কেবল সংবিধান নয়; চাই আমূল পরিবর্তন
একটা গল্প আছে, স্কুল পরিদর্শন করতে আসছেন পরিদর্শক। ক্লাসে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, পৃথিবী কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে? শিক্ষার্থীরা চুপ। প্রধান শিক্ষক ধমকে উঠলেন, পরিতোষ (রোল নম্বর ১) এটা তো পড়ানো হয়েছে, উত্তর দাও না কেন? পরিতোষ কাঁচুমাচু হয়ে বলল, স্যার বিজ্ঞান বইয়েরটা বলব নাকি ধর্ম বইয়েরটা? পরিদর্শক থতমতো খেয়ে বললেন, দুটাই বল?
পরিতোষ দুটারই উত্তর দিল। ষষ্ঠ শ্রেণির পরীক্ষা পাসের জন্য পরিতোষকে দুটাই ‘মুখস্থ’ করতে হয়েছিল। কিন্তু পরিতোষ মস্তিষ্কে ‘ধারণ’ করবে কোনটা? সেটিও খুব সহজেই ঠিক করে দেয় আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা। বিজ্ঞানের শিক্ষক রুটিনের পড়া শেষ করে যখন বই বন্ধ করে ধর্মীয় ওয়াজ করেন, আর তার ফাঁকে টিপ পরা কিশোরীকে অপমান করেন, চাঁদের ফাটল দেখিয়ে নীল আর্মস্ট্রংয়ের মুসলমানি করেন, মোহাম্মদ আলীসহ আরো বিশ্বে পরিচিত মানুষের মুসলমান হওয়ার মধ্যে দিয়ে ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেন তার শিক্ষার্থীরা কী শিখবেন? সেই ক্লাসে তো অন্য ধর্মের শিক্ষার্থীরাও ছিল। সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও প্রকৃত শিক্ষা দেওয়ার সক্ষমতা বা মানসিকতা থাকতে হবে। এই পরিতোষ আমরা সবাই নই কী?
“সংকটের সমাধান, ৭২ এর সংবিধান”- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেকের টাইমলাইনে এরকম দেখছিলাম সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার মধ্যে। অনেকেই বলছেন, রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের সংগ্রামের কথা। আমিও চাই না রাষ্ট্রধর্ম। রাষ্ট্রের কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম থাকে না। রাষ্ট্রের ধর্ম তার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কল্যাণ করাসহ আরো অনেক বিষয় নিষ্ঠার সাথে পালন করা। ইসলাম, সনাতন, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ কোনো রাষ্ট্রের ধর্ম হতে পারে না সেটি আমিও মনে করি। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম বাতিল হলেই কি অন্য ধর্মের মানুষ নিরাপদ? এত বছর ধরে ধর্মভিত্তিক যেসব হামলা হয়েছে, তা কি সংবিধান মেনে হয়েছে? মানে সংবিধানের কোথাও কি লেখা আছে, অন্য ধর্মের মানুষের ওপর হামলা করতে হবে?
সমস্যার মূল উপড়াতে না পারলে এমন হামলা চলতেই থাকবে। যদি ধরেও নিই দেশ থেকে অন্য ধর্মের মানুষ বিতাড়িত হলো, তখন নামাজের সময় হাত বুকের ওপর বাঁধবেন নাকি বুকের নিচে বাঁধবেন তা নিয়েও হামলা-রক্তারক্তি হবে- এতে কোনোই সন্দেহ নেই। শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ও মানবতার শিক্ষা ছাড়া মনের ভেতরের অমানুষত্ব পরিষ্কার করবেন কী দিয়ে? সুশিক্ষা না পেলে সংবিধানকে মানার শিক্ষা পাব কী করে? আমাকে অধিকাংশ স্থানে ধর্ম কী- এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আমি বলি হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান টাইপের কোনো ধর্ম আমার নেই।যখন কোনো ভাবেই আমার মুখ থেকে বের করতে পারে না, তখন আলোচনার শেষ প্রশ্ন গিয়ে ঠেকে জন্ম কোন পরিবারে। সেটিও তথাকথিত ধার্মিকদের কাছে মূল্যবান হয়ে ওঠে। করোনার টিকা দেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানেও একজন জিজ্ঞেস করলেন কোন ধর্মের মানুষ আমি। বিস্মিত হয়ে একটু শ্লেষ মিশিয়ে বললাম, টিকাও কী ধর্ম বিশেষে কাজ করবে নাকি? তিনি উত্তর দিলেন, নাহ্ কপালে অত বড় টিপ দিয়েছেন আর আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল ময়মনসিংহ বা পাহাড়ি এলাকায় বাড়ি (মানে গারো বা কোনো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি) । এবার বোঝেন মানুষের চেহারায়ও ধর্ম খোঁজে আরেকজনের মাথা। এইসব মাথা যদি পরিষ্কার করতে না পারেন, তাহলে সংবিধান কিছু করতে পারবে না।
এসব মাথা থেকে সাম্প্রদায়িকতা নামক বিষ্ঠা পরিষ্কার করতে আগে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। সাম্প্রদায়িক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কীভাবে অসাম্প্রদায়িক মানুষ গড়বেন? সাম্প্রদায়িকতার চাষ তো হচ্ছে শিক্ষার শুরু থেকে। আর চর্চা চলে মরা পর্যন্ত। তার ওপর রাষ্ট্রীয় মদদ তো রয়েছেই! মোল্লাতন্ত্রের সাথে শাসকগোষ্ঠির ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় প্রেম। এমনিতেই সাম্প্রদায়িকতার প্রজননের ধরন ছোঁয়াছে রোগের জীবানুর মতো। ছুঁয়ে দিলেই গর্ভধারণ করে আর গান্ধারির মতো পিণ্ড প্রসব করে যেখান থেকে একেবারে একশটির মতো জন্ম হয়।
শাসকরা যখন সুকৌশলে ধর্মের বিজ্ঞাপন দেন, তখন সেটি আর পরোক্ষ মদদ থাকে কি না জানি না। সংবাদ সম্মেলন করে শাসকেরা যখন বলেন, রাতদুপুরে জেগে কোন নামাজ পড়েন, সকালে উঠে কোন ধর্মীয় বস্ত্রটি খোঁজ করেন- তখন সেটিকে সুকৌশলে ধর্মের বিজ্ঞাপনই মনে হয় আমার কাছে। সত্যিই ধার্মিক হলে আপনার বিজ্ঞাপন দেওয়ার দরকার পড়ে না। কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ী হলে অবশ্যই বিজ্ঞাপনের দরকার পড়ে। আর গ্রাহক অশিক্ষিত ধর্মান্ধ হলেই ব্যবসা লাল!
তাই শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ, মুক্ত চিন্তা ও বাক স্বাধীনতার অবাধ চর্চা, শিক্ষিত গণমাধ্যম ও তার স্বাধীনতা না হলে সাম্প্রদায়িকতার প্রজননের এই স্রোত ঠেকানো সম্ভব নয়।
সাম্প্রতিক মন্তব্য