নারীবাদ ও সম্মতি উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে বামপন্থীদের নীরবতা
নারীবাদ একটি আন্দোলন। এর প্রথম তরঙ্গের পর এখন তো চতুর্থ তরঙ্গ চলছে পশ্চিমে, আর আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে অসম আয় ও উন্নয়ন এর মতই নারীবাদের বিকাশও অসম ভাবে ঘটেছে। তবে এর যত ধারা, উপধারা থাকুক না কেন নারীবাদ কি কখনও পুরুষতন্ত্রের মত নিজেদের শ্রেষ্ঠ দাবি করে পুরুষদের উপর কর্তৃত্ব, অভিভাবকত্ব ফলাতে চায়? না। নারীবাদ লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের, অসম্মানের প্রতিবাদ করে; মানুষ হিসেবে তার স্বাধিকার চায়, নিজেকে কেবল জীবন্ত যৌন বস্তু ও সন্তান উৎপাদনের মেশিন মনে করে না।
লিঙ্গ পরিচয় নারী হলে তাকে অনেক সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, আরও বহু রকমের বৈষম্য, নিপীড়ন, বঞ্চনা, অত্যাচার, অপমান, অসম্মান সইতে হয়। নারীবাদ এর অবসান চায়। এই চাওয়াটা কি স্বাভাবিক, মানবিক ও ন্যায় সঙ্গত নয়? তাহলে নারীবাদকে এমন ভাবে উপস্থাপন করার কারণ কি যাতে মনে হয় নারীবাদী হওয়াটা একটা বাজে ব্যাপার? যেমন সাম্যবাদী বা কম্যুনিস্ট হওয়াটা কে নেগেটিভ ভাবে প্রচার করা হয়। যারা এর বিপক্ষে তারা কি খুব মানবিক? যাদের স্বার্থে ঘা লাগে তারাই বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে বেড়ায়।
আফসোস লাগে যখন আমাদের দেশের সমাজতান্ত্রিক, সাম্যবাদী বলে যারা পরিচিত তাঁরাও নারীদের উপর চলমান জুলুম, বৈষম্য নিয়ে তেমন রা করেন না, নারীবাদকে তাঁরাও দেখি এড়িয়ে চলেন। কেন এর সঠিক ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনীয়তা তারা অনুসন্ধান করেন না? নাকি তাঁরাও পুরুষতন্ত্রের যে গভীর প্রভাব জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা ও বহমান জীবনে তার থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না? তাদের বক্তব্য হল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন সেই পরিবর্তন আনতে হলেও মানুষকে সচেতন হতে হবে। কালচারাল হেজেমনির যে দৃঢ় প্রভাব মানুষের মানসিক জগতে তা বুঝতে হবে সমাজ পরিবর্তন প্রত্যাশী কর্মীদের।
মাও সেতুং যে কতগুলো বাঁধার কথা বলেছেন সমাজ পরিবর্তনের পথে এবং পরিবর্তন হওয়ার পর তা ধরে রাখতে সেটা অনুধাবন করলে তো এটা বুঝতে পারার কথা যে প্রচলিত বিশ্বাস, সংস্কার এগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এই লড়াই সবসময় চলমান না থাকলে বিচ্যুতি ঘটবে। কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তন করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। এর বাস্তব প্রমাণ সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনে মিলল। শত শত বছরের প্রচলিত বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, অভ্যাস, সংস্কার ও প্রবণতা সাংস্কৃতিক চর্চা ছাড়া, মনোজগতের পরিবর্তন হয় না। তাই এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পশ্চিমারা এই বিষয়টা ভাল করে অনুধাবন করেছে বলেই তারা মানুষের মন, ভাবনা, অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এর মাধ্যমে মানুষের উপর এত জুলুমবাজি, দখলদারিত্ব, শোষণ করার পরও তারা মানুষের কাছে গণতান্ত্রিক, মানবতাবাদী। অন্যদিকে যে কয়টা রাষ্ট্র তাদের স্বার্থ পরিপন্থী তারাই খুব খারাপ তাদের কাছে এবং সাধারণ মানুষও গড়পরতা ডিক্টেটর বলতে, ফ্যাসিস্ট বলতে পশ্চিমাদের হাজির করা তথ্যে বিশ্বাস করেন, করান হয়। ,মানুষ তাদের সিনেমা দেখে, তাদের বানানো সিনেমা বিশ্বব্যাপী প্রচার হয়, অস্কার পায়। তারাই সব কিছুর স্ট্যান্ডার্ড। তারা নিজেরা ধর্মের ব্যাপারে গোঁড়া নয়, গনতন্ত্র বলে বলে অজ্ঞান, কিন্তু তারাই আবার তাদের প্রয়োজনে রাজতন্ত্রও সমর্থন করে। এবং তারাই আফ্রিকা, এশিয়ার দেশগুলোতে ধর্মের নামে রাজনীতির চাষাবাদ করে। তারা চায় এই এশিয়া, আফ্রিকার মানুষগুলো ধর্ম নিয়ে মারামারি, কাটাকাটি করতে থাকুক। এসব দেশের জ্ঞান, বিজ্ঞানেড় চর্চা না আগাক, এসব দেশ বর্বর হিসেবে পরিচিত হোক।
ধর্মকে হাতিয়ার করে এসব দেশের নারীদের শিক্ষা, অগ্রগতি, উন্নতি আটকে দিতে চাইছে এরা। এইগুলো যদি বুঝে থাকেন তবে নারীবিদ্বেষ, নারীদের নিয়ে ফতোয়া, নারীদের উন্নয়ন বিরোধী নীতি, কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করাটা কি জুরুরী নয়? দেশকে জ্ঞান, বিজ্ঞান, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা থেকে পিছন দিকে ঠেলে দিতে দিতে অবস্থা আরও খারাপ হলে তখন কি সমাজ পরিবর্তনের কাজটা সহজ হবে নাকি আরও কঠিন হবে? তাহলে নারীর কোন ইস্যু আসলে, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি হলে বামপন্থীদের ( সকলেই নয়) বেশীরভাগ চূপ থাকাটা কী ঠিক? বিন্দু বিন্দু জলে সিন্ধু হয়। হ্যাঁ, তেমনি সমাজের বড় রকমের যে বৈষম্যগুলো, অবিচারগুলো, অন্যায়গুলো, আগাছাগুলো সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, কার্যক্রম চালিয়ে যেতে যেতে সমাজ সুন্দর পরিবর্তনের দিকে এগুবে। সেই কবে শ্রমিক, কৃষক বিপ্লব করবে সেই আশায় এখন যা হচ্ছে সেসব মেনে নিতে থাকলে দেশ আরেক আফগানিস্তান হতে আর দেরি নেই।
বামপন্থীদের অনেককে বলতে শুনেছি বাংলাদেশ কখনও আফগানিস্তানের মত হবে না। কিন্তু ঘর থেকে পথে বের হলেই যখন দেখি তিন বছরের মেয়ে শিশুদের হিজাব পরিয়ে বাবা, মা সাথে নিয়ে যাচ্ছে, এবং এই দৃশ্য এখন বেশ পরিচিত, তখন কিছুই মনে হয় না আপনাদের? নাকি এটাও হিজাব আমার চয়েস বলে চালিয়ে দেবেন? ছোট ছোট মেয়ে বাচ্চাগুলোকে এখন বাংলাদেশে হিজাব পরিয়ে রাস্তায় বের করছে বাবা, মা। এটা কি ওই বাচ্চাগুলোর চয়েস? এই দৃশ্য আপনাদের চোখে পড়েনি? এপর্যন্ত কাউকে এই বিষয়টি উল্লেখ করতে দেখলাম না। গ্রামে গঞ্জে, এমনকি ঢাকায় বাড়ি বাড়ি তালিম, তাবলীগের দাওয়াত, আসর বসে। এগুলো আপনারা দেখেন নি বা জানেন না? ধর্মীয় অনেক সংঘঠন হয়েছে এখন, এগুলোর কর্মীরা বসে নেই।
যে দেশে এত দুর্নীতি, ধর্ষণ, জুলুম, অন্যায়, অবিচার সে দেশে এত নিবেদিতপ্রাণ ধার্মিক রাজনৈতিক কর্মী কোথা থেকে পাচ্ছে? এই সকল তৎপরতা, কর্মকাণ্ড আমি দেখেছি প্রথম ১৯৯৮ এ। এত বছরে জল অনেকদূর গড়িয়েছে। এখন তো পিনাকীর মত উচ্চ শিক্ষিতরা এই কাজে নেমে পড়েছে। নুন্যতম কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করলে বোঝার কথা যে লোক নিজে হিন্দু ধর্মের, সেই লোক বাংলাদেশে অর্থাৎ যেখানে ৯২% মানুষ মুসলিম সেই দেশে ইসলাম ধর্ম রক্ষার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ভারতে মুসলিমরা সংখ্যালঘু, সেখানে মুসলিমদের রক্ষার, ইসলাম ধর্ম রক্ষার জন্য সেদেশের মানুষের উদ্দেশ্যে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে পোস্ট করলে তার বোধগম্য একটা যুক্তি থাকে, কিন্তু যে দেশে হিন্দু ধর্মের মানুষেরা সংখ্যালঘু হতে হতে এখন ৮% এসে ঠেকেছে সে দেশে পিনাকীর মুসলমানদের উদ্দেশ্যে হিন্দু বিদ্বেষী এত বয়ান, কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য কি? পিনাকী কি তার শ্রোতাদের পরিষ্কার করে বলেছেন তিনি কোন ধর্মে বিশ্বাস করেন? বা তিনি নাস্তিক কিনা? কারণ তার শ্রোতারা সকলেই ধার্মিক মুসলিম। এই ধার্মিক শ্রোতারা কেন এই প্রশ্ন করেন না?
ধার্মিক মানুষেরা তো নাস্তিকদের কথা শোনার কথা নয়, আবার তার শ্রোতারা তো হিন্দু বিদ্বেষী তাহলে তারা কেন এই হিন্দু ধর্মের কাফের বক্তার কথা শোনেন? হ্যাঁ, যদি পিনাকী ইসলাম ধর্ম ভালবেসে ইসলাম গ্রহণ করতেন তাহলে যুক্তিতে মিলত। এই কমনসেন্সটুকু এই শ্রোতারা কেন খাঁটান না? তাহলে তো ধরতে পারতেন যে ও বাংলাদেশে ধর্মীয় আবেগ ও সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়ার জন্য কাজ করে চলেছে। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা, কার্যক্রমের ফলে এখন স্বেচ্ছায় বাবা, মায়েরা দুই বছরের শিশুকেও হিজাব পরিয়ে রাখছে। এটা হল ইতালিয়ান মার্ক্সবাদী গ্রামসি বা ফ্রেঞ্চ মার্ক্সবাদী আলথুসারের ভাষায় সম্মতি উৎপাদন মেকানিজমের ফল। আপনাকে অন্ধ বানিয়ে রাখবো, গোলাম বানিয়ে রাখবো বা দাসের মত ব্যবহার করব বা গাধার খাটুনি খাটাবো কিন্তু আপনার সম্মতি উৎপাদনের মাধ্যমে। আপনাকে বিশ্বাস করাব যে আপনি এরই যোগ্য। এই সম্মতি উৎপাদনের বিষয়টা নিয়ে, এর প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে আমাদের এখনই সচেতন হওয়াটা খুব জরুরি।
সাম্প্রতিক মন্তব্য