Select Page

ঘানির বলদ


মোবাইলে এ্যালার্ম বাজছে, ভোর ছয়টা। সাতটায় বেরোতে হবে। দ্রুত উঠে পড়ে ইমা। স্কুলে মাসে তিনদিন লেট হলে একদিনের বেতন কাটা যাবে। চোখের পলকে যেন এক ঘন্টা পার হয়ে সাতটা বেজে যায়। এই এক ঘন্টায় সে নাস্তা বানায়, মেয়েকে নাস্তা খাইয়ে স্কুলের জন্য রেডি করে, নিজেও তৈরি হয়। তারপর ঘর তালা দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পরে। পৌনে আটটায় হাজির হতে হবে স্কুলে। রাস্তায় আজ রিকশা কম দেখা যাচ্ছে। দু’জন রিকশা ওয়ালার সাথে কথা বলে ইমা, কিন্ত ভাড়া বেশি হাঁকছে বলে ছেড়ে দেয়। ইমার বাসা থেকে তার কর্মস্থল, মেয়ের স্কুলে, যাওয়ার কোন বাস, ট্যাম্পো নেই, তাই রিকশাই ভরসা। প্রতিদিন আসা-যাওয়ায় কতগুলো টাকা চলে যায়। স্কুলের আসে পাশে বাসা ভাড়া অনেক বেশী বলে কিছুটা দূরে কম ভাড়ায় বাসা নিয়েছে ইমারা। ইমা বেতন পায় দশ হাজার টাকা। প্রতিদিন যাতায়াত খরচ ১৬০ টাকা অর্থাৎ মাসে ৩২,০০ টাকা। তাই রিকশা ভাড়া নিয়ে দরদাম করতে হয়। পনেরো মিনিট চলে গেল রিকশা পেতে। এখন রাস্তায় জ্যামে আটকে না গেলেই হয়, মেয়েকে নিয়ে রিকশায় উঠতে উঠতে ভাবে ইমা। ভাগ্য ভাল বলতে হবে আজ, তেমন জ্যামে পড়তে হল না। কাঁটায় কাঁটায় পৌনে আটটায় পৌছল তারা। মেয়ে এক দৌড়ে ক্লাস রুমে চলে যায়। আর ইমা তাড়াতাড়ি করে হাজিরা খাতায় সাইন দেয়। ইমার মেয়ে কেজি ওয়ানে পড়ে। তার ক্লাস শেষ হয়ে যায় সাড়ে বারোটায়, আর ইমার ছুটি হয় আড়াইটায়। মেয়েকে ক্লাসের ফাঁকে হাত মুখ ধুইয়ে কিছু খাইয়ে দেয় ইমা। অত সকালে তাড়াহুড়া করে মেয়ে তেমন কিছু খেতে পারে না, আর বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় তিনটা বেজে যায়। ইমার স্বামী রিফাত একটি গার্মেন্টস-এ চাকুরী করে, জুনিয়র কর্মাশিয়াল অফিসার। বেতন তেমন নয়, পনের হাজার এর মত। তার উপর বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে, গ্রামে টাকা পাঠাতে হয়। রিফাতও সকাল সাতটায় বের হয়। গতকাল রিফাত গ্রামে গেছে, মার শরীর ভাল নয়।

ক্লাস নিতে আজ কষ্ট হচ্ছিল ইমার। ব্লাড প্রেশার বেড়ে গিয়েছিলো কাল রাতে, ঘুম হয়নি ভাল। তবুও কিছু করার নেই। পাচঁটা ক্লাস আজ। ছুটি নিতে গেলে ইনচার্জ দুটো কথা শুনিয়ে দেবে। চাকুরি প্রার্থীর তো আর অভাব নেই। এই চাকুরীটা ইমার কাছে সোনার হরিণের মতো। মেয়ের স্কুলের বেতনেও কিছুটা ছাড় পাচ্ছে সে এখানকার শিক্ষিকা বলে। বেশকিছু ছাত্র-ছাত্রী পড়তে আসে তার কাছে তাও এই স্কুলের কারণে। না হলে বেতনের টাকায় চলা অসম্ভব ছিল। স্কুলের শেষ ঘণ্টা পরতেই আর দেরি করে না ইমা। মেয়েকে নিয়ে সে রওনা দেয় বাসায়। বিকাল ৪টা থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানো শুরু হবে, চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে মা-মেয়ে দুটো খেয়ে নেয়। গা ছেড়ে দেয় ইমা, ভাত খাওয়ার পর; চোখ বুজে আসে। তখনই দরজায় কলিংবেল বাজতে থাকে। না, আরাম করার উপায় নেই। শুরু হয় কোলাহল, আর ইমার একটানা পড়ানো। গলাটা শুকিয়ে আসে কথা বলতে বলতে। রাত আটটায় বন্ধ হয় তার পড়ানো। মেয়েটাকে সময় দেয়া হয় না তার , কষ্ট হয় ইমার। কিন্তু সারাদিন এত বক বক , কথা বিক্রি করে খাওয়া কাজ যার তার আর কথা বলার মত শক্তি থাকে না। তাই মেয়ের কথার, নানা প্রশ্নের উত্তর সে হু, হা করে দেয়। রাতে সারাদিনের রান্না-বান্না করে রাখে সে। সব কাজ শেষ করে বিছানায় যেতে রাত ১২টা বেজে যায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে টিভিতে চোখ বুলায় ইমা। প্রিয় কিছু সিরিয়াল, কিছু রিয়েলিটি শো, এইটুকু বিনোদন। ছুটির দিনে ঘর সাফ, সারা সপ্তাহের জমানো গৃহস্থালির কাজ, স্কুলের লেসন প্ল্যান তৈরি, জমে থাকা খাতা দেখা শেষ করে টিভি সিরিয়াল, শো এর ফাঁকে একটু আধটু খবরও দেখে সে। খারাপ খবরই বেশী। ধর্ষণ, খুন, গৃহবধু হত্যা, নানান দূর্নীতি, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, প্রতিদিন এইসব খবরই ঘুরে ফিরে। মাথাটা ভারী লাগে এসব দেখে। নিজেদের পায়ের নিচেই মাটি নেই, বেসরকারী চাকুরী টিকিয়ে রাখতেই প্রাণপাত। চাকুরী না থাকলে দুমাস বসে খাওয়ার যোগাড় নেই, নিজেদের বাড়ী নেই। ঘরভাড়া না দিতে পারলে বাড়ীওয়ালা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। মেয়ে নিয়ে বস্তিতে উঠতে হবে। উফ্, ভাবলেই ইমার প্যানিক এ্যাটাক আসতে থাকে। একবার তাদের এমন হয়েছিল; তার স্বামীর চাকুরী ছিল না। ইমা সদ্য একটা স্কুলে কাজ শুরু করেছে অল্প টাকা বেতনে। কোনও ছাত্র- ছাত্রীও জুটেনি পড়ানেরার মত। তখন তাদের এক রুমের একটা বাসা, রান্নাঘর, বাথরুম তিন ভাড়াটিয়ার সাথে শেয়ারে নিতে হয়েছিল। রান্নার চুলা, বাথরুম নিয়ে মাঝে মাঝে ঝগড়া লেগে যেত। না, আবার সেই রকম অবস্থায় পরতে চায় না ইমা। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সে।


পরদিন স্কুলে টিচার্স রুমে বেশ সরগরম আড্ডা জমেছিল। সামনে ২১ শে ফেব্রুয়ারী, তারই অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে কথা হচ্ছিল। ইমার সহকর্মীদের একজন আর্মি অফিসারের বউ, তার স্বামীর পোস্টিং হিল ট্র্যাক্টসে। উনি কথায় কথায় মাঝে মধ্যে বলেন ওখানে সেনারা কত কষ্ট করে, দূর্গম অঞ্চল। শুনে মায়াই হয় ইমার। তার আরও দু’জন সহকর্মীর একজন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসারের স্ত্রী, আরেকজন নৌবাহিনীর অফিসারের। শেষের জনের স্বামী বিদেশে মিশনে আছেন । এই কলিগের সাথে ইমার খুবই ভাল সম্পর্ক। আর হবে নাই বা কেন, ইনি খুব মিশুক, কোন অহংকার নেই। দুটো ছেলে নিয়ে একা একা তার স্বামীকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হয়। বলেন তিনি, “এবার তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলব।” এদের প্রত্যেকেই স্বামীর সাথে তাদের মধুর সম্পর্কের গল্প করেন। স্ত্রীর প্রতি তাদের কেয়ারিং এর কথা শুনে বেশ ভাল মানুষই মনে হয় ইমার। আরেকজন কলিগ আছেন তার স্বামী খুবই কিপটে, আরেকজনের স্বামীর তার ভাবীদের সাথে খুব খাতির বলে প্রায়ই উস্মা প্রকাশ করেন তিনি। আজ ব্যক্তিগত গল্প কম। ২১শে ফেব্রুয়ারীর কথা আসতেই কথায় কথায় অনেক কথাই আলোচনা হয়। একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি আর্মিরা কি করেছিলো সেসব কথা, কারো কারো বাবা মায়ের মুখে শোনা গাঁয়ে কাঁটা দেয়া কিছু ঘটনা, কারো কারো নিঃস্ব হওয়ার আবার কারো বা ফুলে কলাগাছ হওয়ার গল্প। পাকিস্তান দেশটার নাম শুনলে কেমন একটা বর্বর দেশ বলে মনে হয় তাদের। তবে দু’এক জন আবার ভারতের প্রসঙ্গ টেনে আনে। সীমান্তে ভারতীয় সেনাদের বাংলাদেশী হত্যা, তিস্তা, ফারাক্কা বাঁধ, পানি না দেয়া এরকম নানান ইস্যুতে তাদের ভারতের প্রতিও ক্ষোভ ফুটে উঠে। হিন্দুরা তাদের সব টাকা, সম্পদ ভারতে পাঠিয়ে দেয় এরকম কথাও বলে কেউ কেউ। আলোচনার এই পর্যায়ে উদিতা এসে হাজির। আর্টের শিক্ষিকা, অল্প বয়সী, খুব মিষ্টি একটা মেয়ে উদিতা। তার ধর্ম আবার হিন্দু। তাকে দেখে সবাই হাসিমুখে স্বাগত জানায়। সপ্তাহে দু’দিন তার ক্লাস, তাই ঐ দুদিনই সে স্কুলে আসে। সবাই এই মেয়েটিকে খুব পছন্দ করে। সে যে হিন্দু এটা কারো মাথায় থাকে না। সেও আড্ডায় যোগ দেয়। কথায় কথায় জানায় সে বোধহয় এই চাকুরীটা আর করবে না, তাকে তার বাবা-মার কাছে চট্টগ্রাম চলে যেতে হবে। শুনে সবারই মনটা খারাপ হয়ে যায়।


রিফাত ফিরেছে গ্রাম থেকে। একদিনের ছুটি নিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু দু’দিন লেগে গেল ফিরতে। তাই একটু টেনশানে ছিল, অফিসে বসকে জবাবদাহি করতে হবে, ঝাড়িও খেতে হতে পারে। ইমার চাকুরীটা ছিল বলে রিফাত একটু বল পায়। ইমার আবার ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে বাসায়। সংসার চালিয়ে কিছু টাকা জমানোর স্বপ্ন দেখে ইমা আর রিফাত। ইমার পরিশ্রম বেড়ে যায়। আরও বাড়তি সময় দিতে হয় বাচ্চা পড়ানোয়। তাই সে ঠিক করে এবার একটা কাজের বুয়া রাখবে। একবেলা এসে ভারী কাজগুলো করে দিবে। কিছু পয়সা খরচ হলেও এটা ছাড়া উপায় নেই। রিফাত সেই সকাল সাতটায় বের হয়, ফেরে রাত ৯ টায়। রাস্তার জ্যাম-এ দুঘন্টা বাড়তি খেয়ে নেয়। তাই ওর পক্ষে ঘরের কাজে তেমন সাহায্য করা সম্ভব হয় না। ঠিকে ঝিকে ১,৫০০ টাকা দিতে হবে মাসে। ভাবতে ইমার কষ্ট হয়। তবুও একটু আরাম পাওয়া যাবে এই ভেবে শান্তি পায় সে।

স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে আজকাল ইমা টিচার্স রুমে একটু আধটু আড্ডা দেয়। নতুন এক শিক্ষক এসেছেন, সায়েন্সের। পাহাড়ি ছেলে, বয়সে তরুন। ছেলেটা মেধাবী, ওর কথা বার্তায়ও বোঝা যায়। ইমার সাথে মাঝে মধ্যে কথা হয়। ইমার মাঝে কেমন একটা সরলতা আছে কিংবা ওকে খুব নিরীহ মনে হয় বলেই কিনা কে জানে অনেকেই ইমার সাথে তাদের অনেক ব্যক্তিগত কথা শেয়ার করে। এই ছেলেটিও ইমার সাথে সহজভাবে মেশে। কথায় কথায় ইমা জানে ওর বাবা নেই। মা আছেন, ভাই-বোন আছে। মাঝে মাঝে ওর কথায় কেমন যেন একটা চাপা ক্ষোভ লক্ষ্য করে ইমা । ওর ক্ষোভটা মনে হয় যেন বাঙ্গালীদের প্রতি। মাঝে মাঝে খোচাঁ মেরে বলে- “আমরা তো উপজাতি, দিদি, আপনারাতো আমাদের চেয়ে উপরে।“ ইমার কষ্ট হয় এসব কথা শুনলে। কোথাও কোন দুঃখ বা সমস্যা আছে ছেলেটার, ভাবে ইমা। কিন্তু এর চেয়ে বেশী ভাবার সময় বা শক্তি কোনটাই নেই ইমার। দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রামে তার সবশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। এভাবেই একরকম চলছিল জীবন। একদিন হঠাৎ ইমা, তার সহকর্মীবৃন্দ, তার স্কুলের সকলের মুখরতা স্তব্ধ হয়ে গেল। সেদিনও যথারীতি সবাই স্কুলে ক্লাস নেয়ায়, গল্পে, নানান কাজে ব্যস্ত ছিল। হঠৎ’ খবর রটে গেল ক্যু হয়েছে। টিভিতে দেখাচ্ছে। আধ ঘন্টার মধ্যে স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হল। কখন কি হয়, সবাই তড়িঘড়ি করে একরাশ ভয় আর দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি রওনা দিল। ইমা তার স্বামীকে ফোন দেয়। রিফাতের অফিস বেশ দূরে। তাই দূশ্চিন্তা হতে থাকে ইমার, ফোন ধরছে না রিফাত। বাসায় ফিরে আবারও ফোন দেয় রিফাতকে। এবারও ফোন ধরে না সে। টিভিটা চালু করে ইমা, দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। ইমা তাড়াতাড়ি করে তার মেয়েকে খাইয়ে দেয়। এখনও রিফাতের কোন ফোন আসলো না। কোন ছাত্র-ছাত্রীও আজ আসেনি। কেমন এক অশুভ নিরবতা চারিদিকে। দেখতে দেখতে অন্ধকার নেমে আসে। রিফাতের ফোন বন্ধ পাচ্ছে এখন। ইমা কি করবে বুঝতে পারে না। নেট কানেকশনও নেই। ইমার বাবা মা নেই আর রিফাতের বাবা-মা গ্রামে থাকেন। রিফাতের কোন ভাই-বোনও নেই। ইমার বড় বোন, সে থাকে তার স্বামীর সাথে ভারতে। হিন্দু এক ছেলের সাথে প্রেম করে বিয়ে হয় তার। কোন পক্ষের অভিভাবকই মেনে নেয় নি। একসময় ছেলেটি ভারতে তার এক আত্মীয়র সহযোগিতায় বউকে নিয়ে সেখানে চলে যায়। গত ১০ বছর ধরে সেখানেই আছে। বোনের বরটি ওখানে ছোট খাটো ব্যবসা করে কোনোমতে টিকে আছে। আজ ইমার তার বড় বোনের কথা খুব মনে পরছে। ইমা কাকে ফোন করবে, কার সাথে যোগাযোগ করবে বুঝতে পারেনা। একসময় রাত গভীর হয়, রিফাত ফেরে না। কি হতে পারে? এসব ভাবতে ভাবতে রাত ভোর হয়, এক সময় তন্দ্রা নেমে আসে ইমার চোখ। সকাল সাতটার দিকে কলিংবেল বেজে উঠে। ইমা ধরমড়িয়ে উঠে বসে, দৌড়ে যায় দরজায়। হয়তো রিফাত এসেছে। দরজা খুলতেই দেখে তাদের বুয়া বাদশার মা। বুয়া ঘরে ঢুকেই বলে, “আপা দেশে কি গণ্ডগোল লাগছে? আমার জামাই কাইল দুপুরেই গরে আয়া পরছে। হের রিকশাটা ভাইঙ্গা গেছে রাস্তায় গণ্ডগোলের সময়। কইলো কার্ফু দিছে। রিকশা না চালাইলে তিনটা পোলাপাইনরে কি খাওয়ামু। গেরামে যামু তারও তো এহন উপায় নাই। আল্লাহ একি মুসিবতে হালাইলো। ইমা কি বলবে, সে যে আরো বড় মুসিবতে আছে। তার স্বামী যে এখনও ঘরে ফেরেনি। কোন যোগাযোগও নেই। ইমা তার কলিগ মুশফিকা আপাকে ফোন দেয়। জানায় তাকে রিফাতের কথা। মুশফিকা তাকে ধৈর্য্য ধরতে বলে, এছাড়া আর কিইবা বলবে। তার বাসা বেশ দূরে। সারাদিন কেটে গেল রিফাতের কোন খবর নেই। টিভিতে খবরে দেখালো শহরে গতকাল অনেক জায়গায় বেশ গোলযোগ হয়েছে। আর্মিরা অনেককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গেছে। রিফাতের অফিস থেকে যে রাস্তাগুলো পার হয়ে বাসায় ফিরতে হয় সেই রাস্তাগুলোতেও গোলযোগ হয়েছে। কি ঘটেছে রিফাতের ভাগ্যে কে বলতে পারে। ইমার শরীর ভয়ে হিম হয়ে আসে। এতদিন পর সে আজ তার বড় বোন সোমাকে ফোন দেয়। রিং বেজে যাচ্ছে, ফোনটা ধরছে না। ইমার মনে হয় সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে।

সন্ধ্যের পর ফোন বেজে উঠে ইমার। তার বোন কল ব্যাক করেছে। অনেকদিন পর তাদের কথা হয় আজ। ইমা কেঁদে দেয়। সোমা বলে খবরে দেখেছে, কিন্তু বুঝতে পারেনি যে এতটা ভয়ংকর অবস্থা। টিভিতে আর পাঁচটা যুদ্ধ, প্রাণহানীর খবর দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই এই খবর এতটা গুরুত্ব দেয়নি তারা। তাছাড়া জীবন যুদ্ধে সকাল থেকে রাত অবধি এতটাই ব্যস্ত, উদ্বিগ্ন ও ক্লান্ত যে নিজেদের বাইরের জগতের দিকে তাকাবার ফুরসত কই তাদের। ইমা জানে ও দেশে যাওয়ার পর তাদের জীবন সংগ্রামের কাহিনী। কিভাবে কত কষ্টে জীবিকার পথ বের করতে হয়েছে তাদের। ওদের একমাত্র সন্তান মিলন, এখন ক্লাস ওয়ানে পরে। তারা যে মহল্লায় থাকে তা নিম্নবিত্তদের এলাকা। সেখানকার মানুষগুলো কেউ দোকানদার, কেউ শ্রমিক, কেউ ছোট খাটো চাকুরে। সবারই চেষ্টা নিজেদের ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করা, যেন তারা একটু ভদ্রলোকের জীবন পায়। তাই সবাই যার যার সংসারের চাকা টানতেই দিনপাত করছে। তাদের কাছে তাদের জীবনযুদ্ধটাই অনেক বিশাল, এর বাইরে কি হচ্ছে তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথার সুযোগ নেই। তারা কখনো সরকারকে গালি দেয়, তো কখনো ইশ্বরকে/খোদাকে/আল্লাহকে দোষে নয়তো দোষ দেয় নিজেদের ভাগ্যকে। বোনের সাথে কথা বলে মনটা কিছুটা হালকা হয় ইমার। সোমা ইমাকে বলে যেভাবে হোক গ্রামে শ্বশুরবাড়ী চলে যেতে। কিন্ত কার্ফু না উঠলে, গাড়ী চলাচল শুরু না হলে কিভাবে যাবে সে। তাছাড়া রিফাতের কি হল সে খবরটাও তো সে জানে না। রাত হয়ে গেছে, পরদিন আবার কথা বলবে বলে ফোন রাখে তারা। ফোনটা রাখতেই আবার রিং বেজে উঠে। চমকে উঠে ইমা, তার মনে সর্বক্ষণ রিফাতের জন্য উৎকন্ঠা কাজ করছে। না কলটা রিফাতের না। সেকি, এতো সেই পাহাড়ী ছেলেটা, মং এর নাম্বার। কল রিসিভ করে ইমা। অপরপ্রান্ত থেকে ভীত সন্ত্রস্ত এক কন্ঠ: দিদি, আমি বেশ বিপদে পড়েছি। তাই আপনাকে ফোন করলাম।

ইমা: কি হয়েছে?
মং: দিদি কাল রাতে আমাদের হলে রেইড হয়েছে। অনেককে তুলে নিয়ে গেছে। আমি কোনমতে পালিয়ে বেচেঁছি। ঢাকায় থাকার মত কোন আশ্রয় পাচ্ছি না। আপনার কথা মনে হল। আমাকে আপনার বাসায় আশ্রয় দেবেন? কার্ফ্যু উঠলেই আমি বাড়ি চলে যাব।
ইমা তাকে বাসার ঠিকানা দিয়ে চলে আসতে বলে।
মং এর মার্স্টাস পরীক্ষা সদ্য শেষ হয়েছে। এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছাড়া হয়নি। পরদিন সকালে এক ঘণ্টার জন্য কার্ফু উঠলে মং চলে আসে ইমাদের বাসায়।


ইমার দিকে তাকিয়ে মং অবাক হয়ে যায়। চেনা যাচ্ছে না, এই দু’দিনে কি হাল হয়েছে হাশিখুশী মেয়েটির, চোখ মুখ যেন বসে গেছে। এদিকে তার নিজের চেহারাও যে বিধ্বস্ত তা ইমাকে দেখে সে ভুলেই গেছে। ইমার কাছে এক গ্লাস পানি চায় মং। ইমা পানি দিতে দিতে ভাবে ছেলেটার উপর বেশ ধকল গেছে মনে হচ্ছে। ইমার মেয়ে মুন্নী মংকে দেখে কিছুটা অবাক হয়, খুশীও। তাকে জিজ্ঞেসা করে, “স্যার, আপনাকে এমন লাগছে কেন?” মং কিছু না বলে কেবল স্মিত একটা হাসি দেয়। ইমা বলে, চলুন নাস্তা করবেন। ইমা মংকে রুটি আর আলুভাজি দেয়। মুন্নী খেয়ে নিয়েছে আরো সকালে। ইমা এখনও খায়নি। মং বেশ ক্ষুধার্ত। খাওয়া শুরু করে সে। মং এর খাওয়া দেখে ইমার খেতে ইচ্ছে করে। এ দু’দিন তার পেটে তেমন খাবার পরেনি। সেও খাওয়া শুরু করে মং এর সাথে। এমন সময় বাদশার মা আসে। তার চোখ মুখ শুকনো। এসেই জিজ্ঞেস করে, “মুন্নীর বাপে আইসে? কোন খোঁজ পাইসেন?” ইমার গলায় খাবারটা আটকে যায়। বলে- “না।” মং চমকে উঠে । তইতো এতক্ষন তার মনেই ছিল না ইমার স্বামীর কথা। ইমার স্বামীকে তো দেখতে পেল না বাসায়। বুয়া এসব কী বলছে, “কী হয়েছে দিদি? আপনার হাসবেন্ড কোথায়?” ইমার আর খাওয়া হয়না। পেট মুচড়ে বমি আসে। সে উঠে দ্রুত বাথরুমে চলে যায়। খানিকটা স্থিত হয়ে বাথরুম থেকে বের হয়। প্রথমেই বুয়ার কাছে গিয়ে বলে মুন্নীর সামনে যেন তার বাবার কথা না জিজ্ঞেস করে। মুন্নীকে ইমা বলেছে তার বাবা গ্রামে তার দাদুর কাছে গেছে। তারপর মুন্নীর কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে ইমা বলে “মামুনি এখন একটু পড়তে বসো। তোমাকে আজ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই করে দিবো।“ মং এর খাওয়া শেষ। সে ইতিমধ্যে বুঝতে পেরে যায় যে রিফাতের খোঁজ নেই। কি বলে স্বান্তনা দেবে সে ইমাকে। তার বাবাও ছোটবেলায় এরকম নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলো। ফিরে এসেছিল তার লাশ।

মং: দিদি আপনি আমাকে কিছু বলেন নি কেন?
ইমা নিশ্চুপ
মং: আপনার কষ্ট আমি বুঝতে পারছি। এরকম পরিস্থিতির ভেতর আমার পরিবারও একসময় গিয়েছে।
ইমা: আমি এখন আন্দাজ করতে পারছি। ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পাহাড়ীদের ছবি দেখেছি । সেগুলো অনেকটা গল্পের মত মনে হতো, আঁকা ছবিতে তোমাদের জীবন যাপন দেখতে বেশ ভাল লাগতো। এর বেশি আর কিছু জানতাম না।
মং: আমিও এই দুদিনে আনেক কিছু বুঝলাম দিদি।
ইমা: আমিও। দেখলেতো, জাতি, উপজাতি, আমরা আজ সব এককাতারে মিলে গেছি।

এর মাঝে বুয়া এসে বলে তার কাজ শেষ। আজ নাস্তা সে খেয়ে যাবে না। একটা বাটিতে করে সে তা বাসায় নিয়ে যেতে চায়। ইমা বুঝতে পারে কেন।
বুয়া: আপা, কয়দিন এরম চললে তো আমাগো না খায়া মরা লাগবো।
ইমা শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তার আর মুন্নীরই বা কি হবে, এই ভাবনা তাকে আতংকিত করে তোলে।
মং ভাবছে এদের অবস্থা তার চেয়ে কোন অংশে কম করুণ নয়। ফোনে রিং এর শব্দে সম্বিত ফিরে আসে ইমার। দৌড়ে যায় ফোনের কাছে। অচেনা নাম্বার, কলটা রিসিভ করতেই একটা ধাক্কা খায় ইমা। তার ছোট বোন তমার কন্ঠ, পাকিস্তান থেকে। “কেমন আছিস আপা? কি খবর তোদের? টিভিতে দেখলাম। ঠিক আছিস তো তোরা?” ইমা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কত্তদিন পর তমার গলা শুনলাম, ভাবে ইমা।

ইমা: তুই কেমন আছিস? তোর বর, বাচ্চারা কেমন আছে?
তমা: আমাদের কথা পরে হবে, আগে তোদের খবর বল। রিফাত ভাইয়া, মুন্নী কেমন আছে?
ইমা: রিফাতের কোন খোঁজ নেই পরশু থেকে।
তমা: বলিস কি? খোঁজ নেই মানে কি? কি হয়েছে খুলে বল।

তমার বর পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? ইমা সংক্ষেপে সব বলে। তমার বর ইউসুফ কথা বলতে চায় ইমার সাথে।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল ইউসুফ। তখন পরিচয় হয় তমার সাথে, এরপর প্রণয়। তমা এবং ইউসুফ বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। ইউসুফ তার পরিবারকে জানায়; প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও ছেলের জেদের কাছে হার মানতে হয় তাদের। প্রস্তাব নিয়ে আসে তমাদের বাসায়। তমার পরিবার একেবারেই রাজী নয়। পাকিস্তানী ছেলে। কিন্তু তমাও নাছোড়বান্দা। সে বুঝায়, ছেলের পরিবার শিক্ষিত, স্বচ্ছল, সবদিক থেকেই ভাল। তাছাড়া সে ইউসুফকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবে না বলে দেয়। এক পর্যায়ে রাজী হয়ে যায় তমার পরিবার। সামাজিকভাবেই তাদের বিয়ে হয়, তমা চলে যায় তার স্বামীর সাথে পাকিস্তান। ইউসুফ তমার কাছে থেকে কিছুটা বাংলা শিখেছে। তাদের বাচ্চারাও মায়ের থেকে শিখেছে বাংলা। ইউসুফ বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করে ইমার সাথে।

ইউসুফ: আস্সালামু আলাইকুম আপা। ইসব কি হয়ে গেলো। আপা চিন্তা কোরবেন না। আল্লাহ সাব ঠিক করে দিবে। হামলোক হ্যায় না। সরীরের খেয়াল রাখবেন অর বাচ্চকা ভি।
ইমার খুব অদ্ভুত লাগে। যেন কত আপন, ভাইয়ের মত করে সাহস দিচ্ছে।
ইমা: তুমি যে বলেছো তাতেই খুব খুশী হলাম ভাই। তোমার বাবা-মা কেমন আছেন? তাদেরকে আমার সালাম দিও।
ইউসুফ: আপা, আম্মা এখানেই আছেন, কথা বুলতে চাইছিলেন আপনার সাথে, এই নেন।
ইমা: তাই? দাও ফোনটা। স্লামালিকুম খালাম্মা।
ইউসুফের আম্মা: ওয়লাইকুম আস্সালাম। তুমহারা খাবর সুনকে বাহাত বুরা লাগা। সাবার কারো, ইনশাল্লাহ সাব ঠিক হো যায়ে গা। জীন্দেগী ম্যা মুসিবাতে তো আতি র্যাহেতে হ্যায়, হামকো ভি বহুত কুছ সেহেনা পারতা হ্যায় বেটি।
ইমা: জি খালাম্মা ধের্য্য ধরে তো আছি। আপনার শরীর কেমন আছে। খালু ভালো আছেন? খালুকে আমার সালাম দিবেন।
ইউসুফের আম্মা: ও আচ্ছে হ্যায়। তুম আপকা খ্যায়াল রাখনা। ঘাবড়াও মাত। সাব ঠিক হো জায়েগা।
ইমা: জী খালাম্মা। ভাল থাকবেন, খোদা হাফেজ।
তমা: আপু, কতদিন তোদের দেখিনা, দেশের জন্য মন কেমন করে। এর মধ্যে এসব কি হয়ে গেল। ইউসুফের ব্যবসা আগের মত ভাল নেই। এখানেও নানান সমস্যা, গ্যাঞ্জাম। সবমিলিয়ে আর গুছিয়ে উঠতে পারে না। তাই দেশে আসাও হয় না। তুই এখন কি করবি ভেবেছিস কিছু? বড় আপার সাথে কথা হয় তোর?
ইমা: হ্যা, অনেকদিন পর গতরাতে কথা হল। কি করবো বুঝতে পারছি নারে। বড় আপা বলল কার্ফ্যু উঠলে শশুরবাড়ী চলে যেতে। কিন্তু রিফাতের কোন খোঁজ না নিয়ে কি করে যাই।
তমা: আমার মনে হয় তোর শ্বশুরবাড়ী চলে যাওয়াই ভাল হবে। এত বড় শহরে একা মুন্নীকে নিয়ে কি করে থাকবি এই পরিস্থিতিতে? কখন কি ঘটে তার ঠিক নেই। আগে তো জীবন।
ইমা: তোদের কথা ঠিক। কিন্তু মন যে মানতে চাইছে না রে। রিফাতকে ফেলে আমার বাসা ছেড়ে কোথাও যেতে মন চাইছে না ।
তমা: মনকে শক্ত কর, তোর বাচ্চার কথা ভাবতে হবে। এভাবে ভেঙ্গে পড়িস না। সাবধানে থাকিস। আমি আবার ফোন করবো।

দু’বোনের কথা আপাতত শেষ হয়। মুন্নী জিজ্ঞেস করে কার সাথে কথা হচ্ছিল তার মায়ের। যেই শুনলো তার ছোট খালা, অভিমান করে সে, “আমাকে কেন দিলে না। আমি কথা বলতাম খালামনির সাথে।”
ইমা বলে, “আবার যখন ফোন করবে তখন অবশ্যই দিব, প্রমিস। এখন আর রাগ করে না মামুনি।“
মং জানতো না ইমার বোনদের কথা। তার চোখে বেশ কৌতুহল লক্ষ্য করে ইমা। ‘চা খাবেন?’ ইমা বলে। ‘না থাক,’ মং ইতস্তত করে।
ইমা: আমার খেতে ইচ্ছে করছে, নিয়ে আসছি। দু’কাপ চা করে মিনিট দশেক পর ইমা রান্নাঘর থেকে ফিরে আসে বসার ঘর। দুটো ঘর ইমাদের। একটা বেডরুম আর অন্যটি বসার। সেখানেই ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ায় সে। চায়ে চুমুক দিয়ে মং-এর অমৃত মনে হয়। ইমা নিজ থেকে তার বোনদের কথা, বাবা-মার না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার কথা মং কে বলতে শুরু করে।

সব শুনে মং ভাবে তিনবোনের তিনদেশের জীবন যাপনে কি অদ্ভূদ মিল, তাদের জীবন সংগ্রাম প্রায় একই রকম। এমন করে মং এর আগে ভেবে দেখেনি কখনো। সারাজীবন সে বাংগালীদের ‘সেটেলার’ হিসাবে অপছন্দ করে এসেছে। কিন্তু এই দুদিনে সে দেখলো কিভাবে ইমার মতো, ইমার স্বামীর মতো, বাদশার মার মতো বা বুয়ার স্বামীর মতো, সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ, ভয়ে সিটিয়ে আছে, নিখোঁজ হয়েছে, মার খাচ্ছে। কিভাবে তারা তাদের জীবন- জীবিকা নিয়ে পেরেশান। সবাই একটা ঘোরের মধ্যে কেবল জীবনের ঘানি টেনে চলেছে। কিন্তু কেন? ভাবনার পর ভাবনার ঢেউ, মঙের মাথাটায় জট পাকিয়ে ওঠে।

মন্তব্য করুন

Subscribe to Blog via Email

Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

Join 4 other subscribers

সংরক্ষণাগার