯৫২ সনের আন্দোলন সেই প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শকেই প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে। এই অঞ্চলের সমাজ বিকাশকে সামন্তবাদ; সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে পরিচালিত করার পথ খুলে দেয়। কিন্তু তখনকার সাম্যবাদী বিপ্লবীদের অদূরদর্শিতা ও চরম কাণ্ডজ্ঞানহীনতার ফলে ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের স্থান দখল করে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যা সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণবাদের দ্বারা পুষ্ট হয়ে শক্তিশালী হয় তাদেরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণবাদের ওপর নির্ভর অবক্ষয়ী বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটায় । আজ প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ও উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যকার সংগ্রাম ও আপোষ বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির প্রধান ধারা। উভয় ভাবধারার শেণী ভিত্তি একই, অর্থাৎ সামন্তবাদ ও লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণী বলে তাদের মধ্যে সাময়িক ঐক্য ও আপোষ হয়। ১৯৮৬ সনে এরশাদের শাসনামলে তথাকথিত নির্বাচনে জামায়াত ও আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ, আবার ১৯৯০ সনে এরশাদ সরকার বিরোধী সমঝোতাভিত্তিক আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলন, প্রভৃতি এর দৃষ্টান্ত। আবার গদি দখলের প্রশ্নে এদের মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড বিরোধ।
১৯৫২ সনের রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি ছিল উপলক্ষ মাত্র, কারণ নয়। যদি তাই হত তাহলে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর অনেক আগেই সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু হয়ে যেত। ইংলিশ স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমাগত বৃদ্ধি না পেয়ে বন্ধ হয়ে যেত । সেই সময়কার আন্দোলনকারী নেতাদের সন্তান-সন্ততিদের বাংলা ভাষায় শিক্ষাদনের চেয়ে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা ও আরবি শিক্ষার প্রবণতা কয়েক গুণ বেড়ে যেত না।
১৯৫২ সনের আন্দোলনের আরেকটি দিক ছিল এতদঞ্চলের স্বায়ত্ত্বশাসন, আত্মনিয়ন্ত্রণ। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর জাতিগত নিপীড়নের নীতির ফলে অঞ্চলের শুধু শ্রমিক কৃষকরাই শোষিত নিপীড়িত ছিল না, বুর্জোয়া (সামরিক, বেসামরিক) এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরাও নিপীড়িত ছিল। এ শোষণের, নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ১৯৫২ সনের ২১ শে ফেব্রুয়ারির মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশের উদ্ভবের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণবাদের ছত্রছায়ায় এদেশের বুর্জোয়া (সামরিক আমলাতান্ত্রিক) শ্রেণীর আত্মনিয়ন্ত্রণ তথা রাতারাতি ধনী হবার সুযোগ হলে শতকরা ৯০ ভাগ জনতার শোষণ নিপীড়নের প্রবণতা ধ্বংস না হয়ে বরং অনেকগুণ বেড়ে গেছে। পাকিস্তানের ৭২ টি কোটিপতি পরিবারের জায়গায় কয়েক হাজার কোটিপতির জন্ম হয়েছে। কোনো দেশের স্বাধীনতা বলতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সম্পূর্ণ কবল মুক্ত হওয়া বোঝায়, অগণতান্ত্রিক সামন্তবাদী ভাবাদর্শ থেকে মুক্তি তথা প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ জনগণের রাষ্ট্র বোঝায়। এর কোনটাই আজ বাংলাদেশে নেই। একুশের চেতনা আজ দুর্বৃত্তের কারাগারে বন্দী। এ চেতনাকে মুক্ত করার সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী নয়া গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কায়েম করারই সংগ্রাম।
সাম্প্রতিক মন্তব্য