লিপিশক্তি
আমাদের সৌভাগ্য যে, বাংলা ভাষার নিজস্ব একটি লিপি আছে। এই লিপি দিয়ে আমরা আমাদের প্রতিটি ধ্বনিকে লিখতে পারি। কিন্তু, শক্তিমান লিপিগুলোর মধ্যে বাংলার স্থান একটু পিছিয়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান লিপি হলো ল্যাতিন লিপি, দ্বিতীয় স্থানে আছে আরবী লিপি। প্রশ্ন হলো, লিপির শক্তি নির্ধারণ করবো কিভাবে?
একটি লিপির শক্তি নির্ধারিত হবে, লিপিটি কত বেশি ভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে এবং কত বেশি ধ্বনিকে লিখতে পারে তার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু কোন লিপিই শুরু থেকে এই শক্তি নিয়ে তৈরি হয় না। লিপিকে তৈরি করে নিতে হয়। আধুনিক ইংরেজি ভাষায় ছাব্বিশটি বর্ণ রয়েছে, এটা আমরা সকলেই জানি, কিন্তু এতগুলো বর্ণ পূর্বে ছিল না, প্রয়োজনে বর্ণ তৈরি করা হয়েছে। ইংরেজি লিখিত হয় ল্যাতিন লিপিতে। বর্তমানে ল্যাতিন লিপিতে বর্ণের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এর মধ্যে Basic Latin ৯৫টি, Latin-1 Supplement ৯৬টি, Latin Extended-A ১২৮টি, Latin Extended-B ২০৮টি, Latin Extended-C ৩২টি, Latin Extended-D ১৮০টি, Latin Extended-E ৬০টি, Latin Extended Additional ২৫৬টি, IPA Extensions ৯৬টি, Phonetic Extensions ১২৮টি, সাথে আছে ৬৪টি Supplement. এছাড়া Spacing Modifier Letters, Combining Diacritical Marks, Combining Diacritical Marks Supplement ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। এতগুলো বর্ণের দরকার কী? বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভাষা লিখিত হয় ল্যাতিন লিপিতে। ইউরোপের প্রায় শতভাগ ভাষাই ল্যাতিন লিপিতে লেখা হয়। এশিয়ার অনেকগুলো ভাষাও লেখা হয় এই লিপিতে। এমনকি, ল্যাতিন লিপিকে এত বেশি শক্তিমান করা হয়েছে যে, পৃথিবীর প্রায় সবকটি ভাষাই লেখা সম্ভব হবে ল্যাতিন লিপিতে।
ল্যাতিনের পরেই সর্বাধিক ভাষায় ব্যবহৃত লিপি হলো আরবী লিপি। সাধারণ আমরা জানি আরবী হরফ ২৬টি, কিন্তু পারসী, উর্দুসহ আরও অন্যান্য ভাষা যেগুলো আরবী লিপিতে লেখা হয়, সেগুলোকে সঠিক ভাবে ধ্বনিত করার জন্য আরবী লিপির পরিমাণ আটশতেরও বেশি।
দক্ষিণ এশিয়ার লিপিগুলোর মধ্যে বর্তমানে দেবনাগরী লিপিকে সবচেয়ে শক্তিমান লিপি বলা চলে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই অবস্থানটি বাংলা লিপির ছিল। এককালে সংস্কৃত ভাষাও লেখা হতো বাংলা লিপিতে। পুরোনো গ্রন্থাদি দেখলে অনুমান করা যায় যে, আঠার শতকের শুরুতে বাংলা লিপির শক্তি দেবনাগরী লিপির চেয়ে বেশি ছিল। বাঙালি পণ্ডিতগণ বিদেশী শব্দ, বিশেষ করে ইংরেজি, ফরাসী ও পারসী শব্দের জন্য বাংলায় অতিরিক্ত কিছু বর্ণ ব্যবহার করতেন। তারা মূল বর্ণের সাথে বিভিন্ন চিহ্নাদি ব্যবহার করে কাছাকাছি ধরনের ভিন্ন ভিন্ন ধ্বনি প্রকাশ করতেন। যেমন, ইংরেজি k ও q সাধারণত বাংলা ক ধ্বনি; এদের মৌলিক তারতম্য প্রকাশ করতে হলে আমাদের লিখতে হবে k = ক, q = ক়। অনুরূপ ইংরেজি z = জ়।
সাধারণত মনে হবে, এই সবের দরকার কী? দরকার আছে। আমরা চাইলেই ইংরেজি ভাষাকে অস্বীকার করতে পারি না, আরবী ভাষাকেও অস্বীকার করতে পারি না, সংস্কৃত ভাষাকেও অস্বীকার করতে পারি না। আমরা যদি বলি, সংস্কৃত ও আরবী ধর্মীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে বাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলমান। কথা সত্য, এই দুটো ধর্মীয় ভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। আর আমরা রাতারাতি ধর্ম ত্যাগ করতেও পারবো না বা বদলাতে পারবো না। সিংহভাগ মানুষ তার ধর্মকে আঁকড়ে ধরে রাখবে। ভাষা তো সবার, তাই সবার চাহিদা পূরণ ভাষার দাবীও বটে। বাংলা লিপির এমন একটা শক্তির প্রয়োজন যে লিপি দিয়ে বাঙালী হিন্দু সংস্কৃত ভাষার সঠিক ধ্বনি জ্ঞাপন করতে পারবে, বাঙালী মুসলমান আরবী ভাষা বাংলা লিপিতে লিখলেও পড়তে তাদের কোন সমস্যা তৈরি হবে না। আর ইংরেজির সঠিক উচ্চারণকে আমরা আমাদের প্রয়োজনেই শিখতে হবে। একজন সাধারণ মানুষ যাতে বাংলা বর্ণে লিখিত ইংরেজি শব্দটি সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে।
এমন কথা বলাই চলে, বাংলায় আগত সকল শব্দই বাংলা; তাই বাংলা শব্দ বাংলার মতোই ধ্বনিত হবে। যদি তাই সত্য হবে, তবে আমরা অ্যা, এ্যা, স্ট, ন্ড, ন্ট, ন্ঠ ইত্যকার ligature গুলো কেন সৃষ্টি করেছি? একাউণ্ট, এডভোকেট, একাডেমি, ষ্টেশন, লণ্ঠন ইত্যাদি লিখতে আমাদের সমস্যা কোথায় ছিল? আমরা চেয়েছি ইংরেজি কিছু শব্দের উচ্চারণ ঠিক ইংরেজির মতোই হোক।
অনেকে বলেন বাংলায় দীর্ঘস্বর নেই, এটা একটা বাতুল কথা। অনেকে বাংলা র আর ড় বর্ণের উচ্চারণকে গুলিয়ে ফেলেন, তারা তো বলতেই পারেন বাংলায় ড় থাকলে র-য়ের দরকার নেই, অথবা ড়-কে বাতিল করা হোক। আজকাল অনেকেই ই ও য়-য়ের পার্থক্য বুঝতে পারে না, তারা যদি দাবী করে আমাদের এই দুটোর দরকার নেই, একটি হলেই হবে তবে একটি বর্ণ বাতিল করা হবে না কেন?
কারো কারো দাবীতে ড় বা র অথবা ই বা য় থেকে একটি বাতিল করা যাবে না, কেননা, বাংলা ধ্বনিতে দুটোরই প্রয়োজন আছে। বাংলা লিপিতে আরও কিছু বর্ণ যুক্ত করার প্রয়োজন আছে। সিলেট বা চট্টগ্রামের লোকেদের ক উচ্চারণে ক ও খ-য়ের মাঝামাঝি একটি ধ্বনি তৈরি হয়, আমরা বর্তমান লিপিতে সেই ধ্বনিটি লিখতে পারি না। এর জন্য আমাদের ক বর্ণের একটি সংস্কারকৃত রূপ দরকার, যাতে কোন লেখক সেই সংস্কারকৃত ক লিখলে আমরা সঠিক ধ্বনিটি বুঝতে পারি। আবার রঙপুরের লোকেরা র বর্ণের উচ্চারণ করে অ-য়ের মত, কিন্তু ঠিক অ নয়। আমাদের একটি এমন র দরকার যার দ্বারা রঙপুর ভাষীর সঠিক ধ্বনিটি আমরা বুঝতে পারি।
বাংলা লিপিতে একটি বর্ণকে আমরা জোর করেই অস্বীকার করে চলেছি। সেটি হলো, অন্তস্ত ব বা ৱ বর্ণটি। বাঙলা শব্দে এখনো ৱ একটি অপরিহার্য বর্ণ। আমরা যে স্বামী, স্বাধীন, বিশ্ব, অশ্ব লিখি, স্ব ও শ্ব-য়ের ব-টি অন্তস্ত ব। বাঙলা লিপিতে দুটি র বর্ণ রয়েছে, একটি বাঙলায় ব্যবহৃত হয় অন্যটি অসমিয়াতে। র বর্ণের অসমিয়া রূপটি হলো ৰ এইরূপ।
ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তার ছাত্রজীবনে বাঙলা যুক্তবর্ণ ইত্যাদি সহজে অনুধাবন করতে পারেন নি বলে, পরিণত বয়সে বাঙলা ভাষা লেখার জন্য ল্যাতিন লিপির প্রস্তাব করেছিলেন। এই বিষয়টি আমার আজও বোধগম্য হয় না। ল্যাতিন লিপিতে বাঙলা লিখলেই কি বাঙলা সহজ-সরল-শিশুপাঠ্য ভাষায় পরিণত হত?
সংস্কারবাদীরা বলেন, বাঙলায় দুটি ন কেন, তিনটি শ কেন? একাডেমিয়ানেরা বলেন, বাঙলায় দীর্ঘস্বর নেই। তাদের যুক্তি অযৌক্তিক নয়, কিন্তু অহেতুক। আমরা যখন ইংরেজি ভাষা শিখি, তখন আগে স্থির করে লই, বৃটিশ ইংরেজি শিখব না আমেরিকান ইংরেজি শিখব? তারপর প্রতিটি বর্ণ ধরে ধরে উচ্চারণ শিখি। অথচ, আমরা বাঙলা বর্ণকে কি সেভাবে শিখি? বলবেন মাতৃভাষা, এত করসত করে শেখার প্রয়োজন হবে কেন? কিন্তু, মাতৃভাষা হলেই যে শিখতে হবে না, সেটাই বা কে বলেছে? মাতৃভাষাকে ভাল করে শিখতে হয় না, এমন ধারণার বশবতী হয়েই আমরা বাঙলাকে ভাল করে শিখি না। বাঙলা শব্দগুলোর বানান, উচ্চারণ গুরুত্ব দিয়ে শিখি না বলেই আমরা সহজ-সরল করার পাঁয়তারা করি।
এইসব বহু বিতর্কিত বিষয়ে না বলি, এবার আসি আমার শক্তিমান বর্ণমালা বা লিপির কথায়।
পুরাতন একটি প্রসিদ্ধ অভিধানের ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করার চেষ্টা করছি। সে অভিধানের পাঠ তৈরি করার সময় অনেকগুলো সমস্যায় পড়লাম, কেননা, প্রচলিত বাঙলা ইউনিকোড ফন্টে সব শব্দ মূলগ্রন্থানুগ করা যায় না। এই কাজের জন্য আমি নিজে একটি ফন্ট তৈরি করলাম—আমার ফন্টে বাঙলা ৯৬টি মূল কারেক্টার বা বর্ণ, পাঁচ শতাধিক যুক্ত বর্ণ রেখেছি। এর সাথে ˋ ˇ ´ ¨ ˙ ় ˚ ¸ ﹐˛ ˘ ˜ ˆ ইত্যাদি চিহ্নগুলো রেখেছি যাতে এগুলো প্রয়োজন মত বাঙলা বর্ণের উপরে নিচে যুক্ত করে যেকোন বিদেশি শব্দের প্রতিবর্ণায়ন সম্ভব হয়! যেহেতু পুরোনো অভিধানটিতে IPA ব্যবহার করা হয়নি, আমিও করিনি।
য় আদিতে কোন শব্দ নেই, কিন্তু বর্ণটি আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ৱ বাঙলা বহু শব্দে রয়েছে, অথচ আমরা তাকে অস্বীকার করে চলেছি—আমরা বলছি বাঙলায় অন্তস্ত ব (ৱ) নেই, অথচ স্বামী, বিশ্ব—এই রকম বহু শব্দে ব্যবহার করে চলেছি।
পৃথিবীর সব ভাষাতেই এমন কিছু বর্ণ আছে সাধারণভাবে মনে হয় এগুলো না হলেও চলে, কিন্তু চলে না। Latin লিপিতে ইংরেজি লিখতে C, k, q, gh, kn, ti, tu লেখা এবং উচ্চারণে স্পষ্ট বৈপরিত্য রয়েছে।
ইংরেজি লিখতে ২৬টি বর্ণ লাগলেও, ল্যাটিন লিপির বর্ণের সংখ্যা হাজারেরও বেশি! এই কথা আগেই বলেছি। এর সুবিধা হল, ল্যাটিন লিপিতে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষা লেখা চলে।
আমরা বাঙলায় এটা নেই, ওটা নেই বলছি—নেই এটা আংশিক সত্য, পুরো সত্য নয়।
চট্টগ্রাম, সিলেট অঞ্চলের লোকেরা ক-কে ক ও খ-য়ের মাঝামাঝি একটি উচ্চারণ করে। রাজশাহী ও চাপাই নবাবগঞ্জের লোকেরা স-কে দন্ত উচ্চারণ করে, যা বাঙলা স বর্ণটির সঠিক উচ্চারণ। বৃহত্তর রংপুরের লোকেরা র-কে অ উচ্চারণ করে। এই যে উচ্চারণ ভিন্নতার কারণে এভাবে সকলেই যদি বলে আমরা ওটা উচ্চারণ করি না, তাহলে বাঙলা লিপিই হয়ে যাবে ফসম বাছা কম্বলের মত!
বাঙলা ভাষায় পৃথিবীর নানান ভাষা থেকে শব্দ এসেছে, আমরা সব শব্দকে মূল ভাষার মত উচ্চারণ করতে পারি না, পারা উচিতও নয়। কিন্তু শব্দের চেহারাটি বজায় রাখতে পারি। ইংরেজি Q লেখার মত বর্ণ বাঙলায় নেই, কিন্তু যখন কোন শিক্ষার্থীকে Q-র উচ্চারণ শেখাবো, তখন লিখে বোঝাবো কী করে? আমার উল্লেখিত অভিধানে প্রায় এক শ বছর আগে তার নিদান দেওয়া আছে—Q=ক়।
২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এথ্নোলগের ২১তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এতে উল্লেখিত বিশ্বের মোট ভাষার সংখ্যা ৭০৯৭টি, যা ২০তম সংস্করণের চেয়ে ২টি কম। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষার সংখ্যা ৫৮০টি, শক্তিশালী ভাষা ২,৪৪৬টি, বিকাশমান ভাষা ১,৫৯০টি, সংকটাপন্ন ভাষা ১,৫৫৯টি এবং বিলুপ্তির পথে যাচ্ছে এমন ভাষা ৯২২টি। ২১তম সংস্করণ অনুযায়ী ১২৯৯ মিলিয়ন ভাষাভাষীসহ চৈনিক ভাষা হল বিশ্বের শীর্ষ ব্যবহৃত ভাষা। এথ্নোলগের এই সংস্করণ (২০১৮) অনুসারে বাংলাদেশে বাংলাসহ ৪১ টি ভাষা প্রচলিত আছে এবং সবকটি ভাষাই জীবিত। এর মধ্যে বাংলা, চিলটি ও চাকমা ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষার নিজস্ব লিপি নেই। অসমিয়া ভাষা লেখা হয় বাংলা লিপিতে এবং ম্রু ভাষা লেখা হয় বর্মী লিপিতে। সাঁওতালি ভাষা লেখা হয় ল্যাতিন লিপিতে। বাংলা লিপিকে সম্প্রসারণ করে বাংলাদেশে প্রচলিত যে সকল ভাষার নিজস্ব লিপি নেই, সাঁওতালিসহ সে সকল ভাষায় বাংলা লিপির প্রচলন করা দরকার। এতে বাংলা লিপির শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ভাষাসমূহের লিখন যেমন সাবলীল হবে, তেমনি ভাষা সমূহের সংরক্ষণ দৃঢ় হবে! এছাড়া বৃহত্তর বাংলা ভাষী মানুষেরা ক্ষুদ্র ভাষা সমূহে রচিত গ্রন্থাদি পাঠ করতে পারবে সহজে। সেই সকল ভাষা থেকে শব্দ আহরণ করে বাংলা শব্দ ভাণ্ডার হতে পারে আরও সমৃদ্ধ।
লিপিতে বিভিন্ন উচ্চারণের জন্য যত বেশি বর্ণ বা চিহ্ন থাকবে, তাতে লিপির শক্তি বৃদ্ধি হবে। আমাদের দেশে বাঙলা ছাড়াও শতাধিক উপজাতীয় ভাষা আছে, সেগুলোর অনেকগুলোর নিজস্ব বর্ণ নেই। বাঙলা লিপিতে লিখলে সঠিক উচ্চারণ সম্ভব হচ্ছে না—এটা আমাদের পণ্ডিতদের ব্যর্থতা।
কয়েকটি বর্ণকে কাস্টমাইজ করলে আমরা বৃহৎ বঙ্গের সবগুলো ভাষা বাঙলা লিপিতেই লিখতে পারি। সাঁওতালি ভাষা ল্যাটিন লিপিতে লিখছি কেন? কেন বাঙলা লিপিতে লিখতে পারছি না?
আমি বাঙলা লিপিকে এমন একটি শক্তিমান অবস্থানে আশা করি, যা দিয়ে অন্তত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচলিত সব ভাষা লেখা সম্ভব হয়।
আপনি হয়ত জানেন, দেবনাগরী লিপিকে কাস্টমাইজ করা হয়ে গেছে। ভারতীয় পণ্ডিতদের গবেষণা, সরকারের প্রণোদনায় দেবনাগরী লিপির এমন একটি শক্তিমানরূপ তৈরি করা হয়েছে যার দ্বারা ভারতবর্ষের সব ভাষা লেখা সম্ভব। কয়েক বছর আগে মৈথিলীকে দেবনাগরী লিপিতে লেখার সরকারি নির্দেশনা কার্যকর হয়েছে।
লিপির শক্তি থাকা উচিত, যাতে অন্তত নিজের ভূখণ্ডের সবগুলো ভাষার উচ্চারণ সূচিত করতে পারে।
লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে প্রসঙ্গটি নিয়ে কাজ করার কথা ছিল বাংলা একাডেমি/একাডেমীর , তা হচ্ছে না। “এককালে সংস্কৃত ভাষাও লেখা হতো বাংলা লিপিতে” – তথ্যসূত্র উল্লেখ থাকলে ভাল হতো। “লিপিতে বিভিন্ন উচ্চারণের জন্য যত বেশি বর্ণ বা চিহ্ন থাকবে, তাতে লিপির শক্তি বৃদ্ধি হবে। আমাদের দেশে বাঙলা ছাড়াও শতাধিক উপজাতীয় ভাষা আছে, সেগুলোর অনেকগুলোর নিজস্ব বর্ণ নেই। বাঙলা লিপিতে লিখলে সঠিক উচ্চারণ সম্ভব হচ্ছে না—এটা আমাদের পণ্ডিতদের ব্যর্থতা।” – একদম । আশা করি , এ নিয়ে অনেকেই সরব হবেন। আলোচনায় অংশ নিবেন। লেখককে অনেক অনেক ধন্যবাদ বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার জন্য।
সম্প্রতি আমি অসুস্থতা বোধ করছি, আশাকরি শীঘ্র তথ্যসূত্রসহ আপডেট করবো।
যেটাকে বঙ্গীয় লিপি বলা হয় সেটা আসলে বঙ্গীয় নিজস্ব লিপি নয়। এটা মূলত বঙ্গীয়-অসমীয় লিপি বা পূর্ব নগরী লিপি। এর উৎপত্তি গৌড়ী লিপি থেকে। এই লিপি এক সময় কোন বিশেষ ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। মধ্যযুগে এই পূর্ব নগরী লিপি ব্যবহার করে সংস্কৃত লেখা হতো। এরপরে বঙ্গীয়, অসমীয়া, মৈথিলী ও উড়িয়া ভাষা এ লিপি ব্যবহার করে লেখা শুরু হয়। চতুর্দশ শতকে , এই লিপি গৌড়ী লিপি থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং উড়িয়া ভাষায় এই লিপির আকারে কিছুটা পরিবর্তন আসে। তবে বঙ্গীয় অসমী ও মৈথিলী ভাষায় এই লিপি এখনও প্রায় একই রকমই আছে। অতএব, যেভাবে ইংরেজি ভাষা লাতিন লিপি ব্যবহার করে লেখা হয় তেমনি আজকের বঙ্গীয় ভাষা পূর্ব নগরী লিপি ব্যবহার করে লেখা হয়।
এত গভীরে গেলে, ভারতবর্ষের প্রায় সব লিপিই একই মূলের। আপনি যদি লিপিগুলোর নাম এবং উচ্চারণ লক্ষ্য করেন, তবে দেখবেন ভারতবর্ষের প্রায় সব লিপির নাম ও উচ্চারণ অভিন্ন। যা পার্থক্য আছে তাও আঞ্চলিকতার কারণে। কিন্তু বর্তমানে লিপিগুলো যে যে নামে পরিচিত হয়েছে সেই নামেই সম্বোধন করা উচিত। কেননা, আমি লিপির বিবর্তন নিয়ে লিখিনি, লিখেছি বর্তমানের লিপি নিয়ে এবং কিভাবে বাংলা লিপিকে আরও বেশি ভাষায় ব্যবহার করা সম্ভব হয় তার সম্ভাবনা নিয়ে।
ভালো লেখা। কিন্তু, কয়েকটা খটকা আছে।
১. “দক্ষিণ এশিয়ার লিপিগুলোর মধ্যে বর্তমানে দেবনাগরী লিপিকে সবচেয়ে শক্তিমান লিপি বলা চলে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই অবস্থানটি বাংলা লিপির ছিল। এককালে সংস্কৃত ভাষাও লেখা হতো বাংলা লিপিতে। পুরোনো গ্রন্থাদি দেখলে অনুমান করা যায় যে, আঠার শতকের শুরুতে বাংলা লিপির শক্তি দেবনাগরী লিপির চেয়ে বেশি ছিল।” – এই স্টেটমেন্টটা সম্ভবত প্রমাণিত সত্য নয়, প্রত্যভিজ্ঞা। সেক্ষেত্রে আরও যুক্তি দেখানোর প্রয়োজন আছে।
২.সংস্কৃত (আসলে হিন্দু ধর্ম সংক্রান্ত) আর আরবি (আসলে ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত) শব্দের জন্য বাংলায় নতুন বর্ণ ঢোকানো কেন দরকার? এই আমি একসময় সংস্কৃত ও আরবিকে (ভাষাকে) ধর্মের থেকে পৃথক করতে চাইলাম। আবার বাংলাভাষায় নতুন করে ধর্মের জোগানও চাইছি!- এটা তো পরষ্পরবিরোধি হয়ে যাচ্ছে। বাংলাভাষা এক শতাব্দী আগেই যেসব উৎপাত কাটিয়ে এসেছে, আবার তাকে ফিরিয়ে আনতে কেন চাইছি? একসময় ওয়াজেদ আলির মতো বেশ কয়েকজন আরবি-ফারসি শব্দগুলির শুদ্ধ উচ্চারণ নিশ্চিত করার জন্য বাংলা বর্ণমালার সংস্কারের প্রসঙ্গও তোলেন। তারা চেয়েছিলেন কিছু কিছু উর্দু (আদতে ফারসি) বর্ণের উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্য প্রায়-সমোচ্চারিত বাংলা বর্ণগুলির ওপর আরোপ করা হোক। তবে মুসলমান বুদ্ধিজীবিদের সিংহভাগই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল, বর্ণমালাকে ‘বিকৃত’ করার বদলে ইসলামী ভাবধারায় সাহিত্য রচনাই যথেষ্ট।
৩. মাথায় রাখতে হবে, ভাষার কাজ ধর্মকে কাছে টানা নয়, ধর্মেরই কাজ ভাষার সঙ্গে নিজেকে অ্যাডপ্ট করে নেওয়া। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের প্রসারের সময় তার উৎসস্থলের ভাষা আরবি মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবগুলো ভাষাকে গিলে ফেলেছিল। কিন্তু, পারস্যে সেটা পারেনি। বরং পরে ফারসি ভাষা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বনে পরিণত হয়।- এর কারণটা বোঝা দরকার। পারস্যের সংস্কৃতি গোটা মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির চেয়ে অনেক বেশি সম্পৃক্ত ছিল। তাই ‘মিলিয়নিয়ার’ (আরবি) ‘লাখপতি’দের (মধ্যপ্রাচ্যের বাদবাকি ভাষা) গ্রাস করলেও ‘বিলিয়নিয়ার’কে (ফারসি) সে গিলে ফেলতে পারেনি, সমঝোতা করেছে। এর ফলে ধর্ম এক হলেও পারস্য তার সংস্কৃতি রক্ষা করতে পেরেছিল দীর্ঘদিন। বাংলাভাষার সাংস্কৃতিক দৈন্যতা যখন নেই, কেন মিছে উপযাচক হয়ে অন্য ভাষার জন্য নিজেকে বদলাবে? জোর করে কিছু ঢোকানোর দরকার নেই। জলখাবারকে নাস্তা বলা যতটা হাস্যকর, সব বদমাশকে দুর্বৃত্ত বলতে শুরু করলে আপদ কিছু কমবে না। যে সব বিদেশী শব্দ বাংলা ভাষার প্রাণের সঙ্গে সহজে যোগ হয়েছে, তারা সহজেই মিশেছে/ মিশবে। ঘাড় ধরে মেশানোর/ হাত ধরে লেখানোর জন্য জবরদস্তি নতুন শব্দ/ বর্ণের আমদানি করার দরকার নেই
৪. “ল্যাটিন লিপির বর্ণের সংখ্যা হাজারেরও বেশি”- এই কথাটা বোধহয় ঠিক নয়।
৫. “পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান লিপি হলো ল্যাতিন লিপি, দ্বিতীয় স্থানে আছে আরবী লিপি।”- এটা নিয়েও ভাবতে হবে। ল্যাটিনের পর ম্যান্ডেরিন, দেবনগরী আছে। আরবি তার পরে।
১. আমি লিপির শক্তি নির্ধারণ করেছি একটা লিপি দিয়ে কতগুলো ভাষার ধ্বনি লেখা সম্ভব হয় তার ভিত্তিতে। দেবনাগরী লিপির ইউনিকোড সারণী দেখলে বুঝতে সহজ হবে, দেবনাগরীর প্রচলিত বর্ণগুলো ছাড়াও আরও অনেকগুলো বর্ণ সৃষ্টি করা হয়েছে। দেবনাগরী লিপির প্রধান সারণীতে বর্ণ সংখ্যা ১২৮টি, বাংলায় ৯৬টি। এছাড়া দেবনাগরীর এক্সটেনডেড লিপি আছে ৩২টি। মূল বর্ণ ঠিক রেখে নতুন ধ্বনি প্রকাশের জন্য বর্ণে কিছু চিহ্ন ব্যবহার করা হয়, যা বাংলা কার চিহ্নের মত। যেমন— জ = j, জ় = z, ক = k, ক় = q। এছাড়ার দেবনাগরীতে grave ও acute সংযোজন করে ধ্বনির সুক্ষ্ম তারতম্য সূচিত করার ব্যবস্থা আছে। তাই আমি ভারতীয় উপমহাদেশের লিপিগুলোর মধ্যে দেবনাগরীকে সবচেয়ে শক্তিমান মনে করি।
২. আমরা চাইলে বাংলা থেকে সংস্কৃত এবং আরবীকে বিস্মৃত করে দিতে পারছি না। তাই এই দুই ভাষার ধ্বনির জন্য আমাদের কিছু নতুন এক্সটেনশন দরকার। দেবনাগরীতে বেদিক এক্সটেনশন নামে ৪২টি লিপি রয়েছে, এগুলো দিয়ে সংস্কৃত ভাষা সঠিকভাবে লেখা সম্ভব। আরবীর উচ্চারণ বাংলাতে সম্ভব নয়। কিন্তু কিছু এক্সটেনশন যুক্ত করলে সম্ভব হবে। এর মধ্যে ক় ও জ় যথারীতি বাংলাতে ইংরেজির জন্য ব্যবহার হচ্ছে। এই দুটি দিয়ে আরবী দুটি বর্ণের হুবহু উচ্চারণ সম্ভব। আমরা ইংরেজির জন্য স্ট, ন্ট, ন্ড সৃষ্টি করেছি। আরবী বা সংস্কৃতের জন্য এত কিছু লাগবে না।
৩. ভাষার কাজ ধর্মকে কাছে টানা নয়, স্বীকার করি। কিন্তু আমি ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে বলছি না, আমি বলছি বাংলা লিপি দিয়ে কতটি ভাষা লেখা সম্ভব হতে পারে তার সম্ভাবনা নিয়ে। ল্যাতিন লিপি দিয়ে দুনিয়ার সব ভাষা লেখার জন্য তারা লিপিতে আইপিএ এক্সটেনশন যুক্ত করেছে, এতে সুবিধা বৈ অসুবিধা হয়নি। আপনি একটি বাংলা বইয়ের অনুবাদ করবেন ইংরেজিতে, তখন বাংলা কিছু নাম যদি অবিকৃত রাখতে চান তাহলে আপনাকে আইপিএ-এর আশ্রয় নিতে পারেন। তেমনি আমরা যদি কোন কোন বিদেশি ভাষার বই বাংলাতে অনুবাদ করি, তাহলে সে ভাষার কোন নাম বা বিশেষ শব্দকে অবিকৃত রাখার প্রয়োজন হলে আমাদের লিপির সেই শক্তি থাকা দরকার। আরবীর স্থলে ফারসি প্রতিস্থাপিত হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, কেননা, ক্ষমতা যতদিন আরবদের হাতে ছিল ততদিন আরবীর প্রাধান্য ছিল। কিন্তু ইরানীদের হাতে ক্ষমতা আসার পর পারসি ভাষা আরবীর স্থলে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। যেমনটি ভারতবর্ষে পারসির স্থলে ইংরেজি হয়েছে।
৪ ও ৫. ল্যাতিন লিপি বলতে যদি ইংরেজি লিপি মনে করি, তাহলে মাত্র ২৬টি বর্ণ। কিন্তু ইংরেজির লিপি নেই, ল্যাতিন লিপিতে ইউরোপ ও এশিয়ার অনেকগুলো ভাষা লেখা হয়। প্রতিটি ভাষার ধ্বনি যথার্থ রাখার জন্য ল্যাতিন লিপিতে বিভিন্ন চিহ্ন যুক্ত করে নতুন নতুন বর্ণ তৈরি করা হয়েছে। যেমন তুর্কি ভাষা, ইন্দোনেশিয়া ও মালেশিয়ার ভাষা, ফিলিপাইনের তাগালুগ ভাষা ল্যাতিন লিপিতে লেখা হয়, এবং তাদের বর্ণগুলো হুবহু ইংরেজিতে ব্যবহৃত ল্যাতিন লিপির মত নয়। মূল ল্যাতিন লিপিতে অনেকগুলো ডায়ালেকটিক মার্কযুক্ত করে ধ্বনি যথার্থ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
পরিশেষে, বৃহদ্বঙ্গে বাংলা ছাড়াও আরও অনেকগুলো ভাষা আছে। সবগুলো ভাষার নিজস্ব লিপি নেই। বাংলা লিপিকে সংস্কার করে সেই সব ভাষার ধ্বনি উচ্চারণের ব্যবস্থা করা সম্ভব। বাংলার আঞ্চলিক ভাষাগুলোর উচ্চারণে অনেক পার্থক্য আছে। আপনি উপন্যাসের সংলাপ লিখলেন কোন একটি আঞ্চলিক ভাষায়, যদি বাংলা লিপিতে কিছু চিহ্ন ব্যবহার করে সঠিক ধ্বনি বজায় রাখা সম্ভব হয় তাতে মন্দ কী? এর জন্য সবাইকে সব ধ্বনি শিখতে হবে না, যেমন ক ও ক় লেখার পর যিনি উচ্চারণ পারেন তিনি K ও Q ধ্বনির উচ্চারণ করবেন, যিনি পারেন না তিনি ক উচ্চারণ করলেও সমস্যা হবে না।
আমি সম্ভবত ঠিক গুছিয়ে বলতে পারিনি, এটা আমার ব্যর্থতা।
আমি ল্যাতিন লিপিকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান লিপি বলেছি কেননা, এই লিপি দিয়ে যথার্থ ধ্বনি বজায় রেখে পৃথিবীর সর্বাধিক ভাষা লেখা সম্ভব। দ্বিতীয় পজিশনে আরবী বলেছি, কেননা, আরবী লিপি দিয়েও প্রায় অর্ধশত ভাষা লেখা হচ্ছে যথার্থ ধ্বনি বজায় রেখে। প্রতিবেশি উর্দুভাষীদের লক্ষ্য করুন, হিন্দি আর উর্দু দুটি বর্ণ দিয়ে লেখা হলেও উচ্চারণে কি তেমন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়? ম্যাণ্ডারিণ ভাষা হিসেবে সর্বাধিক মানুষের মুখের ভাষা। কিন্তু এর লিপি শুধু ম্যাণ্ডারিণ লিখতেই ব্যবহৃত হয়। তাও আবার মডিফাইড লিপিতে কেননা, ম্যাণ্ডারিণের একেকটি লিপি অনেক সময় একটি বাক্যের মতো হয়ে যায়। উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিমান লিপি দেবনাগরী, কেননা, হিন্দি ছাড়াও নেপালি, মারাঠিসহ আরও বেশ কয়েকটি ভাষা লেখা হয় এই লিপিতে।