বাঙালি মুসলমানের নাম: বাঙালি মুসলিমের নাম
ড. মোহাম্মদ আমীন
ব্যক্তিনাম কী— তা আমরা জানি; কিন্তু ইসলামিক ব্যক্তিনাম কী— তা নিয়ে সংশয় থাকতে পারে। অথচ এটি এ আলোচনার মুখ্য বিষয়। অতএব, আলোচনার প্রারম্ভে দেখে নিই ইসলামিক ব্যক্তিনাম’ নাম কী?
প্রথমেই বলে রাখি, কাউকে অনুসরণ না— করে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের আলোকে উপমহাদেশের প্রাসঙ্গিকতায় আমি এর সংজ্ঞার্থ পরিবেশন করব। আমার সংজ্ঞার্থের সঙ্গে সবাই ঐকমত্য পোষণ করবেন— এমনটি হয় না এবং আমিও তা চাই না। আপনার ভিন্নমত আমার মতকে ঋদ্ধ করবে— এটি আমি নিশ্চিত বলতে পারি। তবে অযথা কটূক্তি করবেন না, কিংবা অহেতুক ধর্মকে টেনে আনবেন না। কারণ, আমার মত গ্রহণে কেউ বাধ্য নন বা আমি কাউকে বাধ্যও করছি না।
এবার আমার সংজ্ঞার্থটি দেখে নেওয়া যায়: মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষত আরবি ভাষাসম্পৃক্ত কিংবা যে ভাষার হোক না, আরবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শব্দ দ্বারা রাখা ব্যক্তিনামগুলো উপমহাদেশে ইসলামিক নাম হিসেবে পরিচিত। এ ভাষাসমূহের মধ্যে আরবি, ফারসি, হিব্রু ও তুর্কি প্রধান। অনেকের কাছে এ ভাষাসমূহের শব্দ দিয়ে রাখা নাম আরবীয় নাম হিসেবেও প্রসিদ্ধ। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের ভাষাগুলো ইসলামের আবির্ভাবের বহু পূর্ব হতে চলে আসছে।
ষষ্ঠ শতকে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে অর্থাৎ প্রাক—ইসলামিক যুগে মাতৃভাষা অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের নাম রাখা হতো আরবি, হিব্রু ও ফারসি এবং সীমিত মাত্রায় তুর্কি ভাষায়। তখন ইসলাম ধর্ম ছিল না বলে আরবি নামের ব্যক্তিবর্গ মুসলিম ছিলেন না। আবুবকর, ওমর, ওসমান, আলী, হামজাহ, হায়দার, আবু তালিব, আবদুল্লাহ, আবু লাহাব, আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান, হাফসা, সায়েফা, আমেনা, খাদিজা, মরিয়ম প্রভৃতি আরবীয় নাম হলেও ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে তারা কেউ মুসলিম ছিলেন না, তারা ছিলেন প্রস্তরপূজক।
অথচ ইসলামের আবির্ভাবের পর তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন খ্যতিমান মুসলিম। কিন্তু তাঁদের কেউ অমুসলিম থাকাকালীন পূর্বের নাম পরিবর্তন করেননি, করার চিন্তাও করেননি। কারণ, ধর্ম পরিবর্তন হলেও তাদের মাতৃভাষাটাই ধর্মীয় ভাষার স্থান নিয়েছিল। অন্যদিকে পারসিক কবি ফেরদৌসির শাহনামার অন্যতম চরিত্র সোহরাব, রুস্তম ও তাহমিনা ছিলেন অগ্নি উপাসক। ইয়াকুব আর ইবরাহিম বা আব্রাহাম ছিলেন ইহুদি। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে এসব নাম মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ব্যক্তিনাম। সুতরাং এটি সর্বজনবাদীস্বীকৃত যে, মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদের ব্যক্তিনাম ধর্মগত নয়, বরং ভাষাগত। এর কারণ, ওই অঞ্চলের প্রধান ভাষায় (আরবি) কুরআন লিখিত হয়েছে। তাই তাঁদের ব্যক্তিনামের সঙ্গে ধর্মীয় নামের কোনো সংঘর্ষ ঘটেনি। ফলে ভাষাগত নাম ব্যক্তিনামে এবং ব্যক্তিনাম ধর্মগত নামে মহাগ্রহে একাকার হয়ে গেছে।
কাগজে একজন লোকের নাম জানা গেল Ameen। নামের পর জানা গেল তিনি উমহাদেশের লোক। এই দুটি তথ্য দ্বারা Ameen নামের লোকটির ধর্মীয় পরিচয় বহুলাংশে নিশ্চিত হওয়া যায়। যদিও তার জাতীয়তা বা ভাষা সম্পর্কে মোটেও নিশ্চিত হওয়া যায় না। যদি Ameen নামের লোকটির জন্ম-এলাকা অজ্ঞাত থাকত তাহলে শুধু ‘Ameen’ নাম দিয়ে তার ধর্ম, জাতীয়তা ও ভাষা কোনোটাই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হতো না। কারণ, পৃথিবীতে ‘Ameen’ নামের অনেক মুসলিম আছে, অনেক ইহুদি আছে, অনেক খ্রিষ্টানও আছে। যদি বলা হয়, Mohammed Ameen , তাহলে এ নামের দ্বারা লোকটির ধর্ম বহুলাংশে নিশ্চিত হওয়া যায়, যদিও তার জাতীয়তা বা ভাষা সম্পর্কে মোটেও নিশ্চিত হওয়া যায় না। কেননা, পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন দেশে এ নামের অসংখ্য মুসলিম রয়েছে।
প্রমিতা দাস লাবণী একটি ব্যক্তি নাম। এ নাম শুনে তার ধর্মীয় পরিচয় এবং একই সঙ্গে জাতীয়তা, ভাষা ও সংস্কৃতি বহুলাংশে নিশ্চিত হওয়া যায়। এজন্য তার জন্ম—এলাকা জানার প্রয়োজন পড়বে না। অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই বলে দিতে পারবেন— প্রমিতা দাস লাবণী বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মহিলা। এখানে তার বাংলা নাম ও পদবি তার পরিচিতির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। তেমনি, রমণী মোহন আচার্য্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রভাত কুমার স্যানাল প্রভৃতি।
আমার এক সহকর্মীর নাম শাহ উছমান ইবনে শামস। তিনি কী মুসলিম? অনেকে বলবেন, মুসলিম। তার জন্ম উপমহাদেশে হলে বলা যেত তিনি মুসলিম। কিন্তু তার বাড়ি উপমহাদেশে নয়। আসলে, তিনি একজন ইরানিয়ান ইহুদি, কিন্তু মাতৃভাষা আরবি বলে তার নাম আরবীয়। আবির (Abir) একটি প্রসিদ্ধ হিব্রু শব্দ, যার অর্থ শক্তিশালী। বাংলায় আবির একটি রঙ। ইব্রাহিম একটি প্রসিদ্ধ হিব্রু ও আরবীয় নাম— কুরআনেও নামটি রয়েছে। সারা, সারাহ (প্রিন্সেস), মরিয়ম, মায়মুনা প্রভৃতি ইহুদীয় হিব্রু শব্দ, কুরআনে ‘মরিয়ম’ নামের একটি সুরাও রয়েছে। কিন্তু মধ্যাপ্রাচ্য-সহ পৃথিবীর অনেক দেশে এসব নামের অনেক মুসলিম দেখা যায়। কারণ এসব শব্দরাজি মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা থেকে আগত।
আমার এক খালার নাম মরিয়ম এবং আরেক খালার নাম হোসানা—দুটিই হিব্রু শব্দ; দুজনের নাম হ্রিব্রু- ইহুদীয় ভাষা; কিন্তু তারা কেউ ইহুদি নন। তবে মধ্যপ্রাচ্যের নাম এবং একই সঙ্গে আরবীয়-প্রকৃতির বলে উপমহাদেশে এসব নাম ইসলামিক নাম হিসেবে পরিচিত। তবে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো নামই ইসলামিক নাম নয়, আরবীয় নাম। আর একটা নাম দেখা যাক; আমার স্ত্রীর নাম এ্যনি (Anee)। হিব্রু ভাষায় শব্দটির অর্থ Gracious। আমার সিনিয়র এক বিখ্যাত মৌলানা কন্যার নামও এ্যানি, তিনি এখন সৌদি আরবের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরবি পড়ান। নাম দুটো মধ্যপ্রাচ্যের ভাষার হলেও আরবীয়-প্রকৃতির নয় বলে অনেকে মনে করেন— এটি খ্রিষ্টানীয় নাম।
বাবুল, দুলাল, জয়, মিন্টু, টুটুল, মিল্টন, লিংকন, রানা, সজল, সজীব, চয়নিকা, অথেই, প্রতীতি, স্নিগ্ধা বৃষ্টি, শান্তা, রেখা প্রভৃতি এখন উপমহাদেশের বহুল প্রচলিত কয়েকটি নাম। পুরো না—শুনলে কেবল এসব নাম দিয়ে নামধারীর ধর্ম, ভাষা ও জাতীয়তা কোনো কিছু নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ উপমহাদেশে বর্ণিত নামসমূহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দেখা যায়। আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধুর নাম ছিল বাবুল, সে ছিল হিন্দু। বাবুল নামের আমার অনেক মুসলিম সহকর্মী ও ছাত্র আছে।
সুতরাং, উপমহাদেশে বাঙালি মুসলিমদের নাম ভাষাগত নয়, পুরোপুরি ধর্মগত। কেন তা ব্যাখ্যা করছি: সপ্তদশ শতকের প্রথম দিক থেকে উপমহাদেশের সঙ্গে মুসলিম তথা আরবীয়দের পরিচয় নিবিড় ও বিস্তৃত হতে থাকে। এরপর থেকে উপমহাদেশের সঙ্গে ইসলামিক নামের পরিচয় ঘটে। আরবদের সংস্রবে আসার ফলে উপমহাদেশের যেসব অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন, তাদের অস্পৃশ্য, ধর্মত্যাগী, পাপিষ্ঠ, একঘরে, কুলাঙ্গার প্রভৃতি নাম দিয়ে প্রাক্তন সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হতো। তাদের হত্যা করা হতো, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। ফলে নব্য—মুসলিমরা প্রাক্তন সমাজ হতে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচার জন্য আরবীয়দের উপর এতই নিভর্রশীল হয় পড়ত যে, নিজের পুরানো নামটাও বদলে নেওয়াকে নিরাপত্তার এবং একই সঙ্গে পুণ্যের বা গৌরবের মনে করত। তারা প্রাক্তন সমাজ ব্যবস্থাকে প্রচণ্ড ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করে চলে আসত নতুন জগতে।
এভাবে, উপমহাদেশে ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে তত প্রবল হতে থাকে তাঁদের ধর্মীয় বোধ। পূর্বতন সমাজ থেকে বিতাড়িত ও বিচ্ছিন্ন এসব নও—মুসলিরা মাতৃভাষার আবহে ইসলাম ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশনায় গড়ে তুলে একটি নতুন সমাজ। সংগত কারণে উপমহাদেশের মুসলিমদের ধর্ম, তাদের প্রাক্তন সমাজ,সংস্কৃতি ও ভাষার চেয়ে পবিত্র হয়ে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে আরবীয় নামগুলো উপমহাদেশে ভাষাগত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে সম্পূর্ণ ধর্মগত হয়ে পড়ে। এ কারণে উপমহাদেশে প্রথমদৃষ্টে নামই হয়ে পড়ে ধর্ম—পরিচিতির প্রথম চিহ্ন। এভাবে বাঙালি মুসলমানের এবং একই সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের নাম রাখার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে।
“আরবদের সংস্রবে আসার ফলে উপমহাদেশের যেসব অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন, তাদের অস্পৃশ্য, ধর্মত্যাগী, পাপিষ্ঠ, একঘরে, কুলাঙ্গার প্রভৃতি নাম দিয়ে প্রাক্তন সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হতো। তাদের হত্যা করা হতো, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। ফলে নব্য—মুসলিমরা প্রাক্তন সমাজ হতে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচার জন্য আরবীয়দের উপর এতই নিভর্রশীল হয় পড়ত যে, নিজের পুরানো নামটাও বদলে নেওয়াকে নিরাপত্তার এবং একই সঙ্গে পুণ্যের বা গৌরবের মনে করত। তারা প্রাক্তন সমাজ ব্যবস্থাকে প্রচণ্ড ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করে চলে আসত নতুন জগতে।”
ঘৃণা করত জানি। আর এই ঘৃণা একপাক্ষিক ছিল না। এটাও সত্য।
কিন্তু মুসলিম শাসনের অধীনে মুসলমানদের হত্যা করত হিন্দুরা, এটা কি আসলেই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। যদি হয়, তথ্যসূত্র দিলে পাঠক উপকৃত হবেন।
নিরপেক্ষ মুসলিম লেখকদের লেখায় অন্য ছবি পাওয়া যায়। ছলে বলে কৌশলে অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হত। মুসলিম শাসনের অধীনে মুসলমানদের হত্যা করত হিন্দুরা!! একেবারে উলটো ঘটনা লেখা হয়েছে।,