মুনিঋষিদের রেতঃপাত
পুরাণাদিতে মুনিঋষিদের রেতঃপাতের বহু বর্ণনা আছে। ছোটদের কাছে এইসব কাহিনী এড়িয়ে যেতে হয় এবং বড়রাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এইসবের প্রকৃত অর্থ না বুঝে খুব লজ্জা পান। এইসব কাহিনী থাকার কারণে কেউ পুরাণাদিকে দূরে সরিয়ে রাখেন, কেউ পূর্ব্বপুরুষদের অশ্রদ্ধা করেন ও পুরাণাদির কদর্থ করায় রত হন। এখানে এইরকম কয়েকটি কাহিনী বিবৃত করে খুব সংক্ষেপে সেগুলির ক্রিয়াভিত্তিক ব্যাখ্যা দিচ্ছি। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ এই ব্যাপারে আমার প্রধান অবলম্বন। আপনারা এই কাহিনীগুলির যুক্তিপূর্ণ অর্থ সম্বন্ধে ভাবুন, আলোচনা করুন- এই কামনা করি। অনুগ্রহ করে সবাই মনকে উঁচু করবেন, পৌরাণিক কবিদের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখবেন এবং কেউ কোনো কুতর্ক করবেন না।
১.
ব্রহ্মার বীর্য্য থেকে ব্রহ্মপুত্ত্র নদের সৃষ্টি হয়।
২.
মহর্ষি ভরদ্বাজ গঙ্গায় স্নানের সময় অপ্সরা ঘৃতাচীকে দেখে উত্তেজিত ও কামার্ত্ত হন এবং তার ফলে তাঁর বীর্য্যপাত হয়। তিনি সেই বীর্য্য এক কলসে সংরক্ষণ করেন। সেই কলস থেকে দ্রোণের জন্ম হয়। কলসী থেকে জন্মের জন্য দ্রোণকে কুম্ভজ বলে।
৩.
একদা মহর্ষি বিভাণ্ডক রেতঃপাত করেন এবং স্বর্ণমুখী নামক হরিণী সেই রেতঃভক্ষণ করেন। তার ফলে তার গর্ভসঞ্চার হয়। সেই গর্ভের থেকে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির জন্ম হয়। ঋষ্যশৃঙ্গের মা হরিণী বলে জন্ম থেকে তার মাথায় একটি শিঙ ছিল। তিনি দশরথের পুত্ত্রেষ্টি যজ্ঞ করে রাজাকে এক বাটি পায়েস দেন। সেই পায়েস খেয়ে দশরথের তিন রাণীর গর্ভের সঞ্চার হয়। যথাকালে সেই তিন গর্ভ থেকে বিষ্ণুর চার অবতার রাম-লক্ষ্মণ-ভরত-শত্রুঘ্নের জন্ম হয়। কৃত্তিবাসী রামায়ণে বিশদ বর্ণনা দ্রষ্টব্য।
৪.
একদিন যজ্ঞভূমিতে হলচালনরত জনক রাজা উর্ব্বশী নাম্নী অপ্সরাকে দেখে রেতঃপাত করেন। সেই বীর্য্য থেকে একটি ডিম্ব সৃষ্ট হয়। বহুদিন পরে রাজা জনক সেই ডিম্ব ভাঙেন এবং তার থেকে সীতার জন্ম হয়। কৃত্তিবাসী রামায়ণ দ্রষ্টব্য।
৫.
একদিন রাজা উপরিচর বসু মৃগয়ায় গিয়ে নিজ স্ত্রী গিরিকার কথা স্মরণ করে বীর্য্যপাত করেন। ঘটনাচক্রে এক মৎস্য সেই বীর্য্য ভক্ষণ করে এবং তার ফলে সেই মৎস্যের পেট থেকে একটি পুত্ত্র (মৎস্য নামক রাজা) ও একটি কন্যা (মৎস্যগন্ধা) জন্মলাভ করে।
৬.
শিবের বীর্য্য এক শরবনে পতিত হলে তা থেকে কার্ত্তিকের জন্ম হয়।
ক্রিয়াভিত্তিক ব্যাখ্যা:
প্রথমেই বলি যে কোন কোন আধুনিক পাঠক ইংরেজী প্রভাবিত প্রতীকী শব্দার্থবিধির প্রভাবে পড়ে এইসব কাহিনীর মর্ম্ম না বুঝে পুরাণাদিকে অশ্রদ্ধা করেন। আবার কেউ কেউ এগুলিকে অলৌকিক ঘটনা বলে মনে করেন এবং ধর্ম্মের নামে কুসংস্কার ছড়াতে থাকেন। ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে এগুলি বুঝতে পারা যায় যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। সবাই যে আমাদের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারবেন তা আমি মনে করি না। এর চেয়ে ভালো ব্যাখ্যা কারো জানা থাকলে তিনি আমাদের তা জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।
এই ধরণের কাহিনীগুলিতে রেতঃ মানে বাহ্য বীর্য্য বুঝলে হবে না। ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে রেতঃ মানে ‘জ্ঞানসম্পদের যে অংশকে বা যে তত্ত্বাদিকে উৎপাদন কর্ম্মযজ্ঞে প্রয়োগ করা হয়’ (দ্র. ‘সরল শব্দার্থকোষ’)। সেই কারণে স্বাভাবিকভাবেই এইসবের বর্ণনায় পৌরাণিক কবিরা কোনো লজ্জা অনুভব করেননি। এবার উপরি-উক্ত কাহিনীগুলির ব্যাখ্যা বলছি।
১.
ব্রহ্মপুতত্র নদ মানে ব্রহ্মজ্ঞানের নদকে বুঝতে হবে। এটি মানস সরোবর বা ব্রহ্মজ্ঞানী মানুষদের মন থেকে উৎপন্ন হয়। প্রতীকী অর্থে ব্রহ্মপুত্ত্র মানে হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে বঙ্গোপোসাগর পর্য্যন্ত বিস্তৃত তন্নামক বাহ্য নদ হতে পারে।
২.
দ্রোণের জন্মকাহিনীর অর্থ আমি এখানে পরিষ্কার ক’রে বলতে অপারগ, তবে এটুকু বলতে পারি যে এ কোনো অশ্লীল গল্প নয়। কবিদের বক্তব্যের অর্থ বুঝতে গেলে বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনার দরকার আছে এবং আগ্রহী পাঠকেরা এই ব্যাপারে খান-চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ থেকে দ্রোণ শব্দের বিস্তারিত ব্যাখ্যা পড়ে দেখতে পারেন। এই কাহিনীর অর্থ করতে গিয়ে কেউ কেউ মনে করেন যে প্রাচীন ভারতে বুঝি টেস্টটিউব বেবী আবিষ্কার হয়েছিল। এই ধরণের দাবী হাস্যকর। তবু এমন দাবী যারা করেন তারা পৌরাণিক কবিদের কোন অশ্রদ্ধা করেন না। যারা একে শুধু অশ্লীলতা বলে মনে করেন এবং এইসব নিয়ে কেবলই ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতে থাকেন তারা আধুনিকতার প্যাঁচে পড়ে পৌরাণিক কবিদের ভাষা বুঝেন না। এরা ধর্ম্মীয় কুসংস্কার দূর করতে চান এবং তাদের সেই উদ্দেশ্য সাধু, তবু ধর্ম্মের প্রতি শ্রদ্ধার অভাবে তারা বিষয়গুলির মর্ম্মোদ্ধার করতে ব্যর্থ হন।
৩.
বিভাণ্ডক মানে যিনি যৌথসমাজে ভাণ্ডের ধন ভাগ করে দেন। তিনি রেতঃপাত করেন মানে কিছু ধন সরিয়ে রাখেন। হরিণী মানে deer না বুঝে হরণকারিণী বুঝলে সুবিধা হবে। তার নাম স্বর্ণমুখী মানে বোধ হয় সোনার দিকে তার লোভ ছিল। ঋষ্যশৃঙ্গের মাথায় শিং ছিল মানে তিনি পুঁজি ও পণ্যের উগ্র সমর্থক ছিলেন বলে বুঝতে হবে। দশরথের পুত্ত্র হয় মানে তাঁর রাজ্যে পণ্যোৎপাদন বৃদ্ধি পায় বলে বুঝতে হবে। বিষ্ণু সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর স্বামী। রাম-লক্ষ্মণ-ভরত-শত্রুঘ্ন ইত্যাদি পুঁজির চার প্রকারের রূপ বলে বুঝতে হবে। প্রসঙ্গত, পুরাণের দশাবতার আসলে পুঁজির দশবিধ রূপ এবং কার্লমার্কস তাঁর পুঁজি গ্রন্থে আধুনিক ধনপতিদেরও বিষ্ণুর অধঃপতিত রূপ (দুষ্ট অবতার !) বলে মনে করেছেন। বিষয়গুলি এইভাবে না বুঝলে বীর্য্য পান করে হরিণীর গর্ভসঞ্চার ও হরিণীর পেটে মানুষের জন্ম, পায়েস খেয়ে রাণীদের গর্ভসঞ্চার ইত্যাদির কোন বিকল্প যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। আপনাদের জানা থাকলে অনুগ্রহ ক’রে তা জানান।
৪.
অপ্সরা মানে ফেরিওয়ালাদের বুঝতে হবে। জনকরাজা ওদের সমৃদ্ধি লক্ষ ক’রে নিজেও কিছু বিনিয়োগ করেন এবং তার ফল পান। যারা জন করে কৃষিকার্য্য করতেন তারাই জনক। সীতা মানে কৃষির দেবতা বা প্রকৃতপক্ষে জনক রাজার কৃষিমজুরের দলকেই বুঝতে হবে। কাহিনীর বিস্তারিত ব্যাখ্যা বর্ত্তমান লেখকের টাইমলাইনে আগেই বলা হয়েছে।
৫.
মৎস্যগন্ধার জন্মকাহিনীর অর্থ মৎস্য বা ব্যক্তিমালিকানার আগমন এবং স্বীকৃতি লাভ (মৎস্যগন্ধার পদ্মগন্ধা হয়ে যাওয়া)। আমার টাইমলাইনে একটি পৃথক পোষ্টে বিষয়টি সবিস্তারে বলা হয়েছে।
৬.
কার্ত্তিকের জন্মকাহিনী আসলে ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় লিখিত সেনাবাহিনীর জন্মকাহিনী যা ফেসবুকে আমার টাইমলাইনে অন্য একটি পোষ্টে আগেই ব্যাখ্যা করেছি।
পরিশেষে আমি বলব যে, পৌরাণিক কবিদের কাব্যপ্রতিভা যথেষ্ট ভাল ছিল বলেই মনে হয়। হরিণ বা মাছের পেটে বা কোন ডিম ভেঙে যে মানব সন্তান হয় না, তা তাঁরা জানতেন। ওদের ভাষা ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা যার বাইরের অর্থ একরকম আর ভিতরের অর্থ আর একরকম। খান-চক্রবর্তীর অভিধানে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে এইসব কাহিনীর মর্ম্মোদ্ধারের উপায়ও দেখান হয়েছে। যারা এইসব রচনার জন্য আমাদের পূর্ব্বপুরুষদের অশ্রদ্ধা করেন তারা কাজটা ঠিক করেন না। আমি আমার নাস্তিক ও যুক্তিবাদী বন্ধুদের সবিনয়ে অনুরোধ করব যে আপনারা ধর্ম্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান কিন্তু ধর্ম্ম গ্রন্থের কদর্থ করা বন্ধ করুন। গঠনমূলক সমালোচনা কাম্য। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির বিষয়ে বিশদ আলোচনার জন্য আমার লেখা ‘বর্ণসঙ্গীত’ গ্রন্থ দ্র.।
ধন্যবাদ।
সাম্প্রতিক মন্তব্য