
ব্যাণ্ডেল বানানে ণ্ড শুদ্ধ

অণ্ড, কাণ্ড, মণ্ড, প্রকাণ্ড, ভণ্ড ইত্যাদি শব্দে ণ্ড হয়; ন্ড হয় না। প্রশ্ন : তাহলে Bandel (পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার একটি শহর) শব্দটি বাংলায় লেখার সময় ব্যাণ্ডেল লিখব, না ব্যান্ডেল লিখব? অণ্ড, ভণ্ড ইত্যাদি শব্দের মতো এই ক্ষেত্রেও ণ্ড ব্যবহার করলে সমস্যা হয় না। কিন্তু আজকাল অনেকেই ণ্ড-এর বদলে ন্ড ব্যবহার করে শব্দটিকে ‘ব্যান্ডেল’ লিখছেন। এর পিছনে ওদের যুক্তি হল Bandel শব্দটি একটি বিদেশি শব্দ এবং বিদেশি শব্দে ণ্ড ব্যবহার করা চলবে না। কিন্তু অণ্ড, কাণ্ড প্রভৃতি শব্দের মতো ব্যাণ্ডেল শব্দেও ণ্ড ব্যবহার করলে সবরকম শব্দের ক্ষেত্রে একই রকম বানানরীতি বজায় থাকে, যা সুবিধাজনক। প্রসঙ্গত, ব্যাণ্ডেল স্টেশনের পুরাণ বোর্ডগুলিতে আজও ব্যাণ্ডেল বানান লেখা আছে (সঙ্গের ছবি দেখুন), হাল আমলের নতুন বোর্ডগুলিতে ‘ব্যান্ডেল’ বানান লেখা হয়েছে। প্রশ্ন: বিদেশী শব্দের ক্ষেত্রে ণ্ড ব্যবহার করলে দোষ কোথায়? আরও প্রশ্ন: Bandel, band, pendulum ইত্যাদি শব্দে যদি ন্ড ব্যবহার করা হয় (যেটা অধুনা অনেকেই করছেন) তবে অণ্ড, ভণ্ড, পণ্ডিত ইত্যাদি শব্দে ন্ড ব্যবহার করা যাবে না কেন? পণ্ডিত, অণ্ড ইত্যাদি শব্দের ণ্ড-এর সঙ্গে Bandel-এর nd এর উচ্চারণের তফাৎ কতটা?
আমাদের যেখানে ন, ণ দুটি বর্ণ আছে সেখানে ইংরাজীতে শুধু n আছে। আমাদের কোথায় ণ, কোথায় ন হবে তার নির্দ্দিষ্ট নিয়ম আছে। বর্তমান ক্ষেত্রে ণ ও ড একই বর্গের (ট ঠ ড ঠ ণ) বলে ণ্ড (ণ +ড) হওয়াই বাঞ্ছনীয়। প্রসঙ্গত, শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাংলা ভাষার অভিধান’ গ্রন্থে ‘ব্যাণ্ড’ বানান আছে, ‘ব্যান্ড’ নয়। এটা উনি ঠিক কাজই করেছেন। বেশ কয়েক বছর আগে আমি বাঁকুড়া শহরের ভৈরবস্থানের কাছে ‘লিজেণ্ড’ নামে একটি বিউটি পার্লারের বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। তারা ইংরেজী Legend শব্দের লিপ্য়ন্তর করেছিলেন ‘লিজেণ্ড’ এবং সেটা সম্পূর্ণ ঠিকই করেছিলেন (বুঝে বা না বুঝে)। অধুনা আমাদের বাংলা একাডেমি যে বিদেশি শব্দে ণ ব্যবহার না করার কথা বলে তা আমি জানি। কিন্তু একাডেমির এই বিধির পিছনে যথেষ্ট যুক্তি নাই (আমার ভুল হলে জানান)।
আমার তো বারে বারে মনে হয় যে, বাংলা একাডেমি বাংলার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে পারছে না এবং ভাষার ক্ষেত্রে আমরা আজও ইংরেজীর দাসত্ব করে চলেছি। আমি তাই বানানের ক্ষেত্রে শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্য়ায় ও শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস মহাশয়ের অভিধান অনুসরণ করার পক্ষপাতী। ঐ দুই অভিধানে প্রদত্ত বাংলা বানানগুলি ব্যাকরণ ও নিরুক্তের বিচারে একদম যুক্তিপূর্ণ।
ব্যাণ্ডেল শব্দে ণ-এর ঠিক উচ্চারণ হয় কিনা, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। এই বিষয়ে আমার কিছু বলার আছে। আমি উচ্চারণবিশেষজ্ঞ নই, তবু আমার সীমিত জ্ঞান অনুসারে ব্যাণ্ডেল বানানে ণ-এর উচ্চারণ হয় ( ভুল হলে জানান)। যদি তা নাও হয় তাহলেও কিন্তু ব্যাণ্ডেল বানানে ণ্ড লিখতে অসুবিধা নাই। বানান যে সর্ব্বদা উচ্চারণ অনুসারী হতে হবে তা নয়। যেমন আমরা লিখি ‘বলছি’, কিন্তু উচ্চারণ করি ‘বোলছি’। লেখা হয় pneumonia, কিন্তু উচ্চারণ করা হয় নিউমোনিয়া (p বাদ)। তেমনি উচ্চারণ ‘ব্যান্ডেল’ বা তার কাছাকাছি হলেও ( খুব সম্ভব তা হয় না) বানান ‘ব্যাণ্ডেল’ লিখলে তা দোষের হয় না; বরং পণ্ডিত, খণ্ড, কাণ্ড ইত্যাদি শব্দগুলির সঙ্গে একত্রে স্থান পেয়ে তা আমাদের ব্যাকরণ ও নিরুক্তের রীতিকে ধরে রাখে। ভাষায় ভাষায় গভীর সম্পর্ক থাকে এবং শেষ বিচারে কোনো ভাষাই বিদেশি নয়। তাই শব্দের দেশি-বিদেশি জাতপাত বিচার না করে প্রাচীনদের মতো একরকম বানানবিধি চালু রাখার কথা আমরা বিবেচনা করতেই পারি। সেটা করলে অধুনা বানান নিয়ে যেসব বিশৃঙ্খলা হচ্ছে সেগুলি দূর করার একদম সহজ ও যুক্তিপূর্ণ উপায় পাওয়া যায়।
ব্যাণ্ডেল একটি পোর্তুগিজ শব্দ। এক জায়গায় পেয়েছিলাম যে, এর অর্থ ‘ছোট গ্রাম’। কেমন ক’রে এই অর্থ হয় (এবং সত্যিই তা হয় কিনা) তা আমার অজানা। কেউ যদি ব্যাণ্ডেল শব্দটির ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ একটু ব্যাখ্যা করতে পারেন তাহলে কৃতজ্ঞ থাকব।
পরিশেষে বলি যে, বাংলা থেকে অর্ব্বাচীন ন্ড যুক্তাক্ষরটিকে পুরা বাদ দিয়ে আগেকার মতো সর্ব্বত্র ণ্ড ব্যবহার করলে একেবারে সব গণ্ডগোল মিটে যায়। তবু কেউ যদি ব্যান্ডেল, লন্ডন ইত্যাদি বানান লিখতে চান তবে তিনি সেসব লিখতে পারেন। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই কেউ ণ্ড লিখলে তাকে ভুল বলা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে আপনাদের মতামত কাম্য। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির সদস্যরাও বিষয়টি ভাবুন। সকলকে ধন্যবাদ।
‘ন্ড’ সহ নানাবিধ অর্ব্বাচীন বানানের প্রসারে ছদ্ম বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অবদান অস্বীকার করা যায় না। বর্তমান কালের প্রসাব মাধ্যম নিয়ন্ত্রণকারী নব্য দৈনিক শ্রেণী ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে শক্ত রকমের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আঁতাত লক্ষণীয়।