Select Page

টিপ পরা নিয়ে এত প্রতিবাদ যে কারণে

টিপ পরা নিয়ে এত প্রতিবাদ যে কারণে

যারা বলছেন প্রতিদিন ধর্ষণ হয় তার এত প্রতিবাদ তো হয় না যতটা টিপের বেলায় হচ্ছে। হ্যাঁ, এই দেশে নারী স্বামীর হাতে, শ্বশুর বাড়ির লোকের হাতে খুন হয় এবং একটা সময় সেটা প্রায় প্রতিদিন হত; ধর্ষিত হয় কেবল নারী নয়, শিশুও, যাদের এখনও শরীর এর কোন উত্তেজক ভাঁজ বা আকার বোঝা যায় না। ঘরের বউ এর স্বামীর হাতে পিটানি খাওয়া তো এদেশে স্বাভাবিক ঘটনা। ঝাড়ু, লাঠি, বেত, রুটি বানানোর বেলুনি যা পাওয়া যায় হাতের কাছে তাই দিয়ে পেটানো; চড়, ঘুষি, লাত্থি। এগুলো শুধু দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে ঘটে তা সত্য নয়। দরিদ্র শ্রেণীর ক্ষেত্রে তা দশ জনে দেখে, আর মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের বেলায় চার দেয়ালের ভেতর থেকে শব্দ বাইরে বের হয় না, ‘মান সম্মান’ বলে কথা। আবার মান সম্মানের খাতিরে বা অনেক সময় টাকার চড়া মূল্যে স্বামীর সকল বিশ্বাঘাতকতা মেনে নেয়; তাই গায়ে হাত তোলার প্রয়োজন হয় না অনেক ক্ষেত্রে।  

এই সব নৃশংসতা, জুলুম আমরা মেনে নিয়েছি বলেই আজ একজন পুরুষ পুলিশের পোশাক গায়ে দিয়ে একজন নারীকে রাস্তায় তার কপালে সামান্য টিপ পরা নিয়ে এত হেনস্তা করতে পারল। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চাকুরি করা একজন সেই পোশাক গায়ে অর্থাৎ দায়িত্বে থাকা অবস্থায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে এভাবে নসিহত, অপমান করতে পারেন না। কিন্তু এটা বাস্তবে ঘটেছে। নারীর অভিভাবক সবাই, একজন কেবল নারী বলেই তাকে যে কেউ তার পোশাক, তার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে যা তা বলতে পারবে! এই ঘটনার প্রতিবাদ না হলে এই খবরদারী করার আস্কারা কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে? রাস্তার কেউ বললে তো আপনি প্রতিবাদ করতে পারবেন কিন্তু পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা যাদের হাতে তারা যদি এখন নারীর উপর এই খবরদারি শুরু করে তবে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? 

রাস্তায়, বাসে সব জায়গায় দেখি সকল পুরুষ যেন নারীদের অভিভাবক। বাসে কোন সমস্যা হলে, হয়রানি হলে কোন নারী যাত্রী তা নিয়ে কথা বলতে গেলে বাসের হেল্পার বা অন্য পুরুষ যাত্রীরা বলবে ‘আপনি মহিলা মানুষ, চুপ থাকেন।’ বা রাস্তায় রিকশায় চলার সময় কোন ঝামেলা হলে কিছু বলতে গেলে অনেক সময় রিকশাওয়ালা বা পাশের রিকশার পুরুষ যাত্রী বা রাস্তায় থাকা লোকটি বলে ‘আপা, আপনে মহিলা মানুষ, এত কথা বলেন কেন?’

‘মহিলাদের এত কথা বলতে নেই’, বা ‘আমি মহিলাদের সাথে কম কথা বলি’ এই কথাগুলো যে জীবনে কতবার শুনেছি, এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যে কতবার গিয়েছি। অর্থাৎ আপনি একজন নারী হলে যদি আপনি উচ্চ শিক্ষিতও হন, প্রাপ্ত বয়স্ক হন তবু একজন রিকশাওয়ালা, বাসের হেল্পার বা রাস্তার যেকোন পুরুষ আপনার চেয়ে উপরে, তারা আপনার উপর অভিভাবকত্ব ফলাবে, আপনাকে মহিলা বলে এক ধমক দিয়ে চুপ করতে বলবে। এই ঘটনা, এই মানসিকতা আমরা দিনের পর দিন মেনে নিতে নিতে আজ আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে।

আমাদের পুরান ঢাকার যে এলাকায় আমরা থাকতাম সেখানে এক লোক, পাগলের মত ভাবসাব, তার কাজ হল রাস্তায় কোন মহিলার মাথায় কাপড় না থাকলে তাকে ধমকে মাথায় কাপড় দিতে বলা। ‘মাথায় কাপড়, মাথায় কাপড় দে’ আমাকে কয়েকদিন বলেছে, আমি, আমার হাসবেন্ড ওকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। লেবু বেশী কচলালে তিতা হয়ে যায়। এত বছর ধরে নারীদের গায়ে হাত তুলে, এসিডে ঝলসে, কুপিয়ে, মেরে, ধর্ষণ করে, ঘরে বন্দি রেখে, জেলখানার কয়েদীদের মত অজস্র বেড়ি পরিয়ে রেখে আপনাদের তৃপ্তি হচ্ছে না, ভয় কাটছে না নারীদের নিয়ে। আপনারা নিজেদের সংশোধনের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ভাবিত নন। আপনাদের যত ভাবনা নারীদের নিয়ে, তারা কি পরছে , কি করছে, কোথায় যাচ্ছে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সমাজ সুন্দর হয়ে যাবে। অথচ যত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তার সিংহভাগ আপনারাই করছেন। অনেকেই বলেন নারীরাও তো কত খারাপ, নারীরা কি দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতা! অনেকেই আবার বলেন যে স্বামী তো বউয়ের কথায় উঠবস করে, নারীদের হাতেই তো আসল ক্ষমতা। যেসব পুরুষেরা স্ত্রীর কথা শোনেন তাদের কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। একদল আছে যারা নিজেরাই নিজের পরিবারের মানে বাবা, মা, ভাই, বোনদের প্রতি সম্মান পোষণ করেন না, বা একটা সময় হয়তো তাদের কাছ থেকে বঞ্চনা পেয়েছেন বা কোন কারনে সেটা হতে পারে টক্সিক পারিবারিক পরিবেশে বড় হওয়ার কারণে। আরেকদল আছেন যারা নিজেরাই অত্যন্ত স্বার্থপর, নিজের আখের গোছাতে চান। আরেক দল আছেন যারা বহুগামিতায় অভ্যস্ত, বিয়ে করলেও সেই অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারেন না বা চান না, এরা বউকে অনেক বিষয়ে ছাড় দিতে পারেন যেহেতু বউ এটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। অনেক প্রবাসী শ্রমিক আছেন যারা প্রবাসে বছরের পর বছর পরে থাকতে বাধ্য হন, এবং সঙ্গত কারনেই সেখানে হয় তাদের ব্রথেলে যেতে হয় বা এরকম কিছু উপায় অবলম্বন করতে হয়। ইনাদের ভেতর একটা  সূক্ষ্ম অপরাধবোধ কাজ করে, এরাও অনেকে এই কারনে স্ত্রীদের ছাড় দেন। তবে ইনাদের স্ত্রীদের ঠিকই বোরকা পরতে হয়। পুরুষরা স্ত্রীর কথা শোনে বলে যারা নারীদের ক্ষমতার কথা বলেন তারা এগুলো নিয়ে ভাবেন না, বা এ ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করেন না বা করার প্রয়োজনও অনুভব করেন না। নিজের স্বার্থেই এরা স্ত্রীদের এইটুকু ছাড় দেন, এবং সেটা কেবলই ঘর কন্না বা সাংসারিক বিষয়ে। 

ভাই, নারীও মানুষ, আপনার মতই রক্ত মাংসের, আবেগ সম্পন্ন মানুষ। আপনি যেমন ভুল করেন, সেও করবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই প্রমাণ করে যে সে আপনাদের কল্পনার কোন কাঠ পুতলি নয়। তবু সেই ভুলের মাত্রা আপনাদের কর্মকাণ্ডের ধারে কাছেও নেই। নিচের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন, তাহলে নিজেই টের পাবেন আপানদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে নারীদের কর্মকাণ্ডের কি বিশাল ব্যবধান।
বলুন —

প্রতিদিন বা প্রতি মাসে কয়জন নারী তাদের স্বামীকে খুন করছে? কয়জন পুরুষ বা শিশু প্রতিদিন নারীদের দ্বারা বীভৎসভাবে ধর্ষণের ও তারপর খুনের শিকার হচ্ছে? কতজন পুরুষ নারীর ছোড়া এসিডে ঝলসে গেছে? কতজন পুরুষ স্ত্রীর হাতে প্রায়ই বেদম পিটুনি খান? কতজন পুরুষের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে কেবল সে পুরুষ লিঙ্গের অধিকারী বলে? কতজন পুরুষ রাস্তায় নারীদের দ্বারা টিজিং এর শিকার হন? টিজিং এর শিকার হয়ে কতজন বালক স্কুলে বা কলেজে যাওয়া বন্ধ করেছে? কতজন পুরুষ রাস্তায় বের হতে সংকোচ বোধ করেন কেবল মহিলাদের কুদৃষ্টি বা বাজে ভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকার কারনে? কত জন পুরুষ বাসে যাতায়াত করার সময় বাসের নারী যাত্রীদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হন? কতজন পুরুষকে চাকুরি ছাড়তে হয়েছে যৌন হয়রানির কারনে?

চিড়িয়াখানায় পশুরা মানুষকে আক্রমণ করতে পারে তাই পশুদের খাঁচায় আটকে রাখা হয়, অথচ আমাদের সমাজে যারা আক্রমণ করে চলেছে নারীদের প্রতিদিন ধর্ষণের মাধ্যমে, খুনের মাধ্যমে, গায়ে হাত তোলার মাধ্যমে আরও অনেক রকম উপায়ে তাদের নিয়ম, শৃঙ্খলা, আইনের আওয়তায় না এনে নারীদেরকে কত উপায়ে বেঁধে ফেলা যায়, আটকে রাখা যায়, নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা নিয়ে যত লেকচার, উপদেশ; কত কুৎসিত মন্তব্য, কথা। আপনাদের কারণে নারীদের জীবন কতভাবে সংকুচিত, অবদমিত, অত্যাচারিত। অথচ আপানদের ভাবখানা এমন যে যত অপরাধ, ঘৃণ্য কাজ নারীরা করে তাই এদের কঠিন শৃঙ্খলে বেঁধে রাখতে হবে, এদের উপর সর্বক্ষণ নজরদারি রাখতে হবে। এদের জীবন আপনাদের হাতে, আপনাদের খুশি মত চালাতে পারলে জগতের সব সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে। আপনাদের মানুষ না হলেও চলবে কিন্তু নারীদের ফেরেশতা হওয়া লাগবে। আগের কথায় ফিরে যাই।

অনেক, অতিরিক্ত হয়ে গেছে আপনাদের নারীর উপর জুলম, মাতব্বরি। যে পর্যায়ে এখন নারী বিদ্বেষ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যে ভাবে নারীদের আবার অন্ধকার কারাগারে ঠেলে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে (এটার পেছনে একটা জাতিকে পঙ্গু করার নীল নকশা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়) তা এখনই অত্যন্ত সচেতন ভাবে আমাদের প্রতিবাদের মাধ্যমে রুখে দিতে হবে। না হলে আরেক আফগানিস্তান হবে যেখানে মেয়ে বাচ্চাগুলো স্কুলে যেতে না পেরে কান্না করছে। একটা জাতিকে, দেশকে ধ্বংস করার অন্যতম বড় কৌশল হল সেই জাতির, দেশের নারীদের অর্থাৎ অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পঙ্গু, অশিক্ষিত, দুর্বল করে রাখা। তাই দেশপ্রেমিক  ও সুন্দর সমাজ এর প্রত্যাশা যারা সত্যি করেন তারা এটা দ্রুত অনুধাবন করেন। বিশ্বের যে পরিস্থিতি এখন এবং সামনে অপেক্ষা করছে তাতে আর পশ্চিমে বা উন্নত দেশে চলে যাবেন বা সন্তানদের পাঠিয়ে দিবেন ভাবলে ভুল করছেন। জ্বালানি সম্পদ এর সঙ্কট, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাইরে গিয়েও আর ভাল থাকতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাই নিজের দেশটাকে বাসযোগ্য করার জন্য এখনই সচেতন হন। আপনার ভুলের মাশুল আপনার সন্তান দেবে। আপনার কন্যা সন্তানদের জন্য এমন একটি দেশ  বানাবেন না যেখানে সে আপনার মৃত্যুর পর তার ভাই, স্বামী, ছেলে, সহকর্মী, পাড়ার লোকজনদের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হবে। পর্দা করলেই যে নারী রক্ষা পায় না তার প্রমাণ বাং;লাদেশে প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে। তাই আপনার কন্যা যত পর্দাই করুক যদি সমাজে আপনার, আমার, মানসিকতা নারীর প্রতি এত বিরূপ থাকে, যদি নারীকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ না ভাবেন তবে সে কখনই নিরাপদ থাকবে না।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার