সন্তানদের শিক্ষা এবং পিতা-মাতার দুঃখ দুর্দশা
সন্তানদের মানুষ করা বা সমাজে টিকে থাকার যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলার যন্ত্রণা (মানুষ ব্যতীত) অন্য কোন জীবজন্তুর আছে কি?
ঘটনা-এক। ভদ্রলোক বললেন, অনেকদিন রাতে ঠিকমত ঘুম হয় না। আমি বললাম, নিয়মিত বিকালে যদি এক ঘণ্টা হাঁটেন, তাহলে রাতে ভালো ঘুম হতে পারে। ভদ্রলোক বললেন, হাঁটাহাঁটি যথেষ্ট পরিমাণ করি, তবুও রাতে ঘুম হয় না। আমি বললাম, কি নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করেন যে, রাতে ঘুম হয় না? ভদ্রলোক বললেন, সন্তানদের পড়ালেখার জন্য টাকা দিতে হয়, এই টাকাটা ঠিকমতো গোছাতে পারিনা, ছেলে মেয়েদের ‘মানুষ করা’ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় থাকি।
উক্ত ঘটনাটি সত্য, ইদ্যানিং অসংখ্য পিতা-মাতা বা অভিভাবক এমন পরিস্থিতি’র শিকার। শিক্ষা ব্যবস্থার অতি বাণিজ্যকরণের কারণে এমনটি হয়েছে। প্রকৃতিতে বিরাজমান প্রতিটা জীবের সন্তান হয়। প্রতিটা জীব, তার সন্তানদের প্রকৃতিতে টিকে থাকার শিক্ষা দেয়। খেয়াল করে দেখুন; বাঘ, সিংহ, কুকুর, বিড়াল বা পাখি এসব জীবজন্তু কিন্তু তাদের সন্তানদের প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়ে থাকে। তাদের সন্তানদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য এসব জীবজন্তুদের খুব বেশি কষ্ট পোহাতে হয় না, খেলার ছলেই তারা তাদের সন্তানদের প্রকৃতিতে টিকে থাকার শিক্ষা দেন। মানুষও আর পাঁচটা জীবজন্তুর মতোই একটি জীব, মানুষের সন্তান হয় মানুষ সন্তানদের শিক্ষা দেয়।
এই পৃথিবীতে আধুনিক মানুষের উৎপত্তি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে। এই যে লক্ষ বছর ব্যাপী মানুষ এই পৃথিবীতে বিচরণ করেছে, প্রকৃতিতে টিকে থাকার শিক্ষা নিশ্চয়ই মানুষ পেয়েছিল তাদের পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে। প্রাচীনকালে মানব শিশু খেলার ছলে বড়দের কাছ থেকে প্রকৃতিতে টিকে থাকার শিক্ষা লাভ করতেন, বাবা-মা কি কর্ম করে, তা দেখেই ধীরে ধীরে সন্তানেরাও সেই কর্মগুলো আয়ত্ত করে নিতেন। ছোটদের খেলাধুলার ধরনগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, একটি মেয়ে বাচ্চা শিশুকালে ছোট ছোট হাড়ি পাতিল দিয়ে রান্না করার কলা কৌশল নিয়ে খেলাধুলা করে, পুতুলের বিয়ে দেয়, কলাপাতা ও বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ছোট ঘর তৈরি করে। এই যে খেলার ধরন, এগুলো কিন্তু বড়দের কর্মগুলোই ছোট বয়সে আয়ত্ত করা, তাছাড়া শিশুরা মাছ ধরে, তীর ধনুক দিয়ে পাখি শিকার করে, গাছে উঠে ফল সংগ্রহ করে, এসবই কিন্তু প্রকৃতিতে টিকে থাকার শিক্ষা লাভ করা। মানুষের এইসব শিক্ষা লাভ করার জন্য কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হয়নি, এই ধরনের শিক্ষা বড়দের কর্মগুলো দেখে দেখেই মানব শিশুরা আয়ত্ত করে। তাছাড়া প্রাচীন মানুষেরা তাদের সন্তানদের হাতে-কলমে কিছু শিক্ষাও দিয়েছিল। আধুনিক যুগ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা বহাল ছিল। সন্তানদের এই ধরনের শিক্ষা লাভ করার জন্য পিতা-মাতার কোন দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। সেই সময়ে কৃষকের ছেলে খুব সহজে কৃষিকাজ শিখে গিয়েছে, কামারের ছেলে যন্ত্রপাতি তৈরি করতে শিখেছে, কুমোরের ছেলে হাড়ি পাতিল তৈরি করতে শিখেছে, কাঠুরিয়ার ছেলে কাঠের কাজ শিখেছে। এইসব শিক্ষা দেওয়ার জন্য ছেলে=মেয়েদের অন্যের কাছে পাঠাতে হয়নি। তৎকালে, ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্য পিতা-মাতাদের খুব বেশি দুশ্চিন্তা করতে হয়নি, বরং সন্তানরা বড় হলে পিতা-মাতারা খুশি হতেন এই ভেবে যে, সন্তানরা সংসারের কাজ করে বাবা মায়ের কষ্ট কিছুটা লাঘব করবে।
বর্তমান যুগে সন্তানদের মানুষ করা সত্যিই খুবই কঠিন এবং খুবই দুঃখ-যন্ত্রণা ও হতাশার কাজ। এখন কৃষকের ছেলে কৃষক হয় না, কাঠুরিয়ার ছেলে কাঠুরিয়া হয় না, কুমোরের ছেলে কুমোর হয় না, ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হয় না। মোটকথা বাবা-মায়ের পেশা সন্তানরা গ্রহণ করে না বললেই চলে। সুতরাং বাবা মায়ের কাছ থেকে সন্তানেরা আয় রোজগার করার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠে না। এখন পরিবার থেকে সন্তানেরা সাধারণত পারিবারিক মূল্যবোধ ও ধর্ম শিক্ষা লাভ করে শুধু। সমাজে টিকে থাকার যোগ্য হতে হলে সন্তানদের স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেরণ করতে হয়, এই যে শিক্ষা এই শিক্ষাটা খুবই প্রতিযোগিতামূলক এবং ব্যয়বহুল। তাছাড়া সন্তানদের বাসা থেকে দূরে প্রেরণ করলে বাবা-মায়েরা এক ধরনের দুশ্চিন্তায় থাকবেই তদুপরি পড়াশুনার খরচ অনেক। দূরে একা থেকে সন্তানেরা ঠিকমতো পড়াশোনা করছে কি-না তা নিয়েও বাবা-মাদের মনে অনেক শংকা কাজ করে। সব মিলে এখন পিতা-মাতাদের সব সময় দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়, যে কারণে সন্তানদের মানুষ করা এখন অনেকটাই দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে।
এখন প্রশ্ন হল মানুষের এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কি?
মানুষ তো আর প্রাচীনকালের মত শিকার নির্ভর জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে পারবে না অথবা বংশ-পরম্পরায় একই ধরনের পেশায়ও মানুষ আর থাকতে চাচ্ছে না। প্রতিটি মানুষ তার মনের মত শিক্ষা লাভ করবে। যে, যে বিষয়ে আনন্দ পায় তার সেই বিষয়েই শিক্ষা লাভ করা উচিত। তাহলে নিশ্চয়ই একজন কৃষক তার সন্তানকে কৃষিকাজ শেখাতে পারে না যদি না সন্তান কৃষিকাজে আগ্রহী হয়ে না উঠে। তাছাড়া কৃষি কাজও প্রযুক্তি নির্ভর এবং বিজ্ঞান নির্ভর হয়ে উঠেছে সুতরাং সবাইকেই এখন বিদ্যালয়ে যেতেই হবে। তাই শিক্ষাব্যবস্থা যদি সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় খরচে পরিচালনা করা সম্ভব হয়, তাহলে সন্তানদের ‘মানুষ করা’ বা প্রকৃতিতে টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জন করা নিয়ে পিতা-মাতাদের দুঃখ, দুর্দশা ও কষ্ট কিছুটা লাঘব হতে পারে।
সাম্প্রতিক মন্তব্য