Select Page

জম্বির জীবন

ক্যামেরা মোবাইলে চলে আসার পর, ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রামে সে-সব ছবি সবাইকে দেখানোর সুযোগ চলে আসায় মানুষের আনন্দের মুহুর্তগুলো আর নির্মল রইল না। ছবি তুলতে তুলতে প্রকৃতির সঙ্গ আর অনুভব করা হয় না আগের মত। জন্মদিন বা কোন আনন্দ উৎসবও পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করা হয় না। অসংখ্য বিনোদনের ডিভাইস- কম্পিউটার , টিভি, নেট ইত্যাদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রাকৃতিক সাবলীলতা, সম্পর্কগুলো, ছোট ছোট আনন্দের বা দুঃখের মুহুর্তগুলোকে আর উপলব্ধি করতে দেয় না। প্রকৃতির বরদানের সাথে চলছে আমাদের বিচ্ছেদ। প্রযুক্তি, বুদ্ধি বা চিন্তার বিকাশের মাঝামাঝি এই পর্যায়ে মন ও চিন্তা মানুষকে এতটাই আছন্ন করে রাখছে যে স্বাভাবিক একটি প্রাণী হিসেবে খাওয়া দাওয়ার আনন্দ, ঘুমানোর আনন্দ বা ঘুম ভেঙ্গে সকাল দেখার আনন্দ, হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে দিনটা শুরু করার যে আনন্দ বা সন্ধ্যার অপরূপ নিসর্গ ও নীরবতা বা রাতের আগমন কোন কিছুতেই যেন আর বেঁচে থাকার রোমাঞ্চ বা শিহরণ নেই।

প্রাণী হিসেবে জীবন যাপনের পরতে পরতে প্রকৃতির সাথে নিবিড় সংযোগে বেঁচে থাকার সহজাত শরীর বৃত্তীয় যে আনন্দ তা আজ হারিয়ে গেছে চিন্তার অস্থির ঢেউ আর ভোগের কৃত্তিম উপকরণ ও প্রতিযোগিতায়। আদিবাসী সমাজগুলো এমন অস্থির ও প্রকৃতি বিরুদ্ধ ছিল না। তারা প্রকৃতিকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে মানত। যে মানুষেরা একেবারে সরল ও প্রকৃতির সাথে নিবিড় ভাবে সহবস্থান করতো (যেমন পূর্বের গ্রামীণ বা আদিবাসী সমাজগুলো) তাদের চাকচিক্য বা ভোগের মেকি আয়োজন দরকার পড়ত না। জীবনের স্বাভাবিক আনন্দ তারা উপভোগ করতে পারত। বেঁচে থাকতে যেটুকু পরিশ্রম করা দরকার তা করা, আবার তেমন কিছু না করে চারণ ভুমিতে বাঁশি বাজিয়েও কেউ আনন্দ পেত। পশ্চিমারা তাদেরকে যত অজ্ঞ, জংলি বা অসভ্য জাতিই বলুক না কেন এখন বাস্তবে আমরা দেখছি যে বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের বা উন্নতির যে বড়াই তারা করে তা কতোটা আত্মঘাতি। প্রকৃতি, মানুষের জীবন সবই আজ তারা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। উপহার দিয়েছে বিষণ্ণতা, হতাশা আর যুদ্ধ। তাদের চাপিয়ে দেয়া (ছলে, বলে, কৌশলে) এই তথাকথিত সভ্যতা, প্রতিযোগিতামূলক সমাজ ব্যবস্থা মানুষের হতাশা ও কষ্টের কারণ হয়েছে। মানুষকে কলের মেশিনে পরিণত করেছে। কঠোর পরিশ্রমী শ্রমিক, কৃষক, নিম্ন বেতনের চাকুরে বা মধ্যম ও ভাল আয়ের মানুষ সকলেই এখন যন্ত্রের মত বেঁচে আছে। বেঁচে থাকতে একদল খেটে মরছে মেশিনের মত আর একদল বিলাসিতার অঢেল সুযোগ ও সময় পেয়েও তাদের সাম্রাজ্য বা অবস্থান ধরে রাখতে বা আরও বাড়াতে লোভের কলে পা দিয়ে বিবেক ও হৃদয় বিবর্জিত হয়ে জম্বিতে পরিণত হয়েছে। জীবিত শরীরে মৃত মানুষ। এদের এখন আর রক্ত মাংসের মন, আবেগ বা হৃদয় আছে এমন মানুষের প্রয়োজন পড়ে না মনের খোরাক যোগাতে। টাকা দিয়ে কেনা চাটুকার, সম্পর্ক, ভোগের বিবিধ উপকরণ নিয়ে এরা বেঁচে আছে।

বুদ্ধিমত্তা বা জ্ঞানের বিকাশের এই স্তর থেকে অনেক উচ্চতায় বা গভীরে না গেলে এই অস্থির, অস্বাভাবিক, প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতা, বিষন্নতা, হতাশা থেকে মুক্তি আসবে বলে মনে হয় না। আর তাই হয়তো জ্ঞানীরা মানুষকে সহজ সরল জীবন যাপনের কথা, জ্ঞান চর্চার কথা বলে গেছেন। জ্ঞানের গভীরে না গেলে সত্য অনুধাবন করা যায় না। এখানে জ্ঞান বলতে পুঁথিগত জ্ঞানের কথা বলা হচ্ছে না। কিসে জীবন সুন্দর ও শান্তিময় হতে পারে সেই জ্ঞান দরকার। প্রকৃতি, সমাজ, ইতিহাস, জীবন ও পারিপারশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে পাঠ নিয়ে আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করলে বোধ জাগ্রত হয়, উপলব্ধি আসে। মানুষ মনে, মননে, প্রজ্ঞায় যখন উন্নত হয়, গভীরতায় পৌছায় তখন সে মেকি জীবন যাপন বা ভোগ বিলাসের প্রতিযোগিতা ও এর অসারতা বুঝতে পারে। মাঝামাঝি স্তরের এই জ্ঞানই কি এই ধ্বংসের কারণ? কথায় আছে অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী। আংশিক জ্ঞান নিয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবলে বিপদ ও আপদ দুটোই হাজির হয়। যেমন ধরুন একজন এমবিবিএস ডাক্তার আর একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মধ্যে পার্থক্য আছে তাদের জ্ঞানের। এখন এমবিবিএস পর্যন্ত গিয়ে যদি কেউ মনে করে এটাই চূড়ান্ত জ্ঞান তবে তো বিপদ। মানব জাতি এখনও বস্তু জগতের বা বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডারের আংশিক উন্মোচন করেছে মাত্র এবং এই প্রক্রিয়া চলমান। আমরা এখন জ্ঞান বিকাশের একটা স্তরে আছি। এর উপর ভিত্তি করে সব বুঝে গেছি ভাবা মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার