Select Page

বস্তু থেকে জীবন

বস্তু থেকে জীবন

আজ থেকে তিন যুগ আগে ছাত্রাবস্থায় (১৯৮৯-৯০) বস্তু থেকে জীবন, রাসায়নিক এবং জৈব বিবর্তন নিয়ে কিছু লেখালেখি করেছিলাম। তখন গুগল সার্চ ইন্জিন জন্ম হয় নি, ইন্টারনেটও ছিলো না ব্যবহারের আওতায়। সম্বল ছিলো ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইউসিস আর সেভিয়েত সংস্কৃতি কেন্দ্রের লাইব্রেরির বইপত্র। লেখাগুলোর কিছু দুএকটি ম্যাগাজিন-পত্রিকা, মেডিকেল কলেজ বার্ষিকী পত্রিকাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কারো কারো অসন্তুষ্ট মুখাবয়ব দেখতে হলেও, এসব লেখার জন্য কেউ আমাকে মারতে আসে নি। বর্তমান সময়ে তথ্যসমৃদ্ধি, সহজলভ্যতার যুগে এসেও আমরা রাজনীতিক কারণেই সংস্কৃতিগতভাবে পিছিয়েই রয়েছি, এমনকি উল্টোযাত্রার করুণচিত্র দেখছি!

তিন যুগেরও বেশী আগের তথ্যনির্ভর এই লেখাগুলো আপগ্রেড না করেই পোস্ট করছি কিছু কারণে।

১. বৈজ্ঞানিক তথ্য বিকাশমান, গবেষণা চলমান। তত্ত্ব-উপাত্ত বদলাবে। যা বদলাবে না, তা হলো কার্যকারণ অনুসন্ধানের তাগিদ। বদলাবে না যৌক্তিক সিদ্ধান্তের তাগিদ। তিন যুগের আগের লেখাতে মানুষের কার্যকারণ অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতার এই দিকটিই তুলে ধরা হয়েছে।

২. এই সময়ের মধ্যে, আমার আগ্রহের বিষয়বস্তু বদলেছে। আমার সময় হবে না, সব তথ্য আপগ্রেড করবার, মনে হয় দরকারও নেই। কিছু মূল শব্দ যেমন Coacervate, biopoesis, chemical evolution , proto-atmosphere আর উল্লেখিত দার্শনিক-বিজ্ঞানীদের নাম দিয়ে অনুসন্ধান করলেই হাই স্কুল লেভেলের যে কারও পক্ষেই সহজ হবার কথা, লেখার বিষয়বস্তুর গভীরে পৌঁছানো। এই লেখার বিভিন্ন দিক ধরে, কয়েক মাস ধরে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব। বর্তমান সময়ে অনেকেই সম্পর্কিত বিষয়গুলোয় উচ্চতর গবেষণা করেছেন বা করছেন। তাঁরা চাইলে যোগ করতে পারেন , সময়ানুগ তথ্য।

৩. জীবন সৃষ্টি এবং বিবর্তনের রহস্য উদ্ধার হয়ে যায় নি, তবে যে পথপরিক্রমায় বিজ্ঞান কাজ করে, এবং পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, তা থেকেই কোন ভাবনাগুলো বর্জন করা দরকার, আর কোনগুলো গ্রহণযোগ্য তা বুঝতে পারার কথা।

লেখাটা কষ্ট করে পড়তে হবে। বহু তথ্য অল্প পরিসরে ঠাঁসা। ক’জন ধৈর্য ধরে পড়বেন জানি না। সেসময়ে লেখা আরও দু’একটি লেখা সময় পেলে দেবো, যদি গোটাদশেক পাঠক হয়।

বস্তু থেকে জীবন

জীবনের উদ্ভব কী করে হলো? মানুষ, মানুষের চিন্তা ও চেতনা কোথা থেকে এলো? এই প্রশ্নগুলো বিশ্বের স্বরূপ উদ্ঘাটনের চাইতেও জরুরী এবং বিতর্কিত। বস্তু এবং চেতনার সঠিক সংজ্ঞায়ন, এদের কোনটি আগে কোনটি পরে এসব সহস্র বছর ধরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনগুলোকে নিয়োজিত রেখেছে। মানুষ মরে গেলে তার চিন্তা করবার, চলাফেরা করবার কিংবা কথা বলবার ক্ষমতা লোপ পায় কেন? এর উত্তরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বলেছেন ; আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যায় বলে। তাহলে আত্মা কী? দেহের সাথে এর সম্পর্কই বা কেমন? ভয়ানক জটিল সব প্রশ্ন। যে জিনিসটা দেখা যায় না, শোনা যায় না কী করে তা নিয়ে অনুসন্ধান চালানো যায়? বিস্মিত হবার কিছু নেই যে এসব বিষয় নিয়ে, অবাস্তব অযৌক্তিক ধ্যান-ধারণার উদ্ভব ঘটেছে প্রচুর। (সহস্র বছরগুলো ধরে এসব প্রশ্নকে পুঁজি করে ভাববাদী মোল্লা-পুরোহিতের দল ফায়দা লোটার চেষ্টা চালিয়েছে এবং এখনও চালাচ্ছে।)

অনেকেই আত্মাকে বর্ণনা করেছেন অজড়, অশরীরী অবিনাশী, আধ্যাত্মিক শক্তি হিসেবে যা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন অবস্থায় রয়েছে। মানবাত্মার সীমানা পেরিয়ে জগতাত্মার ধারণায়ও পৌঁছে গেছেন এদের অনেকেই, কল্পনা করেছেন উর্দ্ধলোকের (The beyond), মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের। মানুষের জন্মের মুহুর্তে ক্ষণিকের জন্য আত্মা দেহে প্রবেশ করে এবং মৃত্যুর পর তা দেহ ছেড়ে চলে যায়, এমনটিই আমাদের পূর্বসূরীরা বিশ্বাস করেছেন। আজও মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের ধারণার অনেক সমর্থক রয়েছে, যদিও উর্দ্ধলোক থেকে কেউ ফিরে এসেছে এমন ঘটনার সাক্ষ্য কোথাও মেলেনি। নয়শো বছর আগে, এ প্রসঙ্গে, ওমর খৈয়াম (যিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক – পারসিক এবং তাজিক ভাষায়) বলে গেছেন :

“Strange, is it not? that of the myriads who
Before us passed the door of Darkness through
Not one returns to tell us of the Road,
Which to discover we must travel too.“

বিশিষ্ট ভাববাদী দার্শনিকেরাও এসব সমস্যার কোন যৌক্তিক কিংবা আপাতবিচারে গ্রহণযোগ্য সমাধান দিয়ে যেতে পারেন নি। প্লেটো স্বর্গ ও আত্মার সমীকরণ ঘটিয়েছেন। তাঁর মতে; পৃথিবীতে আত্মার আগমন তার আদিনিবাস স্বর্গ থেকে পতনেরই ফল’। তিনি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করতেন। হেগেলের মতে আত্মা (soul) হলো বস্তুর সাথে চিদাত্মা (spirit)-এর সম্পর্কের নিম্নতম সংবেদী বহিঃপ্রকাশ- lowest, sensual manifestation of the spirit in its relationship with matter. দ্বৈতবাদী (Dualist)-রা, যেমন দেকার্তে স্পেন্সার ও অন্যান্যরা আত্মাকে প্রাথমিক ভেবেছেন এবং দেহের সাথে এর যৌথ অস্তিত্বের কথা বলেছেন। ইবনে রুশদ- ও দেহ থেকে আত্মার পৃথক বা স্বাধীন অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। মার্কসপূর্ব বস্তুবাদীরা (Metaphysical Materialist’s) আত্মাকে গৌণ এবং দেহের অধীন মনে করতেন। তাঁদের মতে আত্মা জড় পদার্থ এবং আত্মিক প্রক্রিয়াগুলো যান্ত্রিক, শারীরিক বা রাসায়নিক প্রক্রিয়ার পর্যায়ভূক্ত। চেতনার উদ্ভব কি করে হলো এর সদুত্তর না পেয়ে পরবর্তীতে লিওনার্দো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০) রবিনেট (১৭৩৫-১৮২০) এবং ডেনিস দিদেরো (১৭১৩-১৭৮৪)-র মত বস্তুবাদীরাও আত্মাকে বস্তুর অন্তর্নিহিত চিরন্তন ধর্ম – Eternal and inherent property of matter বলে মনে করতেন। অর্থাৎ তাঁদের মতে গোটা বিশ্বই চেতনাযুক্ত। এই দার্শনিক ধারাকে বলা হয় Hylozoism এবং এই ধারা থেকেই সর্বেশ্বরবাদী দর্শন Pantheism-এর উদ্ভব (স্পিনোজা)। বাখনার বা মলেস্কট এর মতো Vulgar Materialist-রা আবার হাজির করেন তাদের অতি- সরলীকৃত দর্শন। তাঁদের মতে মস্তিষ্কই চিন্তা, চেতনা এসব তৈরী করে; যেমন যকৃত তৈরী করে পিত্তরস (Bile)।

ভাবনাদর্শনের এই নানামুখী ধারা থেকে চেতনার উৎস এবং প্রকৃতি সম্বন্ধে যৌক্তিক ব্যাখ্যায় পৌঁছাবার আগে কতগুলো প্রাথমিক প্রশ্নের সমাধানে পৌঁছাতে হবে :

(১) যেহেতু চেতনা কেবল জীবিতের বৈশিষ্ট্য জীবন বা জীবিত বস্তুর উদ্ভব কি করে হলো তা জানতে হবে।

(২) যেহেতু উন্নত সংগঠনবিশিষ্ট (মস্তিষ্ক বিশিষ্ট) জীবেরাই কেবল চেতনার অধিকারী। জীবিতবস্তু থেকে তাদের উদ্ভব কি করে হলো কি করে মস্তিষ্ক প্রাপ্তি ঘটলো এসব জানতে হবে।

(৩) প্রধানত: মানুষই চেতনাবিশিষ্ট জীব। এই মানুষের উদ্ভব কি করে ঘটলো কি করেই বা চিন্তা প্রক্রিয়া এলো- এসব প্রশ্নেরও উত্তর পেতে হবে।

(৪) সবশেষে; এককভাবে মস্তিষ্ক নয় বরং সেই সাথে বস্তুজগত (বা চেতনার উৎস), এদের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া এসবের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে হবে।

জীবনের বৈশিষ্ট, উদ্ভব এবং বিকাশ:

ঐতিহাসিক পটভূমি:

জীবনের উদ্ভব সংক্রান্ত বহু উপাখ্যান, মিথ প্রচলিত রয়েছে যেসবের মতে; জীবনের উদ্ভব ঘটিয়েছে ঈশ্বর, জীবন তার পরমশক্তির বহিঃপ্রকাশ, জীবজগত অপরিবর্তনীয়, সৃষ্টির আদি থেকে প্রতিটি জীবন একই রকম রয়ে গেছে; ইত্যাদি। অপদিকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে, গবেষক বৈজ্ঞানিকেরা মনে করেন অজৈব বস্তু থেকেই জীবনের সৃষ্টি হয়েছে’-এর জন্য কোন আধ্যাত্মিক প্রভাবের প্রয়োজন হয়নি।

১.

একটি জীবিত বস্তুতে যেসব মৌল উপাদান রয়েছে তার সবগুলোই অজৈব প্রকৃতিতে পাওয়া যায় – অর্থাৎ জীবের এমন কোন মৌল উপাদান নেই যা অজৈব প্রকৃতিতে পাওয়া যাবে না। রুশ বিজ্ঞানী ভিনোগ্রাদভ জীবন সংগঠনকারী প্রায় ৬০টি মৌল চিহ্নিত করেছেন, যদিও এর সবগুলোই প্রতিটি জীবে রয়েছে, এমন নয়। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, সালফার জটিল অনুগঠনকারী এই মৌলগুলো প্রতিটি জীবেই রয়েছে এবং আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, কপার ও আয়োডিন এগুলো মোটামুটি সাধারণ উপাদান বলা চলে। একটি জীবসংগঠনের স্বরূপ নির্ধারিত হয় মূলতঃ মৌল উপাদানগুলো কি রীতিতে তাতে সজ্জিত রয়েছে তাই দিয়ে । একটি স্বতন্ত্র পরমাণুর বৈশিষ্ট্য আদৌ বিবেচ্য নয় (যদিও বিভিন্ন পরমাণুর নিজস্ব ইলেকট্রন বিন্যাস-ই জৈবনিক বিক্রিয়াগুলোকে সম্ভব করে তোলে)। জীবনের বৈশিষ্ট্যসূচক ঐ সজ্জা বা Organized_structure কী করে অর্জিত হল, এটি জীবনের উদ্ভব-জনিত প্রশ্নের সমাধানে একটি বড় সমস্যা। বাহ্যতঃ মনে হয় বহিঃশক্তির প্রভাব ছাড়া এটি যেন সম্ভব নয়। ফলে, জীবন-আত্মা-পরমকারণ-এর বর্তনীতে ঘুরে ফিরেছে অধিবিদ্যকেরা ‘Vital force’ থেকে Driesch-এর entelechy’ বার্গসন এর ‘elan vital’ প্রভৃতি অজ্ঞেয়বাদ (agnosticism)এর বিভিন্ন ধারার সূচনা করেছে।

গ্রীক দার্শনিক আনাক্সিমান্দার (600 BC) এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে জীবিত বস্তু পরিবর্তন সাপেক্ষ । তাঁর মতে কোন মৌল উপাদানের গতিয় পরিণতিতেই সূর্য-গ্রহ নক্ষত্র এসবের সৃষ্টি ঐ একই উপাদান থেকেই জীবিত বস্তুর উদ্ভব ঘটেছে যা প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে সক্ষম এবং মানুষ মৎস্যজাতীয় পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত। আনাক্সিমান্দারের ধারণা ছিল; আদ্র বস্তুর ওপর সূর্য রশ্মির প্রভাব জীবনের বিকাশকে প্রভাবিত করেছে। পরবর্তীতে আমরা দেখবো, আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্বের সাথে এই চিন্তার কতটা মিল রয়েছে। তবে তৎকালীন দার্শনিকদের সকলের পক্ষেই তাদের কল্পনায় আনাক্সিমান্দার এর মতো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হওয়া সম্ভব হয়নি। মাটি থেকে জীবের মাথা, হাত, কাঁধ, চোখ ইত্যাদি পৃথকভাবেই সৃষ্টি হয়েছে এবং পরে এগুলো মিলিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ জীব তৈরী করেছে এরকম ধারণাও তখন প্রচিলত চিল (ইম্পিক্লিস)। গ্রীক বিজ্ঞানী ডেমোক্রিটাস (470BC) এর মতে জীবিত বস্তুতে একটি বিশেষ ধরনের তরল পদার্থ রয়েছে- যা কঠিন বস্তুর চাইতে অধিকতর সূক্ষ ও চলমান কণা সমষ্টির (Atoms) দ্বারা তৈরী।

২.

বস্তুসত্বাহীন আত্মার ধারণা এসেছে পরবর্তীতে। প্লোটো (427-347 BC) এবং অ্যারিষ্টটল (385-322 BC) বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়াকে বলেছেন মনোগত (Psychic)। তাঁরা উদ্ভিদগত, প্রাণীগত এবং বৌদ্ধিক ক্রিয়াকলাপের পার্থক্য করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে দেহ (soma) এবং মন বা আত্মা অচ্ছেদ্য। প্লেটো আত্মার পৃথক ও স্বাধীন অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। ক্রিশ্চিয়ানিটির উদ্ভবের ক্ষেত্রে এই দুই দার্শনিকের (অবস্তুগত মন এই চিন্তার) প্রভাব প্রভূত। এর পর থেকেই ‘পবিত্র’ ‘অবস্তুগত’ আত্মার ধারণা ব্যাপ্তি লাভ করতে থাকে। [যদিও মজার ব্যাপার এই যে ক্রিশ্চিয়ান ফাদারদের কেউ কেউ অবস্তুগত আত্মার ধারণার বিরোধিতা করছেন এই যুক্তিতে যে, বস্তুগত সত্বা না থাকলে নরকের শাস্তি এর ওপর কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না, তাই নরকও অর্থহীন হয়ে যাবে।]

প্রাচীন গ্রীক দর্শনে অজৈব বস্তু থেকে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের যে ধারণা প্রচলিত ছিল অ্যারিষ্টটলে এসে তা শেষ হয়ে যায়নি। অ্যারিষ্টটল earth slime, manure এসব থেকে উদ্ভিদ ও প্রাণীর স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে সপ্তদশ শতাব্দীতে এসেই কেবল এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় ।

১৬৬৮ সালে ইতালীর ফ্রান্সেসকো রেডি দেখান, বাসি মাংসে মাছি বসা রোধ করতে পারলে তা পচে পোকা (maggot)-র সৃষ্টি হয় না। রেডির সমসাময়িক লিউয়েনহুক (যিনি সম্ভবতঃ প্রথম জীবানুবিজ্ঞানী) তাঁর আবিষ্কৃত সরল মাইক্রোসকোপের সাহায্যে দেখতে পান পচনশীল বস্তুতে জীবানু (microbe)-র অস্তিত্ব রয়েছে। তার উত্থাপিত তথ্যাদি বিতর্কের সূত্রপাত করে এই জীবানুগুলো বাতাস থেকে আসে নাকি সুপ-বাথ ( broth) থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এদের উদ্ভব ঘটে? অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, ইতালীয় অনুসন্ধানী স্পালানজানি দেখান যে দীর্ঘক্ষণ উত্তপ্ত করবার পর পাত্রাবদ্ধ কাথ এ কোন জীবানুর উদ্ভব ঘটে না। এর বিপরীতে অনেকে যুক্তি তোলেন যে এই প্রক্রিয়ায়নের ফলে জীবন বিকাশের শর্তগুলোই তিরোহিত হয়েছিল। ১৮৩৭ সালে ফরাসী অনুসন্ধানী ক্যাগনিয়ার্ড দ্য লাত্যুর দেখান যে বিয়ার-এর গাজন (fermentation) ইষ্ট নামক ক্ষুদ্র জীবের দ্বারাই ঘটে থাকে। জার্মেনীয় শোয়ান দেখান ক্ষুদ্র জীবানুই মাংসের পচনের জন্য দায়ী, পরবর্তীতে পাস্তুর, টিন্ডাল-এদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা পচা-বাসি জিনিস থেকে জীবনের স্বতঃস্ফুর্ত বিকাশের এই ভোতা ধারণাকে নির্বাসিত করে। কিন্তু এসবের দ্বারা রাসায়নিক বিবর্তনের মাধ্যমে সরল রাসায়নিক দ্রব্যাদি থেকে সহস্র লক্ষ বছরের প্রক্রিয়ায় জীবন সৃষ্টির সম্ভাব্যতা খন্ডিত হয়নি একটুও। বরং উল্লেখিতদের অনেকেই বিশেষ করে টিন্ডল এই সম্ভাব্যতার জোরালো প্রবক্তা।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ডারউইন, টি, এইচ হাক্সলী, টিন্ডাল, শেফার এদের দেয়া তত্ত্ব ও তথ্য আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ ফলাফলের সাথে অনেকটা সঙ্গতিপূর্ণ। টিন্ডাল উপলব্ধি করেছিলেন [Vitality-রচনা থেকে] যে জীবনের জীবনীশক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে সূর্য থেকেই আহরিত। জীবনের শক্তিসংগ্রহের ক্ষেত্রে সূর্য ও জীবনের মধ্যবর্তী ভূমিকায় রয়েছে উদ্ভিদ। জীবের কোষ-কলায় এমন কোন বস্তু নেই যা কিনা প্রাথমিকভাবে পাথর পানি কিংবা বাতাস থেকে আসেনি। মূলতঃ এই মৌল উপাদানগুলোর বিশেষ সজ্জারীতিই জৈবনিক প্রক্রিয়ার সূচক। জীবনসংগঠনকারী বস্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করছে নির্দিষ্ট কিছু যৌগের পূর্ব- অস্তিত্বের ওপর যেমন, কার্বনিক এসিড, পানি এবং কিছু নাইট্রোজেন-যৌগ এসব উদ্ভিদের প্রোটোপ্লাজমের জন্য আবশ্যকীয় উপাদান-যা কিনা আবার প্রয়োজন প্রাণীর প্রোটোপ্লাজমের জন্য। কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন-এগুলো সবই জীবনহীন। নির্দিষ্ট অনুপাতে, নির্দিষ্ট অবস্থার আওতাধীনে এদের সংযুক্তিতে গঠিত হয় কার্বনিক এসিড, পানি, বিভিন্ন নাইট্রোজেন যৌগ এসব, এগুলোও প্রাথমিক উপাদানগুলোর মতোই জীবনহীন। কিন্তু নির্দিষ্ট শর্তাধীনে এরা জটিলতর সংঘঠন প্রোটোপ্লাজম গঠন করে। এই প্রোটোপ্লাজম জৈবিক প্রক্রিয়াগুলো দেখায় ।

উনবিংশ শতাব্দীতেও এমন বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, জীবন এমন একটি সত্তা যা বস্তুকে ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু এর বস্তুনিরপেক্ষ স্বাধীন অস্তিত্ব রয়েছে। সে সময়ে এই বিশ্বাসে প্রশ্ন তুললে ধর্মীয় গুরুদের কাছ থেকে বিপদ বিপত্তির সম্ভাবনা ছিল প্রকট। তবে হাক্সলী, টিন্ডাল এরা দৃঢ়ভাবেই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে পেরেছিলেন। আর যাই হোক প্রচলিত বিশ্বাসবিরুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের জন্য তাদেরকে ব্রুনোর মতো পুড়ে মরতে হয়নি বা গ্যালিলিওর মতো চাপ বা হুমকীর সম্মুখীন হতে হয়নি। হাক্সলী, দার্শনিক হিউম এর উক্তির স্বীকৃতিতে বলেছেন এ পবিত্র স্বর্গীয় গ্রন্থের একটা খন্ড হাতে নিয়ে দেখ, দেখে প্রশ্ন কর। এতে পরিমাণ বা সংখ্যা বিষয়ক কোন যুক্তি (abstract reasoning) রয়েছে কি ? নেই। বস্তুগত ঘটনা এবং অস্তিত্বের প্রশ্নে এতে কোন অনুসন্ধান-মূলক যুক্তি (experimental reasoning) রয়েছে কি ? তাও নেই । তাহলে, এটিকে আগুনে উৎসর্গ কর। কারণ কৃতর্ক ও মোহ-বিভ্রান্তি ঘটানোর মাল- মসলা ছাড়া এতে আর কিছুই নেই।

৩.

বৈজ্ঞানিক চিন্তা বা প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান বিকাশ জীব সৃষ্টির তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করেছে। অনুজীববিদ্যা বিভিন্ন জৈব প্রক্রিয়া কিভাবে ঘটছে তা বুঝতে সাহায্য করছে। ইনফরমেশন থিওরী এবং মলিক্যুলার জেনেটিক্স বস্তুর জটিল সুসংগবদ্ধায়ন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জানতে সাহায্য করছে। বিশৃঙ্খল (chaotic) অবস্থা থেকে শৃঙ্খল (order) প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কি কি ফ্যাক্টর দায়ী এই বিষয়ক গবেষণার মাত্রা বেড়েছে। তবে রহস্যের ঘের এখনও পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি, চিন্তা জিজ্ঞাসাও রয়ে গেছে, তবে এগুলো আসছে নব নব আঙ্গিকে।

জড় বস্তু থেকে জীবিত বস্তুর উদ্ভবের প্রক্রিয়াকে বলা হয় Biopoesis | প্রক্রিয়াটি পৃথিবীতে বা এর বাইরে যেখানেই ঘটুক না কেন এর পূর্বশর্ত হিসেবে সুনির্দিষ্ট কিছু ধাপ রয়েছে। সেগুলো হল; ক) পরমাণু থেকে অণু, খ) অণু থেকে বৃহত্তর অণূ- পলিমার এবং গ) পলিমার থেকে জীবিত বস্তু। Chemical Evolution শব্দটা ব্যবহার করা হয় প্রাক জৈব পর্যায়ের এসমস্ত পরিবর্তনকে বোঝাতে যখন বিদ্যমান প্রাকৃতিক শর্তগুলো এবং বিক্রিয়াগুলো (reactants) – বিশেষ কতগুলো অণুর সংগঠনকেই প্রভাবিত করছে অন্যগুলোকে নয়।

এই শতাব্দীর বিশ এর দশকে ইংল্যান্ডের জে, বি, এস, হেলডেন (১৯২৯) এবং সোভিয়েত ইউনিয়েনের এ, আই, ওপারিন (১৯২৪) পৃথক পৃথক ভাবে জীবনের উদ্ভব সংক্রান্ত বিষয়ে ভাবনা, লেখালেখি করেন। প্রায় সদৃশ এবং পরিপূরক বিধায় তাদের তত্ত্ব ‘হেলডেন ওপারিন তত্ত্ব’ নামে পরিচিত হয়। হেলডেন এর মতে পৃথিবীর আদি আবহমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল খুব কম বা একেবারেই অনুপস্থিত (অক্সিজেনের বর্তমান পরিমাণ ঠিক ততটা, যতটা দরকার হবে ভূগর্ভস্থ কয়লা এবং অন্যান্য জৈব যৌগকে পোড়ানোর জন্য)। তার মতে সেখানে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ছিল এখনকার চাইতে অনেক বেশি এবং বর্তমানে যে পরিমাণ মুক্ত নাইট্রোজেন রয়েছে তাও ছিলো যৌগ (যেমন, নাইট্রাইড) হিসাবে। মুক্ত অক্সিজেন না থাকায় ওজোন-স্তর ও ছিল না, তাই ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের অতিবেগুনী রশ্মি সহজেই পৃথিবীতে এস পৌঁছাতে পারতো। পানি, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, এমোনিয়া এসবের মিশ্রণের ওপর ঐ অতি বেগুনী রশ্মির ক্রিয়ার ফলে সরল জৈব যৌগ এবং সম্ভবতঃ এমাইনো এসিড তৈরি হয়েছে। অনুরূপ প্রক্রিয়াতেই হয়তো জৈব যৌগের পূঞ্জীভবন ঘটেছে এমন একটা পরিণতিতে পৌঁছানো পর্যন্ত যাকে বলা হয়, which reached the con- sistancy of hot, dilute soup এরকম একটা অবস্থায় উদ্ভূত জীবদের ক্ষেত্রে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম (বিশেষ করে খাদ্যের জন্য) ছিল অপ্রয়োজনীয়, ব্যবহার করার মতো মুক্ত অক্সিজেনও ছিল অনুপস্থিত। এসব ক্ষেত্র ওপারিনের সাথে হেল্ডেনের পার্থক্য হল; ওপারিন আবহমন্ডলে কার্বনের মিথেন রূপকে প্রাধান্য দিয়েছেন যেখানে হেলডেন প্রাধান্য দিয়েছেন কার্বন- ডাই-অক্সাইড-কে। এদের উভয়ের মতেই, বায়ুতে মুক্ত অক্সিজেন এসেছে মূলতঃ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার ফলেই ।

ওপারিন ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন কি করে সমুদ্রসঞ্চিত জৈব যৌগ থেকে আদিকোষের পূর্বসূরী স্থানিক প্রক্রিয়া (localized system) এর উদ্ভব ঘটে। আধুনিক কোষের সাইটোপ্লাজমকে ঘিরে দ্বিস্তর বিশিষ্ট লিপিড অণু ও আনুষঙ্গিক প্রোটিন অণুর তৈরি মেমব্রেন রয়েছে, সেই মেমব্রেন ঐ কোষের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দ্রব্যাদির আদান প্রদানকে নিয়ন্ত্রণ করে। ওপারিন মত দেন যে, আধুনিক কোষের জটিল সংগঠন সরল কোন সংগঠন থেকেই এসেছে। এর সমর্থনে তিনি উল্লেখ করেন, জৈব যৌগগুলো জলীয় দ্রবণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে বরং দ্রবীভূত কিংবা বৃহৎ অণু (droplet) এর আকারে অবস্থানের প্রবণতা দেখায়। ১৯৩১-৩২ সালে বানজে্নবাৰ্গ দ্য জং, জলীয় দ্রবণে মোটা দুটি বড় আকৃতির জৈব অণুর একধরনের বৃহদাকার পুঞ্জীভূত সংগঠন দেখান। এগুলোর নাম দেয়া হয় Coacervate । এসব বৃহৎ অণু দ্রবণ থেকে পৃথক হয়ে যেতে পারে এবং এদের চারদিকে পানির অণুর একটা দৃঢ় বেষ্টনী থাকতে পারে। এ ধরনের অণুগুলো জীবকোষের মতোই কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য দেখাতে পারে (যেমন, বিশেষ বিশেষ কিছু দ্রব্যকেই শুধু বৃহৎ অণুর ভেতরে ঢুকতে দেয়া বা এর থেকে বের হয়ে যেতে দেয়া) এবং এভাবে সুনির্দিষ্ট কিছু জৈব অণুকে একটা পৃথক সক্রিয় সংগঠনে নিয়ে আসতে পারে। ওপারিন যুক্তি দেখান আদি সমুদ্রসঞ্চিত জৈব পদার্থের সমাহার থেকে এধরণের অনেক Coacervate তৈরি সম্ভব এবং এদের মধ্যে উপদানগত বিভিন্নতা থাকাও স্বাভাবিক। এদের মধ্যে কোন কোনটি হয়তো ভালভাবে টিকে থাকতে পেরেছে অপরগুলো পারেনি। এক ধরনের শারীর-রসায়নগত (Physiochemical) নির্বাচনই এক্ষেত্রে নির্ধারণী ভূমিকা রেখেছে। পরীক্ষাগারে coacervate তৈরি করে এর মধ্যে এনজাইমের প্রবেশ ঘটানো সম্ভব। আর কিছু না হলেও এ ধরনের coacervate আমাদের এমন একটা প্রক্রিয়ার ধারণা দেয় যার দ্বারা কিছু সংখ্যক জৈব যৌগ একটি স্বতন্ত্র সংগঠনে চলে আসতে পারে (কারো ইচ্ছা অনিচ্ছা নিরপেক্ষভাবেই)। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ ফলাফল অনুযায়ী, কিছু রাসায়নিক যৌগ এবং এদের প্রোটিনে রূপান্তর এর জন্য যেসব উপাদানের প্রয়োজন এই উপাদানগুলোর কিছু কিছু আদি ধুমপুঞ্জ ও dust-cloud, যা থেকে সৌরমন্ডলের উদ্ভব হয়েছে) এ ছিল। এই উপাদানগুলোর সংগঠন ও সম্মিলন প্রভাবিত হয়; যে সুনির্দিষ্ঠ অবস্থায় উপাদানগুলো থাকে, সেই অবস্থাগত শর্তগুলো দ্বারাই। খুব বেশী উত্তপ্ত নাক্ষত্রিক পরিবেশ, যেমন যেখানে তাপমাত্রা পনেরো থেকে আঠারো হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড সেখানে সবগুলো মৌলই পরমাণু আকারে অবস্থান করে। তাপমাত্ৰা বারো থেকে পনের হাজার ডিগ্রি সে. হলে কার্বন ও হাইড্রোজেন এর সরল সংগঠনগুলো (যেমন; মিথেন, ডাইকার্বন) সম্ভব হয়। এই তাপমাত্রায় কার্বন পরমাণুগুলো জোড়াশৃঙ্খল তৈরীর বিশেষ বেশিষ্ট্য দেখায়। এর চাইতে নিম্ন তাপমাত্রার কার্বন, আয়রন, নিকেল, কোবাল্ট এসবের সাথে যুক্ত হয়ে কার্বাইড গঠন করে। এই কার্বাইডগুলো পানির সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন তৈরী করে। আমাদের গ্রহ এই পৃথিবী তৈরীর প্রক্রিয়া প্রায় পঁচিশ কোটি বছর আগে শুরু হয়েছিল গ্যাস তথা ধুম্রগ্যস (Gas and dust cloud) থেকে : এই মেঘে পানি, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রোজেন এসবের পরিমান ছিল যথাক্রমে শতকরা ৮৪.৪ ভাগ, ১৪.৩ ভাগ ১১ ভাগ এবং ০২ ভাগ। এছাড়া সামান্য পরিমাণ অ্যামোনিয়া ও আর্গনও ছিল । ‘মাধ্যাকর্ষণজনিত টানে এই মেঘপুঞ্জ সূর্যের চারদিকে ঘুরছিল এবং ক্রমে এর ঘনত্ব ও পুরুত্ব বেড়ে একটা চাকতির আকার ধারণ করছে। মেঘপুঞ্জের যে, অংশ সূর্যের কাছাকাছি ছিল অপেক্ষাকৃত বেশী তাপ পাওয়ায় সেখানকার গ্যাসীয় উপাদানগুলো উবে যায় এবং অনুদায়ী উপাদানগুলো যেমন, বিভিন্ন ধাতু সিলিকেট, অক্সাইড, সালফাইড, কার্বাইড বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল এই গ্রহগুলো তৈরী করে। দূরবর্তী অংশে অন্যান্য গ্রহগুলো তৈরী হয়েছে কিছুটা স্বতন্ত্র উপাদান দিয়ে।

প্রাথমিকভাবে শীতল পৃথিবী ক্রমে উষ্ণ হয়ে ওঠে এর তেজস্ক্রিয় উপাদানগুলোর ভাঙ্গনের ফলে। উচ্চ তাপমাত্রায় ধাতব শিলা (rock) গলে গিয়ে ঘনত্বনুযায়ী স্তরীভূত হয়। সবচেয়ে ভারী উপাদনগুলো চলে যায় কেন্দ্রে, অপেক্ষাকৃত ভারী উপাদনগুলো চলে যায় নীচে, অপেক্ষাকৃত হাল্কাগুলো থাকে মাঝামাঝি এবং সবচাইতে হাল্কাগুলো থাকে সবচাইতে বাইরের দিকে । তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এ অবস্থায় বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে বিক্রিয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। প্রচন্ড চাপে ভেতর থেকে গ্যাসগুলো বেরিয়ে আসে এবং পৃথিবীর আকর্ষণে বাধা পড়ে এবং প্রাথমিক আবহমন্ডল উপাদানগুলো কেমন ছিল তা বিজ্ঞানীরা হিসেব করেন বর্তমান সময়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরিগুলো থেকে উদ্‌গীরিত গ্যাস এর উপাদান বিশ্লেষণ করে। এরও প্রায় পনেরো কোটি বছর পর পৃথিবীকে ঘিরে এই আদি আবহমন্ডল (proto atmosphere) থেকে জলীয় কণার মেঘ স্তর তৈরী হয়। এরপর তেজস্ক্রিয় ভাঙ্গনের তীব্রতা এবং অন্যান্য রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাত্রা কমে আসে, পৃথিবী ঠাণ্ডা হতে থাকে। তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সে. এর নীচে নেমে গেলে মেঘস্তরের বাষ্প ঘনীভূত হতে থাকে শুরু হয় বৃষ্টি আকারে অবিরাম ঝরে পড়া সহস্র বছর ধরে। পৃথিবী পৃষ্ঠের বড় বড় গহবরগুলো পাহাড়গুলোর মধ্যেই যুগপৎ প্রবল আগ্নেয় উদ্‌গীরণের ফলে যেগুলো সৃষ্ট হয়ে যেতে থাকে; সাগর মহাসাগরের।

৪.

জীবনের উদ্ভব:

এমোনিয়া, কার্বনডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং অন্যান্য কিছু যৌগ বৃষ্টির উষ্ণ পানিতে দ্রবীভূত হয়ে যায়। পানিতে দ্রবীভূত হওয়ায় কার্বনডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমে আসে অথচ হাইড্রোকার্বনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই হাইড্রোকার্বন এবার সুযোগ পায় পানির এলকোহল, এলডিহাইড ও কিটোন যৌগ এবং বিভিন্ন জৈব এসিড তৈরী করবার। এগুলো আবার এমোনিয়ার সাথে বিক্রিয়া করে তৈরী করে নাইট্রোজেন- সম্বলিত অপেক্ষাকৃত জটিল জৈব যৌগগুলো যেমন, এমাইনো এসিড। বিজ্ঞানীদের অনেকেই এসব পরিবর্তনে অতিবেগুনী রশ্মি ও অন্যান্য শক্তি-উৎসের ভূমিকার কথা বলেন। উচ্চচাপের প্রভাবে এই এমাইনো এসিডগুলো যুক্ত হয়ে তৈরী করে প্রথমে সরল ও পরে জটিল প্রোটিন অণুর। দুটি প্রোটিন অণু, লবণ ও পানির সমন্বয়ে তৈরী হয় সেই কথিত বৃহৎ অণু বা coacervate। কোসারভেটগুলো দ্রবণের জৈবাজৈব উপাদান নিজেদের মধ্যে টেনে নিয়ে আকারে বড়ো হতে থাকে এবং এক সময়ে দুভাগ হয়ে যায়। এরা যে কেবল ওসব উপাদান আত্মস্থ করতো তা নয়, কিছু কিছু উপাদান বেরও করে দিতো। প্রতিবেশী সাথী কোসারভেটগুলোর এধরণের আন্তঃপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্ভবতঃ জীবনের আদি সরল রূপ অস্তিত্বে এসেছিলো। এই প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত-করণের মধ্য দিয়ে, প্রতিবেশের সাথে কোসারভেটগুলোর আন্তঃক্রিয়া এবং আত্মঅনুকৃতি (Self renewal) ঘটানোর প্রক্রিয়া জোরদার হয়। আত্মঅনুকৃতি ঘটাতে পারে এবং প্রতিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এমন বস্তুই জীবনের আবির্ভাবঃ তথা বিকাশের পূর্বশর্ত। এর মধ্যে প্রোটিন অণুগুলিও দৃঢ় সংগঠন প্রাপ্ত হতে থাকে। লক্ষ লক্ষ বছরের দীর্ঘ ও ধীর পরিবর্তনের পরিণতিতে সৃষ্টি হয় আদিকোষ Protozoa – জীবনের এককোষী রূপ । কিছুটা জটিল সংগঠনে হলেও এরা এখনো টিকে আছে (যেমন, ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া, ব্লগ্রিণ এলজি)। পরবর্তী বিবর্তনের ধারায় এসব প্রোটোজোয়া থেকেই এসেছে বহুকোষী জীবন সংগঠন (এখানে মনে রাখা উচিত যে; জীবন সংগঠনকারী উপাদানগুলোর একটা সুনির্দিষ্ট সংগঠন চলে আসার পর তা থেকে ক্রমিক পর্যায়ে কোসার্ভেট, সরলকোষ, বহুকোষী জীব প্রভৃতি তৈরী হবার প্রক্রিয়াগুলো ঘটে থাকে অনেকগুলো শর্তাধীনে।

সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার উদ্ভবের পর থেকে পুষ্টিগ্রহণ ও বিপাক প্রক্রিয়ার পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করে জীবন দুটো প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে উদ্ভিদ ও প্রাণী। আদি Flagellate গুলোর পুষ্টিগুণ পদ্ধতি ছিল দ্বিবিধ। আংশিক ইউগ্লেনার ( Euglena) মতো-এরা আলোর উপস্থিতিতে উদ্ভিদের মতোই খাদ্য তৈরী করে এবং অন্ধকারে প্রাণীর মতো খাদ্য গ্রহণ করে। যে সমস্ত জীব সূর্যলোকের উপস্থিতিতে কার্বনডাই-অক্সাইড ও পানিকে জৈব যৌগে পরিণত করে পুষ্টি যোগায় তারাই হল উদ্ভিদের প্রাথমিক সংগঠন। অন্যদিকে পুষ্টির জন্য অক্সিজেন এবং সমুদ্রস্থিত জৈব যৌগের ওপর যারা নির্ভরশীল তারাই জলজ প্রাণীর প্রাথমিক সংগঠন। প্রথমে যে বহুকোষী জীবনাণুগুলোর উদ্ভব হয়েছিল সেগুলো ছিল অনেকটা আজকের স্পঞ্জ ও সিলেনটারেটার মতো যারা পরবর্তীতে হাইড্রা, মেডুসা, এবং কোরালে বিবর্তিত হয়েছে। জীবন প্রগতিতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হল দেহ সংগঠনে দ্বিদেহী প্রতিসাম্যতা (Double body symmetry) এর আবির্ভাব যা দেহকে সম্মুখ ভাগ ও পশ্চাদভাগ (front and rear)-এ এবং পৃষ্ঠদেশ ও উপরীয় (back and abdominal) অংশে স্বতন্ত্রিত করে। সম্মুখভাগে ইন্দ্রিয়গুলোর এবং স্নায়ুগ্রন্থির উদ্ভব ঘটে পরবর্তীতে এ ধারা অনুসৃত হয় মস্তিষ্কের বিকাশে। পৃষ্ঠদিক রক্ষাকারী ভূমিকা রাখে (বিভিন্নরকম ত্বকগ্রন্থি, হুল-কাটা, রক্ষাকারী বর্ণ এসবের মাধ্যমে), উদরীয় অংশ দায়ী হয় চলাচল এবং খাদ্য আয়ত্তে আনার মতো ক্রিয়াকলাপের জন্য। এসব পরিবর্তনের সাথে সাথে ও প্রভাবে প্রাণীদের আচার আচরণ পাল্টে যায়। তারা আগের চাইতে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে ক্ষিপ্রগতি হয়ে ওঠে। ফলে সাধারণভাবে এদের জীবনীশক্তি যায় বেড়ে। প্রায় সকল জীবই তখনও পর্যন্ত জলনিবাসী; যদিও কিছু কিছু বহুকোষী ব্যাকটেরিয়া এবং এককোষী শৈবাল সমুদ্রের বাইরে আর্দ্র এলাকাগুলোয় টিকে থাকতে পারতো এবং এরাই মাটি তৈরী হবার প্রক্রিয়ার সূচনা করে।

৫.

অজৈব বস্তু থেকে জীবনের উদ্ভবের সপক্ষে

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, অজৈব বস্তু থেকে জৈব বস্তু উদ্ভবের বিন্দুতে রয়েছে নিকেল, কোবাল্ট, লোহা এসবের সাথে কার্বনের সংযুক্তি (অর্থাৎ কার্বাইড গঠন)। এই কার্বাইডগুলো পানির সাথে মিলে তৈরী হয়েছে হাইড্রোকার্বন, পরীক্ষাগারে এটি প্রমাণিত হয়েছে। মেন্ডেলিভ উচ্চতাপ আয়রণ-কার্বাইডের ওপর দিয়ে ষ্ট্রীম চালনা করে পেয়েছেন তেল এবং আরও কিছু জৈব বস্তু । সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কি ঘটে ? এটা অজৈব বস্তুকে জৈব বস্তুতে রূপান্তরণেরই একটি প্রক্রিয়া। অজৈব বস্তুকে জৈব যৌগের রাসায়নিক সংগঠনে নিয়ে আসতে যে শক্তির প্রয়োজন হয় উদ্ভিদ সেটা পাচ্ছে সৌরশক্তি থেকে । সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার ফলে গোটা পৃথিবীতে প্রতি বছর একশো বিলিয়ন টন জৈব বস্তু তৈরী হয়, দু’শ বিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড আত্তীকৃত (assimilated) হয় এবং প্রায় একশো পঁয়তাল্লিশ বিলিয়ন টন মুক্ত অক্সিজেন তৈরী হয়। এই প্রক্রিয়ার সূচনা করে, আদি সবুজ জীব আদি আবহমন্ডলে অক্সিজেন যুগিয়েছে; ফলে তৈরী হতে পেরেছে ওজোন স্তর যা জীব বিবর্তনের উপযোগী পরিবেশ তৈরী করেছে। পরীক্ষাগারে মিথেন এমোনিয়া, হাইড্রোজেন এবং জলীয় বাষ্প: এসবের গ্যাসীয় মিশ্রণ কিংবা আদি কার্বনযুক্ত যৌগের ওপর তড়িৎ প্রবাহ বা অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবে জঠিল জৈব যৌগ যেমন; এমাইনো এসিড, নিওক্লিওটাইড, এমনকি পেপটাইড বা নিওক্লটাইড শৃঙ্খল তৈরী করা সম্ভব, যদিও জীবনের জন্য অনুপযোগী অনেক যৌগও এতে তৈরী হয়। জীবনের প্রাকৃতিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের পক্ষেই দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়, এসমস্ত পরীক্ষা। এই সিদ্ধান্তকে আরও সমর্থন যোগাতে পৃথিবীর পুরনো ভূস্তরগুলোতে পাওয়া যাবে একদা অস্তিত্বশীল জীবদেহের অবশেষ আজকের জীবেদের চাইতে যারা পুরনো। ভূ-স্তর যতো গভীর হবে সেই স্তরে ধারিত জীবাবশেষও ততো পুরনো। শেষ পর্যন্ত এমন স্তরে পৌঁছানো যায় যেখানে কোন জীবেরই অস্তিত্ত্ব নেই ।

এসমস্ত পর্যবেক্ষণ পৃথিবী সৃষ্টির পর কোন এক পর্যায়ে জীবের উদ্ভব তারপর উত্তররোত্তর বিবর্তনের ধারায় তার বিভিন্ন রূপসংগঠন লাভের চিত্রকেই তুলে ধরে।

এ যাবত সংগৃহীত তথ্য (পূর্বের লেখাগুলোয় যার আংশিক আলোকপাত করা হয়েছে) এর ওপর ভিত্তি করে এ সিদ্ধান্তে পৌছা যায় যে অদূর ভবিষ্যতে প্রোটিন সংযোগের এবং অজৈব বস্তু থেকে জৈব বস্তু উদ্ভবের সম্ভাব্য সবগুলো প্রক্রিয়াই বিজ্ঞানের আওতায় চলে আসবে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এভাবেই প্রাকৃতিক উপায়ে বস্তুর বিকাশের একটি রূপই ‘জীবন’ এই দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতা প্রমাণ করেছে এবং সেই সাথে অতিপ্রাকৃতিক কোন শক্তিই জীবনের স্রষ্টা এই মতের আবশ্যিকতাকে বাতিল করেছে ।

এ বিশ্বের মতই বস্তুর অসীম অস্তিত্বকালে বহুবার জীবিত বস্তুর উদ্ভব ও বিলয় ঘটেছে বিভিন্ন বিশ্বসংগঠনে। বিজ্ঞানীরা আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কিছু কিছু গ্রহে জীবনাবির্ভাবের এবং কিছু কিছু গ্রহে এর তিরোভাবের সম্ভাব্যতাভিত্তিক ডাটা তৈরী করেছেন। মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী Harlow Shapley (১৮৮৫-১৯৭২) এর মতে বিশ্বের যতটুকু এপর্যন্ত দর্শনের আওতায় এসেছে তাতেই মোট ১০৮ থেকে ১০১৪ টি গ্রহ রয়েছে যেসবে জীবনের বিভিন্ন রূপ সংগঠন থাকা সম্ভব এবং প্রায় সমসংখ্যক গ্রহ রয়েছে যেখান থেকে জীবন চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। উল্কাপিণ্ডগুলোতে বহিরবিশ্বে জীবনের অস্তিত্বের সাক্ষ্য মেলা স্পষ্টতঃই আকস্মিক কোন ঘটনা নয়। কাজেই এ সিদ্ধান্তে চলে আসা যায়, অজৈব প্রকৃতি থেকেই প্রাকৃতিক উপায়ে জীবনের উদ্ভব ঘটে এবং তা ঘটে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মের আওতাতেই। বিজ্ঞানীদের হিসেব মতে জীবনের উদ্ভবের সবচাইতে উপযোগী পরিবেশ পাওয়া যাবে আমাদের সূর্যের মতো কোন নক্ষত্র থেকে ১৪২ থেকে ১৫২ মিলিয়ন কিলোমিটারের মধ্যে। আমাদের গ্রহ সূর্য থেকে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে রয়েছে- যা এতে জীবনের উদ্ভব ও সংরক্ষণ সম্ভব করে তুলেছে।

পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব এবং বিকাশ কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে হয়েছে বললেও এতে কখনই এটা বোঝায় না যে পুরো প্রক্রিয়াটা ছিল পূর্বনির্ধারিত। পক্ষান্তরে বিজ্ঞান এ সত্যই তুলে ধরে যে স্বতন্ত্র বিবর্তন ধারাগুলোর উদ্ভবে accident বা chance-এর প্রধান ভূমিকা রয়েছে। এই accident আবার নিজেই অন্য আরও কিছু বৈশ্বিক নিয়মেরই ফল। তাই এর প্রকৃতি বস্তুগত (objective)। বস্তুর নিজস্ব ধর্মই তাকে পরিবর্তিত হতে বাধ্য করে। পরিবর্তনহীন কোন বস্তুর অস্তিত্বই অসম্ভব। জীবনের আবির্ভাব তথা বিকাশের নিয়মবদ্ধতা বলতে শুধু এটুকুই বোঝায় যে পূর্বস্থিত নির্দিষ্ট পরিবেশের অধীনেই কেবল জড়বস্তু জীবিত বস্তুতে রূপান্তরিত হতে পারে এবং আরও কিছু পরিবেশ গত শর্তাধীনে তা জটিল বা উচ্চতর সংগঠন লাভ করতে পারে। এ থেকেই ব্যাখ্যা মিলবে অবস্থা নির্বিশেষে সকল সরল সংগঠনবিশিষ্ট জীবই কেন উচ্চতর সংগঠনে বিবর্তিত হয় না। এই বিবর্তনের লক্ষ্যমুখ শুধুমাত্র উচ্চতর সংগঠনের বিষয় হলে আজ শুধুমাত্র উচ্চতর সংগঠন বিশিষ্ট জীবদেরকেই আমরা দেখতে পেতাম । প্রোটোজোয়া, পরিফেরা এসব প্রাথমিক পর্বের জীবগুলোর অস্তিত্বই থাকতো না। সরল থেকে জটিল ও উচ্চতর সংগঠনপ্রাপ্ত হওয়ার চেয়ে বরং প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার দিকেই বিবর্তনের লক্ষ্যমুখ বলা যেতে পারে এবং এটা করতে গিয়ে যেসব জীবনের গঠনগত পরিবর্তন হয়েছে তারাই অপেক্ষাকৃত জটিল বা উচ্চতর সংগঠন প্রাপ্ত হয়েছে।

রাসায়নিক বিবর্তন, জীব বিবর্তন এসব অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে। অনেক সমস্যার এখনও সমাধান মেলেনি। তবে জীবনের উদ্ভব ও বিকাশের মৌলরূপ বা essence এখন সুস্পষ্ট। পরিমাণগত, সময়গত উপাদানগত ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভিন্নমত এমনকি বিপরীত মত থাকলেও কোন বিজ্ঞানী বা বস্তুবাদীই বলেন না যে, প্রতিটি জীবকেই তার নিজ নিজ রূপ আলাদা আলাদা করে তৈরী করা হয়েছে, সৃষ্টির গোড়া থেকে জীবেরা অপরিবর্তিত অর্থাৎ নিজ রূপেই রয়ে গেছে; মাটি দিয়ে মানুষ তৈরী করে তাতে প্রাণ দেয়া হয়েছে ইত্যাদি। এসব কথা আজ রূপকথাতেই স্থান পাবার যোগ্য। রাসায়নিক বিবর্তন, জীবন-বিবর্তন এসবের মতো সামাজিক বিবর্তন (Social Evolution) বলেও একটা কথা আছে। এই সামাজিক বিবর্তনের ধারায় এক পর্যায়ে এসে মানুষ শ্রেণী বিভক্ত সমাজের অধীন হয়ে পড়েছে। শ্রেণীশোষণভিত্তিক এই সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার বহু কৌশলের মধ্যে একটি হলো ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী বা ভাড়াটে বিজ্ঞানীকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা, পশ্চাদপদ করে রাখা। হ্যাঁ মানুষের অজ্ঞতা ও অসহায়তাই শোষক প্রতিক্রিয়াশীলদের পুঁজি। এই পুঁজির জোর আছে বলেই আজও অধিকাংশ মানুষের কাছে রূপকথাই বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান রূপকথা।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার