পোশাক ও স্বাস্থ্য
মানুষ ব্যতীত কোন প্রাণীই পোশাক/কাপড় পরিধান করে না, আদিম মানুষেরাও পোশাক পরিধান করতেন না, এখনো পৃথিবীর অনেক (বিশেষত আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার) উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে পোশাকের তেমন একটি প্রচলন নেই।পোশাকের প্রচলন ঠিক কবে কোথায় শুরু হয়েছিল সেটা বলা মুশকিল, তবে এটা ধারণা করা হয় মানুষ যখন আফ্রিকার বাহিরে শীত প্রধান অঞ্চলে (ইউরোপে/সাইবেরিয়া) ছড়িয়ে পড়ে তখন তীব্র শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ পোশাক পরিধান করা শুরু করে। আদিম মানুষের এসব পোশাক কিন্তু সুতা দিয়ে তৈরি হতো না, তারা প্রকৃতিতে যেসব উপাদান পেতেন তাই দিয়েই শীত নিবারণ করতেন, এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পশুর চামড়া এবং গাছের ছাল বা পাতা।
তুলা বা তন্তু থেকে সুতা তৈরি করে কাপড় বুনোনোর বিদ্যা খুব বেশিদিনের নয়। কৃষি যুগে, (আজ থেকে দশ হাজার বছর আগে শুরু হয়েছিল। কাপড় বুনোনোর বিদ্যা আয়ত্ব করে মানুষ সেই বিচারে মানব সমাজে পোশাক পরার প্রচলন শুরু হয় আজ থেকে মোটামুটি দশ হাজার বছর আগে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের পোশাক-পরিচ্ছেদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য দেখা যায় যেটা খুবই যুক্তিসঙ্গত এবং স্বাভাবিক। ইউরোপীয়দের সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার পর শার্ট, প্যান্ট কোট, টাই বা স্কার্ট গাউন পৃথিবীর সব জাতির মানুষই পরিধান করেন বটে, তবে এই ধরনের পোশাক কিন্তু পরিবেশ ও ভৌগোলিক এলাকা ভেদে সবার জন্য ভাল নয়। আসলে কোন কোন পোশাক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয়, যা পরে আমি আলোচনা করবো।
প্রাচীন কালের মানুষ তাদের নিজস্ব আবাস স্থলের আবহাওয়ার ধরনের সাথে সঙ্গতি রেখে পোশাক তৈরি করেছিল, যা কিছুটা স্বাস্থ্য সম্মত ছিল হয়তো। ইউরোপ শীত প্রধান অঞ্চল তাই এই অঞ্চলের পোশাক ছিল সর্বাঙ্গ ঢাকা, পায়ে মোজা, ওভার কোট এবং গলায় টাই যা ভেদ করে শীতল বায়ু দেহের সংস্পর্শে আসতে পারত না, ফলে দেহটা গরম থাকত। অর্থাৎ ইউরোপীয়দের পোশাক ইউরোপের আবহাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আফ্রিকা মহাদেশ বেশ গরম, তাই আফ্রিকার মানুষ তেমন একটা পোশাক পরিধান করতেন না, করলেও তা ছিল খুবই ছোট। আরব অঞ্চলে প্রখর সূর্যের তাপ যা সরাসরি ত্বকে পড়লে ত্বক পুড়ে যেতে বা ফোস্কা পরে যেতে পারে এবং বালু ঝড়ে চুল ও চোখে বালি ঢুকে অস্বস্তিকর অবস্থা হতে পারে, সে কারণে আরবের পোশাক সর্বাঙ্গ ঢাকা এবং ঢিলেঢালা। ঢিলেঢালা পোশাকের জন্য আবহাওয়া গরম হওয়া স্বত্ত্বেও কিছুটা স্বস্তিদায়ক। ভারতীয় উপমহাদেশে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ, তাই এই অঞ্চলের পোশাকটা ছিল সেলাই বিহীন এক কাপড়ের এবং দেহের সর্বাঙ্গ ঢাকার প্রয়োজনও ছিল না। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, প্রাচীন মানুষেরা তাদের আবহাওয়ার অনুযায়ী পোশাক তৈরি ও পরিধান করতেন, অঞ্চলভেদে আবহাওয়ার ভিন্নতার জন্য কোন একটি অঞ্চলের মানুষের পোশাক পৃথিবীর সর্বত্রই প্রযোজ্য হতে পারে না।
এবার জানা যাক, পোশাকের সাথে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক। যা কিছু কৃত্রিম তা কিন্তু স্বাস্থ্য সম্মত নয়, প্রকৃতিতে কোন প্রাণীই পোশাক পরিধান করেন না, প্রাণীদেহের গঠন এবং বিকাশ এমনভাবে হয়েছে পোশাক ব্যতীতই জীব সুস্থ্য থাকবে। তীব্র শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা করা ব্যতীত পোশাকের কোন স্বাস্থ্যগত উপকারিতা নেই, কিন্তু পোশাকের ক্ষতিকর দিক রয়েছে প্রচুর। পোশাক পরে চলাফেরা বা শারীরিক পরিশ্রম করলে দেহ ঘেমে যায় , এই ঘাম দেহে বসে অনেকেরই সর্দিকাশি হয়। ত্বক দীর্ঘ সময় আদ্র থাকলে সেখানে ছত্রাক সংক্রমণ বা দাদ হয়। দীর্ঘ সময় আঁটোসাঁটো পোশাক পরার কারণে পুরুষদের বন্ধ্যাত্ব হতে পারে। পুরুষের অন্ডকোষ দেহের বাইরে অবস্থিত এর কারণ হল শুক্রাণু উপাদানের জন্য অন্ডকোষের তাপমাত্রা দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা থেকে কিছুটা কম দরকার হয়। তাই আন্ডারওয়্যার এবং প্যান্ট পরার জন্যে অন্ডকোষের তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পায়, যা শুক্রাণু উৎপাদন কমিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন আঁটোসাঁটো ব্রেসিয়ার পরার কারণে মহিলাদের স্তনে লসিকা (lynph) প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, একারণেও নাকি স্তন ক্যানসার হতে পারে। শীত কালে পোশাক পরিধান করার কারণে দেহের সঞ্চিত চর্বি ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন কিছুটা কম হয়, ফলে দেহ কিছুটা মুটিয়ে যায় এবং ডায়াবেটিস ও বাত ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। পোশাক গায়ে থাকার কারণে ত্বকে সরাসরি সূর্যালোক পরে না, ফলে দেহে ভিটামিন-ডি এর স্বল্পতা হয়। ভিটামিন ডি স্বল্পতা হলে দেহে রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে যায়, তাছাড়া ভিটামিন ডি সল্পতার সাথে নানাবিধ মানসিক ও শারীরিক রোগের সম্পর্ক রয়েছে।
এক কথায় বলে চলে পোশাক স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ক্ষতিকর। শুধু তাই নয় পোশাক/কাপড় রঙ করতে যেয়ে অনেক ধরনের ক্ষতিকর ক্যামিক্যাল ব্যবহার হয়। যা জল ও মাটিকে দূষিত করছে। নদ-নদী-খাল-বিল সবই আজ দূষিত, মাটিও। ধারণা করা হয় পরিবেশের এই ধরনের ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকার জন্যই উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পোশাক আমদানি করে।
সাম্প্রতিক মন্তব্য