বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, নাট্য জগত ধ্বংসের চেষ্টা রুখে দিন
মামলা দিয়ে ‘হাওয়া’ ছবিটির পরিচালককে যেভাবে হয়রানি করা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে যে বার্তা দেয়া
হচ্ছে; এবং ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটিকে সেন্সর দিয়ে যেভাবে আটকে রাখা হচ্ছে তাতে এদেশের মুখ
থুবড়ে পরা চলচ্চিত্র অঙ্গনের আবার উঠে দাঁড়াবার প্রচেষ্টাকে কি বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে না? যারা ‘হাওয়া’
সিনেমা প্রচুর আলোচিত হওয়ায় এবং প্রচুর দর্শক হলে টানতে পারায় ‘হাওয়া’ নিয়ে চুলচেরা নেগেটিভ
রিভিউ লিখেছিলেন তাদের এখন কোন লেখা বা কথা দেখা যাচ্ছে না কেন? একটা দেশের শিল্প, সাহিত্য,
সিনেমা, নাট্য জগত যদি বন্ধ হয়ে যায়, মুখ থুবড়ে পরে তাহলে সেই দেশের পরিণতি কখনই ভাল হয় না।
আমাদের চলচ্চিত্র, নাট্য অঙ্গন, সঙ্গীত অঙ্গন, সাহিত্য আজ থেকে ৫০ বছর আগে যেমন ছিল তা
থেকে ক্রমশ এর অধঃপতন হয়েছে। একাত্তরে বেছে বেছে দেশের সকল অঙ্গনের মেধাবী মানুষগুলোকে
হত্যা করা হয়েছে। তারপর ক্রমান্বয়ে শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক জগতকে দুর্বল করা হয়েছে। এই অঙ্গনের যে
মানুষগুলো পরবর্তীকালে জনগনের চোখে শ্রদ্ধার ও ভালবাসার ছিল এদের বেশিরভাগই একটা সময়
অর্থের, বিত্তের, পদ-পদবীর লোভে শাসক দলের দালালে রুপান্তরিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এদের প্রতি
মানুষ শ্রদ্ধা ও আস্থা হারিয়েছে। আর একজন শিল্পী যখন কেবল অর্থ, বিত্ত আর পদ-পদবির শেকলে
আটকে যায় তখন তার দ্বারা আর কি আশা করা যায়। এরপর ডিশ এন্টেনার সুবাদে এবং তারপর
ইন্টারনেটের বদৌলতে হলিউড, বলিউড এবং এখন কোরিয়ান সিনেমা বা বিভিন্ন কন্টেন্ট মানুষ দেখতে
পাচ্ছে এবং জনপ্রিয়ও হচ্ছে। সেখানে ইচ্ছেকৃত ভাবে দুর্বল করে রাখা আমাদের চলচ্চিত্র, নাটক, এবং
সঙ্গীত মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না। ঠিক এইরকম সময়ে ‘হাওয়া’ সিনেমাটি যে তুমুল
আলোড়ন ও আগ্রহ তৈরি করে এদেশের মানুষকে আবার সিনেমা হলে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে
তা আশাপ্রদ ছিল। সিনেমা হলগুলো আর কত লোকসান গুনবে। একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে
গেছে।যে কটা এখনও টিকে আছে সেগুলো টিকে থাকার প্রয়োজনে বিদেশী চলচ্চিত্র – হলিউড এবং
বলিউডের মূলত – দেখাচ্ছে এবং দেখাবে। একে একে এদেশের সব কিছুই বিদেশী শক্তির কাছে জিম্মি
হয়ে গেছে, যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদহীন হয়ে যাওয়া, তাদের মনোজগতের, মানসিকতার
অধঃপতনের পেছনে সুপরিকল্পিত ভাবে যে এদেশের সাংস্কৃতিক জগতকে ধ্বংস করা হয়েছে তার অবশ্যই
গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আছে। যারা কেবল নিজেদের মুনাফা বা লাভের বা ক্ষমতার জন্য এদেশের যেকোনো
সেক্টরে ক্ষতি করতে পিছপা নন, তাদেরি একটা অংশ এই দেশে সিনেমা আবার মাথা চারা দিয়ে উঠুক তা
চায় না। রাজনৈতিক নেতৃত্বহীন; শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক, গান অর্থাৎ সাংস্কৃতিক জগত ধ্বংস প্রাপ্ত;
শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষা নিম্ন মানের, গবেষণায় বরাদ্দ নেই অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থা জ্ঞান উৎপাদনহীন; ধর্মীয়
উন্মাদনায়, সাম্প্রদায়িকতায়, নারী বিদ্বেশে, নারীকে বস্তা বন্দী করায় এগিয়ে যে দেশ বা জাতি তাঁকে শোষণ,
শাসন, বা নিপীড়ন করা খুব সহজ, তা সে বাইরের শক্তি দ্বারা হোক বা ভেতরের। তার জ্বলন্ত উদাহরন
আফগানিস্তান বা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী চোখের সামনে। তবুও হুশ নেই কারো। এমনকি যারা নিজেদের
প্রগতিশীল, চিন্তক, বাম বলে পরিচয় দেন তাদের কোন লেখায় বা কর্মকাণ্ডে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
যারা শিল্প, সাহিত্যের রিভিউ লেখেন বা লিখতে পারেন তাদের এই বিষয় গুলো না বোঝার কথা নয়। তাহলে
তারা কেন মানুষ আবার এদেশের তৈরি সিনেমা দেখুক, এদেশি চলচ্চিত্র আবার মাথা তুলে দাঁড়াক, নাট্য
শিল্প আবার ফিরে আসুক সে বিষয়ে প্রচারনা চালান না বা লেখেন না? যখন শাসক শ্রেণী বা রাষ্ট্র এই
বিষয়ে বিরুপ, প্রতিকুল তখন প্রগতিশীল বলে যারা দাবী করেন তাদের এগিয়ে আসাটা কি কাম্য নয়?
দেশে আবার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জাগরন ঘটাতে হবে। এ বিষয়টাকে যদি এখনও গুরুত্ব না দেয়া হয়
তবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ আরও ঘনীভূত হবে এবং সুস্থ রাজনৈতিক ধারা তৈরির জন্য রাজনৈতিক কর্মী
এবং নেতাদের যে গুণাবলীর প্রয়োজন তার অভাব প্রকট হবে। ভবিষ্যৎ এর বাংলাদেশকে আফগানিস্তান
এর মত অবস্থায় ফেলার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তাই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জোরদার করার জন্য এবং তা
চর্চার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে শুভ বুদ্ধির সকলেই যার যার জায়গা থেকে হলেও ভুমিকা রাখতে হবে।
।
“তথ্য মন্ত্রী হাছান মাহমুদ ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের পরিচালকের বিরুদ্ধে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে করা মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন চলচ্চিত্রকার ও নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। সোমবার বিকেলে নাসির উদ্দীন ইউসুফসহ চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের একটি প্রতিনিধি দল তথমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে ছয়টি দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি দেন। ” সরকার পক্ষের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলতে চাই, ভবিষ্যতে যেন কেউ শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র-নাটকের উপর খড়্গ চালাতে না পারে, তা বন্ধে কার্য্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।