পাবলিক ই খারাপ!
পাবলিক ই খারাপ এদেশের! এটা অনেকেই বলে। আপনাদের উদ্দেশ্যে বলছি, বাংলাদেশের ইতিহাস স্মরণ করে দেখুন, এই দেশের প্রতিটা দুঃসময়ে এই পাবলিক বা সাধারণ মানুষই বুক পেতে দেয়, লড়াই করে। বিপদে সাধারণ মানুষই মানুষের পাশে দাড়িয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষ, কৃষক, ছাত্র সবাই ঝাঁপিয়ে পরেছিল। ভবিষ্যতে কি পাবে না পাবে তার হিসাব কিন্তু সাধারণ মানুষ কখনই করেনি।
৮৮’র ভয়াবহ বন্যায় দেখেছি কিভাবে সাধারণ মানুষ দিন রাত পরিশ্রম করেছে মানুষের সেবায়। রানা প্লাজা ধংসের সময় যখন রাষ্ট্র কিছু করতে পারেনি, রাষ্ট্রের সে সক্ষমতা ছিল না একটা বিল্ডিং ধ্বসে পরলে কি করে তা থেকে মানুষকে উদ্ধার করা যায়; তখন একেবারে সাধারণ মানুষেরা যাদের আমরা মানুষ বলে সচরাচর গণ্য করি না তারাই নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার কাজ করে গেছে টানা। বিনিময়ে কি পাবে তা ভাবেন নি। তারা মধ্যবিত্তের মত ক্যারিয়ারিস্ট, বুদ্ধিমান নয়। সেই উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া অনেকই পরবর্তীতে ট্রমায় আক্রান্ত হয়। যারা এত ঝুঁকি নিয়ে এত কষ্ট করে উদ্ধার কাজ করল, রাষ্ট্র তাদের কোন পুরস্কার বা স্বীকৃতি কিছুই দেয় নি। সাধারণ মানুষ এটা জানে তারা সাধারণ, তারা কোন খ্যাতি, অর্থ, পদ, পদবি, বা সুযোগ সুবিধার জন্য লড়াই করেন না, মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন না। লাভ ক্ষতির হিসাব কষে কোন কিছুর প্রতিবাদ করা, মানবতা দেখানো এগুলো শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্তরাই করে।
সাধারণ মানুষই এদেশটাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। ফুলবাড়িতে সাধারণ মানুষই প্রতিরোধ গড়েছিল। সাধারণ মানুষের শক্তিকে এই সুবিধাবাদী, দালাল মনোবৃত্তির মানুষগুলো ভয় পায়। তাই সুযোগ পেলে কষে গালি দিয়ে পাবলিকের বা সাধারণ মানুষের উপর সব দোষ চাপিয়ে বুঝাতে চায় তোরাই খারাপ, তোদের খারাপ অবস্থার জন্য তোদেরই দোষ। যাতে মানুষ হীনম্মন্যতায় ভোগে, যাতে যেখানে প্রশ্ন তোলা দরকার সেখানে প্রশ্ন না তোলে। যেন সব ধামা চাপা পড়ে যায় পাবলিকের দোষের আড়ালে।
শুনুন যদি কোন বিপর্যয় থেকে দেশ রক্ষা পায় তবে তা সাধারণ মানুষদের জন্য পাবে। সাধারণ মানুষই সাধারণ মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। নানাভাবে বুদ্ধি উদ্ভাবন করবে সাধারণ ঘরের মানুষেরা। কারণ এদেশের সরকার তো গরিব, সামর্থ্যহীন। যদিও অনেক মিলিয়ন ডলারের সাহায্য আসে, যদিও পুকুর কাঁটা শিখতে, খিচুড়ি রাঁধতে দল বেধে বিদেশ ভ্রমণের সামর্থ্য আছে, সামর্থ্য আছে আমলাদের জন্য দামি দামি গাড়ি কেনার। যদিও আমাদের পরিকল্পনা বিভাগ আছে, স্বাস্থ্য বিভাগ আছে, সব কিছুর জন্যই আমাদের বিভাগ, দপ্তর সব কিছুই আছে।
২০১৯ এ প্রথম দুমাস ধরে করোনার সংক্রমণ ঘটে চলেছে তবু সেই দুমাসে কিভাবে প্রবাসীরা দেশে ফেরা শুরু করলে সামাল দেয়া হবে তা ভাবা হলো না। কতকগুলো স্থানে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করে, বিমান বন্দর থেকে আলাদা বাসে করে আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা সেই স্থানে নিয়ে যাওয়া যেত। তাতে যাত্রা পথে ছড়াত না। আরও আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখলে সেখানে চৌদ্দ দিন থাকার মত ব্যবস্থা থাকত, অভিযোগ করার মত কিছু ঘটত না। সেখানে সবার নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখে চৌদ্দ দিন পর সুস্থ থাকলে বাড়ি পাঠানো হত, আর যাদের মাঝে ভাইরাস পাওয়া যেত তাদের চিকিৎসা দিয়ে তারপর ছাড়া হত। তাহলে তো আর গ্রামে গিয়ে কী করছে সেটা নিয়ে চিন্তা করার বা তদেরকে অনুরোধ করার বা তাদের গালি দেয়ার দরকার পড়ত না। বিমান বন্দর থেকে বা বর্ডার এরিয়া থেকে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিলে তখন এভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত না প্রবাসীরা বা ভারত থেকে আসা মানুষগুলো বিনা পরীক্ষায়।
দারিদ্র পীড়িত মানুষেরা স্বাস্থ্য জ্ঞান বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান রাখতে পারেনা, তারা তো বাস ই করে অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর জায়গায়। গার্মেন্টসের বিশাল কর্মী বাহিনী গণহারে সস্তায় কোথায় থাকে জানেন না কি? সেখানে তারা বিচ্ছিন্নতা বা সেলফ কোয়ারেন্টাইন কিভাবে করবে? এসব কথা ভাবলে তো আর প্রবাসীদের বা সাধারণ মানুষদের মূর্খ বলে গালি দিয়ে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যাবে না।
এরকম আরও বহু উদাহরণ দেয়া যাবে যেখানে অরাজকতা বা কোন বিপর্যয়ের জন্য যারা আসলে দায়ী তাদের আড়াল করে রাখা হয় আর দোষারোপ করা হয় পাবলিককে। যেমন কৃষি খাত, বিষযুক্ত খাদ্য উৎপাদন এসবের জন্য কোন কোন গোষ্ঠী দায়ী সেসব নিয়ে কোন আলাপ নাই। দুর্বল, ক্ষমতাহীন কৃষকের, মাঠ পর্যায়ের বিক্রেতাদের, ক্রেতাদের বা সাধারণ মানুষদের সচেতন করতে বা দোষারোপ করতে অনেকে ব্যস্ত। যেন কৃষি ও তার বিপণন ব্যবস্থা একটা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের কৃষি নিয়ে যে পলিসি তার বাইরে অবস্থান করে। যেন কেবল সাধারণ মানুষ কোন রাজনৈতিক পরিবর্তন, পলিসির পরিবর্তন, বৈশ্বিক প্রভাবকে মোকাবিলা না করে, পরিবর্তন না করে কৃষি খাতের সমস্যাগুলোকে, খাদ্যের বিষকে নির্মূল করতে পারে।
জনগণ কখন মূর্খ, অসচেতন হয় তা কিন্তু এই আঁতেল, এলিট বা জ্ঞানী গুণীরা বলেন না। জনগণ কে মূর্খ, ধর্মান্ধ করে কারা রাখে, কারা ২৪ ঘণ্টা জীবিকার পিছনে ব্যস্ত রাখে আমাদের? এসব বিষয়ে আপনারা শিক্ষিত জ্ঞানীরা বা ধর্ম পরায়ণ মানুষেরা কখনও প্রশ্ন তোলেন না।
সাম্প্রতিক মন্তব্য