Select Page

ভঙ্গুরতার সূত্র এবং কাণ্ডজ্ঞান

ভঙ্গুরতার সূত্র এবং কাণ্ডজ্ঞান

TOPIC:  PRINCIPLE OF FRAGILITY & COMMONSENSE

প্রকৃতি আর প্রক্রিয়া সরলরৈখিক নিয়ম মেনে চলে না। ধরুন আপনি দশ মিটার উচ্চতা থেকে পড়ে গেলেন, এতে আপনার যে ক্ষতি হবে তা একমিটার উচ্চতা থেকে পড়লে যে ক্ষতি হতে পারতো তার চাইতে হতে পারে দশগুণেরও অনেক বেশি, কিম্বা এক সেন্টিমিটার উচ্চতা থেকে পড়ার ফলে হতে পারা ক্ষতি থেকে হাজার গুণেরও অনেক বেশি! আপনার ভঙ্গুর শরীর পতনের প্রতি এক মিটার উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য পূর্ববর্তী এক মিটার পতনজনিত ক্ষতি থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।একটা বড় পাথর টুকরো দিয়ে আঘাত করলে আপনি হয়তো ব্যাথা পাবেন অনেকটাই, কিন্তু সম্মিলিতভাবে সেই পাথরের টুকরোর সমান ওজন হয় এমন অনেকগুলো পাথরকুচি ধারাবাহিকভাবে ছুঁড়ে দিলে আপনি হয়তো ব্যাথাই পাবেন না! ভঙ্গুরতার এই অসরলরৈখিক চরিত্র সার্বজনীন।

কার্বন নিঃসরণ শতকরা বিশভাগ কমিয়ে এনেই হয়তো কার্বন-দূষণ কমিয়ে আনা যেতে পারে অর্ধেকে, আবার বিপরীতে কার্বন নিঃসরণ শতকরা দশ ভাগ বাড়াতেই দূষণ হতে পারে দ্বিগুণ! পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে অসরলরৈখিক নিয়ম মেনে সামান্য ক্ষতিকর উপাদান হয়ে দাঁড়াতে পারে মহা ক্ষতিকর!  বাজার অর্থনীতির একচেটিয়া করণ (monopolization)  চরিত্রের কারণে নিয়ন্ত্রিত কিছু উপাদানের পরিমাণ-বৃদ্ধি ঘটে দ্রুত ভাঙ্গন-বিন্দুতে পৌঁছানোর অবকাশ থাকে। আর বৈশ্বিকরণ প্রক্রিয়া এই ভাঙ্গনোম্মুখ উপাদানগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বত্র!

প্রাকৃতিক ভাঙ্গনের সাথে মানবসৃষ্ট ভাঙ্গনের পার্থক্য , ভাঙ্গনের নিয়মের গাণিতিক বিশ্লেষণ বিস্তারিত জানতে চাইলে পাঠক নিজ দায়িত্বে জেনে নিতে পারেন। এখানে কিছু সহজবোধ্য উপাদান -সময়, পরিবর্তনশিলতা, ত্রুটি (time, variability, error) ইত্যাদি নিয়ে কথা বলা যাক।

প্রকৃতিতে অনবরতঃ গণনাতীত ভাঙ্গন চলছে। কিন্তু প্রকৃতির অধিকাংশ ভাঙ্গন প্রক্রিয়াই চলে অনেক সময় নিয়ে, বিচ্ছিন্নভাবে, অনেক ক্ষুদ্রতর উপাদানের পরিবর্তনের (thin-tailed or mediocristan) মধ্য দিয়ে। তুলনায় সংখ্যাগত দিক দিয়ে মানুষ অনেক কম পরিবর্তন করছে অল্প সময়ে, অনেক বড় উপাদানের ওপর, কেন্দ্রিকরন  (fat-tailed or extremistan) প্রবণতা নিয়ে।  সহজ কথায় প্রকৃতির অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তন(sum of micro variations) এর বিপরীতে মানবসৃষ্ট পরিবর্তনের প্রবণতা হোল ‘macro shocks’! পরিসংখ্যান-গত যুক্তিতে; প্রকৃতি এই ম্যাক্রো-পদ্ধতি অবলম্বন করলে আজ মানুষের অস্তিত্ব থাকতো না। প্রকৃতির পরিবর্তনগুলো হলো লক্ষকোটি বছরের পরিক্রমায় কোটিকোটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তনের ফল। এমনকি মাঝে মাঝে ঘটে যাওয়া ব্যাপক বিলুপ্তি (occasional mass extinctions) -গুলোও প্রকৃতির কোটিকোটি পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এক একটি অতিক্ষুদ্র ব্যাত্যয়মাত্র! প্রকৃতির পরিবর্তন-পদ্ধতি হলো ‘bottom up, broad design’  আর মানুষের ‘top down, concentrated design’। মানুষের তো ভুল হবেই, প্রকৃতিও ভুল করে। তবে, প্রকৃতি কোটিকোটি ত্রুটি সত্ত্বেও নিজেকে ধবংস না করে টিকে আছে, মানুষের অল্পসঙ্খ্যক ত্রুটি পদ্ধতিগত কারণে, ভঙ্গুরতার সূত্রানুসারে ডেকে আনবে ধবংস। কখন? আমরা জানি না। এবং অবশ্যই জানা পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে চাই না।

প্রমাণ করার দায়িত্ব এবং করণীয়:

মানবসৃষ্ট পরিবর্তন-পদ্ধতির ত্রুটির পরিণতি কি হতে পারে তা প্রমাণের দায় কার? প্রকৃতি এর প্রমাণ যোগাবে না, যেহেতু প্রকৃতি ভিন্ন পদ্ধতিতে কাজ করে। ত্রুটির পরিণতির প্রমাণ বা absence of evidence-এর চাইতে এক্ষেত্রে ক্ষতিকর পরিণতি যে হবে না অর্থাৎ evidence of absence-ই জরুরী! কাজেই ‘প্রকৃতির ক্ষতি হবার প্রমাণ আছে কি’ এরকম প্রশ্নকারীকে এক্ষেত্রে বলতে হবে ‘প্রমাণের দায়িত্ব তারই, আপনার নয়। বিজ্ঞানের ব্যবহারের নয় বরং অপব্যবহারের বিরোধিতার প্রয়াসেই এই লেখা। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে, প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপের (নতুন উপাদান যোগ করা)  ভালো পরিণতি জানতে না পারলেও, ক্ষতিকর প্রভাবগুলো (যেমন প্রকৃতিতে আগে ছিলোনা এমন উপাদানগুলো) দূর করার সুফলতো অনুধাবন যোগ্য।

GMO (Genetically Modified Organism)-এর  ‘top down’ পদ্ধতি, এতকাল চলে আসা সাধারন এবং অন্যান্য প্রকৃতিবান্ধব পদ্ধতির চাইতে ভিন্ন। টমেটোতে মাছের জিন মিশিয়ে ফলনের পদ্ধতিকে প্রাকৃতিক বলা, প্রকৃতির কর্মপদ্ধতিকে অনুধাবন না করারই সামিল। শস্যের এই ধারার পরিবর্তন স্থানীয় থেকে বিশ্বপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি মানুষকেই প্রভাবিত করবে। মনসানতোর কতিপয় পরিচালকের ভুলের মাশুল দিতে আমি চাই না, চাই না দিক আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মও। বৃহত্তর পর্যায়ে আনবিক শক্তির ব্যবহার নিয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, তবে ক্ষুদ্র পরিসরে চলুক, ফসিল ফুয়েল নিয়ে কিম্বা দূষণের অন্যান্য সূত্র নিয়েও একই কথা। কিন্তু GMO একটি ভিন্ন জানোয়ার! দারিদ্র্য দূর করতে এর প্রয়োগ জুয়া খেলে দারিদ্র্য দূর করার প্রস্তাবের মতোই! রিস্ক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ নাসিম নিকলাস তালেব-এর ভঙ্গুরতা(fragility)  বিষয়ে অনেক লেখা অন্তরজাল ঘেঁটেই পেয়ে যাবেন। GMO ব্যবহার করে পুষ্টি বা খাদ্যাভাব দূর করার মিথ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক লেখাও খুঁজলেই পাঠক পেয়ে যাবেন, এই লেখাতে শুধু যৌক্তিক দিকটাই তুলে ধরা হলো।

মার্চ ১০, ২০১৪

১ Comment

  1. স্বপন মাঝি

    আজ থেকে ২৫ বছর আগে, ফাস্টফুডের দোকানে গিয়েছিলাম খেতে। খেতে পারি নি। ভাল লাগে নি। ব্যাপারটা যে অভ্যাসের ছিল না, বুঝতে পারলাম বাজার থেকে মুরগী কিনে এনে। তারপর গরুর মাংস। ভাল লাগে না। জানলাম, এগুলো খামারের। তখনো বাংলাদেশে খামারের গরু-ছাগল-মুরগী চালু হয় নি। প্রকৃতিতে বেড়ে উঠা গরু-ছাগল-মুরগী-মাছ ছিল আমাদের সহায়। ফলে আমেরিকায় এসে আমি নিরামিষ ভোজী হয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় দশ বছর পর, অর্গানিক মাংসের সন্ধান পাবার পেয়ে, আবার ফিরে গেলাম আগের খাদ্যাভ্যাসে।
    কোন গবেষণামূলক লেখা না পড়েও তো বলতে পারি, শত শত বছর ধরে, আমার শরীর যাতে অভ্যস্ত নয়, তা আমি কেন গ্রহণ করতে যাব? আমি কেন পরীক্ষা চালাতে দেব, আমার উপর। তারমানে এই নয়, গবেষণামূলক লেখা পড়ার দরকার নেই। আছে। খুব করেই আছে। কথাটা এ কারণে বলা, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েও তোঁ আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারি।
    চোখের সামনে নদী মরতে দেখে, মাটি মরতে দেখে , বাতাস মরতে দেখেও কি আমাকে গবেষণাগারে যেতে হবে? দরকার কাণ্ডজ্ঞান। তারমানেই এই নয় , গবেষণার দরকার নেই।

    Reply

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার

%d bloggers like this: