সন্দ্বীপের লোকগান
কবি জসিম উদ্দীন বাংলার গ্রামে-গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করেছিলেন অনেক লোকগান। তাঁর আত্মজীবনী “জীবনকথা”-য় পড়েছি, বাংলার প্রত্যন্ত সব গ্রামে বছরের পর বছর ঘুরে কীভাবে তিনি লোকগান সংগ্রহ করেছিলেন, সেসব সুন্দর-সুন্দর গল্প। রবীন্দ্রনাথ এবং জ্যোতিরীন্দ্রনাথও অনেক লোকগান সংগ্রহ করেছিলেন। আমাদের সন্দ্বীপীদের দুর্ভাগ্য যে, এঁরা কেউ সন্দ্বীপে আসেন নি সন্দ্বীপের লোকগান সংগ্রহের জন্য। রাজীব হুমায়ুন সন্দ্বীপের সন্তান। তিনি সন্দ্বীপের কিছু লোকগান সংগ্রহ করেছিলেন।
লোকগীতির দিক থেকে সন্দ্বীপ খুব সমৃদ্ধ, এমন বলা যাবে না। তবে এদিক থেকে আমাদের ভাণ্ডার খুব ছোটও নয়। সন্দ্বীপের লোকগানগুলির গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী সাধারণত সন্দ্বীপের নারীরা। যেসকল পরিবারের মানুষেরা নিজেদের উচ্চশিক্ষিত, ধনী ও অভিজাত মনে করে, তারা এই শিল্পে অংশগ্রহণ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। নিরক্ষর ও দরিদ্র নারীরাই সাধারণত সৃষ্টি করে এই শিল্প এবং নিজেদের কণ্ঠে বাঁচিয়ে রাখে এদের, কোকিলের মতো ছড়িয়ে দেয় চারিদিকে। যেকারো গায়ে হলুদ, বিয়ে, খৎনার অনুষ্ঠানে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয় নারীরা স্বতপ্রণোদিতভাবে উঠোনে গোল হয়ে ব’সে দুলে-দুলে গাইতে থাকে লোকগান। কেউ কেউ দু’হাতে নিজের পরনের শাড়িটির খুঁট ধ’রে ধ’রে নাচতেও শুরু করে দেয়। সঙ্গে চলতে থাকে জলযোগ।
কোনো মেয়ের বিয়ে ঠিক হবার পরে তার আত্মীয়া ও প্রতিবেশীনীরা বিয়ের কয়েকদিন আগে থেকে গাইতে শুরু করে:
আঁইড্ডাকেলার হোল,
বাংলাকেলার হোল,
আইজ্জা কেন্নে ছাড়ি গো যাইবা মা-বাপের কোল…
আক্ষরিক অর্থ: বিচিযুক্ত বাচ্চা-কলা (যে কলা এখনো মোচা থেকে বের হয় নি), বাংলা বাচ্চা-কলা, আজকে কীভাবে ছেড়ে যাবে মা-বাপের কোল?
ভাবার্থ: বিয়ের কনেটি তার প্রতিবেশীনী ও আত্মীয়াদের কাছে এখনো নিতান্তই শিশু – অনাগত বাচ্চা-কলার মতো; যে এখনো মা-বাবার কোলেই থাকে। আজ কীভাবে এই কোলের শিশুটি মা-বাবার কোল ছেড়ে শ্বশুরবাড়ির মতো কঠিন জায়গায় চ’লে যাবে? এ-গানটি গাওয়ার সময় কনের প্রতি গায়িকাদের ভালোবাসা আর গানের দরদী সুরে চারিদিক করুণ হয়ে ওঠে।
আমাখালি জামাখালি মইদ্যে বালুর চর।
ও বালি তোর নাচন ক্ষ্যামা কর।
তোর নাচন তো দেইখ্যা গো বালি, অমুক মিয়া ফাগল…
ভাবার্থ: আমাখালি নামক কোনো জায়গায় বিয়ের কনেটির বাস। আর সুদূরের জামাখালিতে বরের বাড়ি। মাঝখানে বিশাল বালুর চর। এ-বিশাল বালুচরের ওপার হ’তেও ছেলেটি বালির (কনের প্রতি আদরের ডাক) নাচ দেখে পাগল হয়ে গেছে। তার ফলশ্রুতিতেই ঘটতে যাচ্ছে এই বিবাহ!
ও ঘোড়া টকটক করে রে,
সলমান বাশশার ফাগলা ঘোড়া রে।
আর বেশি মনে করতে পারছি না এই গানটির। তবে এর পুরো ভাবার্থটি মনে আছে।
ঠকঠক ক’রে পাগলের মতন ছুটে চলছে একটি ঘোড়া; যে ঘোড়াটি সোলাইমান বাদশার ঘোড়ার মতো ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন। এই ঘোড়ার পিঠে চ’ড়েই বর ছুটে আসছে কনের কাছে!
বরেরাও কিন্তু ফেলনা নয়! বিয়ে ঠিক হবার পর বরের আত্মীয়া ও প্রতিবেশীরাও গায় গীত! বিয়ের দিন সকালে নাপিত আসে বরের বাড়িতে তার চুল-দাড়ি কামাতে। নাপিতকে উদ্দেশ্য ক’রে সবাই তখন গায়:
ও গুণের নাফিতা গো,
আঙ্গো বাড়িত যাইয়ো।
ডাইল দুমু, চাইল দুমু,
রসাই করি খাইয়ো।
ভালা করি কামাইলে, নাউত্তা, ভালা বকশিস হাইবা
বুড়া করি কামাইলে, নাউত্তা, থাপ্পড়-চোপ্পড় খাইবা।
ভাবার্থ: ওগো গুণবান নাপিত! আমাদের বাড়ি যেয়ো! ডাল দেবো, চাল দেবো, রান্না ক’রে খেয়ো। আমাদের ছেলেকে ভালো ক’রে কামালে ভাল বকশিস পাবে। আর মন্দ ক’রে কামালে কিন্তু চড়-থাপ্পড় খাবে!
মা এবং নিকটাত্মীয়ারা ছোট্ট শিশুদের কোলে নিয়ে দোলাতে-দোলাতে গায়:
আঙ্গো মণি কোনানে?
হদ্মানদীর বিশকানে।
হিঁয়ানে কীয়ারে?
টক্কি-টক্কি মাছ ধরে।
স্বণ্যের নৌকা বানামু, তোই মণিরে আনামু।
অর্থ: আমাদের সোনামণি কোনখানে? পদ্মানদীর মাঝখানে। সেখানে কী করে? টপকে-টপকে (সাবধানে) মাছ ধরে। স্বর্ণের নৌকা বানাবো। তারপর সোনামণিকে আনাবো।
পৃথিবীর সব শিশুই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর। মায়ের কাছে তবু তার সন্তানকে আরো সুন্দর লাগে। সন্দ্বীপের মা তার শিশুসন্তানের চাঁদমুখের পানে তাকিয়ে গায়:
এই গুদুরীর হেডেত্তে
এই মানিক অইবো যে,
কে কইসে, কে কইসে?
অর্থ: এই কুরূপার পেট থেকে এমন সুন্দর মানিক জন্মাবে, তা কি কেউ কখনো জানতো?
গভীর দুঃখ-শোকেও গান গায় সন্দ্বীপের গীতমনা নারীরা। নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে নারীদের একে অপরের গলা ধরে মৃতের স্মৃতিগাথা ইত্যাদি সুরে-সুরে পুঁথির মতো বলে তার উদ্দেশ্যে কাঁদাও সন্দ্বীপের একটি ঐতিহ্য। ছোটবেলায় এক মৃত-বাড়িতে গিয়েছিলাম। মৃত ব্যক্তির বোন তার ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে শোকবিহ্বল অবস্থায় ছুটে এসেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে। বাড়িতে ঢুকেই মাটির মেঝেতে ধপাস ক’রে প’ড়ে গড়াগড়ি খেতে-খেতে আর্তনাদ করছে। আর সুরে-সুরে গানের মতো ক’রে বলছে:
ভাজী, ভাজী, ভাজী গো!
ধুলগুন সরাই দ,
গইড়ড়াই গইড়ড়াই কান্দি লই।
মানে: ভাবী, ভাবী, ভাবী গো! ধুলাগুলি সরায়ে দাও, গড়ায়ে গড়ায়ে কেঁদে নিই।
ছোটবেলায় শোনা এসব লোকগীতি এখনো মাঝেমাঝে মনের মধ্যে বেজে ওঠে। বেশিরভাগই ভুলে গেছি। এখন বড় সাধ হয়, সন্দ্বীপে যাই আর মানুষের বাড়ি-বাড়ি হাঁটি; অজানা কোনো বাড়ির উঠোনে জোছনা রাতে হাজির হয়ে প্রাণের ভাষায় হাঁক দিয়ে বলি, কই গো ভাজীরা ব্যাক? কোডে গেলেন অন চান্নি ফোইররা রাইতে? উডানে বার অই আইয়েন স্যাই! গীত ধরেন! ঘর হতে বেরিয়ে আসবে শিল্পী! উঠোনে পিড়ি বা মাদুর পেতে দেবে। ডাকবে প্রতিবেশীনীদেরকেও। সবাই মিলে ধরবে গীত। দরদ আর সুরের বন্যা বইতে থাকবে সবার কণ্ঠ থেকে। চরাচর ভেসে যাবে সুর আর জোছনায়। আমি খাতায় লিখে নেবো সে-সমস্ত মণি-মানিক্য!
এ বিষয়ে একেবারেই অন্ধকারে ছিলাম। আসলে আমাদের লোকগানগুলো তো আমাদের সমাজেরই ছবি। আমরা সে-সব ছবি থেকে অনেক দূরে। বলা চলে – অতীতে পড়ে থাকা নয় যেমন, তেমনি অতীতহারা অনাথ হওয়াটাও ভাল কিছু নয়। তামান্না ঝুমুকে ধন্যবাদ এমন একটি বিষয়কে সামনে নিয়ে আসার জন্য।
গানের অর্থগুলো বলতে গিয়ে অর্থ, ভাবার্থ, মানে, আক্ষরিক অর্থ -ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে এক একটি গানের শেষে? এটা কি ইচ্ছাকৃত। যদি হয়, কেন? অর্থাৎ মানে এবং অর্থ – এ দু’টোর মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে?