
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা: বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সিলিং সেন্টার গঠন করা জরুরী

একজন শিক্ষার্থী বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। যখন তাদের পরিবারের সদস্যরা ও প্রতিবেশিরা জানতে পারেন তাদের ছেলে বা মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে তখন তারা খুশিতে আত্মহারা হয়। কিন্তু এর ঠিক দুই থেকে তিন বছর না পেরোতেই যখন তারা শোনেন তাদের ছেলে বা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে তখন এই খবরটা মেনে নেওয়া যে সেই পরিবারের জন্য কতখানি কষ্টকর তা শুধু জানেন সেই পরিবারগুলো যে পরিবারগুলোতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে । একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা যে শুধু তার পরিবারের জন্য দুঃখজনক পরিণতি ডেকে আনতে পারে তা নয় বরং একটি দেশের জন্যও দুঃখজনক।
বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় , ২০২১ সালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে যা ২০২০ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি ছিল। ২০২০, ২০১৮ এবং ২০১৭ তে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪২ , ১১ এবং ১৯ জন। আত্মহত্যাকারীর মধ্যে স্নাতক তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি ( ৩৬.৬৩ % ) এবং বয়স বিবেচনায় ২২-২৫ বছরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন এর সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি আত্মহত্যা করছে সম্পর্কের অবনতির কারণে। যার শতকরা পরিমাণ ২৪.৭৫ %। এছাড়া পারিবারিক সমস্যা , মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি , লেখাপড়া সংক্রান্ত সমস্যা , আর্থিক সমস্যা , মাদকাসক্ত এবং অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করছে যথাক্রমে ১৯.৮০%, ১৫.৮৪ %, ১০.৮৯ % , ৪.৯৫ % , ১.৯৮ % এবং ২১.৭৮ % । গবেষকদের মতে , আত্মহত্যার প্রধান কারণ ৪ টি — সম্পর্কের অবনতি, পারিবারিক সমস্যা, লেখাপড়া নিয়ে হতাশা ও আর্থিক সংকট ।
এখনি সঠিক সময় বিশ্ববিবিদ্যালয়ের একজন স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচানো । যেহেতু এটি বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষার্থীর সমস্যা তাই এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে । এক্ষেত্রে প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য “বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সেলিং সেন্টার” গড়ে তুলতে হবে। এসব কাউন্সিলিং সেন্টারে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তরুণ তরুণীরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যাপক সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগার ফলে তারা হতাশাগ্রস্ত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া প্রেম ঘটিত আবেগীয় বিভিন্ন সমস্যা, একাডেমিক খারাপ ফলাফল, অর্থনৈতিক সংকট, ক্যারিয়ার, বন্ধু সার্কেল, পারিবারিক জটিলতা এবং একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়গুলোর কারনে অনেক শিক্ষার্থীরা ডিপ্রেশনে ভুগে থাকে। তারা তাদের সমস্যাগুলো শেয়ার করার মত তেমন পরামর্শদাতা খুঁজে পায় না। তারা নিজে নিজে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তখন তারা খুবই একাকী অনুভব করে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়। তাই, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির কথা বিবেচনায় রেখে যদি কাউন্সেলিং সেন্টারের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য মঙ্গলজনক হবে।
দ্বিতীয়ত, যারা প্রেমে জটিলতার কারণে আত্মহত্যা করতে চান, তাদের বলব, অন্যের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করার কোনো মানে হয় না। জীবনে প্রেমে ব্যর্থ হয়েছেন তো কি হয়েছে! অপেক্ষা করুন আপনার জীবনে হয়ত আরো ভালো কেউ আসবে। আর একটি বিষয় হলো, আপনি যা হারিয়েছেন, আপনি বিশ্বাস করুন যে সেটি আমার জন্য নিখুঁত ছিল না। এছাড়া প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে সবসময় সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে।
তৃতীয়ত, এ পৃথিবীর কোন ব্যক্তিই সমস্যার বাইরে নয়। পরিবার, সমাজে সবসময় নানা রকম সমস্যা থাকবেই। পরিবার ভেঙে যেতে পারে, সমাজিক সমস্যার সমাধান নাও হতে পারে। তাই বলে আত্মহত্যা কোন সমস্যা সমাধানের পথ হতে পারে না। নিজেকে শেষ করে দেয়ার পূর্বে নিজের মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের কথা মনে করে নিজের জীবনে তাদের অবদানের কথা মনে করলে এবং তাদের জীবনে নিজের অবদানের কথা ভাবলে কেউ আত্মহত্যা করতে পারবে না।
চতুর্থত , বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যদি কারো আর্থিক সমস্যা থাকে সেক্ষেত্রে টিউশনি করিয়ে অথবা সফট স্কিল গুলোর উন্নয়ন ঘটিয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেই বহন করা যেতে পারে। এতে ডিপ্রেশন ধীরে ধীরে কমে আসবে।
পঞ্চমত, যখন কেউ ডিপ্রেশনে থাকে সেই বিষয়টি বুঝতে পারে ক্লাসমেটরা বা নিকট বন্ধুরা । সেক্ষেত্রে ক্লাসমেট বা বন্ধুরা অন্য একজন বন্ধুর ডিপ্রেশনে থাকার কারণগুলো শুনে তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে তাকে আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের আশেপাশে এমন কাউকে দেখতে পাই যে তার জীবন, ক্যারিয়ার, পরিবার নিয়ে হতাশ বা ডিপ্রেশনে আছে, তাহলে তার পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব। যদি সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন তাহলে সমাজে আত্মহত্যার প্রবনতা একেবারেই কমে আসবে। নিজে কখনো কোন বিষয় নিয়ে হতাশ হওয়া যাবে না, অন্যকেও হতাশ হতে দেয়া যাবে না। আমাদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। পরবর্তীতে, স্বপ্ন আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। আসুন আজকের এই দিনে আমরা সবাই এই অঙ্গীকারবদ্ধ হই, “সুস্থ ও সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায়, আমরা আছি সর্বদাই।”
Great Anil Das.
Go ahead ❤️