‘যৌথতা’ বনাম ‘আমিত্ব’
মানুষ এক অদ্ভুত চিন্তার জগতে বাস করে। অবশ্য এই চিন্তার বৈশিষ্ট্যের রকমফের আছে শ্রেণীভেদে। অর্থাৎ উচ্চবিত্তের, মধ্যবিত্তের চিন্তা এক রকম আবার নিম্নবিত্তের চিন্তা ভিন্ন। তবে কিছু কিছু বিষয়ে প্রত্যেকের চিন্তার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ঐক্য আছে।
‘ঐক্য’ অর্থাৎ বোঝাতে চেয়েছি মিলের বা সামঞ্জস্যতার কথা। আমি এই মিলগুলো নিয়েই আলোচনা করতে চাই এখানে। অন্য একদিন করবো অমিল নিয়ে।
মানুষ মনের মধ্যে যেটি লালন করে, ব্যবহারিক জীবনে অধিকাংশ সময়েই তার প্রকাশ ঘটে না। মুখে যে কথাটি বলে, ব্যবহারিক কাজের সাথে সেই কথার মিল পাওয়া যায় না। এবং কথা ও কাজের মধ্যে যে অসামঞ্জস্যতা এটা ধরিয়ে দিলেও স্বীকার করে না। হয় ক্রুদ্ধ আচরণ করে নতুবা তাচ্ছিল্য করে থাকে।
যারা প্রগতিশীল রাজনীতি করেন, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের উপর আস্থাশীল অথবা জীবনে কোন একটা সময়ে করেছেন বা আস্থা রেখেছেন, তারা এক বাক্যে যৌথ নেতৃত্ব, যৌথ উদ্যোগ, যৌথ বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, না সংগঠন পর্যায়ে না ব্যক্তি জীবনে এর ব্যবহারিক প্রতিফলন দেখা যায়।
ধরুন, একজন নেতা তার সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে কর্মীসভায় বসেছেন। নেতা তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে যৌথতার উপর বিশাল এক গুরুগম্ভীর আলোচনা উপস্থাপন করলেন। কর্মীরাও অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে নেতার আলোচনা শুনলেন এবং আলোচনার মাধ্যমে দৃশ্যত অনুপ্রাণিত হলেন। যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য নেতা-কর্মী সকলেই অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন।
এমন পরিস্থিতিতে, সূচনা বক্তব্যের পর আলোচনা শুরু হলো একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। নেতা প্রথমেই এ বিষয়ে তার অভিমত ব্যক্ত করলেন অথবা তিনি কর্মীদের অভিমত জানতে চাইলেন। যেটা দ্রষ্টব্য, কর্মীদের এবং নেতার সিদ্ধান্ত আলোচনায় ফারাক হলো।
নেতা কোনোভাবেই কর্মীদের আলোচনা বা সিদ্ধান্ত, গ্রহণ করতে পারছেন না। তার অতিজ্ঞান এবং নেতৃত্বসুলভ প্রভাবের মাধ্যমে তার সিদ্ধান্তটিকেই গ্রহণ করার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। সভার শেষ পর্যায়ে নেতা কর্মীদের কাছে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলেন।
কর্মীরা সমস্বরে বলে উঠলেন, যেমন আপনি বলবেন! এই উত্তরে নেতা আবারো ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, এই সংগঠন কি আমার একার? সিদ্ধান্ত কি আমার একার? কর্মীরা মাথা নিচু করে থাকলেন। উত্তর দেবার মতো স্পর্ধা বা স্পৃহা ইতোমধ্যেই তারা হারিয়ে ফেলেছেন। কারণ তাদের সামগ্রিক মনোজগৎ এর পরিবর্তন ঘটে গেছে।
বাস্তবতা হচ্ছে এটাই, সিদ্ধান্তটি সবার সিদ্ধান্ত হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সকলের স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না। ‘যৌথতা’র বুলি কপচানো নেতা একাই মূলত সেটি নির্ধারণ করেছিলেন। সকলেই নেতার ব্যক্তিত্বের প্রভাবে ‘হ্যাঁ’ সূচক সম্মতি দিয়েছে মাত্র। যে সিদ্ধান্ত এককভাবে গ্রহণ করা হয় এমন স্তরে সেখানে বাস্তবায়নের দৃশ্যরূপটিও হয় একক।
আমি নিজে একটি সময়ে মাঝারি মাপের একটি গণসংগঠনের কেন্দ্রীয় প্রধান নেতৃত্বে ছিলাম। জীবনের সেই সময়ের অভিজ্ঞতার জায়গা থেকেই এখন বুঝি, নেতৃত্ব যৌথতার কথা বলে কার্যত কীভাবে কর্মীদের উপর তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। তার সেই চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তকে কীভাবে যৌথ সিদ্ধান্ত বলতে অন্যদেরকে বাধ্য করে। কীভাবে কর্মীরা সংগঠনকে একজনের সংগঠন হিসেবে ভাবতে শুরু করে। কীভাবে ধীরে ধীরে সংগঠনের প্রতি কর্মীর সকল ধরনের মমত্ববোধ নিঃশেষ হয়ে আসে!
মানুষের এই দ্বৈত চিন্তা জগতের কারণেই অনেক সম্ভবনা যেমন নষ্ট হয়ে যায় তেমনি কোন কিছুই নতুনভাবে আর গড়ে ওঠেনা। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুখে ‘যৌথতা’র কথা থাকলেও ব্যবহারিক জীবনে ‘আমিত্ব’বোধ প্রবল। মজার বিষয়, যে সমস্ত রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘যৌথতা’ নামক এই চমকপ্রদ স্লোগান ব্যবহার করে সেই সকল সংগঠনেরই ধারক-বাহক আবার সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই! যারা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘যৌথতা’ ঘোষণা করলেও কার্যত ‘আমিত্ব’ দ্বারাই প্রভাবিত ও পরিচালিত। সমাজে-রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে এরাই আবার নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। এদের একটি অংশ যখন আবার প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনে সাবেক হয়ে অন্য উদ্যোগের সাথে যুক্ত হন তখন তাদের কথাতে ‘যৌথতা’ প্রকট হয়ে ওঠে এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ‘আমিত্ব’ বিষয়টি তারচেয়ে আরো কয়েকগুণ বেশি প্রকট হয়ে ধরা দেয়। একইসাথে সমালোচনা-আত্মসমালোচনার কথা মুখে মুখে বলেলেও কার্যত তার কোনো অস্তিত্ব থাকেনা। কেউ করতে চাইলে সেটা আবার ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অংশ হয়ে যায়। তার উপর খড়্গ নেমে আসে, যাতে অন্যদের মধ্যে এই বিষয়ে আর কোন উৎসাহ তৈরি না হয়!
অবশ্যই সমাজের সব মানুষের মধ্যে চিন্তা জগতের এমন দ্বৈততা থাকে এমনটি নয়। তবে অনেকাংশেই এমনটি হয়। এ এক অদ্ভুত সাইকোলজিক্যাল গেম। এ ধরনের মানুষরা তারা তাদের যুক্তিকে অকাট্য মনে করে থাকেন। এবং অবলীলাক্রমে তার পাশের সকলের যুক্তিকে যুক্তিহীনভাবে তাচ্ছিল্যের সাথে খারিজ করে দেন।
মানুষ মুখে যেটি বলে, সেটি ব্যক্তি ও ব্যবহারিক জীবনে প্রতিপালন করলে যুক্তিসংগত উপায়ে তার চারপাশে কোন সংকট তৈরির সুযোগ থাকে না। কিন্তু মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য সে এসব জানার পরেও অগ্রাহ্য করে।
অধিকাংশের মধ্যেই সাফল্যের কৃতিত্ব নেওয়ার প্রবণতা থাকলেও ব্যর্থতার দায় গ্রহণের প্রবণতা থাকেনা। কিন্তু মুখে মুখে সে অন্যদেরকে ব্যর্থতার দায় গ্রহণের বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করলেও ব্যবহারিক জীবনে সেই দায় গ্রহণ না করে বরং সেটি অন্যের কাঁধেই চাপিয়ে দেয়।
ব্যক্তি, সংগঠন, রাষ্ট্র সব জায়গাতেই একই অবস্থা বিদ্যমান। ব্যর্থতার দায়ভার গ্রহণ করে কোন মন্ত্রী যেমন পদত্যাগ করে না, তেমনি না কোন রাজনৈতিক নেতা অথবা কোন সংগঠনের প্রধান! প্রত্যেক স্তরেই তারা তাদের স্বপক্ষে ‘যুক্তিহীন’ অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করে নিজেদেরকে দায়ভার এর বাইরে রাখেন। কিন্তু এতে দেশ, রাজনীতি বা সংগঠন এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ের মানুষটিও কিন্তু এক সময় অবধারিতভাবে সংকটের মুখোমুখি উপনীত হন। তখন সেটি থেকে উত্তরণের পথ হয়ে যায় অনেক কঠিন। কোন কোন সময় উত্তরণ ঘটানো যায় না।
দেশ স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হলো। এ দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের সূচনা তারও আগে থেকে। একটি সময়, যদি হয় সেটি ৬০, ৭০ বা ৮০’র দশক, প্রগতিশীলরা ছিল এখানে সমুদ্রের স্রোত হয়ে। ধীরে ধীরে আজ সেটি সরু একটি নদীতে পরিণত হয়েছে। তার একটি অন্যতম কারণই হলো নেতৃত্বের ‘যৌথতা’র কথা বলে ‘আমিত্ব’কে প্রতিষ্ঠা করা। আর সকল ধরনের ব্যর্থতার দায়কে অস্বীকার করে নিজেদের জায়গা অটল রেখে কর্মীদের উপর দায় চাপিয়ে দেওয়া। এতে অন্ধকার তৈরি হয়েছে। রাজনীতি পথ হারিয়েছে বারে বারে।
আমাদের ব্যক্তি জীবনটাকেও আমরা তেমনি একটি অন্ধকারের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছি! আমরা নিশ্চিন্তে-নির্লিপ্তভাবে চোখ বন্ধ করে আছি। মনে করছি, একজন ‘হিমু’ এসে আমাদের সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাবে। এটা শাসকের তৈরি করে দেওয়া একটি ভাবনার খোরাক!
মুখে মুখে নয়, ব্যবহারিকভাবেই ‘আমিত্বে’র পরিবর্তে ‘যৌথতা’কেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সকল ধরনের ব্যর্থতার দায়ভার নি:শঙ্ক চিত্তে গ্রহণ করতে হবে। তবেই আগামীর পথ চলা হবে অপেক্ষাকৃত মসৃণ।
যাদের মুক্তির জন্য যৌথতা, রাজনীতি তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করলেও তারা তা বুঝতে চায় না । তা বুঝতে চেষ্টাও করে না, সামাজিক অবস্থানের কারণেই তা বুঝতে চেষ্টা করা তাদের সাধ্যের বাইরে।তবে যৌথ জীবনযাপন ছাড়া মানুষ মানবিক হয় না।