সমাজে বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তি
কিছুদিন আগে ঢাকায় একজন শিক্ষক ও শিল্পী তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। রাস্তায় তিনি হেনস্তা হয়েছেন। তিনি নারী, কপালে টিপ দেন, সেটাই কারণ বলে তাঁর ধারণা। কপালে টিপ কেন হেনস্তার কারণ হবে? যে কেউ এটা কপালে লাগাতে পারেন। ষাটের দশকে হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে নারীরা পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে কপালে টিপ দিতেন। এখন শুনি, কপালের টিপকে ‘হিন্দুয়ানি’ বলে বর্জনের কথা। হিন্দুয়ানি বলতে কী বোঝায়? যা হিন্দু পরিচয়ের মানুষেরা করে, তাই? হিন্দি সিরিয়াল বা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে হিন্দু নারীদের যে পোশাক ও সজ্জা প্রদর্শনী হয়, সেগুলোও কি তবে হিন্দুয়ানি? কিন্তু সেগুলো তো প্রত্যাখ্যান করার কথা শোনা যায় না। বরং সেগুলোর চাহিদা বা বাজারদর এ দেশে অনেক বেশি।
হিন্দু বা মুসলমান বলে কি আসলে সমরূপ কোনো গোষ্ঠী আছে? ধর্মীয় পরিচয় এক হলেই কি সবার পোশাক, খাদ্য, সংস্কৃতি, জীবনযাপন এক হয়? এক ভারতের মধ্যেই উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমে খাবার, পোশাক, উৎসবে মেলা তফাত। কোনটিকে হিন্দুয়ানি বলব? সারা দুনিয়ার মুসলমানদের ইসলাম ধর্মের অবশ্যপালনীয় ইবাদতে মিল আছে। কিন্তু খাদ্য, পোশাক, উৎসব? বহু তফাত। বাংলাদেশের বাঙালি ও অন্যান্য জাতি পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষের উৎসব করে। কেউ কেউ এ উৎসবকেও হিন্দুয়ানি বলেন। আসলে এদের কাছে মানুষের আনন্দ-উৎসবই অসহ্য! ইরানে নতুন বছর শুরুর ‘নওরোজ উৎসব’ ইসলামপূর্ব কালের। তাই বলে সেখানকার ধর্মীয় নেতাদের তা বর্জনের কোনো ডাক দিতে দেখা যায় না। বরং এ উৎসব সেখানে সবচেয়ে গুরুত্ব নিয়ে পালিত হয়।
আসলে একেকটি অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য, সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যায় না। বাঙালি মুসলমান যখন খেতে বসেন, তখন যা যা তার পছন্দ- মাছ শাক-সবজি, ভাত, খিচুড়ি, ভর্তা, ভাজি, দই, মিষ্টি, পিঠা কি বাঙালি হিন্দুদেরও পছন্দের খাবার নয়? তাহলে এগুলো কি মুসলমানি না হিন্দুয়ানি? এসব খাবার হিন্দুয়ানি বলে বাদ দিয়ে আরব বা অন্য কোনো দেশের খাবার দিলে বাঙালি মুসলমানের ক’দিন তা ভালো লাগবে? তাহলে হিন্দুয়ানি কী? কপালে টিপ? ক’জন হিন্দু কপালে টিপ দেয়? বাঙালি ছাড়া আর খুব কম অঞ্চলেই হিন্দু নারীর কপালে টিপ দেখা যায়। দক্ষিণ ভারতের নারীরা সব সময় চুলে ফুল লাগিয়ে রাখেন। চুলে ফুল দেওয়া কি তবে হিন্দুয়ানি? জল বলা? দাদা, মাসি, পিসি, দিদি বলা? শাড়ি? উত্তর ভারতে কামিজ-পায়জামা নারীর সাধারণ পোশাক। সেটা কি হিন্দুয়ানি? জল বলে কেবল ভারতের বাঙালিরা। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের হিন্দু সমাজে পানি, আপা, আম্মা, ভাবি, খালা, ভাইয়া বলা হয়। তাহলে এগুলো কি হিন্দুয়ানি?
শতভাগ ‘মুসলমানি’, ‘হিন্দুয়ানি’, ‘বৌদ্ধ’ ‘খ্রীষ্টান’ বা অন্য কোনো কিছু যদি থাকেও, উৎসব বা অনুষ্ঠান বা পোশাক, তার প্রতি বিদ্বেষ ঘৃণা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য কেন থাকবে? প্রকৃতির মতো মানুষের মধ্যে বৈচিত্রই সুন্দর। যাদের ভেতরে বিষ থাকে তারাই এই সৌন্দর্য দেখতে- উপলব্ধি করতে অক্ষম, আনন্দ উৎসব তাদের কাছে অসহ্য। এদের জন্য করুণা হয়। অন্যকে ছোট করলে ঘৃণা করলে নিজের ভেতরের বড়ত্বই মাটিচাপা পড়ে।
সমাজে বিদ্বেষী সংস্কৃতির চাষ হতে থাকলে তাতে বাতাস দিয়ে নানা গোষ্ঠী তা কাজে লাগাতেই পারে। সমাজের মধ্যে এসবের বিরুদ্ধে অবিরাম প্রতিরোধ না থাকলে সকলেরই বিষম ক্ষতি।
পড়লাম। লেখকের ভাবনার সাথে সহমত। তবে ‘সমাজে বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তি’-র কার্যকারণ এই লেখায় স্পষ্ট নয়। লেখায় পর্যবেক্ষণ এবং সারবস্তু শেষাংশে যা পেলাম; “ শতভাগ ‘মুসলমানি’, ‘হিন্দুয়ানি’, ‘বৌদ্ধ’ ‘খ্রীষ্টান’ বা অন্য কোনো কিছু যদি থাকেও, উৎসব বা অনুষ্ঠান বা পোশাক, তার প্রতি বিদ্বেষ ঘৃণা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য কেন থাকবে? প্রকৃতির মতো মানুষের মধ্যে বৈচিত্রই সুন্দর। যাদের ভেতরে বিষ থাকে তারাই এই সৌন্দর্য দেখতে- উপলব্ধি করতে অক্ষম, আনন্দ উৎসব তাদের কাছে অসহ্য। এদের জন্য করুণা হয়। অন্যকে ছোট করলে ঘৃণা করলে নিজের ভেতরের বড়ত্বই মাটিচাপা পড়ে।
সমাজে বিদ্বেষী সংস্কৃতির চাষ হতে থাকলে তাতে বাতাস দিয়ে নানা গোষ্ঠী তা কাজে লাগাতেই পারে।” … বটেই তো। কিন্তু জানা হলো না বিদ্বেষ বিভাজনের সংস্কৃতির জন্মকথা, কার্যকারণ … !
জলমাটিতে প্রকাশিত লেখাটি মূল লেখার অংশ বিশেষ। মূল লেখাটির লিঙ্ক এখানে দিয়ে দিলাম। https://www.anumuhammad.net/article/358-2019-08-24-17-42-32?fbclid=IwAR3ArlRosijqsRvjtwPKCj9JOVSjQVHLPZDIlddYO0G854jKpwxERS4Mw2I