Select Page

ভয়

ভয়

মেরুদণ্ড বেয়ে এক হিমশীতল ঢেউ খেলে গেল রিমার। আকাশ সত্যি চলে গেছে! রাত দু’টো। এত রাতে জোরে নাম ধরে ওকে ডাকতেও পারছে না। তবু কয়েকবার মৃদু স্বরে আকাশ আকাশ বলে পেছন থেকে ডাকতে থাকে রিমা, তাদের একমাত্র মেয়ের দোহাই দেয়। কিন্তু থামে না আকাশ। রিমা অসহায়ের মত চেয়ে দেখতে থাকে । তার স্বামী তাকে আর তাদের মেয়ে রায়না কে ফেলে চলে যাচ্ছে। তার ডাক অগ্রাহ্য করে ছোট গলিটা পার হয়ে বড় রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেল। রিমা বাড়ির গেট ধরে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে রইল। একবার ভেবেছিল পেছন থেকে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরবে বা ওর হাতে পায়ে ধরে ওকে ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু এত রাতে পাড়ার মধ্যে যদি কারো চোখে পড়ে বা কানে যায় তবে লজ্জার শেষ থাকবে না। তাছাড়া ঘরে মেয়েটা একা, তাকে ফেলে রাস্তায় যাওয়া যায় না। অমোঘ মৃত্যু যেমন ঠেকানো যায় না, মেনে নিতেই হয়, তেমনি এক অনুভুতি হল রিমার।

গেট বন্ধ করে ও ঘরে ফিরে যায়। মেয়েটা অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ও ভাবছে মা বোধ হয় বাবাকে ফিরিয়ে এনেছে। রিমা যখন বলল তোমার বাবা চলে গেছে, ছোট্ট রায়না বিশ্বাস করতে পারছিল না।

বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম বাবা এসেছে।

রিমা, কী বলে সাত বছরের মেয়েকে সান্ত্বনা দেবে বুঝে উঠতে পারে না। তার মাথার মধ্যে এখন অজস্র চিন্তা আর ভয়। এই মেয়েকে সে এখন কী বলে শান্ত করবে। মেয়ে কান্না শুরু করেছে। ঠোঁট ফুলিয়ে অঝোরে কাঁদছে। সব দোষ দিচ্ছে ঈশ্বরকে।

বার বার কেবল বলছে ‘আমার কি দোষ, আমি কেন বাবা হারালাম, আমার কেন বাবা থাকবে না?’

রিমা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কী বলবে ও। যে মানুষ এত ছোট একটা বাচ্চার মনের কষ্টের কথা ভাবল না, ওর জীবনের নিরাপত্তার কথা ভাবল না, যে মানুষ এত রাতে এভাবে ফেলে চলে যেতে পারে, সে-রকম বাবার জন্য কি কান্না করা উচিত? কিন্তু ছোট্ট মন কি আর এসব বুঝে? রিমার প্রথমে খুব রাগ আর জেদ হয়। ভাবে, যে আমাদের ফেলে এভাবে চলে যেতে পারে তাকে জোর করে ফেরানো ঠিক নয়। চলে গেছে যাক। কই আমি তো শত ঝগড়ায়, হাজার কষ্টেও মেয়েকে বা সংসার ফেলে চলে যাওয়ার কথা ভাবিনি। কিন্তু পরক্ষণেই সে বাস্তব জগতে ফিরে আসে। এই অভিমান, আবেগের কোন দাম নেই এই পৃথিবীতে। দু’কূলে রিমার কেউ নেই। এই ছোট মেয়েটাকে নিয়ে ও কি করে থাকবে এই শহরে? কোন বাড়ীওয়ালা কি ওকে ঘর ভাড়া দেবে? যদি দেয়ও, রিমা কি তার মেয়েকে নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারবে? একটি যুবতী নারী, সাথে ছোট একটি মেয়ে। নিস্তার দেবে পাড়ার ছেলেরা বা প্রভাশালীরা? তাছাড়া মেয়েকে কার কাছে রেখে ও চাকুরি করবে? এতদিন তো দু’জনে পালা করে কাজ করেছে। একজন যখন কাজে গেছে আরেকজন তখন মেয়েকে দেখেছে। তার উপর অসুখ বিসুখ তো আছেই। দুজনে মিলে এতদিন সব সামলেছে। কিন্তু এখন কি হবে?

রিমা ভাবে, তার যদি একটা বড় ছেলে সন্তান থাকতো তাহলে হয়ত সামাল দেয়া যেত। ভাইয়ের স্নেহ পেয়ে হয়ত বাবার কষ্ট ভুলে থাকতে পারতো রায়না। কিন্তু মা আর মেয়ে, দু’জনের এই দু’জন ছাড়া কেউ নেই। রিমার না আছে শ্বশুড় বাড়ি না বাবার বাড়ি, না আছে বন্ধুবান্ধব। জীবন থেকে সব হারিয়ে গেছে রিমার। শ্বশুড় শ্বাশুড়ী গত হয়েছেন অনেক আগে। আকাশের ভাই বোনেরা সবাই বিচ্ছিন্ন। যে যার মত সংসার নিয়ে ব্যস্ত।।তাছাড়া তারা সবসময়ই রিমা আর আকাশ থেকে সযত্নে দূরে থেকেছে। আকাশের টাকা পয়সা নেই। অভাবী মানুষের থেকে দূরে থাকাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। রিমার বাবার দিকেও একই অবস্থা। চালচুলোহীন ছেলেকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল বলে সবাই ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারাও যে যার মত আলাদা দ্বীপের বাসিন্দা। যদি রিমা তাদের কাছে সব খুলে বলে তারা হয়ত আবার রিমাকে বিয়ের কথা বলবে। কিন্তু বিয়ের ইচ্ছে আর বিন্দুমাত্র নেই রিমার। পুরুষের লালসা দেখতে দেখতে কোন পুরুষে ওর আর রুচি হয় না। আর বন্ধুবান্ধব সেতো হয়েই উঠলো না বা বলা ভাল হওয়ার সুযোগ হয়নি। অল্প বয়সে বিয়ে, সংসার করে পড়ালেখা করলে বন্ধু বান্ধব হয় না। ক্লাস এ গেলে তবেই না বন্ধু বান্ধবী হবে। সেতো সংসার সামলে সময় বের করে ঘরে বসে বসে পড়েছে।

এখন জীবনের এই পর্যায়ে এসে বিশাল সমুদ্রের মাঝখানে রিমা একা। দিশেহারা লাগে রিমার।

রায়না বলছে ‘মা আমাদের কি হবে?’ আমাদের তো কেউ নেই। আমার শুধুই মা আর বাবা ছিল। আজ বাবাও চলে গেল। আমরা কি করে ঘুমাব আজ?’

মেয়ের কথায় সম্বিৎ ফিরে আসে রিমার। না, যে করেই হোক আকাশকে ফেরাতে হবে। রায়নার এই কষ্ট রিমা আর সহ্য করতে পারছে না। সে দ্রুত ফোন হাতে নেয়। ফোন করতে হবে আকাশকে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে কিবোর্ড উল্টা পাল্টা হয়ে আছে। পাসওয়ার্ড সেট করেছিল একদিন আগেই আকাশের সাথে ঝগড়ার পর। উদ্ভ্রান্ত রিমা কিবোর্ড ঠিক করতে পারছে না। সময় যেন খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। রিমা তার মেয়েকে দেয় ফোনটা। ছোট থেকে ডিভাইস নিয়ে খেলতে খেলতে মেয়ে তার চেয়ে ভাল বুঝে এসব। রায়না চেষ্টা করছে ঠিক করতে। রিমা ভাবে যদি এখন ঠিক না হয় তবে আর ফোন করা হবে না। ততক্ষণে আকাশ অনেক দূরে চলে যাবে। আর হয়ত ফেরানো যাবে না ওকে। কিছুক্ষণের মধ্যে রায়না ঠিক করে ফেলে কিবোর্ড। রিমা দ্রুত ফোনটা হাতে তুলে নেয়। পাসওয়ার্ড দিতেও কতটা সময় নষ্ট হল। কেন যে পাসওয়ার্ড দিতে গেলাম, আফসোস হয় রিমার। দুরু দুরু বুকে রিমা ডায়াল করে আকাশের নাম্বারে। রিং হচ্ছে। বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে রিমার। আকাশ কি ধরবে ফোনটা? ধরেও যদি ফিরিয়ে দেয় ওকে? রিং বেজে চলেছে আর উৎকণ্ঠায় রিমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার