Select Page

তাভেরনিয়ের ভ্রমণ : পর্ব তিন

তাভেরনিয়ের ভ্রমণ : পর্ব তিন

[এই অংশটি মূল ভ্রমণকাহিনীর দ্বিতীয় অধ্যায় বা পর্বের শেষাংশ। দীর্ঘ লেখায় পাঠকের বিরক্তির উদ্বেক না হয়, তার জন্য দুই পর্বে প্রকাশিত হলো। —অনুবাদক]

কাফেলাগুলো একই ধারায় যাত্রা করে না। কর্মযজ্ঞে কখনও তারা দ্রুত আসে, কখনও দেরীতে আসে। এটা নির্ভর করে জল ও সরাইখানা অথবা তাঁবু স্থাপনের উপযুক্ত স্থানের উপর, যেখানে স্থানীয়রা তাদের খাবার সরবরাহ করে এবং পর্বত থেকে পশু খাদ্য নিয়ে আসে। এমনও স্থান আছে যেখানে দুতিন দিনের জন্য খড় ও যব সরবরাহ করতে হয়। যদি মে মাসে ভ্রমণ করেন, ঘাসগুলো তখন বড় থাকে; ঘোড়া ও উটের জন্য তখন খরচ করতে হয় না। কাফেলা অবস্থান নেওয়ার সাথে সাথে চাকরেরা টিলা থেকে ঘাস কেটে নিয়ে আসে। সমতলের ঘাসের ছেয়ে সেগুলো অনেক ভাল। তবে শুধু ঘাস খাওয়ালে পশুগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অন্য সময়ের মত দ্রুত চলতে পারে না।

পর্বত থেকে, যেখানে আরমেনীয়রা দস্যু কবলিত হয়েছিল, আলমাসে আসতে হবে। আলমাস নদী তীরস্থ ছোট একটি গ্রাম, একটি কাঠের সেতু দিয়ে পার হতে হয়।
আলমাস থেকে বেরিয়ে একটি বিশাল সমভূমি পেরিয়ে একটি নদীর তীরে আসতে হবে। নদীটি অতি সুন্দর, নাম টফানলু-সু, এটি টোকাট নদীতে পড়ে।

এই নদী পাড়ি দিয়ে আপনি একটি পর্বতে আরোহন করবেন। স্থানীয়রা এটিকে বলে কারা-বিচির-বোগুইয়েন্ড্রেন। অথবা গ্রাণ্ড সাইনরকে ঠেকানোর পাহাড়। এটির প্রচুর প্রস্তরময়, এতে আরোহণ করতে হলে আপনাকে সাবধান হতে হবে। ঐ বাজে রাস্তায় দুটি ঘোড়ার পতন হয়েছিল। সেগুলো প্রত্যেকে দুই বেল করে ইংলিশ কাপড় বহন করছিল। এরা আমাদের আগে যাওয়া তার্তারদের দুর্দান্ত খাবারে পরিণত হল। যেখানে পিচ করা হয়েছিল আমরা সেখানে থাকার মনস্থ করেছিলাম, কিন্তু তারা সেখানে থাকায় আমাদের বাধ্য হয়ে পোয়া লীগ দূরে অবস্থান নিতে হয়। তার্তারেরা যখন আমাদের দুটি ঘোড়ার মৃত্যু সংবাদ শুনল, কল্পনাতীত আনন্দের সহিত তাদের পনের ষোল জন এসে সেগুলোকে পর্বতের দিকে নিয়ে গেল খাওয়ার জন্য। তারা ঘোড়াগুলোকে নিয়ে গেল এবং (আমি তাদের কর্মকাণ্ড দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলাম) তারা ঘোড়ার জিনে ও পীঠে করে বড় বড় মাংসের টুকরো নিয়ে ফিরে এল। এভাবে মাংসগুলো নরম হয়ে উঠে এবং ঘোড়ার গতি ও উত্তাপে ঝলসানো মাংসের মত হয়ে যায়। তারা আর কিছু করা ছাড়াই এই মাংস খায়। তাদের একজনকে দেখলাম একটুকরো ঘোড়ার মাংস নিয়ে দুই টুকরো বাজে লিলেন কাপড়ে পেঁচিয়ে লাঠি দিয়ে সশব্দে পেটাতে লাগল। এরপর দাঁতে ছিঁড়ে লোভনীয় খাবারের মত খেতে লাগল।

আমার কথিত পর্বতের চুঁড়ায় একটি সমভূমি রয়েছে। সে সমভূমিতে চেসমে বেলের নামের একটি ঝর্ণ রয়েছে। স্ফটিক প্রস্রবণ। এর দক্ষিণে রয়েছে একটি গ্রাম।

আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে আদ্রাস নামক একটি ছোট শহরে চলে আসি, এখানকার বাসিন্দাদের সকলেই আর্মেনীয়।

আদ্রাস থেকে দুই লীগ দূরে আরেকটি গ্রাম, আস্পিদার।

পর্বতশিখরে আরেকটি গ্রাম হল ইসবেদার। সাধারণত, কাফেলাগুলো দুই-এক দিনের জন্য এখানে থাকে। এখানে শুল্ক দিতে হয়, প্রতি উটে পোয়া আর প্রতি ঘোড়ায় আধ রিক্সডলার। এখানকার ওয়াইন সস্তা ও উৎকৃষ্ট, যা প্রত্যেকেই নিজের জন্য সংগ্রহ করে রাখে।

আমরা দু বার বিনাশুল্কে পাশ দিয়ে যাতায়াত করেছি, এই বিবেচনায় যে শুল্ক আদায়কারীদের তুলনায় কাফেলা ছিল অনেক শক্তিশালী। এবং যদি কাফেলা ওয়াইনের জন্য অবস্থান না করে তাহলে কোন কিছু না দিয়েই তারা চলে যেতে পারে।

ইসবেদার ছেড়ে আমরা পর্বতশিখরের আরেকটি বড় শহরে এসে উপনীত হলাম। বাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে পাথর কেটে কেটে, সোপানগুলোও একই রকমে তৈরি। এই গ্রাম থেকে কাঠের সেতুর উপর দিয়ে একটি নদী পার হলে, একেবারে শেষ মাথায় একটি সরাইখানা আছে। স্থানটির নাম জাকাপা। এই গ্রাম থেকে সরু পথে চলতে হয়। বাধ্য হয়েই উটগুলো থেকে মাল নামিয়ে নিতে হয়। ত্রিশ কদমের মত মানুষের কাঁধে বহন করতে হয়। এখানে একটি ছোট সমতলে তাঁবু খাটাতে হবে। স্থানটির নাম ডিকমেবেল, এটি উচ্চ পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত। পরের শহর কুর্দ-আগা। এরপর আপনাকে তিনটি নদী পার হতে হবে। একটি অগভীর, পার হতে হয় পদব্রজে, অন্য দুটির উপর সেতু আছে। এরপর আপনি এসে পৌঁছবেন গার্মেরু গ্রামে।

গার্মেরু থেকে সিউকমেন গ্রাম, এরপর লরি। লরি থেকে চাউকেউ—এ দুটি খুব সুন্দর শহর।

চাউকেউতে আমি একজন বৃদ্ধকে দেখেছি যার বয়স একশত ত্রিশ বছরেরও বেশি। সুলতান আমুরাত যখন বাগদাদ অবরোধ করেছিলেন তখন তিনি সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে একদিনের জই (ওট) সরবরাহ করেছিলেন। এর প্রতিদান স্বরূপ, সুলতান তার ও তার পুত্রদের আজীবনের জন্য যাবতীয় কর ও শুল্ক থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন।

চাউকেউ থেকে আসবেন আগ্গিডুগী বা দ্য বিটার মাউন্টনে, এটি উঁচু ও বন্ধুর পর্বত। পথ সংকীর্ণ, বাধ্য হয়েই কাফেলাগুলোকে একক ভাবে চলতে হয়; তখন তারা একটি একটি করে উট ও ঘোড়াগুলো গণনা করে। কাফেলার মালিককে নির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক দিতে হয়। কাফেলা বেশি হলে শুল্কের পরিমাণও হয় অনেক বেশি। এই অর্থের একটি অংশ দিতে হয় আর্মেনীয়দের, যারা সমস্ত পথ কাফেলাকে পাহারা দিয়ে রাখে। অন্য অংশ দিয়ে পথখরচ বহন করা হয়। অবশিষ্টাংশ সৈন্যাধ্যক্ষ লভ্যাংশ হিসেবে গ্রহণ করেন।

এই পর্বত পেরিয়ে আপনি একটি সমভূমিতে চলে আসবেন, যাকে তারা জিওগাণ্ডারেসি বলে। এখান থেকে এরজেরম পর্যন্ত পথে তিনটি গ্রাম মিলবে—আচিকালা, গিনিস ও হিগিয়া—এগুলোতে কাফেলা বিশ্রাম করে। শেষ তিন দিনের যাত্রায় আপনাকে ইউফ্রেটিস নদীর তীর ধরে অনেকগুলো স্থান চলতে হবে, রাস্তাটি এখন পর্যন্ত সংকীর্ণ। এর উৎস এরজেরমের উত্তর দিকে। বিস্ময়কর ব্যাপার হল নদীর ধারে প্রচুর পরিমাণে শতমূলী গাছ জন্মাতে দেখবেন। এগুলো দিয়ে আপনি কয়েকটি উট বোঝাই করতে পারবেন।

এরজেরম থেকে এক লীগ গেলেই কাফেলাকে থামতে হবে। শুল্ক দপ্তরের কর্মকর্তা পাশার প্রতিনিধির সাথে এখানে আসেন। তিনি গাঁট ও সিন্দুকগুলো রশি দিয়ে আড়াআড়ি বেঁধে সীল করে দেন। শেষ পর্যন্ত বণিক যখন শহরে আসেন, তখন তারা লুকানোর উদ্দেশ্যে কোন মুদ্রার থলে বা অন্য কোন জিনিসপত্র সরাতে পারে না। পাশার প্রতিনিধির বিশেষ কাজ হল, বণিকদের সঙ্গে মদ আছে কিনা তা ভালভাবে তদারক করা। যদি তিনি কোন বোতল চান, তা তাৎক্ষণিক বা শহরে যেখানে তারা বণিকদের সাথে মিলিত হতে সংকুচিত হন না, তাকে দিতে হবে। এর কারণ হল, এরজেরমে মদ উৎপাদন করা হয় না। তারা মিনগ্রেলিয়ার ছোট ছোট ওয়াইন পান করে। এগুলো সর্বদা সবুজ। যার কারণে বণিকেরা নিজেদের টোকাটের মদ দিয়ে সজ্জিত রাখে, যা তাদের পারস্য পর্যন্ত চাহিদা মেটাবে। শুল্ক দপ্তরের কর্মকর্তা সাধারণত কাফেলাকে তিন দিনের অবস্থানের অনুমতি প্রদান করে। এই সময় তিনি প্রধান বণিকের নিকট কিছু ফল ও অন্যান্য ছোট ছোট খাবার পাঠান, যার দ্বারা তিনি বেশ একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তিন দিন শেষ হলে তিনি এসে গাঁটগুলো ও সিন্দুকগুলো খুলে দেন, এবং সূক্ষ্মভাবে সমস্ত পণ্যের হিসাব নেন। এই অনুসন্ধান ও বাহনের পশুগুলোকে পরিবর্তনের কারণে কাফেলাকে সাধারণত এরজেরমে বিশ পঁচিশ দিন অবস্থান করতে হয়।

এরজেরম পারস্যের দিকে তুরস্কের একটি সীমান্তবর্তী শহর। এটি পর্বত ঘেঁষে বিশাল সমভূমির প্রান্তে অবস্থিত। সমতলে অনেকগুলো মনোরম গ্রাম শোভা পাচ্ছে। আপনি যদি দূর্গ এবং শহরের নিকটবর্তী মফঃস্বলে থাকতে পারেন, কিন্তু ঘরগুলো কাঠের তৈরি, পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যহীন। এখানে আর্মেনীয়দের কিছু গির্জার অবশেষ ও প্রাচীন ভবন রয়েছে। এগুলো দেখে আপনার ধারণা হবে যে এটা কখনো খুব একটা সুন্দর ছিল না। দুর্গটি একটি উঁচু ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিস্তর দেওয়াল, বর্গাকার চুঁড়াগুলো একটার সাথে একটা লাগোয়া। চারপাশে অগভীর পরিখা। পাশা এখানে বাস করেন, কিন্তু তার বাড়িটির অবস্থাও খারাপ। দুর্গের ভিতরে সব গুলো প্রাসাদের অবস্থাই খারাপ। একই চত্বরের মধ্যে একটি সামান্য উঁচু মাঠ রয়েছে যার উপরে তারা একটি ছোট দুর্গ গড়ে তুলেছে। সেখানে জনিসারি আগা বাস করেন এবং সেখানে পাশার কোন ক্ষমতা নেই। সুলতান যদি পাশা বা প্রদেশের কোন মান্যব্যক্তির শিরোচ্ছেদ চান, তখন তিনি পদাতিক বাহিনীকে সেই ব্যক্তিকে ছোট দুর্গে প্রেরণের আদেশ দিয়ে একজন জল্লাদ পাঠান। সম্প্রতি সেখানে একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। আমার শেষ পারস্য ভ্রমণে আমি একটি ঘটনা দেখেছি। ক্যাণ্ডি যুদ্ধের সময়ে সুলতান এরজেরমের পাশার নিকট বারো হাজার সৈন্য চেয়েছিলেন, কিন্তু পাশা দ্রুত সৈন্য পাঠাতে ব্যর্থ হন। তখন একই জল্লাদ তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ নিয়ে এসেছিল। কার্সের পাশার মৃত্যুর দণ্ডের জন্যও একই আদেশ ছিল। গ্রামের একটি রাস্তায় এই জল্লাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তখন তিনি কনস্টান্টিনোপলে ফিরে এসেছেন। তিনি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছেন কী করেননি তার প্রমাণ স্বরূপ দুই পাশার কর্তিত শির একটি থলেতে করে সুলতানকে প্রদান করেন।

দুর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় ফটকে মধ্যে চব্বিশটি কামান দেখা যাবে। চমৎকার গোলা নিক্ষেপক। কিন্তু গাড়ি ছাড়া একটির উপর আরেকটি পড়ে আছে। সুলতান যখন পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন তখন যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এগুলোকে এরজেরমে রাখা হয়েছিল।

এরজেরমে বেশ কয়েকটি ভাল সরাইখানা রয়েছে; টোকাটের মত এই শহরও তুরস্কের অন্যতম সেরা প্রবেশপথ। এ শহরেও মদ প্রস্তুত হয়, কিন্তু খুব বেশি ভাল নয়। জনগণের মদ পান কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। বণিকেরা কাজী যাতে জানতে না পারেন সে ভয়ে গোপনে মদ খরিদ করেন।

যদিও এরজেরমে খুব ঠাণ্ডা, তবুও একটি চমৎকার ব্যাপার রয়েছে। এখানে চল্লিশ দিনে যব এবং ষাট দিনে গম জন্মায়। স্বর্ণ, রৌপ্য ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর জন্য এখানে কঠোর ভাবে শুল্ক আদায় করা হয়। পারস্য থেকে আসা রেশমের একেকটি উটের বোঝার জন্য চব্বিশ ক্রাউন শুল্ক দিতে হয়। একটি উটের বোঝা আটশ পাউণ্ডের সমপরিমাণ। পর্বতময় দেশগুলোতে একটি উট এর চেয়ে বেশি বহন করতে পারে না। কিন্তু সমতল ও অন্যান্য দেশে তারা এক হাজার পাউণ্ডের বেশি বোঝা বহন করতে পারে। ভারতের কালিকটে এই রকম একটি বোঝার জন্য একশ ক্রাউন শুল্ক দিতে হয়। কিন্তু লিনেন রেশমের চেয়ে ওজনে অনেক ভারী। অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর জন্য সেগুলোর মূল্যের ছয় শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হয়।

এই স্থান থেকে কাফেলা হাসান কালা নামক একটি চৌকির দিকে এগিয়ে যাবে। সেখানে আপনাকে এরজেরম থেকে এরিভানে যাওয়া প্রতিটি উট বা ঘোড়ার বোঝার জন্য অর্ধেক পিয়াস্ত্রে শুল্ক দিতে হবে। কিন্তু ফেরত আসার সময় দিতে হবে তার অর্ধেক পরিমাণ। চৌকি ছেড়ে আপনাকে যেতে হবে চোবান কুপ্রি গ্রামের পাশের সেতুর উপর, সেখানে রাত্রি যাপন করতে হবে। এই সেতুর উপর দিয়ে আপনাকে দুটি নদীর মোহানায় পার হতে হবে, এই ভ্রমণ হবে সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয়। একটি নদীর নাম কার্স, অন্যটি বিঙ্গুয়েল পর্বত থেকে প্রবাহিত একটি ধারা, উভয়েই আরাস নদীতে বিলীন হয়েছে। এই সেতুতে কাফেলা একদিন বা দুদিনের জন্য অবস্থান নিবে। কেননা, কাফেলা এখানে দুভাগে বিভক্ত হয়ে এক ভাগ বড় রাস্তা এবং অন্য ভাগ কার্সের রাস্তায় ধরে চলে যায়। এতে আরাসকে কয়েক দফা পদব্রজে চলা এবং মহাসড়কে বড় অঙ্কের শুল্ক এড়ানো যায়। এখানে প্রতিটি উটের বোঝার জন্য চার পিসাস্তে এবং ঘোড়ার বোঝার জন্য দুই পিয়াস্তে শুল্ক দিতে হয়। অথচ কার্সে তার অর্ধেক শুল্ক দিতে হয়।

কার্সের রাস্তায় আমি দুইবার ভ্রমণ করেছি; এটি অন্য রাস্তা হতে দীর্ঘ এবং সমস্যাসঙ্কুল। সেতু ত্যাগ করে যাওয়ার পর আপনাকে প্রথম চারদিন চলতে হবে অরণ্যময় পর্বতের উপর দিয়ে। এরপর আসবে মরুময় পথ। অবশ্য এখানে একটি গ্রাম পাবেন। কার্সের কাছাকাছি এলে পাবেন মনোরম ও উর্বর ভূমি। এখানে প্রচুর শস্য ফলে।

কার্সের অবস্থান ৭৮ ডিগ্রি ৪০ মিনিট দ্রাঘিমাংশ ও ৪২ ডিগ্রি ৪০ মিনিট অক্ষাংশে। এখানকার মাটি খুব উর্বর। শহরটি অনেক বড়, কিন্তু জনবসতি খুব অল্প। প্রচুর শস্য উৎপাদিত হয় এখানে, দামেও সস্তা। সর্বদা সুলতান এই স্থানটিকে তাঁর সৈন্য সমাবেশের জন্য পছন্দ করেন। যখনই তিনি নতুন সৈন্য নিয়োগ করার মনস্থ করেন, এখানে লোক পাঠিয়ে বসতি স্থাপন করেন। পারস্যের বাদশাহ সমস্ত অঞ্চলকে ধ্বংস করেছেন, যেমন তিনি করেছিলেন সালফা ও সীমান্তের আরও অনেক স্থানে। এই সকল স্থান ভ্রমণ করতে সময় লাগবে নয় দশ দিন।

কার্স থেকে এরিভান যেতে কাফেলার নয় দিন ভ্রমণ করতে হয়। রাত্রি যাপন করতে হয় সুবিধাজনক কোন স্থানে, তার নির্দিষ্টি নেই। প্রথম দিনের ভ্রমণ শেষ হবে একটি আশ্রম ও একটি গ্রামে। গ্রামেও আশ্রমের মত অল্পলোকের বাস। পরের দিন আপনি আসবেন একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বড় শহরে, নাম অনিকাগা। আর্মেনীয় ভাষায় আনি শহর, এটি একজন আরমেনীয় রাজার নামে যিনি এটি স্থাপন করেছিলেন। প্রাচীরের ধারে, পূর্ব দিকে মিংগ্রেলিয়া পর্বত থেকে প্রবাহিত একটি ধারা দ্রুত বয়ে চলেছে। এটি কার্স নদীতে নিজেকে বিলীন করেছে। এই নগরটি সুদৃঢ়ভাবে স্থাপন করা হয়েছে। এখানে দুটি উঁচু বাঁধ রয়েছে যা শহরকে ঘিরে রেখেছে। এখানে অনেকগুলো মঠের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। যে দুটি রয়েছে, ধারণা করায় হয় সেগুলো রয়েল ফাউণ্ডেশন। এখান থেকে এরিভান দুদিনের পথ। পথে দুটি মাত্র গ্রাম। শেষেরটি পাহাড়ের পাদদেশে। এ পথ দিয়ে যাওয়া কাফেলার কাছে বিক্রয় করার জন্য লোকেরা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঘোড়া নিয়ে আসে। সেতু থেকে মহাসড়ক পর্যন্ত পথে কাফেলাগুলো এভাবেই পড়ে থাকে।

সেতু থেকে দুই লীগ গেলে দক্ষিণ দিকে হাতের ডানে একটি বিশাল পর্বত রয়েছে, স্থানীয় লোকেরা যাকে মিংগোল বলে। এই পর্বতে অনেকগুলো প্রস্রবণ রয়েছে। এর একদিক থেকে ইউফ্রেতিস নদী, অন্যদিক থেকে কার্স নদী প্রবাহিত হয়েছে। এটি চৌদ্দ পনের লীগ দূরে এরিভানের নিকটে আরাসে পতিত হয়েছে। আরাস, প্রাচীন নাম আরাক্স। এটি মিংগোল পর্বতের পূর্বপ্রান্তের অন্যান্য পর্বত থেকে প্রবাহিত হয়েছে। এটি আরমেনিয়ার উচ্চ ভূমিতে একেবেঁকে প্রবাহিত হয়েছে। এই সময় আরও অনেক নদী আরাসের সাথে মিলিত হয়েছে। ফলে এর স্রোত অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং শামাকি থেকে দুই দিনের পথ প্রাচীন মেডিস সীমান্তে কাস্পিয়ান সাগরে পতিত হয়েছে।

সমগ্র প্রদেশটি আরাস ও কার্স এবং এই দুটিতে মিলিত হওয়া অন্যান্য নদীর দ্বারা আন্তঃকাটা হয়েছে। জনবসতি খুব কম, কিছু খ্রিষ্টান, কিছু মুসলমান। কিন্তু মুসলমানেরা এতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন যে তারা এই সকল নদীর জল পান করে না, স্নানও করে না, তারা বিশ্বাস করে খ্রিষ্টানেরা অপবিত্র এবং তারা এই নদীগুলোর জলকে অপবিত্র করে দিয়েছে। তাদের নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট কূপ ও জলাধার রয়েছে, তারা সেগুলো থেকেই জল ব্যবহার করে। কোন খ্রিষ্টানকে সেগুলোর কাছে আসতে দেয় না।

চোবান কুপ্রি সেতু থেকে এরিভানে যাওয়ার পরে প্রথম গ্রাম কোমাসুর, এখানেই আপনি রাত্রি যাপন করবেন।

কোমাসুরের পরে হালিচারা, এটি খ্রিষ্টান অধ্যুসিত বড় শহর। কিন্তু ঘরগুলো গুহার মত মাটির নীচে। ১৬৫৫ সালের মার্চের সাত তারিখে এত বেশি তুষারপাত হয়েছিল যে ভ্রমণ করা সম্ভব ছিল না, ফলে এখানে আমরা বাধ্য হয়ে আট দিন থেকেছি। এরজেরুমের শুল্ককর্তা আমাদের খারাপ অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। পাঁচশত ঘোড়া নিয়ে আমাদের জন্য রাস্তা তৈরি করতে ব্যক্তিগতভাবে এসেছিলেন। আশপাশের বসবাসকারীদের রাস্তা থেকে তুষার সরিয়ে ফেলার জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এইসব আমাদের প্রতি তার উদারতা ছিল না, তার নিজস্ব স্বার্থেই এইসব করেছিলেন। ২২শে মার্চ তার স্থলাভিষিক্ত হবেন একজন নতুন কর্মকর্তা। আমাদের কাফেলা ছিল অনেকগুলো, সেই দিনের পূর্বে আমরা এরজেরুমে না পৌঁছালে তিনি এক লক্ষেরও বেশি ক্রাউন লাভ থেকে বঞ্চিত হতেন। বরফের দিকে ক্রমাগত তাকিয়ে থাকার কারণে অনেক যাত্রী প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তুষারের রঙ দৃষ্টিশক্তিকে অনেকটাই ম্লান করে দেয়। এর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্যটকেরা মুখের উপর কালো সাইপ্রেস হুড ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। অন্যরা পশমযুক্ত টুপি (bonnet) পরিধান করে। এতে ছাগলের লম্বা চুল ঝুলে থাকে, যা চোখের উপর পড়ে এবং পুরোপুরি জোংরার মত কাজ করে।

এরজেরুম থেকে এরিভান পর্যন্ত সাধারণত কাফেলার বার দিনের রাস্তা। হালিকারকারা ত্যাগ করে তিনবার আরাস হেঁটে পার হতে হয়। অত্যধিক বাতাসের কারণে পরের দিন আবার আরাস পার হতে হয়। যে জায়গাটি চতুর্থবার পায়ে হেঁটে পার হতে হয়, সেটি হতে দেড় লীগ দূরে উচ্চ পর্বত শিখরে একটি দূর্গ রয়েছে। নাম কাগুইসগান। এটি এদিকে তুর্কিদের দখলে থাকা সর্বশেষ স্থান। সেখানে বাসকারী শুল্ককর্তা তার শুল্ক নিতে কাফেলায় আসেন। যা প্রতি উটের বোঝার জন্য চার পিয়াস্তে, আর ঘোড়ার বোঝার জন্য দুই পিয়াস্তে। ১৬৫৫ খ্রিষ্টাব্দে কাগুইসানের দুর্গ থেকে এক লীগ দূরে থাকে কাফেলা, এই পার্বত্য অঞ্চলটি আরমেনীয় খ্রিষ্টান অধ্যুষিত। আমাদের কাছে একজন দরিদ্র বিশপ এসেছিলেন, তার দলে ছিল পনের ষোলজন মানুষ। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন পুরোহিত। তারা আমাদের জন্য রুটি, মুরগী ও ফল এনেছিলেন। তারা বণিকদের বদান্যতা কামনা করেন, বণিকেরাও তাদের সন্তুষ্ট করেছিলেন। চার পাঁচ মাস পরে একজন জেনিসারি সেই বিশপের একটি চোখ উপড়ে ফেলে। সেই পাপাত্মা লোকটি সেই শহরে এসেছিল যেখানে বিশপ বাস করেন। সে বিশপের উপর লণ্ঠন ধরে, এবং অর্থ চায়। বিশপের কাছে তাকে দেওয়ার মত কোন অর্থ ছিল না, রাগে সে বিশপের চোখে ছুরিকাঘাত করে। আগার নিকট অভিযোগ করা হয়েছিল, আশা ছিল তিনি অপরাধীকে শাস্তি দিবেন। কিন্তু তিনি সন্তোষজনক কোন প্রতিকার না করে বিশপকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলেন।

আরাসের নিকটে শেষ যে স্থানে আমরা শিবির স্থাপন করেছিলাম, সেখান থেকে পরদিন আমরা একই নদীর তীরে, মোটামুটি পোয়া লীগ দূরে একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। পরদিন আমরা কার্স থেকে বয়ে যাওয়া নদী পার হলাম। আমরা পারস্যের সীমানা ছেড়ে তুরস্কের সীমায় এসে পৌঁছলাম। পরদিন, একটি ছোট শহর থেকে অর্ধলীগ দূরে আরাসের তীরে থামলাম। শেষবারের মত আপনি এই নদীটি দেখবেন যা বেশ কয়েকবার পার হয়েছেন।

আরাস ত্যাগ করে একটি সমভূমিতে আমরা তাঁবু স্থাপন করলাম। স্থানটি একটি শহরের নিকটে যা খুব বেশি দূরে নয়। পরদিন কাফেলা একটি ময়দানে অবস্থান গ্রহণ করে। এর পরদিন এমন একটি জায়গায় এলাম যেখানে তিনটি গির্জা রয়েছে। স্থানটি এরিভান থেকে অর্ধ দিনের রাস্তা। [ক্রমশঃ]

About The Author

তাহের আলমাহদী

আমার জন্ম কুমিল্লায়। দেড় যুগ ধরে আছি সাউদী আরবে। ছাত্রজীবন থেকেই অল্পস্বল্প লেখালেখি করি। কিন্তু লেখক হয়ে উঠার জন্য কলমের যে পরিমাণ শক্তি, যে পরিমাণ অধ্যবসায় দরকার তা আমার পুরোপুরি নেই। একটা কাজ শেষ না করে আরেকটি কাজ ধরলে যা হয়। তবু চেষ্টা করছি। আমার লেখা পাঠকের ভাল লাগলেই হয়ত লেখক হয়ে ওঠা হবে।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার