বিজ্ঞান, ধর্ম, ধার্মিকতা ও ঈশ্বরবিশ্বাস – আইনষ্টাইন যেভাবে দেখেছেন
সূত্র: Ideas and Opnions-A. Einstien
[প্রায় দুই যুগেরও বেশী সময় আগে লেখা এই লেখাটা উদ্ধার করলাম, এখনও প্রাসঙ্গিক মনে করেই। এই লেখায় প্রাককথন এবং আইনষ্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গি, এই দু’টি শিরোনামে কিছু তথ্য, মতামত সংবেশিত হয়েছে আপাত বিচ্ছিন্নভাবে। এগুলোকে যুক্ত করে কোন যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর দায় পাঠকের। আইনষ্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আনুষঙ্গিক কিছু কথা যোগ করা হয়েছে বন্ধনীর ভেতরে। পঠনশেষে মনে হতে পারে, আইনষ্টাইনের দৃষ্টিতে দেখলে নাস্তিক অধার্মিক বলে চিহ্নিত ইতিহাস চরিত্রগুলোর অনেকেই আসলে প্রকৃত ধার্মিক এবং অনেক মহাধার্মিক মূলতঃ অধার্মিক বা বকধার্মিক – লেখক]
ঈশ্বরবিশ্বাস এবং ধর্মবিশ্বাস শব্দ দুটোকে প্রায় সমার্থক মনে হলেও এই দুটোকে স্পষ্টভাবে পৃথক করে দার্শনিক চিন্তার বিকাশ ঘটেছে অনেক আগেই। এরকম একটা দার্শনিক ধারা অনেক আগে থেকেই প্রবলভাবে বিদ্যমান, যাতে ঈশ্বরকে কল্পনা করা হয় বিশ্বসৃষ্টির একটি নৈর্ব্যক্তিক পরম কারণ হিসেবে; সৃষ্টির পর থেকে যে ঈশ্বরের আর কোন ভূমিকা নেই, অর্থাৎ সৃষ্টির পর থেকে বিশ্ব চলছে আপন নিয়মে সৃষ্টিকর্তার কোন প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই। “একটা চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া জনম ভইরা ঘুরিতেছে”, বহুলশ্রুত এই পংক্তিতে উল্লেখিত দার্শনিক চিন্তার ছোঁয়া পাওয়া যায়। এই দার্শনিক ধারার সুসংহত রূপ হলো দেইজম্ (Deism)। অন্যদিকে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের তত্ত্বগত ভিত্তি হল থেইজম্ (Theism)- এতে মানুষ তথা বিশ্বের প্রতিটি ঘটনাবলীর ওপর ঈশ্বরের সক্রিয় প্রভাবের কথা বলা হয়।
থেইজম-এর প্রাবল্যের বিপরীতে দেইজম ছিলো মূলতঃ নাস্তিকতা বা অ্যাথেইজম্ (Atheism)- এর বহিঃপ্রকাশ, সামন্ত-ধর্মীয় অনুশাসনের যুগে যা হয়ে দাঁড়ায় বস্তুবাদীদের চিন্তা প্রকাশের একটি কৌশলী মাধ্যম। ফ্রান্সের রুশো ভলতেয়ার থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের লক্, নিউটন, টল্যান্ড, রাশিয়ার রাদিচেভ-এরা সবাই দেইজম্ এর প্রবক্তা। বর্তমান সময়ে অবশ্য ধর্মকে যুক্তিসম্মত প্রমাণ করার জন্য দেইজম্ এর সাহায্যে নেয়া হয়, ধর্মবিশ্বাসকে সমর্থন করতে গিয়ে বলা হয় দেইষ্টদের ঈশ্বরবিশ্বাসের কথা। এক্ষেত্রে সচেতনভাবেই ভুলে যাওয়া হয় বা ভোলানোর চেষ্টা করা হয়, ঈশ্বরবিশ্বাস আর ধর্মবিশ্বাসের গুণগত পার্থক্যের কথা।
ঈশ্বরবিশ্বাসের যেমন রকমফের রয়েছে ধর্মবোধেরও তেমনি। নিঃসীম সমুদ্র কিংবা উঁচু পাহাড়ের মুখোমুখি হলে আমরা একরকম বিশেষ বোধে আচ্ছন্ন হই, প্রকৃতির ঘটনাবলীর আশ্চর্য শৃঙখলা আমাদের মনে জাগায় বিশেষ অনুভূতি। এসবই প্রকৃত ধর্মবোধ, আর সত্য সুন্দরের সন্ধানে মানুষের যে সংগ্রাম সেগুলোই প্রকৃত ধর্মপালন। নির্দিষ্ট কিছু আচার আচরণ, বিশ্বাস-ভীতি নির্ভর ধার্মিকতার ধারণার বিপরীতে উল্লেখিত ধারণাগুলোর মতো হাজারো ধারণা রয়েছে। কাজেই নির্দিষ্ট কোন ধর্মবিশ্বাসের প্রতি আনুগত্য না থাকলেই যে একজন মানুষ অধার্মিক হবেন এমনটি ভাবা যায় কি?
আইনষ্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গি:
(ক) বিশ্বাস, বিজ্ঞানের অপারগতা এবং ধর্মের আবশ্যিকতা:
(এই অংশটা জটিল মনে হলে, সরাসরি পরবর্তী অংশগুলো অর্থাৎ খ ও গ, পড়ে দেখতে পারেন।)
বোধের আওতায় চলে আসা প্রক্রিয়াগুলোকে সুসংবদ্ধ চিন্তার মাধ্যমে পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত করবার যে প্রয়াস মানুষ শত বছর ধরে চালিয়ে আসছে, আইনষ্টাইন বিজ্ঞান বলতে সেই প্রয়াসলব্ধ জ্ঞানকেই বোঝেন। স্হানে ও কালে, বস্তু ও ঘটনার পারস্পরিক সম্পর্ক-নির্ধারক কিছু সাধারণ নিয়মের প্রতিষ্ঠাই বিজ্ঞানের লক্ষ্য। এই নিয়মগুলোর ওপর নির্ভর করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই কোন ঘটনার গতি-প্রকৃতির পূর্ব নির্ধারণ সম্ভব হয়। এই সাফল্য আধুনিক মানবমনে গভীর আস্থাবোধ জাগায়, যদিও ঐ নিয়মগুলো সম্বন্ধে তার ধারণা থাকে সামান্যই। সে শুধু এটুকুই মনে রাখে যে গ্রহ-নক্ষত্রগুলো গতি, অবস্থান কিছু নিয়মের সাহায্যে নির্ভুলভাবে হিসেব করা যায়, এটুকুই বোঝে যে তার চারপাশের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আর হিসেব মেনেই কাজ করে যাচ্ছে, ইত্যাদি।
একটি ঘটনায় অংশগ্রহণকারী উপাদানের সংখ্যা যতো বেশী হবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করাও হবে ততো কঠিন। আবহাওয়ার কথাই ধরা যাক, মাত্র কিছুদিনের জন্যও এ সম্পর্কে নিশ্চিত নির্ভুল পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব নয়। প্রভাবকারী উপাদানের সংখ্যা বেশী বলেই এক্ষেত্রে শতভাগ নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বলে, কার্যকারণ সম্পর্ক অস্বীকার করে আবহাওয়ার পরিবর্তনকে নিয়ম-না-মানা ঘটনা বলা চলে না।
মানুষ প্রকৃতির ঘটনাবলীর নিয়মমবদ্ধতা সম্বন্ধে যতো বেশী জানে ততোই তার এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, এইসব ঘটনাবলীর ভিন্নচরিত্রের কোন নিয়ন্ত্রকের প্রয়োজন নেই। (মানবিক কিংবা ঐশ্বরিক কোন স্বাধীন নিয়ম-নীতি ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করে এরকম ধারণা তার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে। সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে স্বাধীন কোন মানবিক বা ঐশ্বরিক নীতির অস্তিত্ব সে অস্বীকার করতে চায়। কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার আলো যেখানে অপর্যাপ্ত বা অনুপস্থিত সেখানকার অন্ধকার থেকে পুষ্টি নিয়েই বেঁচে থাকে প্রকৃতির ঘটনাবলীতে হস্তক্ষেপকারী ব্যক্তি-ঈশ্বরের ধারণা।
বিজ্ঞান আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাথে এবং এদের আন্তঃসম্পর্কের সাথে। বিজ্ঞান আমাদের বলে দিচ্ছে অনেকগুলো ‘কী’-এর সমাধান।কিন্তু এর দ্বারা কী হওয়া উচিত তার সমাধান সরাসরি হয় না; বিজ্ঞানের অবদানকে কিছুমাত্র খাটো না করেও একথা বলা যায়। কোন একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বস্তুগত জ্ঞাননির্ভর হয়েই তা করতে হয়। এতদসত্ত্বেও ঐ নির্দিষ্ট লক্ষ্যটা নির্ধারণের জন্য সেই বস্তুগত জ্ঞান অর্জনের প্রেরণার উৎস কিন্তু অন্যত্র। এটা সকলেই স্বীকার করবেন যে নির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং সেই জনিত মূল্যবোধ ছাড়া আমাদের ক্রিয়াকলাপ নিতান্তই অর্থহীন। সত্য সম্বন্ধে জ্ঞান সুন্দর সন্দেহ নেই, তবে সুন্দরের পেছনে ছোটার যুক্তি বা মূল্য যে কী সেটার ধারণা ঐ সত্যজ্ঞান স্বয়ং দিতে পারে সামান্যই। আমাদের অস্তিত্ব প্রসঙ্গে বিশুদ্ধ যৌক্তিক চিন্তার সীমাবদ্ধতা এখানেই। কিন্তু এ থেকে এরকম ধারণা মোটেও করা চলে না যে, লক্ষ্য ও নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে যৌক্তিক চিন্তার কোন ভূমিকা নেই। যৌক্তিক চিন্তা লক্ষ্যবস্তু এবং লক্ষ্য অর্জনের উপায়ের আন্তঃসম্পর্ককে স্পষ্ট করে। তবে, মৌল লক্ষ্যগুলোর নির্ধারণ, মূল্যায়ন এবং মানুষের সামাজিক জীবনে এসবের প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্বতন্ত্র প্রয়াস প্রয়োজন। এই প্রয়োজন মেটানোর কাজটা করতে পারে ধর্ম। ধর্ম এবং বিজ্ঞানের আন্তঃনির্ভরতাকে প্রকাশ করা যায় এভাবে, ‘ধর্মবোধ ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু, বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ!’ এখন দেখা যাক, এখানে ধর্ম বলতে আইনষ্টাইন কী বুঝিয়েছেন।
(খ) কারা ধার্মিক?
আইনষ্টাইন ধর্মবোধপ্রাপ্ত বলেছেন তাদেরকে যারা সংকীর্ণ স্বার্থবোধের উর্দ্ধে উঠতে পেরেছে, যাদের চিন্তা, অনুভূতি, উদ্যোগের মূলে রয়েছে কোন অতিব্যক্তিক বোধ (Super personal value) এই বোধের প্রাবল্যটাই বড় কথা। কোন স্বর্গীয় বা অতিপ্রাকৃতিক অস্তিত্ব (যেমন, ঈশ্বর)-এর সাথে এই বোধকে জড়িত হতে হবে এমন কোন কথা নেই। কেননা সেক্ষেত্রে বুদ্ধ, স্পিনেজা এঁদেরকে ধর্মবোধহীন বলতে হবে। সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও কিছু লক্ষ্য ও অভিমুখের প্রতি অবিচল আস্থা রাখাই ধার্মিকতা।
[এ অর্থে বলা যায়, বেহেশত-প্রাপ্তির আকাঙ্খা কিংবা দোজখ প্রাপ্তির ভীতি থেকে নয় বরং কোন প্রকার অপার্থিব প্রাপ্তির আশা ছাড়াই যে বোধ মানুষকে ভালো কাজ করতে এবং মন্দকে এড়াতে উদ্বুদ্ধ করে তাই ধার্মিকতা। গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সংগ্রাম করতে গিয়ে অনেকেই চরম আত্মত্যাগ করেছেন। কেন এই আত্মত্যাগ? বিশ্বটাকে সমৃদ্ধ সুন্দর করে তোলার দায় মানুষের থাকবে কেন? এই প্রশ্ন থেকে শুরু করে; বেঁচে থাকার লক্ষ্য কি? আমরা সবাই মিলে আত্মহত্যা করবো না কেন? এসব প্রশ্নের কোন পরম সমাধান নেই। তবুও মানুষ বেঁচে থাকে, অন্যকে বাঁচায়, সুন্দর সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ার কল্পনা করে এবং এই কল্পনাকে বাস্তব করার জন্য লড়াই করে। এমনকি জীবন পর্যন্ত দেয়! এসবের পেছনে যে বোধ কাজ করে তাই ধর্মবোধ এবং এই বোধ মৃত্যুপরবর্তী প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির ভাবনা-নিরপেক্ষ। ধর্ম-বোধকে এভাবে দেখলে বিজ্ঞানের সাথে এর বিরোধটাও আর থাকে না।
কোন ধর্মপক্ষ যখন নির্দিষ্ট কোন গ্রন্থের সব কথাই পরম সত্য বলে দাবী করে তখনই সংঘাত আসে, কেননা এতে করে ধর্ম বিজ্ঞানের পরিমন্ডলে প্রতিস্থাপকের ভূমিকায় চলে আসে, গ্যালিলিও ও ডারউইন, এঁদের মতবাদের বিরুদ্ধে গীর্জার যে সংগ্রাম, তার কারণটা এখানেই। ধর্মের প্রবক্তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে আইনষ্টাইন বলেছেন, যে মতবাদ কেবল অন্ধকারে ঠাঁই খুঁজতে চায়, আলোয় আসতে পারে না, মানুষের ওপর তার প্রভাব ক্রমশঃ কমে আসতে বাধ্য এবং এর ফলাফল হবে মানব প্রগতির অন্তরায়। মানুষের আত্মিক চিন্তার বিবর্তন (Spiritual Evolution) যত এগুচ্ছে ততোই এই সত্যটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, জীবন-মৃত্যু নিয়ে ভীতিভয়, অন্ধবিশ্বাস এসবে প্রকৃত ধার্মিকতা নেই। যৌক্তিক জ্ঞানার্জনের প্রচেষ্টাই প্রকৃত ধার্মিকতা। এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে বলা যায়, বস্তুতান্ত্রিক এই যুগে আন্তরিক বিজ্ঞানকর্মীরাই সবচাইতে বেশী ধার্মিক’।
(গ) ব্যক্তি-ঈশ্বরের ধারণা প্রসঙ্গে :
আইনষ্টাইন ব্যক্তি-ঈশ্বর (Personal god)-এর ধারণার বিরোধী। ধর্ম ও বিজ্ঞানের বিরোধের মূল কারণ হিসেবে তিনি ব্যক্তি ঈশ্বরের ধারণাকে দায়ী করেন। আধ্যাত্মিক চিন্তা-বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ তার ক্রিয়াকলাপের নির্ধারক (বা নিয়ন্ত্রক) দেবতাদের কল্পনা করেছে নিজেদের প্রতিরূপে এবং কল্পিত দেবতাদের মেজাজ-মর্জিকে প্রভাবিত করতে চেয়েছে যাদুচর্চা, প্রার্থনা এসবের মাধ্যমে।
[এলিয়াটিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা দার্শনিক জেনেফিনিস (খ্রীঃপূঃ ৫৭০-৪৮০) বলতেন, প্রকৃতপক্ষে গরু কিংবা ঘোড়ার যদি মানুষের মতো হাত থাকতো এবং তারাও যদি মানুষের মতো চিত্র আঁকতে পারতো, তাহলে ঘোড়া তাদের ঈশ্বরকে ঘোড়ার মতো এবং গরুরা তাদের ঈশ্বরকে গরুর মতো করে আঁকতো।]
বর্তমান সময়ে মানুষের অনুসৃত ধর্মগ্রন্থগুলোতে (সবগুলোয় নয়) ঈশ্বরকে যেভাবে বর্ণনা করা হয়, তা মূলতঃ উল্লেখিত প্রাথমিক চিন্তারই অর্থাৎ ব্যক্তি-ঈশ্বরেরই বিবর্তিত রূপ। দেবতাদেরকে নরগুণসম্পন্ন মনে করার ধারণা (anthropomorphism), ঈশ্বরের কল্পনায় এসেও বলবৎ থেকেছে। এই নরত্বারোপমূলক (anthropomorphic ) চরিত্রের প্রমাণ মেলে ‘ইচ্ছা পূরণের জন্য ঈশ্বরের কাছে দোয়া-প্রার্থনা, ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্য পূজা-নামাজ এসবের মধ্যে।
এটা সবাই স্বীকার করবে যে, সর্বশক্তিমান, সর্বমঙ্গলময় ঈশ্বরের ধারণা মানুষকে সান্ত্বনা, পথনির্দেশনা দিতে পারে, তাছাড়া অনুন্নত অবিকশিত মানবমনে সহজেই ঈশ্বরের ধারণাটা স্থান করে নিতে পারে। কিন্তু একটা ঈশ্বর কল্পনা করে নেবার কেজো এই দিকগুলো সত্ত্বেও কিছু দুর্বলতা থেকে যায়। ইতিহাসের গোড়া থেকেই এটি অনুভব করা গেছে। ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন তাহলে মানুষের ক্রিয়াকলাপ, চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি-আকাঙখা থেকে শুরু করে জগতের তাবৎ ঘটনা মূলতঃ ঈশ্বরেরই কাজ। এরকম একজন শক্তিমানের অস্তিত্ব থাকলে মানুষকে কী করে তার চিন্তা বা কর্মের জন্য দায়ী করা যায়? মানুষকে শাস্তি দেয়া বা পুরস্কৃত করার মধ্য দিয়ে তো ঈশ্বর প্রকৃত বাস্তবে নিজের সিদ্ধান্তকেই শাস্তি দেবে বা পুরস্কৃত করবে। ঈশ্বরের সদাশয়তা, ন্যায়পরায়ণতা এসব কি সেক্ষেত্রে প্রশ্নের সম্মুখীন হয় না? তাই কারণিকতা (Causuality)-এর সূত্রের জাগতিক দিকটা যার উপলব্ধিতে রয়েছে সে কোনভাবেই ঘটনা ঘটনের ক্ষেত্রে কারো হস্তক্ষেপের কথা মেনে নিতে পারেনা; অবশ্য কারণিকতার প্রকল্পটাকে সে যদি প্রকৃত অর্থেই গভীরভাবে উপলব্ধি করে থাকে তাহলেই। পারলৌকিক ভয়ভীতির কথা বলে যে ধর্ম, গভীর উপলব্ধির মানুষের কাছে সেই ধর্মের কোনো প্রয়োজন নেই, একই ভাবে সামাজিক নৈতিক ধর্মও তার কাছে অপ্রয়োজনীয়। মানুষকে পুরস্কৃত করে, শাস্তি দেয়-এরকম ঈশ্বরের ধারণাকে সে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারে না; কেননা অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক প্রয়োজনই মানুষের ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে।
ঈশ্বর একটা প্রাণহীন বস্তুকে যেমন তার গতি-প্রকৃতির জন্য দায়ী করতে পারে না একজন মানুষকেও তেমনি তার কাজের জন্য দায়ী করতে পারে না। কার্যকারণ সূত্রের চর্চার মধ্য দিয়েই এসব জিজ্ঞাসা-অবিশ্বাসের জন্ম। তাই কার্যকারণ সূত্রের চর্চা অর্থাৎ বিজ্ঞানকে দায়ী করা হয় নীতিবোধের ধ্বংসকারী হিসেবে (যদিও এটা করার কোন বাস্তবানুগ কল্যাণমুখী যুক্তি নেই)। একজন মানুষের নৈতিক আচার-আচরণের ভিত্তি হওয়া উচিত শিক্ষা, সহমর্মিতা ও সামাজিক প্রয়োজন; ধর্মীয় কোন ভিত্তি (প্রচলিত অর্থে) এখানে অপ্রয়োজনীয়। আসলে, মৃত্যুপরবর্তী শাস্তির ভয় আর পুরস্কারের আশা যদি মানুষের ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে তা কখনও তার জন্য ভালো হবে না।
এই কথাগুলো থেকে এই সত্যটা স্পষ্ট হয় আইনষ্টাইন যে রকম ধার্মিকতার প্রয়োজনের কথা বলেছেন তা মোটেও প্রচলিত অর্থে ধার্মিকতা নয়। কাজেই ঐশ্বরিক গ্রন্থ, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, বেহেশত দোজখ জাতীয় বিষয়বস্তু-নির্ভর ধর্মের প্রবক্তাদের আইনষ্টাইনকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করবার কোন যুক্তি নেই। আইনষ্টাইনের দৃষ্টিতে দেখলে নাস্তিক অধার্মিক বলে চিহ্নিত ইতিহাস চরিত্রগুলোর অনেকেই আসলে প্রকৃত ধার্মিক এবং অনেক মহাধার্মিক মূলতঃ অধার্মিক বা বকধার্মিক। পাঠকেরা নিজেরাই এ ধরনের চরিত্রগুলো খুঁজে নিতে পারবেন।
সাম্প্রতিক মন্তব্য