Select Page

‘বেশি’ না ‘বেশী’- কোনটা ঠিক!

‘বেশি’ না ‘বেশী’- কোনটা ঠিক!

কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তী

‘বেশ’ শব্দের অর্থ না জানলে এই বিতর্কে অংশগ্রহণ অসম্ভব। 

[ বেশ (বেশধারী, বেশ-করা) = বিশ্‌+অ(ঘঞ্‌)-ভাববাচ্যে।

বেশ=দিশাগ্রস্ত ‘বিশ’ যাহাতে; কিম্বা যাহার ভিতরে ‘বিশ’ (প্রবেশ) করা হয়।

বেশ = প্রবেশ, বেশ্য, গৃহ, বেশ্যাগ্রহ, বেশ্যাজনাশ্রয়, সুবর্ণচন্দনাদিকৃত শরীর শোভা, বেশ্যার ভূতি বা আয়; উত্তম, ভাল, উ্কৃৎষ্টতর, অধিক, বেশী, ন্যায্য, যুক্ত, ঠিক, সুস্থ, কুশলী, নিরাপদ।

বেশধারী = ছলপূর্ব্বক রূপান্তরকারী, ছদ্মবেশী, ছদ্মতপস্বী, ধর্ম্মধ্বজী, বেশকারক, নট। বেশ করা = অন্যের ভয় না করে নিজের খেয়াল খুশিমতো কাজ করা।

তবে ‘বেশ’ শব্দ এককভাবে যত না প্রচলিত, তার চেয়ে উপসর্গ-যোগে শব্দটির ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। যথা –

আবিষ্ট, উপবিষ্ট, বিবিষ্ট, প্রবিষ্ট, অধিবেশ, অধিবেশন, অভিনিবেশ, অভিনিবিষ্ট, আবেশ, আবেশন, আবেষ্টন, উপবেশ, উপবেশন, দুষ্প্রবিষ্ট, দুষ্প্রবেশ, উপনিবেশ, নিবেশ, নিবেশন, পরিবেশ, পরিবেশন, প্রতিবেশ, প্রতিবেশী, প্রবেশ, প্রবেশন, সুবেশ, বিনিবেশ, সন্নিবিষ্ট, সন্নিবেশ, সন্নিবেশিত, সমাবিষ্ট, সুপ্রবেশ…ইত্যাদি।

কেউ যদি একটি আচ্ছাদনের ভিতরে ঢুকে পড়ে, ‘বিশ্‌’ করে, প্রবিষ্ট হয়, বেশ করে, প্রবেশ করে – তা সেই আচ্ছাদনটি একটি প্রাসাদ, গৃহ, ঘর, কামরা, ঝুপড়ি অথবা তার পোশাক, কাপড়-চোপড় … কিংবা নিদেনপক্ষে তার চামড়া ঢেকে দেওয়া নানারকমের রং, উল্কি, চন্দনাদি হয় – তাহলে সেগুলিকে মানুষটির ‘বেশ’ বলে।

‘কর’ যেমন hand-কে বোঝায়, handling-কেও বোঝায়, ‘বেশ’ তেমনি ‘আচ্ছাদন’কে বোঝায়, সেই ‘আচ্ছাদনে ঢুকে পড়া’কেও বোঝায়। তাই এ ‘বেশ’ মানে গৃহ, পোশাক …ইত্যাদি যেমন হয়, তেমনি সেগুলির ভিতরে প্রবেশ করাও হয়। ‘বেশধারী’ শব্দটি তাই ‘আচ্ছাদনে ঢুকে পড়া’ বা ‘কোনো প্রকার আচ্ছাদনে প্রবেশ করা’ অর্থেই প্রযুক্ত হয়ে থাকে।

তবে ‘বেশ করা’র বেলায় ‘বেশ’ কিন্তু উপরোক্ত দু’রকম অর্থেই সীমাবদ্ধ থাকে না, ব্যঞ্জনার্থও ধারণ করে। যেকারণে ‘করেছি, বেশ করেছি’ বললে ‘আচ্ছাদনে ঢুকে গেছি’ বোঝাতে পারে, ‘আচ্ছাদন চাপিয়ে নিয়েছি’ও বোঝাতে পারে এবং সর্ব্বোপরি ‘ভাল করেছি’ বা ‘যথার্থ করেছি’ও বোঝাতে পারে।

এই ‘বেশ-করা’র ধারণা ফারসীর হাত ধরে এসেছে বলে মনে হলেও, ধারণাটি আগে থেকেই আমাদেরও ছিল; ফারসীর আগমনে সে জনপ্রিয় হয়ে গেছে। আর ‘বেশ’ শব্দটির বিশাল সৌরভ ধরে রেখেছে, উপসর্গ-যুক্ত ‘বেশ’ শব্দগুলি। আমরা তাদের কয়েকটির অর্থ নিম্নে মন্তব্যসহ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।

অধিবেশ, অধিবেশন ঃ-

যে ‘অধিকারের এলাকা’র ভিতরে অন্যের প্রবেশ ঘটে, তাকে ‘অধিবেশ’ বলে। সেই অধিবেশ অন (on) থাকে যাহাতে তাকে ‘অধিবেশন’ বলে।

অভিনিবিষ্ট, নিবিষ্ট, সন্নিবিষ্ট, অভিনিবেশ, উপনিবেশ, নিবেশ, নিবেশন, বিনিবেশ, সন্নিবেশ, সন্নিবেশিত ঃ- 

‘বিশ’ করা নি-কৃত বা সক্রিয়ভাবে অন-কৃত যাহাতে’, তাকে বলে ‘নিবিশ্’‌। সেই নিবিশ, কোথাও ঢুকে গেলে তাকে বলে ‘নিবেশ’; আর কোনো স্থান-কাল-পাত্রে ঢুকে গিয়ে টঙ্কারিত হলে, তাকে বলে নিবিষ্ট। নিবেশ অন থাকে যাহাতে, তাকে বলে ‘নিবেশন’। অভিভাবে কিংবা সম্যকভাবে নিবিষ্ট বা নিবেশ হলে, তাদের যথাক্রমে ‘অভিনিবিষ্ট’ ও ‘সন্নিবিষ্ট’ এবং ‘অভিনিবেশ’ ও ‘সন্নিবেশ’ বলে। বিকল্প নিবেশ ঘটলে তাকে ‘বিনিবেশ’ বলা হয়। কিন্তু ‘উপনিবেশ’-এর বেলায় শাসক আপন অবস্থান ছেড়ে আসেন না, তার চেলাচামুণ্ডারা এসে যেখানে ঢুকে পড়ে, সেই স্থান হয়ে যায় উপনিবেশ। অর্থা্‌ৎ, এখানে শাসকের শক্তির একটি অংশ নিবেশ করে ফেলেছে, কিন্তু শাসক এখনও নিবিষ্ট হননি।

উপবিষ্ট, উপবেশ, উপবেশন ঃ-

যে এখনও প্রবেশ করেনি, প্রবেশ করবে বলে প্রবিষ্ট হওয়ার আগের অবস্থানে বসে আছে, তাকে বলে ‘উপবিষ্ট’। এরূপ করার বিশেষ্য রূপকে বলে ‘উপবেশ’। সেই উপবেশ করতে থাকাকে বলে ‘উপবেশন’।

পরিবেশ, পরিবেশন : –

ইতোপূর্ব্বে পৃ-ক্রিয়ামূলে ‘পরি’ উপসর্গের চর্চ্চায় এই প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন ছিল, পরিবেশ বললে যদি environment বোঝায়, তাহলে খাদ্য-পরিবেশন, গ্রন্থ-পরিবেশন প্রভৃতি বললে খাদ্যাদি-পরিবেশন, গ্রন্থাদি-পরিবেশন বোঝায় কেন? এই সমস্যার মূলটিকে আমরা উপরে ‘বেশ’ শব্দের ব্যাখ্যায় ‘আচ্ছাদন’ ও ‘আচ্ছাদনে ঢুকে পড়ার’র সমস্যা বা বিশেষ্য ও ক্রিয়ার সমস্যা রূপে উল্লেখ করে এসেছি। পরিবেশ-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আর একটু বিচিত্র। প্রবেশ বা ‘বেশ’-কে কেন্দ্র করে যে বৃত্তাকার এলাকা, তার পরিধিসহ-বেশকে ‘পরিবেশ’ বলে। অর্থা্‌ৎ কিনা, যার কেন্দ্রে ‘বেশ’ রয়েছে, তাকে পরিবেশ বলে।

আর ‘পরিবেশ-করা’ বললে তার মানে দাঁড়ায় দু’রকম – (এক) পরিধিসহ প্রবেশ করা বা করানো, (দুই) পরিধি-পর্য্যন্ত প্রবেশ করা বা করানো। ফলে পরিবেশন করারও দু’রকম মানে দাঁড়িয়ে যায়। খাদ্য-সঙ্গীত-নৃত্যাদি পরিবেশন করার ক্ষেত্রে খাদ্যের সঙ্গীতের নৃত্যের আপন আপন-পরিধিসহ পরিবেশন বোঝায়। সবার আগে জল দেবেন না, অথচ খাওয়ার থালা বাড়িয়ে দেবেন – বাঙালী তাকে খাদ্য-পরিবেশন বলতে রাজী হবেন না। নৃত্যনাট্য পরিবেশন করবেন, তবলাবাদন থাকবে না – কোনো নটরাজ সেটা মানবেন না। কিন্তু গ্রন্থ-পরিবেশন-এর বেলায় ওসব নাই। পাঠক সাধারণের সমগ্র বৃত্তের পরিধি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়াই গ্রন্থ-পরিবেশন।

প্রতিবেশ, প্রতিবেশী ঃ

রাজা বললেন, ‘আমার নাম রাজা রঘু। ভিটাতে চরাই ঘুঘু’। ঘুঘু চরল। ভিটাহারা মুখুজ্জে যায় কোথায়! ছিল নিশ্চিন্দিপুরের ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠে প্রবেশ করে অশ্বথ্থগাছের ছায়ায় একটি কুঁড়েঘর বানিয়ে ফেলল সে। নতুন ঘরে প্রবেশ করে সে হয়ে গেল ‘বেশী’। তাই দেখে ঘটিহারা বদ্যিও সেই মাঠে প্রবেশ করে পাশের বটগাছের ছায়ায় গেড়ে ফেলল তার আস্তানা। দেখাদেখি আরও অনেকেই এসে আম জাম শাল বেল তাল তমালের ছায়ায় যে যার কুঁড়ে বানিয়ে ফেলল। এরা সবাই হয়ে গেল ভিটাহারা মুখুজ্জের ‘প্রতিবেশী’ এবং পরস্পরেরও ‘প্রতিবেশী’। (‘প্রতিবেশি’ বানান লেখা হয় না কারণ তাতে ‘প্রতিবেশ’-এর সক্রিয়ণ বোঝায়, প্রতিবেশ-এর সক্রিয় আধারকে বোঝায় না। প্রতিবেশ-এর সক্রিয় আধারকে বোঝাতে হলে ঈ-এর আগম হয়, অর্থা্ৎ ‘তিবেশী’ হতে হয়)।

বেশী=বেশ+ইন(ইনি)। 

বেশি=বেশ-এর সক্রিয়ণ (বেশ-এর বিকাশন বা গতিময় সক্রিয়ণ)।

[ যেমন ‘তর’ (তারণ-রহন)-এর  সক্রিয়ণ হল ‘তির’ (অর্থাৎ জলের তির তির করে চলন) এবং ‘তির’ থাকে যে আধারে তাই হল ‘তীর’ (তির-এর আধার)। তেমনি ‘বেশ’-এর সক্রিয়ণ (বিকাশন বা গতিময় সক্রিয়ণ) হল ‘বেশি’ এবং ‘বেশি’ থাকে যে আধারে তাই হল ‘বেশী’। ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি আমাদের বলে দেয় – ‘ই’-এর অর্থ হল সক্রিয়ণ এবং ‘ঈ’-এর (‘ই’-এর আধার) অর্থ হল যে আধারে সক্রিয়ণ থাকে। অর্থা্‌ৎ ‘ই’ হল আধেয় (পুরুষ), আর ‘ঈ’ হল আধার (প্রকৃতি)।]

বেশী=বেশ-এর গতিশীল বা সক্রিয় আধার যে। বেশবান, প্রসাধনযুক্ত। (ফারসী – অধিক, অনেক, উদ্বৃত্ত, অতিরিক্ত)।

কথা তো ছিল একটাই – ‘আচ্ছাদনে ঢুকে পড়েছি’ অর্থা্‌ৎ ‘বেশ করেছি’, ‘প্রবেশ করেছি’, ‘বেশ ধারণ করেছি’, ‘বেশধারী হয়েছি’, ‘বেশী হয়েছি’। কিন্তু সে তো বাপু তোমার অস্তিত্বের চেয়ে অধিক, উদবৃত্ত, অতিরিক্ত, বেশী! বেশধারী হয়েছ কি বেশী হয়ে গেছ! নিজের থেকেও বেশী হয়েছ।

অতএব বেশী মানে ‘বেশধারী’ বটে, ‘অধিক’ও বটে। তবে কিনা, এই ‘বেশ’ ও ‘বেশী’ কথাটি ফারসী থেকে এসেছে বলেই শব্দদুটিকে আমরা চিনি-জানি, আমাদের পুর্ব্বপুরুষগণ শব্দ দুটি জানতেনই না, সেকথা আমরা মানি না। অন্তত শব্দদুটির অন্তর্নিহিত অর্থ আমাদের ‘শব্দদুটি বিদেশাগত’ এমন কথা অমান্য করতেই প্ররোচনা যোগায়। হতে পারে, ফারসীরও ওরকম দুটি শব্দ ছিল, আছে। আমাদেরও ছিল এবং আছে। পার্থক্য এইটুকু যে মধ্যযুগের রাজকৃপায় শব্দদুটির জনপ্রিয়তা বেড়েছে।” – (কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তী রচিত “বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ” থেকে)।

এ ছাড়াও ‘বশ’/’বেশ’ থেকে বশত, বশবর্ত্তী বংশ, বাঁশ, বশ্য বেশ্য, বেশ্যা, বৈশ্য, বাঁশ, বংশী, বশংবদ, বশত, বশে, বশিষ্ঠ, বৈশিষ্ট্য, বিশিষ্ট, বিশ্বাস, বিশ্বকর্ম্মা, বিশ্বশ্রবা, বিশ্বানর, বিষ্টি, বিষুব, বেষ্টন, বিষ্ণু, বৃশ্চিক, বৃ্‌ষ, বৈশ্রবণ, বৈশ্বানর, ইত্যাদি অজস্র শব্দ তৈরী হয়েছে বাংলাভষায়। তবে তার অর্থ বারান্তরে।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার