Select Page

মৌলবাদি গোষ্ঠির বিজ্ঞানপ্রীতি এবং বিজ্ঞানবিদ্বেষ প্রসঙ্গে

মৌলবাদি গোষ্ঠির বিজ্ঞানপ্রীতি এবং বিজ্ঞানবিদ্বেষ প্রসঙ্গে

দু’যুগ আগের লেখা, এখনও প্রযোজ্য বিধায় রিপোস্ট করলাম।

অন্ধবিশ্বাসীদেরও একরকম যুক্তিবোধ থাকে। থাকে বৃত্তাবদ্ধ যুক্তি, কানাগলিতে ঘুরপাক খাবার যুক্তি; যা থাকে না তা হল যুক্তির শৃঙ্খলা, বাছবিচার। নিজ নিজ বিশ্বাসের পক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে অন্ধবিশ্বাসীদের যুক্তিপ্রয়োগ হয়ে উঠতে পারে হাস্যকর, আচরণ হয়ে উঠতে পারে জান্তব। এর একটা ভাল উদাহরণ হতে পারে, ধর্মীয় মৌলবাদিদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা-সিদ্ধান্তগুলোকে নির্ভুল প্রমাণ করবার প্রাণান্তিক (নিজেদের এবং অন্যদের) চেষ্টা এবং এই উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা ও একই সাথে অবজ্ঞাও করা। বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত-অনুসিদ্ধান্তগুলোর প্রতি এদের এই দুই চরমপ্রান্তিক আচরণ; অর্থাৎ আনুগত্য (মিলে গেলে/ মেলাতে পারলে) এবং অবজ্ঞা (না মিললে); এই দু’য়ের মাঝখানের বিশাল ফাঁকা জায়গাটা ভরাট হতে পারে মৌনতা দিয়ে, নয়তো গোঁয়ার্তুমি দিয়ে। সুযোগ আর পরিস্থিতি বুঝে, এই দু’টি উপায়ের যে কোন একটির প্রয়োগ প্রধান হয়ে উঠতে পারে। বলাবাহুল্য, এর কোনটাই যৌক্তিক আচরণ নয়। অবশ্য যৌক্তিক আচরণ করা এদের পক্ষে সম্ভবও নয় এই জন্যে যে কিছু ভিত্তিহীন অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের ওপর দাঁড়িয়েই এদের বাদবাকী তৎপরতা।

ধর্মগ্রন্থগুলো যে স্থানে-কালে রচিত হয়েছে সেই স্থান-কালের জ্ঞানচর্চার মানের ওপরই নির্ভর করেছে ওগুলোতে কী কী বিষয়ে কতটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা। স্থান-কাল পাল্টে যাওয়ায় বিভিন্ন ব্যাখ্যা সংবেশিত হয়েছে; এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। ধর্মগ্রন্থের নৈতিক আবেদনকেই মূল বলে যারা মানতে পারছে, তাদের এ নিয়ে ক্ষোভ বা অস্বস্তি নেই। সমস্যা হয় মৌলবাদীদের, যারা ধর্মগ্রন্থের প্রতিটি ব্যাখ্যা, সিদ্ধান্তকে আক্ষরিক অর্থে সত্য, বিজ্ঞান-সম্মত বলে মনে করতে এবং করাতে চায়। সপক্ষ-সমর্থনের এই উন্মাদনা থেকে সূচনা হয় নানা অপকৌশল-প্রবৃত্তির। খুব সাধারণএকটা প্রবৃত্তি হলো বিজ্ঞানী কিংবা উচ্চ-IQ সম্পন্ন লোকদের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা।

আইজাক আসিমভ তাঁর এক লেখায় High IQ-ওয়ালা মানুষদের সংগঠন মেনজা (Mensa)-র জমায়েতে (নিউইয়র্কে) তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছিলেন।এই High-IQ ওয়ালাদের মধ্যে জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে শুরু করে হরেকরকম ভোজবাজি আর গুঢ়তত্ত্বে (Occultism) বিশ্বাসী লোকেরাও ছিলেন। এঁদের সাথে কথাবার্তা বলে আসিমভ এই উপলব্ধিতে পৌঁছেন যে, হাই-IQ ওয়ালারাও ক্ষেত্রবিশেষে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতে পারেন। গোটা বিশ্বেই, অশিক্ষিত জনগোষ্ঠির কথা বাদ দিলেও, শিক্ষিত জনগোষ্ঠির একটা বড় অংশ (এমনকি যারা বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিত তারাও) অলৌকিকত্বে এবং নানা অপবিজ্ঞানে বিশ্বাসী। যুক্তির এবং প্রমাণ ক্ষমতার আয়ু শেষ হলে নিজ নিজ মতের সমর্থনে এরা দ্বারস্থ হন High IQ-ওয়ালাদের; উনি এটা বলেছেন, তিনি ওটা বিশ্বাস করতেন, ইত্যাদি ইত্যাদি! বাস্তবতা এই যে, সুদূর অতীত থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্তও এসব ব্যাপারে উদাহরণের কোন ঘাটতি থাকেনি! জোহান কেপলার জ্যোতিষশাস্ত্রকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন, আইজ্যাক নিউটন ক্ষারধাতুকে সোনা রূপায় পরিণত করবার চেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং

লগারিদমের আবিষ্কর্তা জন ন্যাপিয়ার ঐশী গ্রন্থের (Book of Revealation) ব্যাখ্যায় পাহাড়-প্রমাণ অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছিলেন! ইউরেনাসের আবিষ্কর্তা উইলিয়াম হার্সেল মনে করতেন আগুনের বাতাবরণের নীচে সূর্য মূলতঃ শীতল ও অন্ধকারময়। এই লিষ্টিকে অনায়েসে আরও বাড়িয়ে তোলা যায় এবং এভাবে সমগ্র রেকর্ড ঘেটে দেখলে একথাই বরং অবিশ্বাস্য ঠেকবে যে আজকের দিনে বড় বড় বিজ্ঞানী-বিদ্বানদের মধ্যে কেউই অযৌক্তিক, অলৌকিক বিজ্ঞানবিরুদ্ধ কোন বিষয়ে বিশ্বাস রাখবেন না।

মানুষের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে বিভিন্ন রকম অপবিজ্ঞানের যেসব ধ্বজাধারীরা ব্যবসা/রাজনীতি ইত্যাদি করে আসছে তারা নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য এই ব্যাপারটাকে (High IQ সম্পন্ন/ সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত লোকেদের বিজ্ঞানবিরুদ্ধ বিশ্বাস-ভাবনা) কাজে লাগায়। মৌলবাদীরাও আধ্যাত্মিকতার সমর্থনে এবং নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থগুলেকে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ করবার চেষ্টায় একই পদ্ধতি কাজে লাগায়। এর সাথে যুক্ত হয় প্রকৃত তত্ত্ব-তথ্যের বিকৃতি এবং এটা হতে পারে দু’দিক থেকেই; বিজ্ঞানীর মূল কথার বিকৃত উপস্থাপনা করে কিংবা কথিত ঐশিবাণীর অর্থ পাল্টে দিয়ে।

মৌলবাদীদের সমর্থনে ধর্মগ্রন্থের উক্তি-সিদ্ধান্তগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হাজির করবার একটি সাধারণ কৌশল হল , ধর্মগ্রন্থ এবং বিজ্ঞান দু’বিষয়েই জনগণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে, যে কোন পক্ষের বক্তব্যকে বিকৃত করা কিংবা অসমভাবে জুড়ে দেয়া। মৌলবাদী তাত্ত্বিকেরা বিবর্তনতত্ত্বকে না মানলেও ধর্মগ্রন্থগুলোর মর্ম-অর্থের যে বিবর্তন ঘটাচ্ছেন পরকালের ভয় না করে (!) তা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। কসমোলজি থেকে শুরু করে হালের ইনফরমেশন থিয়োরি, কোয়ান্টামতত্ত্ব-সবকিছুরই না কি ইঙ্গিত রয়েছে এদের যার যার ধর্মগ্রন্থগুলোয়। আধুনিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক অনেক সিদ্ধান্তেরই না কি উল্লেখ আছে হাজার বছর আগের এই গ্রন্থগুলোয় (অবশ্য প্রত্যেক মৌলবাদী গ্রুপের মতে শুধু তাদের নিজেদেরটায়, অন্য কারো ধর্মগ্রন্থে নয়)! প্রশ্ন হল, আরো কয়েক হাজার বছর পরে হয়তো অনেক বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তই পাল্টে যাবে, তখন কী এই মৌলবাদি, ভুয়া বিজ্ঞান-প্রেমী তাত্ত্বিকেরা নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থগুলোর উক্তির নতুন অর্থ-ব্যাখ্যা খুঁজে পাবে, না কি দোষ চাপাবে ভাষাতাত্ত্বিকের ঘাড়ে? কতকটা অনন্যোপায় হয়ে, কতকটা অলীকতা-অবাস্তবতার বিপরীতে বিজ্ঞানের বিজয়জনিত গরিমায় ভাগ বসানোর লোভে; বিজ্ঞানের প্রতি এরকম মেকি আনুগত্য দেখানোর পাশাপাশি সময় সুযোগ বুঝে সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করাও এদের স্বভাবজাত। বিজ্ঞানের অবদানকে খাটো করে দেখাতে পারলেই যেন অপবিজ্ঞানের তথা আধ্যাত্মবাদের বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞান কোন একটা ‘করেছে।

বিবর্তনবাদের বিরোধিতা কিন্তু এখনও চলছে। যাবতীয় ঐশ্বরিক গ্রন্থালম্বী ধর্ম সৈনিকেরাই অত্যন্ত যত্নের সাথেই একাজটি এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের বহু শাখাতেই এই তত্ত্বটির সপক্ষে বহু প্রামাণিক তথ্য থাকলেও যেহেতু চর্মচক্ষে সরাসরি (চলচ্চিত্র দেখানোর মত করে) প্রক্রিয়াটাকে প্রত্যক্ষ করানো যাচ্ছে না, তাই হয়তো। যুক্তির চোখতো এদের বন্ধই, বোধ বুদ্ধিও তথৈবচ; অথচ হাস্যকরভাবে এই গোষ্ঠির অনেকেই নিজেদেরকে গভীর বোধসম্পন্ন বলে মনে করে এবং প্রচারও করে।

মানুষের বিবর্তন প্রসঙ্গে ডারউইনের ব্যাখ্যার বিরোধিতা করতে গিয়ে বাকী বানরগুলো মানুষ হয়ে যাচ্ছে না কেন-এ জাতীয় বোধবুদ্ধিহীন প্রশ্ন থেকে শুরু করে ডারউইনকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-কার্টুন ইত্যাচি রুচি-বিগর্হিত কাজ এরা সদম্ভে করে থাকে। কিন্তু, ডারউইনকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা কেন? তার তত্ত্বের ব্যাখ্যার যৌক্তিক বিরোধিতা করা যেতে পারে, যা সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীমহল থেকে করা হয়েছে, হচ্ছে। তা না করে তাঁর প্রতি অবজ্ঞার ভাব দেখানো কেন? তিনি কি শয়তানের উপাসক ছিলেন, না কি বানরকে পূর্বপুরুষ বলে তিনি মানুষকে অপমান করতে চেয়েছেন?! বানরের পরিবর্তে সিংহকে পূর্বপুরুষ বললে কি কিছুটা সহনীয় হত? না, এসব কিছুই নয়।মৌলবাদীরা বিশ্বাস করে এবং করাতে চায়; মানুষ মানুষ হিসেবেই পয়দা হয়েছে, অন্য কোন জীব থেকে আসে নি। বাকী জীবগুলোও যার যার রূপে আস্ত আস্ত তৈরী হয়ে, কোন একটা মুহূর্ত থেকে হঠাৎ জীবনযাত্রা শুরু করেছে। আকাশ-মাটি তৈরী হল, তৈরী হল সমুদ্র; যাবতীয় জীব-জানোয়ার ও তৈরী হল একই সাথেই; তারপর হঠাৎ করেই একদিন আকাশে পাখি, সমুদ্রে হাঙ্গর, ডাঙ্গায় মানুষের পদচারণা শুরু হয়ে গেল; সব এক সাথেই!

বিজ্ঞানীরা আজ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ডারউইনের ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করলেও তত্ত্ব হিসেবে বিবর্তনবাদকে কেউ অস্বীকার করেন না। জীবনের উদ্ভব কোথায় হয়েছে, পৃথিবীতে না কি বাইরে; জীব-বিবর্তনের জন্য কি কি ফ্যাক্টর দায়ী ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞানীদের ভিন্ন ভিন্ন মত এমনকি বিপরীত মত পর্যন্ত রয়েছে। কিন্তু তাই বলে প্রক্রিয়া হিসেবে ক্যামিকাল ইভেল্যুশন কিংবা বায়োলজিকাল ইভোল্যুশন; এসব প্রক্রিয়ার অনস্তিত্বের কথা কেউ বলেন না। বিজ্ঞানী আবদুস সালামের নোবেল বিজয়ে গোটা মানবজাতির পক্ষ হয়ে উল্লাস না করে, বিশেষ ধর্মপক্ষের হয়ে উল্লাস প্রকাশ করে তৃপ্তি পেয়ে থাকে কিছু সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠি, যদিও ধর্মের সাথে এরকম সাফল্যের কোন যোগাযোগ, তারা বা অন্য কেউ দেখাতে পারে নি। এক্ষেত্রে অবশ্য সম্প্রদায়গত বিভাজনের কথা মনে না রেখে তারা বেশ উদারতার (!) পরিচয়ই দেয়। (প্রফেসর সালাম আহম্মদীয়া সম্প্রদায় ভুক্ত)। এই বিজ্ঞানী বিবর্তনবাদের একজন উৎসাহী সমর্থক। রাসায়নিক বিবর্তন-এর একটি বিষয়ে তিনি গবেষণাও করেছেন। তিনি জীবনের অপার্থিব (Extra-terrestrial) উৎপত্তির ধারণায় আস্থাবান।পৃথিবীতে সময় এবং পরিবেশজনিত অপ্রবেশ্যতার কারণে এই ধারণা-উদ্রেককারী প্রকল্প বর্তমান সময়ে অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। এর মূল কথা হল পৃথিবীর বাইরে প্রজননক্ষম জীবাণুর জন্ম হয়েছে, যা কোন উপায়ে (যেমন, ধুমকেতুর মাধ্যমে) পৃথিবীতে পৌঁছেছে; পরবর্তীতে এই জীবাণু-থেকেই বিবর্তনের মাধ্যমে নানা বিচিত্র জীবনরূপের সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীতে। কাজেই বিবর্তনের মৌলভাব নাকচ হচ্ছে না এতে মোটেও; বরং সমৃদ্ধতরই হচ্ছে। বিবর্তনতত্ত্ব সত্য প্রমাণিত হলে, ঈশ্বর কী মারা যাবে, না কি মানুষ নৈতিকতা-বর্জিত হয়ে যাবে? কোনটাই নয়! ধর্মগ্রন্থগুলো যে স্থানে-কালে রচিত হয়েছে সেই স্থানকালের লব্ধজ্ঞানের প্রতিফলনই সেগুলোতে থাকবে, অথচ মৌলবাদীরা সেগুলোকে নির্ভুল, চিরসত্য প্রমাণ করার উন্মাদনায় বিজ্ঞান তথা বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে, একরকম স্যাডিষ্টিক চর্চায় লিপ্ত। এই মনেবৈকল্য নিঃসন্দেহে এদের ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স থেকেই এসেছে। ধর্মগ্রন্থের কোন উক্তি ভ্রান্ত প্রমাণিত হলেই প্রকৃত ধর্মবোধসম্পন্ন মানুষের ধর্মবোধ লুপ্ত হয় না, আর সামগ্রিকভাবে ধর্মগ্রন্থগুলো অচল-অব্যবহারোপযোগী প্রতিপন্ন হলেও প্রকৃত ঈশ্বরবোধ সম্পন্ন মানুষের ঈশ্বরবোধ লুপ্ত হয় না; কেন না ধর্মবোধ আর ঈশ্বরবোধ কখনোই সমার্থক নয় ।

বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া বহুদিন ধরেই চলে আসছে। তথাকথিত শীতল যুদ্ধকালীন সময়ে ও পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদের বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট হয়ে বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠি ব্যাপারটাকে একটা বহুস্পর্শী প্রাতিষ্ঠানিক ফর্মে নিয়ে এসেছে। সুযোগসুবিধা মতো একদিকে বিকৃত বা অবিকৃত যেভাবে সম্ভব, সেভাবেই বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা, অন্যদিকে বিজ্ঞান তথা বিজ্ঞানীদের অবদানকে খাটো করে দেখানোর প্রয়াস চালানো, এই দু’কাজেই …বিস্তর পয়সা ঢালা হচ্ছে। পাঠক-জনগোষ্ঠির অজ্ঞতা-অসহায়তাই হল এদের সাফল্যের বড় কারণ, তবে, এর বাইরেও একটা উল্লেখযোগ্য কারণ হল এমন একটা সাধারণ বিশ্বাস যে সর্বজ্ঞানী সর্বশক্তিমান একটা কিছুর অস্তিত্ব থাকতেই হবে।

বিজ্ঞান কখনোই এই দাবী করে না যে চরম সত্য কে জেনে দেবে। চরম সত্য বলে কোন কিছুর অস্তিত্বের কথাও বিজ্ঞান বলে না।পর্যবেক্ষণের সীমায় যতটুকু রয়েছে ততটুকু নিয়েই বিজ্ঞান কাজ করে; দূরতম সীমা অতিক্রম করার কিংবা বিশ্বের সকল, রহস্য উদঘাটন করবার প্রতিজ্ঞাও সেখানে নেই। ধীর লয়ে বিজ্ঞানের পথ পরিক্রমা হয়, ক্ষণে ক্ষণে ‘ইউরেকা’ বলে ওঠার অবস্থা নেই এই পথ-চলায়।

বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, জিজ্ঞাসা হয়তো কোনদিন শেষ হবে না, সকল রহস্যের সমাধান কোনদিনই হয়তো সম্ভব হবে না, সব সময় কালেই অজানা কিছু থেকেই যাবে; কিন্তু এই পারা-না-পারা, জানা-না-জানার সাথে, ঈশ্বরের থাকা-না-থাকার কোন সম্পর্ক নেই। রহস্যের শেষ নেই, হবে না; এর জন্য হতাশ হবারও কারণ নেই, একে বরং চিরন্তন প্রেরণার উৎস বলেই মনে করা যেতে পারে। ‘সবকিছু জানা হয়ে গেলে জীবন কী আকর্ষণহীন হয়ে যাবে না?’ আইজ্যাক আসিমভ তাঁর এক গল্পে একজন সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ-এর কল্পনাকাহিনীতে বলছেন; সেই সর্বশক্তিমান এমন এক বিশ্ব তৈরী করলো যাতে অসংখ্য বুদ্ধিমান প্রাণী তৈরী হতে পারে। এ ধরনের অসংখ্য প্রাণীকে জড়ো করে সে নিত্য নতুন আবিষ্কারের কাজে লাগিয়ে দিল, এই আশাহীন আশায় যে এই প্রাণীদের কেউ হয়তে কোন একদিন সক্ষম হবে তার কাঁধ থেকে অমরত্বের দুঃসহ বোঝা সরিয়ে নেবার উপায় বের করতে!

বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের প্রতি মৌলবাদীদের সময় সুযোগমত সম্পূর্ণ বিপরীত প্রবণতার দুরকম আচরণের ব্যাপারটা যাঁদের কাছে স্পষ্ট নয় তাঁরা; আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনা চরিতামৃত সংঘ বা ইস্কন গোষ্ঠির প্রচারকৃত কিছু বই যেমন ‘জীবন আসে জীবন থেকে’, মরিস বুকাইলির, ‘বাইবেল কোরান ও বিজ্ঞান ইত্যাদি অভিজাত ভাবাপন্ন (!) বই কিংবা উন্মুক্ত (নাকি উন্মত্ত!) মানসকাঠামো গড়ার লক্ষ্যে মৌলবাদি ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠিগুলোর প্রকাশিত বিভিন্ন সাময়িকী ঘেঁটে দেখতে পারেন।

মৌলবাদিদের উল্লেখিত দ্বিমুখী প্রবণতার মধ্যে বিজ্ঞানের অবদানকে খাটো করে দেখানোর প্রবণতাই বেশী ক্ষতিকর বলে মনে হয়। উদাহরণ দিয়ে দেখাতে গেলে বিস্তৃত পরিসরের প্রয়োজন। নীচে একটি মাত্র বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া গেল।

[বইটি, ভক্তি বেদান্ত বুকট্রাষ্ট-এর ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত, ‘জীবন আসে জীবন থেকে’; ইসকন গোষ্ঠির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল প্রভুপাদ এর ভাষ্যনির্ভর।]

-বৈজ্ঞানিকরা বিজ্ঞানে মোটেই পারদর্শী নয়, তবে বাক্য বিন্যাস করে অন্যকে প্রতারণা করতে তারা খুব পটু।’ (পৃ-৯৬)

ডারউইন এবং তার অনুগামীরা হচ্ছে এক-একটা মূর্খ।’ (পৃ-৫০)

(হাতে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে) কোন বৈজ্ঞানিক কী এই রকম একটা ফুল তার গবেষণাগারে তৈরী করতে পারবে?” (পৃ ১৭)

বৈজ্ঞানিকেরা বাক্চাতুরী করে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, প্লুটোনিয়াম, ফোটন ইত্যাদি নাম সৃষ্টি করছে, কিন্তু তার ফলে জনগণের কী লাভ হচ্ছে ? বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের

মাধ্যমে কি প্রগতি হয়েছে ? তারা কেবল গন্ডা গন্ডা বই প্রকাশ করেছে।’ (পৃ-২৩)

বৈজ্ঞানিকেরা মৃত্যুকে রোধ করতে পারে না, তারা জন্ম, ব্যাধি এবং জরাকেও রোধ করতে পারে না। সুতরাং তারা কী করেছে ? পূর্বেও মানুষ জরাগ্রস্ত হত, এখনও মানুষ জরাগ্রস্ত হচ্ছে। পৃথিবীর অবস্থার পরিবর্তনে বৈজ্ঞানিকরা কোনরকম সাহায্য করে নি। বৈজ্ঞানিকেরা যদি বলে যে, জড় পদার্থ হচ্ছে জীবন সৃষ্টির কারণ, তা হলে আমরা তাদের অনুরোধ করবো, অন্ততঃ একজন মৃত মানুষকে তারা বাঁচিয়ে তুলুক; আইনষ্টাইনের মত একজন মহান ব্যক্তিকে তারা বাঁচিয়ে তুলুক তো।’ (পৃ-৭০) [উল্লেখ্য, যে এই বইয়ের ভূমিকাতেই বইয়ের মূল সুরের সমর্থনে কিছু বিজ্ঞানীর বক্তব্যকে (যেমন, ইউজিন উইগনার, হারবার্ট ইয়কি) রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।]

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার