Select Page

মকর (মকরক্রান্তি, মকরন্দ, মকরবাহন, মকরবাহিনী, মকরসংক্রান্তি, মকরস্নান)

মকর (মকরক্রান্তি, মকরন্দ, মকরবাহন, মকরবাহিনী, মকরসংক্রান্তি, মকরস্নান)

কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তী

[মকর=ম+কৃ+অন-কর্ত্তৃবাচ্যে; মিত করে যে; অথবা, মিত কৃত যাহাতে। সামুদ্রিক জলচরবিশেষ, কামের মকরাকৃতি ধ্বজ, ব্যূহবিশেষ (ইহার মুখ ও পশ্চাদ্‌‌ভাগ স্থূল ও মধ্যভাগ সূক্ষ্ম; মকরাকার কুণ্ডলবিশেষ, কুবেরের নিধিবিশেষ, (জ্যোতিষে) দশম রাশি, মকরসংক্রান্তি, মকরে গঙ্গাস্নানের পরে পাতানো স্ত্রীলোকের সখীত্বসূচক সম্বন্ধবিশেষ, মকররাশিযুক্ত মাঘমাস।

মকরক্রান্তি=মকর অতিক্রান্ত যে স্থান বা কাল হইতে; বিষুবরেখার দক্ষিণস্থ অয়নবৃত্ত (Tropic of Capricorn) ।

মকরন্দ=মকর-এর রহস্যরূপের দাতা যে; ‘কাম দেয় যে’ (‘কামদাতা’); পুষ্পমধু, পুষ্পরস, কুন্দবৃক্ষ, কোকিল, মধু;  কিঞ্জল্ক।

মকরবাহন=যিনি (যে দেব) মকর-এ বাহিত হন; বরুণ।

মকরবাহিনী=যিনি (যে দেবী) মকর-এ বাহিত হন; গঙ্গা।

মকরস্নান=মকরসংক্রান্তিতে যে স্নান করা হয়; মকরসংক্রান্তিতে গঙ্গাদিতে স্নান।

মকরসংক্রান্তি=সূর্য্যের মকররাশিতে গমন।]

বর্ত্তমানে মকরসংক্রান্তি, মকরস্নান শব্দ দুটি ধর্ম্মপ্রাণ হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত। ‘মকর’ শব্দটি গ্রাম-বাংলায় সর্ব্বজাতির মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত, বিশেষত আদিবাসী সাঁওতাল ভূমিজদের মধ্যেও। মকরক্রান্তি শব্দটি ভূগোল পড়ানোর সময় ইংরেজী Tropic of Capricorn-এর প্রতিশব্দ রূপে পড়ান হয়। মকরধ্বজ ও মকরন্দ কথা দুটি আয়ুর্ব্বেদ চিকিৎসকগণ আজও ব্যবহার করে থাকেন। মকরক্রান্তি বাদে বাকী শব্দগুলি একালের অ্যাকাডেমীতে অপ্রচলিত।

না, মকর নামে কোনো জীব বা animal দৃশ্যলোকে নাই, কিন্তু অদৃশ্যলোকে ছিল, আছে, এবং বর্ত্তমানে তার বিপুল বিকাশ ঘটেছে; এমনভাবে যে, সমগ্র মানবসমাজকে সে প্রায় ঢেকে ফেলতে চলেছে। সেকালের শব্দবিদ মানুষেরা তাকে তার শৈশবেই ‘মকর’ নামে চিহ্নিত করেছিলেন এবং মানুষের সমাজে তার কীর্তিকলাপকে বোঝাতে বহু ‘মকর’যুক্ত শব্দ সৃষ্টি করেছিলেন। উপরে ‘মক্‌’-ক্রিয়ামূলের বংশে জনিত ‘মকর’যুক্ত শব্দগুলির দিকে তাকালেই সেকথা বোঝা যাবে। এখন সেই মকর-এর দৌরাত্ম্যে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাকে চিনতে ও চেনাতে পারিনা, তার বিষয়ে কথা বলতে পারিনা। কী করে বলব? যে শব্দ দিয়ে বলব, বোঝাবো, সেই শব্দই তো হারিয়ে ফেলেছি। অথচ আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা পারতেন।…

কিন্তু সমাজে যা কিছু অত্যন্ত সক্রিয় তাকে তো একালের মানুষও কমবেশী চিনতে বাধ্য, তাই আমরাও চিনি। তবে কিনা সেকালের মতো আমরা অখণ্ড স্বভাবের ক্রিয়াভিত্তিক শব্দ দিয়ে তাকে চিহ্নিত করতে পারিনা, আমরা করি খণ্ড শব্দ দিয়ে। সেকালে যে ‘ম-করণ’ ও ‘ম-করণকারী’-কে এককথায় মকর বলা হত, এখন আমরা তাকে ‘বিক্রয়যোগ্য-করণ’, বণ্টনযোগ্য-করণ’, ‘অর্থমূল্য-নির্দ্ধারণ’, ‘বিনিময়যোগ্য-করণ’ বা ‘বিপণনযোগ্য-করণ’… ও তদ্রূপকারী …ইত্যাদি নানা নামে শনাক্ত করে থাকি।

এগুলি সবই চাহিদা ও যোগানের মধ্যবর্ত্তী ক্রিয়া ও ক্রিয়াকারী-বাচক শব্দ। ইংরেজিতে এদের saleable, marketable ইত্যাদি বলা হয়। কিন্তু সেসব করতে গেলে বণ্টনযোগ্যকে অবশ্যই একটি বিশেষ সীমায় মিত করে নিতে হয় (‘ম’-বর্ণের অর্থ দ্রষ্টব্য), তার অর্থমূল্য ধার্য্য করতে হয়, বাঁধা-ছাঁদা গোছাগুছি করতে হয়, প্যাকেজিং করতে হয়; কেবল তাহলেই বিক্রয়যোগ্য বিষয় বা বস্তুটি, তা সে কৃত্রিম বিশ্ব হোক আর অকৃত্রিম বিশ্বই হোক, লেনদেনযোগ্য বা বিক্রয়যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। সেভাবে বিশ্বের প্রতিটি বিষয় ও বস্তুকে বা বিশ্বকে মিত করে নেওয়াকে, সীমায়িত করে লেনদেনযোগ্য করে নেওয়াকে আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা নাম দিয়েছিলেন – ‘মকর’। চাহিদা ও যোগানের মধ্যবর্ত্তী সমস্ত ক্রিয়াকে ‘মকর’ শব্দটি এককথায় প্রকাশ করে থাকে। শব্দসৃষ্টির নিয়মে যে সত্তা এরূপ ‘ম’-করণ করত তাকেও বলা হত ‘মকর’।

এই মকর-এর পিঠে চেপেই গঙ্গাধারা বা পণ্যধারা প্রবাহিত হয়ে থাকে বলে তাকে ‘মকরবাহনা’ বা ‘মকরবাহিণী’ বলা হয়। সত্যগোপনকারী সত্তা বরুণও এই ‘মকর’-এর পিঠেই সওয়ার থাকে বলে তিনি ‘মকরবাহন’ নামে চিহ্নিত হয়েছিলেন। চাহিদা বা কামদেব এই মকরচিহ্নিত পতাকা ঊর্দ্ধে তুলে ধরেন (‘ম’-করে ফেলুন, মিত করে ফেলুন, make করুন বা match করুন, marketable করে ফেলুন …ইত্যাদি করে আমাকে দিন), ব’লেই চাহিদা বা মানবমনের কামনাকে মকরকেতন, মকরকেতু, মকরকেতুমান, মকরধ্বজ, মকরলাঞ্ছন …ইত্যাদি বলা হত। এই মকর জনসমুদ্রে বাস করে বলে সমুদ্রকে মকরাকর, মকরাবাস, মকরালয়…ইত্যাদি বলা হত।

আমাদের সেকালের আয়ুর্ব্বেদাচার্য্যগণ একটি ঔষধ প্রস্তুত করেছিলেন এবং তার নাম দিয়েছিলেন মকরধ্বজ। কারণ সেই ঔষধটি মানবশরীরের চাহিদা বা কামদেবকে সদাজাগ্রত রাখতে পারে বলে মনে করা হত। … এখনও এসবই সত্য, বাস্তব, দারুণভাবে সক্রিয়; অথচ আমরা তাদের এভাবে উল্লেখ করতে ভুলে গেছি।…

আমাদের পূর্ব্বপুরুষদের হাতে মকর ও ক্রান্তি দুটো শব্দই ছিল, তার বোধও স্বভাবতই ছিল। একালের পাশ্চাত্যের astronomy-বিদ্যা যাকে Tropic of Capricorn-নামে শনাক্ত করেছে, আমরা এখন তাকে ‘মকরক্রান্তি’ বলে থাকি। মকরক্রান্তি শব্দটি প্রাচীন শব্দ নয়, যদিও মকর ও ক্রান্তি দুটোই প্রাচীন শব্দ। ৫০/৬০ বছর আগে আমাদের যে বাঙলাজ্ঞানী পূর্ব্বপুরুষেরা ছিলেন, তাঁরা এই নতুন শব্দটি বানিয়ে গেছেন। তাঁদের তৈরী করা পদার্থবিদ্যা …প্রভৃতি শব্দ যেমন Physics-এর তুলনায় অনেক ব্যাপকার্থক, এই মকরক্রান্তি শব্দটিও Tropic of Capricorn শব্দের তুলনায় ব্যাপকার্থক। কীভাবে, এখন সেকথায় যাওয়া যাক।

গ্রামবাঙলায় আজ থেকে ৫০/৬০ বছর আগেও হিন্দু-মুসলিম-আদিবাসী-ভূমিজ নির্ব্বিশেষে কৃষিজীবী মানুষেরা একটি প্রথা অবশ্যই মান্য করতেন। সে হল মকরসংক্রান্তি পালন। এটি পৌষ মাসের শেষ তারিখ ব’লে একে পৌষ-সংক্রান্তিও বলা হয়। শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন-কার্ত্তিক-অগ্রহায়ণ-পৌষ এই ছয় মাস জুড়ে (অর্থাৎ দক্ষিণায়ন জুড়ে) যে কৃষিকর্ম্ম করা হত, তার ফসলরূপে প্রাপ্ত নতুন ধান তুলে, ঝাড়াই-মাড়াই করে গুছিয়ে মরাইয়ে বা হামারে রাখার কাজ সেরে ফেলা হত ঐ মকরসংক্রান্তির আগেই।

মকরসংক্রান্তিতে হত উৎসব (পুলিপিঠা ইত্যাদির)। আর নতুন ধানের বিক্রিবাটা শুরু করা হত মকরসংক্রান্তির পর থেকে, এবং তার আগে কিছুতেই নয়। এই বিক্রিবাটা চলতে পারত পরবর্ত্তী মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্র-বৈশাখ-জৈষ্ঠ-আষাঢ় এই ছয়মাস ব্যাপী (অর্থাৎ সূর্য্যের সমগ্র উত্তরায়ণকাল জুড়ে)।

প্রাচীন ভারতে সমাজের জ্ঞানসম্পদ-ধনসম্পদের কেন্দ্রকে বলা হত সূর্য্য, তৎসাদৃশ্যে আকাশের আলো ও তেজের কেন্দ্রকেও সূর্য্য বলা হত। মকরসংক্রান্তির পর থেকে শুরু হত সূর্য্যের ‘উত্তরায়ণ’, রাজকোষ বা সূর্য্য কর্ত্তৃক প্রজাসাধারণের (=জল-এর) উৎপাদিত ফসলকে (=বাষ্পকে) উত্তীর্ণ করা হত মেঘে (দ্রষ্টব্য বর্ষ); এই প্রক্রিয়া চলত একেবারে আষাঢ় মাস পর্য্যন্ত। মনে করা হত, দৃশ্য সূর্য্যতো ঐ ছয় মাস জলকে বাষ্পরূপে গ্রহণ করে থাকে। শ্রাবণ মাস থেকে শুরু হত উল্টো পথে হাঁটা।

রাজকোষ উন্মুক্ত হত জনসাধারণের জন্য, অর্থ বীজ ধান … প্রভৃতি প্রয়োজনও নিয়মানুসারে যোগানো হত এবং এই প্রক্রিয়া চলত পরবর্ত্তী পৌষ মাস পর্য্যন্ত। মনে করা হত, দৃশ্য সূর্য্যটিও উত্তরায়ণ কালের ছয়মাস ধরে সংগৃহীত জলীয় বাষ্পসমূহকে শ্রাবণ মাস থেকে পরবর্ত্তী ছয়মাস ধরে বা দক্ষিণায়নকাল ব্যাপী মেঘেদের মাধ্যমে বৃষ্টিরূপে বিতরণ করে থাকে। সামাজিক সূর্য্য ও আকাশের সূর্য্যের এই ছ’মাস দানের কাল বা দক্ষিণায়ন এবং ছ’মাস গ্রহণের কাল বা উত্তরায়ণ – এই দুই কালের মধ্যেকার বিভাজক কালখণ্ডটি হল মকরসংক্রান্তি। ঐ দিন সূর্য্য যে রেখাটি পেরিয়ে যান, সেটির নাম তাই মকরক্রান্তি।…

প্রসঙ্গক্রমে আর একটি কথা এখানে বলে রাখা যেতে পারে। তা হল, আমাদের পুরাণাদিতে রাজার কর্ত্তব্যরূপে বারংবার সূর্য্যের এই ভূমিকার কথা নানাভাবে বলা হয়েছে। ভারতীয়দের মস্তিষ্কে এই বোধ এত গভীরভাবে প্রোথিত ছিল যে, সম্রাট অশোক, হর্ষবর্দ্ধন, সমুদ্রগুপ্ত, বিক্রমাদিত্য … পর্য্যন্ত প্রত্যেক রাজার স্বভাবে এই ‘সূর্য্য’সম রাজ্য পরিচালনার চেষ্টা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। এমনকি বীরবলের দ্বারা একই বোধে বুদ্ধ হয়ে সম্রাট আকবরও একরকম সূর্য্য-উপাসনা শুরু করে দিয়েছিলেন।

আকবর প্রচলিত সাল গণনার রীতিটিও ঐ নিসর্গ-প্রকৃতির সঙ্গে ও ভারতের প্রচলিত সামাজিক সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে প্রস্তুত করা হয়েছিল। (দ্রষ্টব্য – শ্রী ননীগোপাল চৌধুরী রচিত ‘শাহন্‌শাহ্‌ আকবর’)। এমনকি গত শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্য্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয়ের শিক্ষাবর্ষ ছিল জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতির বিভিন্ন পরীক্ষা সমেত গোটা শিক্ষা-বর্ষটি এমনভাবে প্রকল্পিত ছিল যে, চাষীর ছেলেমেয়েরা যাতে মকরসংক্রান্তির পরে তাদের প্রদেয় পরীক্ষার ‘ফি’ ইত্যাদি জমা দিতে পারে।

পাশ্চাত্য-প্রভাবিত পশ্চিমবঙ্গের বাম-সরকার ১৯৮০-র দশকের মধ্যে সেই নীতি বদলে দেয়। বাংলার প্রাকৃতিক, সামাজিক, পারিবারিক, উৎপাদন-কেন্দ্রিক, বার্ষিক (দ্রষ্টব্য-বর্ষ) আবর্ত্তনের সমগ্র ব্যবস্থার বিপরীতে চলে যায় ঐ নীতি। তার কুফল কয়েক বছরের মধ্যেই টের পেতে শুরু করে তারা। এখন আবার সেই আগের শিক্ষাবর্ষের নীতিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। একেই বলে তুঘলকী-শাসন।

কার্য্যত বাঙলার প্রাকৃতিক, সামাজিক, পারিবারিক, উৎপাদন-কেন্দ্রিক, বার্ষিক আবর্ত্তন যে এক নিয়মে পরস্পরের সমান্তরাল হয়ে চলে এবং তাদের প্রত্যেকের বিরাম-বিন্দুটি যে একই মকরসংক্রান্তি, আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা সেকথা বুঝতে পেরেছিলেন, তার উত্তরাধিকার একালের সাধারণ বাঙলাভাষী আজও বুঝে-নাবুঝে বহন করে চলেন।

পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্য্-প্রভাবিত একাডেমী বোঝে না। পাশ্চাত্য ভাষায় ‘মকর’ ইরেজী make(r), match(er) বা match-maker, জার্ম্মাণ machen, গ্রীক makro (=macro) …ইত্যাদি।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার